উলূপী
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
“খবরটা দেখেছিস? কী কাণ্ড!” বলে
শৈবাল কাগজটা এগিয়ে দিল। একটা জনপ্রিয় দৈনিকের তৃতীয় পাতার নিচের দিকের একটা খবরে দৃষ্টি
আকর্ষণ করল।
“কী খবর, দেখি?” দেবসেনাপতি
খবরটা একবার ঝুঁকে দেখল। কিন্ত সেরকম কোনও আকর্ষণীয় কিছু দেখতে না পেয়ে ব্যাজার মুখে
বলে উঠল, “অত পড়তে পারব না। তুইই বলে দে না!”
বলা বাহুল্য, আজকের দিনটা হল
শনিবার। আমরা সবাই শনিবারের বিকেলে আবার প্রতীকদের উত্তর কলকাতার বাড়িতে জড়ো
হয়েছি। আজকে অনিলিখাদি ও বিশ্বজিৎদাও
আমাদের সঙ্গে আছে। রীতিমতো অঘটনই বলা চলে। এদের দুজনকে একসঙ্গে শনিবারের আসরে পাওয়া
সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
সামনেই পুজো। দুপুরের দিকে
জোর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তায় কোথাও কোথাও একটু জলও জমেছে। এখন
গরম তেমন না থাকলেও বাইরে খানিকটা গুমোট হয়ে আছে। কার
কী পুজোর প্ল্যান, কে কোথায় বেড়াতে যাব - এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল।
এসব কথার মধ্যেই হঠাৎ শৈবাল এ
খবরের কথাটা বলে উঠেছিল।
দেবসেনাপতির কথায় উৎসাহ পেয়ে শৈবাল
ফের বলতে শুরু করল, “খবরটা হল, সুদানে লাটুকা উপজাতির লোকেরা নাকি বিয়ের সময় পাত্রীকে অপহরণ
করে। মানে, বাড়ি থেকে জোর করে তুলে আনে। তারপর ওই ছেলের বাড়ির থেকে কোনও এক গুরুজন
মেয়ের বাবার কাছে গিয়ে এর জন্য বিয়ের অনুমতি চায়। মেয়ের বাবা যদি সম্মতি দেয়,
তাহলে তার প্রমাণস্বরূপ যাকে পাঠানো হয়েছে, তাকে আচ্ছা করে উত্তমমধ্যম দেওয়া হয়।
আর মেয়ের বাবা যদি অসম্মতি জানায়, তাহলে আর সেক্ষেত্রে ছেলের বাড়ির লোককে মারা হয়
না। তবে মেয়ের বাবার অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও সে ছেলে কিন্তু ইচ্ছে করলে জোর করে ওই
মেয়েকে তার পরেও বিয়ে
করতে পারে।”
“বাহ, এ তো বেশ ইন্টারেস্টিং
ব্যাপার,” একটু নড়েচড়ে বসল বিশ্বজিৎদা, “তা হঠাৎ করে এরকম কথা বললি কেন রে শৈবাল!
তুই আবার এরকম কোনও মেয়ে অপহরণজাতীয় কিছু করিসনি তো? সেক্ষেত্রে অনিলিখাকে দূত
হিসেবে মেয়ের বাড়ি পাঠাতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। কি
বল অনিলিখা?”
অনিলিখা আজ বেশ সেজেগুজে
এসেছে। পুজোর সময় কলকাতায় থাকবে না। তাই মনে হয় পুজোর পোশাক আগেই পরে ফেলেছে। একটা
নীল সালোয়ার কামিজ। চুলে একটা ঝিনুকের ক্লিপ।
অনিলিখাকে মুচকি হাসতে দেখে
বিশ্বজিৎদা বলে উঠল, “তা খবরটা জানা ছিল তোমার?”
“না, এ ব্যাপারটা ঠিক জানা
ছিল না। তবে এরকম অনেক আজব অভ্যেস অনেক উপজাতির মধ্যেই থাকে। আমাদের ভারতেই এরকম
কত উপজাতি আছে। চাকমা, গারো, কুকি, বোরো, চিরু, ভিল কত যে আছে! আমরা তাদেরই খবর
রাখি না। আর প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু রীতিনীতি থাকে। একবার এরকম এক উপজাতিকে খুব
কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল।”
“তার মানে তোমার ঝুলিতে এ ব্যাপারে
কোনও গল্প আছে, তাই তো?”
