লাল সাইকেল
সৈকত মুখোপাধ্যায়
পাহাড়ের
কোলে জঙ্গলের মাঝে একটা ছোট্ট গ্রাম ছিল।
গ্রামের মাপে একটা ছোটো পোস্টঅফিসও ছিল সেখানে।
তারপর একদিন সেই গ্রামের পানীয় জলের একমাত্র উৎস যে ঝরনা, সেটা শুকিয়ে গেল; তাই গ্রামের লোকেরা গ্রাম ছেড়ে চলে গেল অনেক দূরে অন্য এক ঝরনার ধারে নতুন করে গ্রাম পাততে।
ওরা
চলে যাওয়ার পর একটা বছর কাটতে না কাটতেই চারপাশের জঙ্গল এসে পরিত্যক্ত গ্রামটাকে অধিকার করে নিল।
নুড়ি-বিছানো রাস্তাগুলোর মাঝখানে গজিয়ে উঠল ল্যানটানা ফুলের ঝোপ।
বাড়িগুলোকে ছেয়ে ফেলল বুনো আইভি-লতা।
মেঝে আর দেয়ালের মধ্যে শেকড় ঢুকিয়ে ইটগুলোকে আলগা করে দিল যত রকমের জংলা গাছ আর তারপর বাকি কাজটা করল বর্ষার জল।
বর্ষা শুরু হতেই নড়বড়ে দেয়াল আর ছাদগুলো জলের ধাক্কায় ভেঙে পড়ল মাটির ওপরে।
চারপাশের
বনভূমি থেকে পোকা, পাখি আর জন্তুজানোয়ারেরা এই সবকিছুই লক্ষ করছিল।
যখন তারা দেখল যে, গ্রামটায় সত্যিকারেই আর কোনো মানুষের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, তখন তারা প্রথমে খুব সাবধানে রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি সেখানে ঢুকে খোঁজখবর নিয়ে গেল।
সবার
আগে এসেছিল এক শেয়াল দম্পতি, তাদের চারটে ছানাকে সঙ্গে নিয়ে।
যখন ওই গ্রামে মানুষ থাকত, তখনও তারা প্রায়ই মুরগি-পায়রা এইসব চুরি করতে ওখানে যেত।
তাই ওদের সাহসটা অন্যদের চেয়ে একটু বেশি ছিল।
শেয়ালগুলো
প্রথমেই সব ক’টা বাড়ির পেছনের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে, গন্ধ শুঁকে দেখল, কোথাও কোনো ফাঁদ-টাদ পাতা আছে কিনা।
যখন নিশ্চিত হল যে, না, সেরকম কিছু নেই, তখন তারা গ্রামের মোড়লের বাড়ির বৈঠকখানার মধ্যে সংসার পেতে বসল।
ওই শেয়ালগুলোই হুক্কা হুয়া শব্দে চারিদিকে ঘোষণা করে দিল যে, গ্রামটা এখন আমাদের থাকবার পক্ষে খুব নিরাপদ একটা জায়গায় পরিণত হয়েছে।
তোমরা চলে এসো।
তাই
শুনে তখনই উত্তরের পাইনবন থেকে নিঃশব্দে উড়ে এল বিশাল দুটো হুতোমপ্যাঁচা।
তারা কবিরাজবাড়ির ভাঙা চিমনির মধ্যে চটপট একটা বাসা বানিয়ে ফেলল।
তারপর একে-একে এল বেজি, বুনো খরগোশ, হরিণ, সাপ, বনমোরগ, এমন আরও কত প্রাণী।
তারা সবাই ভাঙা বাড়িগুলোর মধ্যে নিশ্চিন্তে বসবাস শুরু করে দিল।
গ্রামের
চারিপাশে মানুষের তৈরি ফসলের খেত ছিল।
যদিও তখন সেই খেত বড়ো বড়ো ঘাসে ছেয়ে গেছে, তবু বর্ষার জল পেয়ে সেই ঘাসের ভেতর থেকেই মাথা তুলল জোয়ার, ভুট্টা আর রামদানার গাছ।
হরিণেরা তো আগে থেকেই ছিল; এবার ফসলের মিষ্টি গন্ধে চলে এল বুনো শুয়োর আর হাতির পাল।
তারা
অবশ্য গ্রামে থাকল না।
বেশিক্ষণ একজায়গায় থাকা ওদের পোষায় না।
সারারাত পাহারা-বিহীন খেতে প্রাণভরে ফসল খেয়ে, ভোর না হতেই তারা আবার ফিরে গেল গভীর জঙ্গলে।
