তিতাসের প্রথম অভিযান
অদ্রিজা মণ্ডল
সপ্তম শ্রেণি, সেণ্ট মেরী’জ কনভেণ্ট স্কুল, সাঁতরাগাছি
আমি আর আমার কলেজের বন্ধু
তিতাস দু-দিন আগে দিল্লি এসেছি। এমনিতে
দিল্লি একটা জমজমাট শহর, কিন্তু আমরা আপাতত যে জায়গাটাতে রয়েছি, সে জায়গাটা বেশ নিরিবিলি
আর মনোরম। যে
হোটেলে আছি, তার নাম ইন্দ্রপ্রস্থম্ হোটেল। হোটেল কমপ্লেক্সে একটা পার্কে একটা
লাগোয়া সুইমিং পুল।
বিকেলবেলা পার্কের একটা বেঞ্চে বসে ইয়ারপডে গান শুনছিলাম আর দেখছিলাম যে বাচ্চারা
খেলছে।
হঠাৎ একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে একজন ভদ্রমহিলা এসে
বসলেন। বাচ্চাটাকে
এমনভাবে ধরে রয়েছেন তিনি, যে তার মুখ আমি দেখতে পেলাম না। আমায়
জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কী?” বললাম, “মহিমা রায়।” ভদ্রমহিলা আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কার
সঙ্গে এসেছ?”
আমি বললাম, “কলেজের বন্ধুর সঙ্গে।” তিনি বললেন, “খুব ভালো, তা, কোথা থেকে আসছ?”
বললাম, “কলকাতায় বাড়ি, কিন্তু ব্যাঙ্গালোরে থাকি।” ভদ্রমহিলা বললেন, “আমি
আভেরি দে।
নাম শুনেছ নিশ্চয়ই?” আমি বলে উঠলাম, “আপনি তো আই আই টি মুম্বইয়ের প্রফেসর, তাই না?” “হ্যাঁ,” বললেন
মিসেস দে।
ততক্ষণে তিতাস ফোন করেছে। আমি বললাম, “ম্যাম, আমি
চলি, সন্ধে হয়ে গেছে আর আমার বন্ধু ফোন করছে।”
মিসেস দে বললেন, “আচ্ছা।”
আমার নাম তো শুনেছ, মহিমা রায়। তিতাস হল
গিয়ে তিতাস সাহা।
আমার আর তিতাসের বয়স ২০ আর আমরা মাস দুয়েকের ছুটি পেয়ে দিল্লি ঘুরতে এসেছি। এখানে সবে দু-দিন হল এসেছি।
ঘরে ঢুকতেই তিতাস বলল, “কী রে? ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাকি? বেরোবি না?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “বেরোব? কোথায়?”
“নীহারের
বাড়ি যাবি না?” তিতাস বলল, “সকালেই
তো বলেছিলাম, ভুলে গেলি?”
আমি বললাম, “ও, হ্যাঁ, মনে পড়েছে।”
তিতাস বলল, “চটপট রেডি হয়ে নে।”
আমরা সঙ্গে করে একটা ইলেকট্রিক গাড়ি (ব্যাটারিতে চলে এমন গাড়ি)
এনেছিলাম।
সেটা সকালবেলা তিতাস চার্জ দিয়েছে। আমাদের গাড়ি আধঘণ্টা-একঘণ্টা চার্জ দিলেই বহুদূর যেতে পারে। তা আমরা
গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একঘণ্টা লাগল পৌঁছোতে। তিতাস বাড়ির
গ্যারেজে গাড়িটা চার্জে বসিয়ে দিয়ে কলিং বেল বাজাল। দরজা
খুলল একজন ভারী সুন্দর মেয়ে। তবে আজ তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে
রয়েছে।
তিতাস বলল, “মহিমা, এই নীহার
সুলতানা, আমার স্কুলের বন্ধু। নীহার,
এ হচ্ছে মহিমা রায়, আমার কলেজের বন্ধু।”
নীহার বলল, “হ্যালো।”
তিতাস বলল, “তোর মুখটা এরকম কেন?”