“হ্যাঁ, সেরকম একটা অভিজ্ঞতা
হয়েছিল একবার। তবে বহু বছর আগের ঘটনা।”
“সেকি? এতদিন বলনি তো!” আমরা
সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম।
অনিলিখা ফের মুচকি হাসল। ব্যাগ
থেকে লাল লিপস্টিক বার করে ঠোঁটে একবার বুলিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল, “সবই যদি
একদিনে বলে ফেলতাম, তাহলে কি আর আজকে এমন সুন্দর ঘুগনি খেতে পারতাম?”
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, দরজা দিয়ে
কাজের মাসি বেশ বড়ো একটা প্লেট নিয়ে ঢুকেছে। তাতে ঘুগনি, ঝুরিভাজা।
অনিলিখা আর বিশ্বজিৎদা এই দুই
বিশেষ অতিথির জন্যই যে আজকে এই ঘুগনির বিশেষ আয়োজন তা বলাই বাহুল্য। আমাদেরও সেই
সুযোগে বেশ জমাটি সান্ধ্যভোজন হবে।
ঘুগনি অধ্যায় শেষ হতে মিনিট পনেরো
লাগল। ইতিমধ্যে মাসিমা মানে প্রতীকের মাও গল্পের
গন্ধে গন্ধে চলে এসেছেন।
অনিলিখা এবারে ধীরেসুস্থে বলতে
শুরু করল –
"এটা বেশ কয়েক বছর আগের কথা।
তখন ইউনিভার্সিটিতে ছুটি পেলে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রতিবারই কোনও না কোনও পাহাড়ে
ট্রেকিং করতে বেরিয়ে পড়তাম।
"তা সেবারে গিয়েছিলাম হর কি
দুন। তোদের মনে আছে কি না জানি না, মহাভারত অনুযায়ী এই পথেই পাণ্ডবরা স্বর্গে
যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। এখান থেকে বেশ কয়েকটা পাহাড়ের চূড়া দেখা যায়, যার মধ্যে ওই
স্বর্গারোহিণী ১.২.৩ নামের তিনটে পাহাড়চূড়াও পড়ে।
"পুজোর ঠিক আগে গিয়েছিলাম। ট্রেনে
দিল্লী। সেখান থেকে বাসে দেরাদুন। দেরাদুনে পৌঁছে রীতিমতো বিপদে পড়ে গেলাম। কয়েকদিন
ধরে ওখানে ভারী অকালবর্ষণ শুরু হয়েছে। শুনলাম, পাহাড়ে নানান জায়গায় ধস নেমেছে। প্রাইভেট গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। একমাত্র ভরসা বাস।
"আমাদের দেরাদুন থেকে সাকরি
যেতে হত। সেখানে দিনে দুটো বাস যায়। শুনলাম, এখন শুধু একটাই বাস যাচ্ছে।
"যাই হোক, অতদূর গিয়ে তো আর
ফিরে আসা যায় না। আমার সঙ্গে আমার কলেজের আরও দুজন বন্ধু ছিল। মিলন আর ধৃতিমান। আমরা
ঠিক করলাম একটু অসুবিধে হলেও যে করেই হোক যাব। একদিন অপেক্ষা করে পরেরদিন সকালে
দেরাদুন থেকে সাকরির বাস ধরলাম। অনেকটা পথ। প্রায় দশঘণ্টার। যে
সময়ের কথা বলছি, তখন এ পথে প্রায়ই দুর্ঘটনা হত। এখন জানি না কী অবস্থা। বাসে উঠে
খেয়াল করলাম, আমাদের সঙ্গে যারা যাচ্ছে, তারা সবই স্থানীয় বাসিন্দা। আমরা ছাড়া
ট্রেকিং-এর উদ্দেশ্যে যাচ্ছে, এরকম অন্য কাউকে চোখে পড়ল না। বুঝলাম, ট্রেকিং করতে যারা এসেছিল, তাদের একটা বড়ো অংশ আশা ছেড়ে বাড়ি ফিরে গেছে।
"ভেবেছিলাম সন্ধে আটটার
মধ্যে সাকরি পৌঁছে যাব। কিন্তু বিধি
বাম। ছ'টা নাগাদ মাঝপথে হঠাৎ বাস দাঁড়িয়ে গেল। নো নড়নচড়ন। কয়েকজন বাস থেকে নেমে