সেদিন সূর্য ওঠার পরে টিয়ার ঝাঁক এসে মহা ক্যাঁওম্যাঁও শুরু করল— এইভাবে কেউ মুড়িয়ে সব খেয়ে নেয় গো! হতভাগা হাতির পাল আমাদের জন্যে একটা ভুট্টাও আস্ত রাখেনি।
গ্রামের
লোকেরা গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার সময় বাড়িটি বাদে তাদের আর সমস্ত জিনিস নিয়ে চলে গিয়েছিল।
বই খাতা চেয়ার টেবিল হাঁড়ি ডেকচি লাঙল কোদাল— সব।
অনেকে বাড়ির চালের টিন আর দরজা জানলার কাঠের পাল্লাগুলোকেও নিয়ে গিয়েছিল।
সেটাই তো স্বাভাবিক।
নতুন জায়গায় সংসার পাততে গেলে সব কিছুরই তো আবার প্রয়োজন পড়বে।
তখন কি আবার নতুন করে কিনবে?
থেকে
গিয়েছিল শুধু পোস্টঅফিসের বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা একটা লাল সাইকেল।
মানুষের চিহ্ন বলতে গোটা গ্রামে ওইটুকুই।
বড়োদের
দু-চাকার সাইকেল।
তবু তার গায়ে লাল রং করা হয়েছিল, কারণ, সাইকেলটা ছিল পোস্টঅফিসের সম্পত্তি।
আর পোস্টঅফিসের যত কিছু সম্পত্তি, বাড়ি থেকে গাড়ি, সবকিছুতেই লাল রং করে দেওয়াই নিয়ম।
সেই
পোস্টঅফিসে পোস্টমাস্টারবাবুই ছিলেন একমাত্র কর্মচারী।
তিনিই পোস্টমাস্টার, তিনিই পিয়োন।
গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই যাতায়াতের পথে একবার করে তার কাছে খোঁজ নিয়ে যেত, মাস্টারমশাই, আমার নামে কোনো চিঠি আছে নাকি? থাকলে হাতে-হাতে নিয়ে যেত।
কাজেই খুব বেশি চিঠি বিলি করা বাকি থাকত না।
নিতান্ত কয়েকজন বুড়োমানুষ যাঁরা পোস্টঅফিস অবধি আসতে পারতেন না, পোস্টমাস্টারবাবু ওই সাইকেলটায় চড়ে, দুপুরের দিকে, তাঁদের বাড়িতে চিঠিগুলো দিয়ে আসতেন।
গ্রামটা
উঠে যাওয়ার দু-দিন বাদেই পোস্টঅফিসটাও তুলে দেওয়ার নোটিশ এল।
গ্রামই নেই তো পোস্টঅফিস রেখে আর কী হবে? নোটিশ পেয়ে পোস্টমাস্টারবাবু একটা সরু চেন আর ছোটো তালা দিয়ে সাইকেলটাকে বারান্দার থামের সঙ্গে বেঁধে, টিনের সুটকেসটা নিয়ে চলে গেলেন তার নতুন কাজের জায়গায়।
বড়ো
অফিসে তিনি একবার লিখেছিলেন, সরকারি সাইকেলটা ওখানে পড়ে রইল, কেউ যেন ওটাকে নামিয়ে আনার বন্দোবস্ত করে।
কিন্তু অমন পুরোনো একটা লজঝড়ে সাইকেল নিয়ে মাথা ঘামাতে বয়েই গেছে বড়ো অফিসের বড়ো সাহেবদের।
তাদের বলে কত কঠিন-কঠিন কাজ থাকে।
কাজেই
পোস্টঅফিসের বারান্দায় একা পড়ে রইল সেই লাল সাইকেলটা।
সাইকেল
তো আর টিয়া, হাতি, শেয়াল, প্রজাপতি এদের মতন বুনো জন্তু নয়।
মানুষের হাতেই তার জন্ম, মানুষের সঙ্গেই তার সম্পর্ক।
তাই গ্রাম থেকে মানুষেরা চলে যাওয়ার পরে তার ভীষণ মনখারাপ হয়ে গেল।
টালি-ছাওয়া বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সে ঝিমোয় আর ভাবে কী জানি আবার কবে মানু্ষেরা ফিরবে এখানে।
এর
মধ্যেই একদিন ক’টা বোলতা এসে তার বেলের মধ্যে ঘোরাঘুরি শুরু করল।
বেল মানে যেটা ক্রিংক্রিং করে বাজে।
তো, সাইকেলটা তাই দেখে বোলতাদের বলল, কী ব্যাপার? এখানে ঘোরাঘুরি করছ কেন?