নীহার বলল, “আমাদের ঘরের মধ্যে একটা খুব দামি
জিনিস চুরি হয়ে গেছে। ভেতরে আয়, বলছি।”
আমি তিতাসের পিছু পিছু নীহারের ঘরে ঢুকলাম। ঘরের ভিতরটা ভারী সুন্দর। তিনটে সোফা তিনদিকে রাখা রযেছে। একটা সোফার
পাশেই দরজা, দু-নম্বর সোফার পিছনে লাল কেল্লা, কুতুব মিনার আর
জামা মসজিদের ছবি।
তাদের পাশে তাজমহলের ছবি আর ফতেপুর সিক্রির ছবি। তিন
নম্বর সোফার পিছনে একটা বইয়ের তাক। বইগুলোর গায়ে হেলানো ছবিগুলোর মধ্যে
একটা নীহারের, আরেকটি তার পুরো পরিবারের ছবি। তার পাশে
বোঝাই যাচ্ছিল যে একটা মূর্তি ছিল, কিন্তু সেটা নেই।
তিতাস সেই জায়গাটা ভালো করে
দেখে নিয়ে বলল, “কবে থেকে মূর্তিটা উধাও হয়েছে?”
নীহার বলল, “আজ সকালে আমি প্রত্যেকদিনের মতোই বইগুলো ঝাড়তে এসে দেখি যে
মূর্তিটা কোথাও নেই। ভাবলাম হয়তো মা কোথাও রেখে দিয়েছে,
কিন্তু সারা বাড়িতে কোথাও নেই আর সেইসঙ্গে আমার ভাই রুহানও নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।”
আমি তখন দাঁড়িয়ে নীহারের পরিবারের ছবিটা দেখছিলাম। মি. সুলতান
লম্বা, ফরসা আর সৌম্যদর্শন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে মিসেস সুলতানা, তাঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে তিনি এককালে অসাধারণ সুন্দরী
ছিলেন, এখনও আছেন।
মিসেস সুলতানার পাশে নীহার আর মি. সুলতানের পাশে সৌম্যদর্শন
ফরসা ছেলে, চুল ঝাঁকড়া, মুখে গোঁফ আর অল্প দাড়ির ফাঁক দিয়ে
ছোট্ট ছেলের হাসি। বুঝলাম,
এ-ই রুহান।
নীহারকে বললাম, “তোমার মা আর বাবা কই?”
নীহার বলল, “বাবা দিল্লি
ইউনিভার্সিটিতে জুলজির প্রফেসর, এখনও ফেরেননি। আর
আমার মা জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্সের প্রফেসর, তিনিও ফেরেননি। রুহান তো নিরুদ্দেশ, তাই আমি একাই
আছি।”
তিতাস বলল, “মূর্তিটা কীসের?”
“নটরাজের,” উত্তর এল দরজার কাছ থেকে। আমরা
তিনজনে দেখি মি. সুলতান দাঁড়িয়ে আছেন দরজার সামনে। বললেন, “আরে তিতাস, কেমন আছ? এই নীহার,
এদের কফি দিয়েছিস?”
নীহার বলল, “আনছি পাপা।”
মি. সুলতান বললেন, “তা আমার জন্যেও এককাপ নিয়ে আসিস,
ততক্ষণে আমিও চেঞ্জ করে আসি।”
দুজনে চলে যেতেই তিতাস বলল, “মহিমা, একবার দেখে আয়
কেউ আসছে কিনা।”
আমি দেখে এসে বললাম, “কেউ নেই।”
তিতাস বলল, “এ বাড়িতে থাকাটা রিস্কি হতে পারে। চল এইবেলা
পালাই।”
আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে
সে যোগ করে দিল, “হোটেলে গিয়ে বুঝিয়ে দেব তোকে।”
সবদিক দেখে নিয়ে আমরা লুকিয়ে
লুকিয়ে গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লাম। তখনও গাড়ির চার্জ আশি পার্সেণ্ট। দশ মিনিট
পর একটা গাড়ি এসে হাজির হল। তখন তিতাস ঘামছে। দেখি, একজন
মহিলা নামলেন।
তিতাস বলে উঠল, “ইনি হলেন আসল কালপ্রিট।” সেই মহিলা হেঁটে গিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। আমি বললাম,
“ইনিই কি মিসেস সুলতানা?”
তিতাস মাথা নাড়ল। আমি
বললাম, “কালপ্রিট বলছিস কেন?”
তিতাস কোনো জবাব দিল না। যখন আর কাউকে দেখলাম না, তখন গাড়িটার চার্জার খুলে
নিয়ে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
হোটেলে এসে জামাকাপড় চেঞ্জ
করে আমরা বিছানায় এসে বসলাম। তিতাস বলল, “আজ তাহলে এক কাজ করা যাক। আমরা আজ যা
যা করলাম, বা দেখলাম তা লিখে ফেলি। ট্যাবলেটে লেখা শুরু কর।”
আমি ট্যাবলেটে বার করলাম।
“প্রথমে তোর
অবজারভেশনগুলো লেখ।
প্রথমে কার সঙ্গে দেখা হয়েছে?”