এগিয়ে দেখতে গেল। আমরা বাসে বসেই অপেক্ষা করতে থাকলাম। এভাবে প্রায় আধঘণ্টা কেটে
গেল। খানিকক্ষণ বাদে বাসের ড্রাইভার এসে জানাল, বাস আর যেতে পারবে না। সামনের
রাস্তা ধসে বন্ধ হয়ে গেছে।
"বাস থেকে নেমে পড়লাম। সরু
রাস্তা। দুশো মিটার-মতো দূরত্বে একটা বড়ো ধস নেমেছে। রাস্তা বলে আর কিছু নেই। হয়
বাসেই সারারাত অপেক্ষা করতে হবে, না হলে আশেপাশে কোনও গ্রাম আছে কি না খোঁজ নিতে
হবে। এমনিতেও বাসে বেশি প্যাসেঞ্জার ছিল না। বেশিরভাগ আগেই নেমে গেছে। এখনও সাকরি
প্রায় কুড়ি কিলোমিটারের রাস্তা। সারারাত তো এখানে এরকমভাবে বাসে বসে থাকা যাবে
না। কী করব তা ভাবছি। এর মধ্যে একজন স্থানীয় বৃদ্ধ লোক জানাল যে কাছেই চার কিলোমিটার
দূরে একটু অন্যদিকে একটা খুব ছোট গ্রাম আছে। সে সেখানেই থাকে। আমরা যদি চাই ওর
সঙ্গে যেতে পারি। রাতে একটা মাথা গোঁজার মতো জায়গা পেয়ে যাব।
"উপায় ছিল না। ওই অচেনা লোকটার
সঙ্গে এগোলাম। একটু অন্যদিকে। আরও প্রত্যন্ত গ্রাম। গ্রাম বলাটাও ঠিক কি না জানি
না। সামান্য কয়েক ঘর লোকের বাস। নাম জিজ্ঞেস করলাম। লোকটা প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়ে
বলে উঠল, 'না, এ গ্রামের কোনও নাম নেই। অনেকে জানেই না যে এখানে কিছু লোক বাস করে।'
"আমাদের ওই লোকটা গ্রামের মোড়লের
বাড়ি নিয়ে গেল। তখন সন্ধে হয়ে এসেছিল। আমাদের সঙ্গে তাঁবু, রুকস্যাক আছে। কোনও
বাড়িতে থাকার জায়গা না পাওয়া গেলে সেরকম কিছুই ব্যবস্থা করতে হবে।
"কিন্তু না! রাতের থাকার জায়গার কোনও অভাব হল না।
তবে একসঙ্গে জায়গা পাওয়া গেল না। আমার থাকার
ব্যবস্থা হল এক গরিব চাষির বাড়িতে। আমাকে ওরা সে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেল।
"অদ্ভুত সে বাড়ি। নিচু। মাটি
থেকে ছয় ফুট উঁচুতে টিনের চাল। চাষির নাম মনোজ সিং। ছোটখাটো চেহারা। পঞ্চাশের
মতো বয়স হয়েছে। ওর সঙ্গে ওর মেয়ে থাকে। অবশ্য আশেপাশে সে মেয়েকে দেখতে পেলাম না।
"যেটা আমাকে অবাক করল, তা হল
ওই লোকটার কথা বলার ধরন। একেবারেই চাষিসুলভ কথাবার্তা নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাই
মনোজজী বলে কথা বলতে শুরু করলাম।
"এরকম বাড়িতে থাকার অভিজ্ঞতা আগে আমার হয়নি। দুটো ছোট ছোট ঘর। তার
একটাতে আমার থাকার ব্যবস্থা হল। দুটো ঘরেই আসবাব বলে কিছু নেই। চাষি যে ঘরে থাকে,
সেখানে একদিকে স্টোভ আর সামান্য কিছু বাসনকোসন
রাখা আছে। একটা বাটিতে দুধ রাখা আছে। কোনও বাথরুম নেই। সেটা অবশ্য এই গ্রামেই
কারুর বাড়িতে নেই বলে মনে হল।
"মনোজজীর ঘরে এসে বসলাম। সন্ধে সাতটা। আকাশ তারার ভিড়ে ঢাকা পড়েছে। কলকাতায় আকাশে কখনও এতো সুন্দরভাবে তারামণ্ডলী
ধরা দেয় না। দূরে এককোণে কিছু