বোলতাগুলো
বলল, তোমার বেলের মধ্যে যে খোঁদলটা রয়েছে, ওটা আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছে।
আমরা ওখানে একটা চাক বাঁধতে চাই।
শুনে
সাইকেলের তো চক্ষু চড়কগাছ।
সে বলল, ছিঃ।
সাইকেলের বেলের মধ্যে বোলতার বাসা! এরকম কথা কেউ কোনোদিন শুনেছে কি? বেলের খোঁদলটা যদি তোমাদের চাক দিয়েই ভরতি হয়ে যায়, তাহলে বেলটা বাজবে কেমন করে?
বোলতাগুলো
ভেংচি কেটে বলল, বাজাচ্ছেই বা কে? বাজানোর দরকারটাই বা কী? আমরা চাক বাঁধবই বাঁধব।
কাল থেকে কাজ শুরু হবে।
দেখি, কেমন করে ঠেকাও।
বোলতাগুলো
চলে যাবার পরে দুটো বুলবুলি উড়ে এসে সাইকেলের হ্যান্ডেলের ওপরে বসল।
সাইকেলের পাশেই দেয়ালের গায়ে যে লাল টুকটুকে লেটার-বক্সটা ছিল, বুলবুলিদুটো সেটার মধ্যে বাসা বানিয়েছিল।
এখন তো আর ওটার মধ্যে কেউ চিঠি-টিঠি ফেলে না, কাজেই অসুবিধে ছিল না।
এতদিন
এত কাছাকাছি থাকার ফলে বুলবুলিদুটোর সঙ্গে সাইকেলের বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল।
ওদের সঙ্গেই তার সুখ-দুঃখের কথা হত।
তো, সেদিন বিকেলে বুলবুলিদুটো সাইকেলকে বলল, কিছু মনে কোরো না সাইকেলদাদা, আমাদের মনে হয় এই গ্রামটায় থাকলে তোমাকে আরও হেনস্থা হতে হবে।
দেখবে, ক-দিন বাদে কাকগুলো এসে বাসা বানানোর জন্যে তোমার সিটের গদি ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
পিঁপড়েরা তোমার টায়ার ফুটো করে হাওয়া বার করে দিচ্ছে।
তখন তোমার খুব মনখারাপ হবে।
তার চেয়ে তুমি সময় থাকতে-থাকতে এই গ্রাম ছেড়ে এমন কোথাও চলে যাও, যেখানে মানুষ আছে।
মানুষের কাছে তুমি আদর-যত্ন পাবে।
সাইকেল
তাই শুনে বলল, আমারও তো সেরকমই ইচ্ছে।
কিন্তু যাব কেমন করে? কেউ না চালালে তো আমি চলতে পারি না।
বুলবুলিগুলো
বলল, ওরকম মনে হয়।
আসলে তুমি দিব্য নিজে-নিজে চলতে পারো।
কোনোদিন চেষ্টা করে দেখোনি, তাই ওরকম মনে হচ্ছে।
সাইকেল
বলল, আর এই চেন-তালাটা?