কালো মেঘ জড়ো হয়েছে। পরে বৃষ্টি আসতে পারে।
"আমাকে দেখার জন্য গ্রামের লোকেদের মধ্যে খুব
আগ্রহ। ওই চাষি ছাড়াও ঘরের মধ্যে তিনজন এসে বসল। বুঝলাম, খুব কম বাইরের লোকই এখানে আসে। এদের সবার
রং বেশ ফরসা। ছোটখাটো চেহারা।
"একটু কথা বলতেই বুঝলাম, এরা
বাইরের পৃথিবীর কোনও খবরই প্রায় রাখে না। এমনকি শরীর খারাপ হলেও এখানে ভালো ডাক্তার পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রত্যেকেই খুব সহজসরল।
"যার বাড়িতে উঠেছি, তাকে সবাই
বেশ শ্রদ্ধার চোখে দেখে। মনে হল তার কথা সব মেনে চলে। কারণটা ঠিক বুঝলাম না।
"একটা জিনিস হঠাৎ চোখে
পড়ল। খেয়াল করে বেশ অবাক হলাম। ঘরের দেওয়ালে কী সব সংখ্যা লেখা। দেখতে কাছে এগিয়ে
গেলাম। চমকে উঠলাম, এ তো বিখ্যাত সেই ফিবোন্যাচি নাম্বার সিকোয়েন্স! এখানে
লেখা কেন? কে লিখেছে?"
“ফিবোন্যাচি নাম্বার
সিকোয়েন্স কী অনিলিখাদি?"
অনিলিখার কথার মধ্যে বাধা
এল। সহেলী প্রশ্ন করেছে।
অনিলিখা একটু জল খেয়ে বলে উঠল, "১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫, ৮৯ - এটা হল ফিবোন্যাচি নাম্বার সিকোয়েন্স। এখানে খেয়াল কর, পরপর
দুটো সংখ্যা যোগ করলে পরের সংখ্যাটা পাওয়া যায়। যেমন ১+১ হল ২, ১+২ হল ৩, ২+৩ হল ৫, ৩+৫ হল ৮। এরকম চলতেই থাকবে। ১২০২ সালে ইতালির এক গণিতজ্ঞ
লিওনার্দো অফ পিসা এর উপরে একটা বই লেখেন। উনি পরে ফিবোন্যাচি ছদ্মনাম নেন। আর সেই
নামেই এই সিকোয়েন্স। উনি খরগোশের একটা পরিবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে বাড়বে তা
বোঝানোর জন্য এই সিকোয়েন্স ব্যবহার করেছিলেন।"
একটু থেমে অনিলিখা ফের বলে
উঠল, “কী, মাথায় ঢুকল? এবার আসল গল্পে ফেরা যাক। যা বলছিলাম।
"আমাকে অবাক হয়ে দেওয়ালে লেখা ওই সংখ্যাগুলো দেখতে
দেখে বলে উঠল, 'কী ভাবছ? এই সংখ্যাগুলো কোথা
থেকে এল, তাই তো? আমার সব সংখ্যাতেই খুব আগ্রহ।'
'হ্যাঁ,
ঠিক তাই। এই সংখ্যাগুলো তো ফিবোন্যাচি সিকোয়েন্সের মধ্যে পড়ে?'
"মনোজজী হেসে উঠল, 'না। না। আমি
অতো শক্ত কিছু বুঝি না। এটা হল ফুলের পাপড়ির সংখ্যা।'
"লোকটার পাশে বসা টাকমাথা মাঝবয়সি লোকটা বলে উঠল, 'আমাদের মনোজভাই খুব পণ্ডিত লোক। ওর সঙ্গে কথা বললেই অনেক কিছু জানা যায়।'
"মনোজজী একথা শুনে একটু হেসে ফের বলে উঠল, 'আমার একটা
অভ্যেস হল, যখনই কোনও ফুল দেখি, তার পাপড়ির সংখ্যা গুনি। এখানে তো নানান ধরনের অজানা ফুল পাওয়া যায়। জঙ্গল থেকে খুঁজে নিয়ে আসি। অবাক
হয়ে দেখি তাদের সবার পাপড়ির সংখ্যা এই সংখ্যাগুলোর মধ্যেই কোনও একটা। এর বাইরে অন্য
কোনও সংখ্যার পাপড়ি প্রায় হয়ই না।'
"৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫, ৮৯,
১৪৪, মনোজজী পরপর বলে গেল।
'১৪৪ এতো পাপড়ি আবার কার হয়?'
'কেন সূর্যমুখী ফুলের পাপড়ির
সংখ্যা ৫৫, ৮৯ বা ১৪৪ হয়।'
'কিন্তু বাকি ফুলেরও কি
পাপড়ির সংখ্যা এরকমই হয়?'
'হ্যাঁ, জবার পাপড়ি ৫, ঝুমকোলতায় ৫, নয়নতারায় ৫, তারাফুলে ২১
- প্রায় সব ক্ষেত্রেই পাপড়ির সংখ্যা ওই সংখ্যাগুলোর মধ্যে।'
'বাহ্, দারুণ ব্যাপার তো!'
"মনোজজী একটু থেমে ফের হেসে বলে
উঠল, 'আমি কি আর অত অঙ্ক বুঝি? সবথেকে বড়ো অঙ্কের জাদুকর তো আমাদের সামনেই বসে আছে আর তা হল আমাদের
প্রকৃতি। লক্ষ করেছ কীভাবে
গাছের পাতাগুলো একটা শাখার চারদিকে ছড়িয়ে থাকে! একটা নির্দিষ্ট কোণ থাকে পরপর দুটো
পাতার মধ্যে। অঙ্কের সব সূত্র যেন ওদের জানা। আর
এটা কী কারণে হয় জান?'
'যাতে ওরা সবাই একইরকমভাবে আলো পায়,
তাই তো?'
'হ্যাঁ ঠিক তাই। আমরাও তাই নিয়ম
ভাঙতে পারি না।'
"বলতে বলতে মনোজজী আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। একটু
থেমে ফের বলে উঠল, 'আমরা চাইলেও প্রকৃতির নিয়ম ভাঙতে পারব না। আমাদের মেনে চলতেই
হবে। না হলেই অনর্থ।'
"পাশে বসে থাকা তিনজন লোকও
দেখলাম সায় জানিয়ে ঘাড় নাড়ল। একজন বলে উঠল, 'আমরা নিয়ম ভাঙব না।'
"খানিকবাদে আমরা সবাই মিলে
বাজরার রুটি আর একটা ডাল খেলাম। বলতে নেই, এরকম অখাদ্য ডাল আমি খুব কমই খেয়েছি।
তাতে ডাল কম, জলই বেশি। তা আবার আধসেদ্ধ। এরা এতই গরিব যে
কোনওরকমে এ ধরনের খাবার খেয়ে চালায়। তাতেই এরা
খুশি। শুনলাম, এরা হিড়িম্বার পুজো করে। এদের কাছে হিড়িম্বাই হল মূল দেবতা।
"যে তিনজন ঘরে বসেছিল, তাদের
মধ্যে একজনের নাম লখন। সে দেখি গাড়োয়ালি ভাষায় মনোজজীকে বলে উঠল, 'আচ্ছা, উলূপীর শরীর
কেমন আছে?'