বুলবুলিদুটো
কলকল করে হেসে উঠল।
বলল, তুমি না একটা কী যেন।
জলে ভিজে, মরচে পড়ে কবেই চেনটা ছিঁড়ে গেছে।
এখন তোমার কোনো বাঁধন নেই।
সাইকেল
বলল, তাহলে যাই?
বুলবুলিরা
বলল, এসো।
আমরা মাঝে মাঝে উড়ে গিয়ে দেখে আসব, তুমি কত দূরে গেলে।
তারপর
বুলবুলিদুটো সাইকেলের চাকায় জড়িয়ে রাখা চেনটাকে ঠোঁটে করে খুলে দিল আর সাইকেলের পেছনে দিল একটা আলতো করে ঠেলা।
ঠেলা দিতেই পাহাড়ি ঢালু রাস্তা বেয়ে সাইকেলটা গড়গড়িয়ে নেমে চলল।
নামতে
নামতে গ্রামের সীমানা পেরিয়ে গভীর থেকে আরও গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়ল সেই সাইকেল।
সে নিজেই অবাক হয়ে গেল, এত চমৎকারভাবে সে চলছে কেমন করে।
রাস্তায় কত গর্ত আর পাথর।
কত গাছের শেকড় আর পাতার স্তূপ।
তার ওপরে যখন-তখন এদিক থেকে ওদিকে রাস্তা পেরোচ্ছে বনমোরগ না হলে খরগোশ, হাতি না হলে ভালুকের ছানা।
তাদেরও বাঁচিয়ে চলতে হচ্ছে।
সামনে ওরকম কোনো বুনোজন্তু চলে এলে তার বেলটা নিজে থেকেই ক্রিংক্রিং করে বেজে উঠছে।
এসব সে পারছে কেমন করে কে জানে।
বেশিক্ষণ
পারল না অবশ্য।
দেখতে-দেখতে ঝুপ করে রাত্রি নেমে এল।
তখন সাইকেল ভাবল, আর এগিয়ে কাজ নেই।
ওই যে একটা আলো দেখা যাচ্ছে, ওইখানেই আজ রাতের মতন আশ্রয় নিই।
বনের
রাস্তা থেকে আরেকটা পায়ে চলা সরু পথ একটু নীচের দিকে নেমে গিয়েছিল।
আলোটা আসছিল সেই সরু রাস্তার শেষমাথা থেকে।
লাল সাইকেল ধীরে ধীরে সেই আলোটা লক্ষ্য করে সেখানে পৌঁছে দেখল বনের মধ্যে একটা কুঁড়েঘর।
কুঁড়েঘরের সামনে পরিষ্কার উঠোনে একটা কুসুমগাছ।
লাল সাইকেল সেই কুসুমগাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বেল বাজিয়ে দিল ক্রিংক্রিং।
আর অমনি ঘরের দরজা খুলে মোটা কাপড় পরা, রুক্ষ চুল, শ্যামলারঙের এক মহিলা বেরিয়ে এসে বললেন, কে? কে এলেন সাইকেল নিয়ে?
সাইকেল
একগাল হেসে বলল, কেউ নিয়ে আসেনি।
আমি খুবই স্বাবলম্বী সাইকেল।
নিজেই নিজেকে নিয়ে এসেছি।
সেই
মহিলা অনেকক্ষণ অবাক হয়ে সাইকেলের দিকে তাকিয়ে থেকে, কপালে দুটো হাত জড়ো করে প্রণাম করলেন।
তারপর বললেন, না ভাই সাইকেল।
তুমি বুঝতে পারছ না, তোমাকে ভগবান এখানে নিয়ে এসেছেন।
সাইকেল
বলল, এমন কথা বলছেন কেন?
মহিলাটি
তখন কুঁড়েঘরের দরজাটা খুলে দিয়ে বললেন, ওই দেখো।
বিছানার ওপরে যে ছোট্ট মেয়েটা শুয়ে রয়েছে, ওর নাম তিন্নি।
ওর বয়স পাঁচ বছর।
আর ওর মাথার কাছে যে ছেলেটা বসে আছে, ও তিন্নির
দাদা তীর্থ।
ওর বয়স বারো বছর।
তিন্নি জন্মানোর পরেই ওদের বাবা, মানে আমার স্বামী নিখোঁজ হয়ে গেছেন।
স্বামী থাকতে যা করতেন, এখন আমি সেই কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করি।
বনের মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে শহরের বাজারে বিক্রি করি।
আমার নাম শান্তি।
সাইকেল
শান্তিকে বলল, এই ঘোর জঙ্গলের মধ্যে দুটো বাচ্চাকে নিয়ে একা থাকতে আপনার ভয় করে না?
শান্তি
বললেন, একটুও না।
এখানে ধারে-কাছে কোনো মানুষ নেই তো।
তাহলে আর ভয় পাব কাকে? জন্তু-জানোয়াররা ভয় পাবার মতন জিনিস নয়।
মানুষের ভয় শুধু মানুষকে নিয়েই।
তাছাড়া আমার স্বামীর একটা দেশি বন্দুক ছিল, বিপদে-আপদে ব্যবহারের জন্যে।
সেটা আমিও চালাতে পারি।
আমার ছেলেমেয়েরাও তির-ধনুক চালায় খুব ভালো।
আমরা তিনজন মিলে আস্ত একটা ফৌজকে রুখে দিতে পারি।
সাইকেল
বলল, তাহলে আপনি বললেন কেন, আমাকে ভগবান পাঠিয়েছেন।
শুনে তো ভাবছিলাম, আপনি কোনো বিপদে পড়েছেন।
শান্তি
বললেন, ঠিকই ধরেছ।
তিন্নির আজ দু-দিন থেকে ধুম জ্বর।
জ্বর কিছুতেই নামছে না।
এক্ষুনি শহর থেকে ওষুধ কিনে এনে ওকে না খাওয়াতে পারলে জ্বর আরও বাড়বে।
তারপর কী হবে জানি না।
এই বলে তিনি চোখ মুছলেন।
তারপর বললেন, সবেমাত্র ভাবছিলাম, হাঁটতে হাঁটতেই শহরের দিকে রওনা হই, যদিও হেঁটে যতক্ষণে শহরে পৌঁছব ততক্ষণে ওষুধের দোকান সব বন্ধ হয়ে যাবে, এমন সময় তুমি এলে।
এবার তাহলে তীর্থ তোমাকে নিয়ে পোঁ করে শহর থেকে ঘুরে আসতে পারবে।
সাইকেল
বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ।
চলো বাবু তীর্থ।
আর একদম দেরি কোরো না।
তারপর
সেই সাইকেল তীর্থকে নিয়ে যে দৌড়টাই দৌড়ল, ইতিহাসে কোনো পুরোনো সাইকেল ওরকম দৌড়য়নি।
তীর্থকে কিছুই করতে হচ্ছিল না।
সে শুধু হ্যান্ডেলদুটো শক্ত করে চেপে ধরে বসেছিল।
যথাসময়ে শহরেও পৌঁছে গেল সাইকেল।
ওষুধও কেনা হল।
কিন্তু
ফেরার পথে হল এক কাণ্ড।
শহর
ছেড়ে যে-রাস্তাটা পাহাড়ের দিকে গিয়েছে, যে-রাস্তা ধরে তীর্থকে নিয়ে তার ফেরার কথা সেই রাস্তায় না গিয়ে, সাইকেল হঠাৎ বাঁক নিল অন্য একটা রাস্তায়।
সেটা একেবারে ঘিঞ্জি একটা রাস্তা।
গায়ে গায়ে লাগা নোংরা নোংরা বাড়িঘর।
রাস্তায় বসে লোকে তাস খেলছে, কোথাও মারপিট করছে দুটো লোক, আরও দশজন তাদের ঘিরে ধরে মজা দেখছে।
সাইকেলটাকে দেখতে পেয়েই সাত-আটটা ইয়া তাগড়া নেড়িকুকুর ঘেউঘেউ করে তাকে তাড়া করল।
তীর্থ বেচারা ভয়ের চোটে চেঁচিয়ে উঠল, এ কী
সাইকেলকাকু! এ কোন
রাস্তায় ঢুকে পড়লে? এ তো
আমাদের বাড়ির রাস্তা নয়।
সাইকেল
খুব করুণ গলায় বলল, আরে, আমিও কি জানি নাকি কোথায় যাচ্ছি? নাকি আমি ইচ্ছে করে এখান দিয়ে যাচ্ছি? আমাকে কে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
যেতে
যেতে যেখানে
বস্তি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, দেখা যাচ্ছে শহরের ময়লা ফেলার জায়গা, সেখানে এসেই এক জায়গায় সাইকেল হঠাৎ থেমে গেল।
পড়তে পড়তে কোনোরকমে মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল তীর্থ।
পাশেই
বসেছিল এক পাগল।
কম্বলের মতন নোংরা একটা কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা।
শুধু মুখটুকু বেরিয়ে রয়েছে।
উবু হয়ে বসে বিড়বিড় করে বকছে আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।
সামনে যে দুজন মানুষ এসে দাঁড়াল, তাদের যেন দেখতেই পেল না।
সাইকেল
আপনমনে ফিশফিশ করে তীর্থকে বলল, মনে হয় এই লোকটির জন্যেই আসা।
সেইজন্যে এখানে এসেই চাকা জ্যাম হয়ে গেল।
চেনো নাকি একে?