'ভালোই আছে। তবে আমার মেয়ের যা
বদমেজাজ, পাঁচজনের সামনে তো আর তাকে বার করা যায় না।'
"ওর মেয়েকে নিয়ে কথোপকথন
পুরোটা না বুঝলেও বুঝলাম, ওর মেয়েকে সবাই ভালোবাসে, আবার বদমেজাজের জন্য খানিকটা
এড়িয়েও চলে। একটু মাথা খারাপ আছে বোঝা গেল। ওদের কথাবার্তা থেকে বুঝলাম, ওর মেয়ে উলূপী
এখানেই থাকে। পাশের অন্য একটা ঘরে।
"কোথায় সে ঘর জিজ্ঞেস করতে, মনোজজী
ওর ঘরের অন্যদিকের একটা নিচু দরজার দিকে দেখাল। দেখলাম, যেখানে রান্না করা হয় তার
পাশে একটা নিচু দরজা আছে। আগে ভেবেছিলাম ওটা বোধহয় বাড়ি
থেকে বেরোনোর আরেকটা রাস্তা। ওদিকে যে আরেকটা ঘর আছে তা খেয়াল করিনি।
"আমরা কথা বলছি। এর মধ্যে হঠাৎ
দেখি আরও দুজন লোক বাইরের দরজার কাছে উঁকি মারছে। মনোজজী ওদের দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে
গেল। খানিক বাদে আবার ফিরে এল। এসে একটা খুব আনন্দের খবর জানাল। গ্রামে
একজনের নাকি বাচ্চা হয়েছে। এমনিতে বেশ কয়েকদিন বাদে হওয়ার কথা ছিল। হঠাৎ কয়েক
ঘণ্টা আগে প্রসববেদনা ওঠে। যাই হোক, এখন সব নির্বিঘ্নে হয়ে গেছে। মা ও মেয়ে দুজনেই
ভালো আছে।
"ঘরের সবার মধ্যেও আনন্দ ছড়িয়ে
পড়ল। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওরা বেশ কিছু কাঠ জড়ো করে আগুন জ্বালাল। শুনলাম, এটাই নাকি এখানকার রীতি। নতুন কাউকে এভাবে স্বাগত জানান হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই
গ্রামের প্রায় সবাই এসে হাজির। এ আনন্দে শরিক হতে।
"লক্ষ করলাম, মনোজজী এর
মধ্যেই একজন বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলছে। ওদের কথার মাঝে অনেকেই সে লোকটাকে এসে প্রণাম করে যাচ্ছে।
"খানিকবাদে মনোজজীকে একা পেয়ে
জিজ্ঞেস করলাম, 'লোকটা কে হয়?'
"মনোজজী বলে উঠল, 'বুধুয়া। এই
গ্রামের সবথেকে বয়স্ক লোক। সবাই ওনাকে খুব ভালোবাসে আর শ্রদ্ধা করে।
যখনই কেউ বিপদে পড়ে, উনিই সবার আগে এগিয়ে আসেন।'
"খুব ভালো লাগল শুনে। এরা
তাহলে গুরুজনদের এরকমভাবে সম্মান করে।
"রাত ন'টা নাগাদ সবাই যে যার ঘরে ফিরে গেল। পূর্ণিমা আর
কয়েকদিনের মধ্যে। কিন্তু চারদিক থেকে কালো মেঘটা যেভাবে চাঁদটাকে ঘিরে ধরেছে, মনে হচ্ছে
কেউ যেন একটা সোনার থালায় কালির দোয়াত উল্টে ফেলেছে। আমিও মনোজজীর বাড়িতে ফিরে এসে
ওর সঙ্গে খানিকক্ষণ কথার পরে রাত দশটার সময় শুয়ে পড়লাম।
"একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। একা
শোবো। তাও পাশের ঘরে এমন একজন যাকে প্রায় চিনি না।
"তখনকার দিনে তো আর আমাদের
কাছে মোবাইল ফোনও থাকত না। তাই মিলন বা ধৃতিমানকে রাতে দরকার হলে জানানোরও কোনও
উপায় ছিল না।
"ঘুম আসছিল না। রাত বারোটা
নাগাদ মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। টিনের চালের উপরে পড়া বৃষ্টি
আর হাওয়ার কনসার্ট শুনতে শুনতে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়লাম।
"খানিক বাদে কীসের শব্দে হঠাৎ ঘুম
ভেঙে গেল। মনে হল, পাশের ঘরে কীসের যেন আওয়াজ পাচ্ছি। একটা খসখস আওয়াজ। মাটিতে চাদর
পেতে শুয়েছিলাম, মনে হল পাশের ঘরে যেন কিছু একটা চলে বেড়াচ্ছে। ঘরে ঠিক যেন কোনও হাঁপানি-রুগী আছে। আর সে মাঝে মধ্যে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। দরজা খোলার সুযোগ
নিয়ে কেউ ভেতরে চলে আসেনি তো! পাশে ব্যাগের মধ্যে টর্চ ছিল। টর্চ নিয়ে চাদরের মধ্যে থেকে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু টর্চ জ্বাললাম না। যদি মনোজজীর ঘুম
ভেঙ্গে যায়!
"কান খাড়া করে আবার শুনলাম।
একটা আওয়াজ আসছে। কেউ যেন জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। একটু থেমে আবার বড়ো করে নিঃশ্বাস।
অনেকটা খানিকক্ষণ দম বন্ধ করে যেভাবে
কেউ তারপরে নিঃশ্বাস
নেয়।
"চোখ একটু অন্ধকারে অভ্যস্ত
হয়ে গেলে পাশের ঘরে গেলাম। আওয়াজটা যেন হঠাৎ করে থেমে গেল। মনোজজী
ঘরের একধারে চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। মনে হল, পাশের ঘরের দরজাটা যেন সামান্য খোলা। কোনও কিছু কি তাহলে ওর মেয়ের ঘরে ঢুকেছে?
ঢুকে দেখব?
"শুনেছিলাম মেয়ে স্বাভাবিক নয়।
এত রাতে কোনওরকম পরিচয় ছাড়া তার ঘরে ঢোকা কি ঠিক হবে? একটু দ্বিধা নিয়ে আবার আমার ঘরে ফিরে এলাম।
"ভোরের দিকে আবার ঘুম ভেঙে গেল। আবার সেই একই শব্দ শুরু হয়েছে। কিছু একটা যেন পাশের ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবারে
তাড়াতাড়ি করে উঠে পাশের ঘরে চলে এলাম। বাইরে এখন সামান্য আলো হয়েছে। মনোজজীর ঘরের ছোট
জানলা দিয়ে প্রথম সূর্যের ঘুমভাঙা আলো এসে মাটিতে পড়েছে। কিন্তু ঘরে কিছু নেই। কোনও কিছুই দেখতে পেলাম না। মনোজজী এখনও নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। বাইরের
দরজা বন্ধ নয়। ভেজানো। হঠাৎ চোখ পড়ল দুধের বাটিতে। বাটি থেকে দুধ খানিকটা বাইরে
মাটিতে এসে পড়েছে। পাশে মেয়ের ঘরের দরজা সামান্য খোলা। তাহলে কি সেই এসেছিল এখন?
"সাহস করে পাশের ঘরের দিকে
এগিয়ে গেলাম। মাঝের দরজা খুলে অন্য ঘরে ঢুকলাম।
"ছোট ঘর। এখানে কোনও জানালা
নেই। ঘরের মধ্যে অন্ধকারে ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছে না। টর্চটা এবার জ্বাললাম। এখানে
কী করে কেউ থাকে, ভেবে অবাক হলাম। ঘরের এককোণে একটা কাঠের বাক্স। কিছু মাটির কলসি
রাখা। একটা ছোট টেবিল। তার
উপর কিছু জামাকাপড় রাখা। একটা মেয়ের ঘরে মেয়েদের কোনও পোশাক চোখে পড়ল না। তাহলে
কে থাকে এই ঘরে? আর শব্দই বা কীসের?
"তাহলে হয়ত আমারই মনের ভুল।
"এর মধ্যে আবার খুব কাছ থেকে
আওয়াজটা শুনতে পেলাম। সেই জোরে জোরে নিঃশ্বাস।
"সেই শব্দের উৎসটাকে এবার
খুঁজে বার করতে অসুবিধে হল না। আসছে আমার সামনে রাখা মাটির কলসিটা থেকে। আর ওই
কলসি থেকে আস্তে আস্তে উঠে আসছে একটা লাঠির মতো জিনিস। হঠাৎ ভয়ে চমকে উঠলাম। ওটা
লাঠি নয়, একটা বিশাল কিং কোবরার ফণা! আমার
থেকে ঠিক দেড় ফুট দূরে মাটি থেকে পাঁচ ফুট উপরে উঠে এসেছে ফণাটা। আর স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
খানিকক্ষণের জন্য ঘাড় অব্দি উঠে আসা ওই রাগী দৃষ্টির সামনে সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়েছিলাম।
"এক মুহূর্তের জন্য ভয়ে বিহ্বল
হয়ে গিয়েছিলাম। তারপরে একটু পিছিয়ে আসার চেষ্টা করতেই পেছনে হঠাৎ মনোজজীর গলা
শুনলাম।
'কোনও ভয় নেই, আমি এসে গেছি। উলূপী
কিছু করবে না।' একটু থেমে, 'উলূপী, উলূপী,
শান্ত হো যা', বলে দেওয়ালে টোকা মারল মনোজজী।
"সাপটা দেখি একটা বড়ো শ্বাস
ফেলে ফের কলসীর মধ্যে মাথা নিচু করে নিল।
"মনোজজী ফের আমাকে বলে উঠল, 'এখানে না এলেই পারতে, আমি নেহাত টের পেয়েছিলাম। নাহলে একটা ছোবলেই সব শেষ।'
'আসলে একটা শব্দ পাচ্ছিলাম, তাই ভাবলাম
কিছু একটা ঢুকেছে ঘরে। তা এটা কি আপনার পোষা সাপ?'