তীর্থ
ভালো করে কিছুক্ষণ সেই পাগলের দাড়িগোঁফে ঢাকা নোংরা মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ প্রায় চিৎকার করে ডেকে উঠল, বাবা!
পাগলও
চমকে মুখ তুলে তাকাল।
তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে তীর্থর দিকে এগিয়ে এসে দু-হাতে তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল।
বলল, তীর্থ, আমার সব মনে পড়ে গেছে… সব মনে পড়েছে আমার।
সেই যে এক ভণ্ড সাধু খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে আমাকে অজ্ঞান করে টাকাপয়সা নিয়ে পালাল, তারপর থেকে ক্রমশ সব স্মৃতি হারিয়ে ফেললাম।
এতদিন ধরে কত মনে করার চেষ্টা করেছি, আমার বাড়ি কোথায়, বাড়িতে আমার কে কে আছে, কিছুতেই মনে পড়ত না।
হ্যাঁ রে, তোরা সবাই ভালো আছিস তো? তোর মা, আমার মেয়েটা?
তীর্থ
বলল, সবাই ভালো আছি বাবা, শুধু বোনের জ্বর হয়েছে।
ওর ওষুধ কিনতেই এসেছিলাম।
চলো, এবার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরি।
চল, বলে তীর্থর বাবা তড়াক করে সাইকেলের সিটে উঠে বলল, তুই সামনের রডে বোস।
তারপর
আর কী? পরদিন সকালে দেখা গেল তীর্থর বাবা চানটান করে দাড়িগোঁফ কামিয়ে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে দাওয়ায় রোদে বসে আছে।
শান্তি খুব খুশি-খুশি মুখে ওদের কুঁড়ের পেছনের রান্নাঘরে বসে লুচি ভাজছে।
আর তীর্থ ছেঁড়া ন্যাকড়া, কেরোসিন তেল, পুরোনো টুথব্রাশ এইসব নিয়ে কুসুমগাছের তলায় বসে সাইকেলকে ঘষে-মেজে ঝকঝকে করে তোলার কাজে মন দিয়েছে।
ঠিক
তখনই একজোড়া বুলবুল এসে কুসুমগাছের ডালে বসে ঘাড় ঝুঁকিয়ে সাইকেলকে বলল, ভালোই তো আছ দেখছি সাইকেলদাদা।
বলেছিলাম না, মানুষের কাছে যত্ন পাবে।
সাইকেলের
বেলটা মনের আনন্দে নিজে থেকেই দু-বার বেজে উঠল ক্রিংক্রিং ক্রিংক্রিং।
তবে তাই শুনে তীর্থ একটুও অবাক হল না।
সে তো জানেই, এ এক
ম্যাজিক সাইকেল।
----------
ছবি - স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
কী যে ভালো গল্প!
ReplyDeleteঅসাধারণ সুন্দর গল্প।
ReplyDelete