"প্রশ্নটা শুনে মনোজজীর গলা হঠাৎ
অন্যরকম হয়ে গেল। খসখসে গলায় বলে উঠল, 'কী নামে ডাকলাম
শোননি? ও সাপ না। আমার মেয়ে। উলূপী।' বলে আমার দিকে আগুনের দৃষ্টিতে
তাকাল। আর তখনই লক্ষ করলাম ওর চোখের সঙ্গে কিং কোবরার চোখের অসম্ভব মিল। একটা
প্রায় গোল চোখের মধ্যে কালো গোল মণি। চোখের ধার দিয়ে সেরকমই চামড়ায় ভাঁজ।
"আমি কী বলব বুঝে উঠতে পারলাম
না। ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
"ভোর হয়ে এসেছিল। শিক দেওয়া
জানলা দিয়ে ঢুকেছিল ঠাণ্ডায় কাঁপতে থাকা ভোরের রোদ্দুরের আলোছায়া।
"বাড়ির বাইরে গিয়ে বসলাম। কেন
জানি না, ওই ঘরে থাকতে ভরসা পাচ্ছিলাম না। খানিকবাদে মিলন ও ধৃতিমান চলে এলো। ম্যাগি
দিয়ে আমরা সকালের
ব্রেকফাস্ট সারলাম। মনোজজীকেও খাওয়ালাম। ও ওরকম জিনিস আগে কোনওদিন খায়নি।
"আমাকে উলূপীর সম্বন্ধে কোনও কথা বলতে বারণ করেছিল। খানিকবাদে সকাল আটটা
নাগাদ আমরা সাকরির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। প্রায় পনেরো কিমি পথ হাঁটতে হবে। গ্রাম
থেকে বেরোনোর সময় একটা জায়গায় দেখি বেশ কিছু লোকের ভিড়। এগিয়ে গিয়ে শুনলাম কালকের
সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক, বুধুয়া মারা গেছেন। মৃত্যুর কারণ কী জিজ্ঞেস করতে একজন বলে উঠল, সাপের কামড়। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করতে আর কোনও উত্তর দিল না।
"তাহলে কি উলূপী এখানেই এসেছিল
মাঝরাতে? আর তাই আমি ওই আওয়াজ শুনেছিলাম।
"ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক দেখতে গিয়ে
দেখলাম আমাদের পাশে কিছু দূরে মনোজজী দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গেলাম।
"মনের মধ্যে একটা সন্দেহ
হচ্ছিল। তাই জিজ্ঞেস করে উঠলাম, 'আচ্ছা, এ গ্রামে কতজন থাকে?'
"মনোজজী নির্বিকারভাবে বলে
উঠল, '৮৯।'
'আর তাই নতুন কেউ এলে, কাউকে তার জন্য জায়গা
ছেড়ে দিতে হয়, যাতে গ্রামের জনসংখ্যা একই থাকে।
কোনওভাবেই ফিবোন্যাচি সিকোয়েন্সের
বাইরে এ সংখ্যা হতে পারে না। আর সে কাজটা সারে আপনার মেয়ে উলূপী। তাই
তো?'
"মনোজজী আরেকবার দীর্ঘশ্বাস
ফেলে বলে উঠল, 'বুধুয়াকাকুর হাতে
আমি মানুষ। খুব ভালো লোক ছিল। কিন্তু আমরা তো আর প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যেতে পারি
না। তাই ওই সংখ্যাগুলোর
বাইরে অন্য কোনও সংখ্যা হয় এরকম আমরা হতে দিতে পারি না। তাই
কেউ এলে, কাউকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। এটাই এখানকার নিয়ম। চলে আসছে গত কয়েকশো বছর
ধরে।'
"মনোজজীর চোখ ছলছল করে উঠল।
ফের বলে উঠল, 'আমার বাবা খুব কম বয়সে মারা যান। আমি মানুষ ওই বুধুয়ারই হাতে।'
"বলে আমার দিকে ফের স্থিরদৃষ্টিতে তাকাল। ফের মনে করিয়ে দিল আজকে ভোররাতে দেখা সেই দৃষ্টিকে।
উলূপীকে।”
_____
ছবিঃ পম্পা প্রধান