“হুঁ, মিসেস
আভেরি দে।”
“প্রফেশন?”
“আই আই টি
মুম্বইয়ের ফিজিক্সের প্রফেসর।”
“সঙ্গে কেউ
ছিল?”
“একটা বাচ্চা।”
“বয়স?”
“আমি কীভাবে জানব? মুখটাই তো দেখতে পেলাম না!”
“আন্দাজ করে
বল।”
“অন্তত পাঁচ–ছয়
মাস হবে।”
লিখে নিয়ে আমি তিতাসকে
ট্যাবলেট এগিয়ে দিলাম। তিতাস বলল, “এখন দিস না,
আরও লিখবার আছে।”
অগত্যা আবার আমি ট্যাবলেট নিয়ে বসলাম।
“লেখ, নীহারের বাড়িতে গিয়ে প্রথমে কার সঙ্গে
দেখা হল?”
“নীহার।”
“তারপর?”
“মি. সুলতান।”
“কথা হয়নি
বটে, কিন্তু ইয়ে…”
“মিসেস সুলতানা।”
“এবার দে।”
আমি ট্যাবলেট এগিয়ে দিলাম। তিতাস আরও কীসব লিখে ট্যাবলেট বন্ধ করে বলল, “চল,
এবার শুয়ে পড়ি।” আমার খুব ক্লান্ত লাগছিল, তাই আমি চুপচাপ শুয়ে পড়লাম।
পরদিন তিতাসের ধাক্কায় বিছানা
থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। সামলে নিয়ে বললাম, “কী হল?”
তিতাস বলল, “মি. সুলতান খুন হয়েছেন।”
“সে কী, বলিস কী রে?” বলে আমি একলাফে উঠে পড়লাম।
তিতাসের মুখ ফ্যাকাশে
দেখাচ্ছে, “ভোর রাতে। তাড়াতাড়ি
রেডি হ।”
আর মিনিট দুয়েকের মধ্যে আমরা
রেডি হয়ে গাড়ি করে নীহারদের বাড়ির দিকে ছুটলাম। সেখানে
লিভিং রুমে গিয়ে দেখি, মিসেস সুলতানা হাউ হাউ করে কাঁদছেন। নীহার এসে বলল, “কী সর্বনাশ হল
বল তো! রুহান নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। তারপর আবার পাপা খুন। মাম্মিকে
কে দেখবে বল!”
মিসেস সুলতানা কোনোরকমে বললেন, “আর যাই হোক
না কেন, আমার ছেলেকে এনে দাও!”
তিতাস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে
বলল, “ঠিক আছে আণ্টি, তাই করব।”
তারপর নীহারকে বলল, “একটু ওপরে চল, কথা আছে।”
নীহার বলল, “হ্যাঁ, দাঁড়া।” বলে ডাকল, “নিশাদি! ও নিশাদি!”
একটা মেয়ে ছুটে এল। নীহারের চেয়ে দু-তিন বছরের বড়ো হবে।
নীহার বলল, “মাম্মিকে একটু দেখে রাখো।”
নিশাদি মিসেস সুলতানার পাশে
বসে পড়ল। নীহার তিতাসকে আর আমাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা ছোটো ঘরে নিয়ে গেল। বলল, “এই
আমার ঘর।”
ঘরের ভিতর একটা বড়ো খাট, তাতে কয়েকটা বালিশ একদিকে সাজিয়ে রাখা। তার একদম
পাশে বারান্দা, সেখানে চেয়ার টেবিল পাতা আর রেলিং-এ
বাঁধা গাছ। নীহার বলল, “ওগুলো
রুহানের শখের গাছ, রোজ জল দিত।” বারান্দায়
ঢোকা যায় একটা কাচের দরজা খুলে, তার সামনে
পর্দা।
আরেকদিকে একটা বেডসাইড টেবিল, তাতে রাখা একটা ল্যাম্প, একটা কাচের জগে জল, দুটো
গ্লাস আর কয়েকটা বই, তার পাশে একটা স্টাডি টেবিল, দুটো
চেয়ার, একটা টেবিল ল্যাম্প, দুটো ল্যাপটপ আর টেবিলের নীচে দু-দিকে দুটো বন্ধ করা পাল্লা। টেবিলের
পাশে জানালা।
দরজার পাশে একটা বুকশেলফ, তারপাশে একটা গিটার আর একটা উকেলেলে রাখা। বুকশেলফের
ওপরে একটা ছবি, তাতে নীহার আর রুহান দাঁড়িয়ে।
নীহার বলল, “শুধু আমার নয়, এটা রুহানের ঘরও বটে।”
“আচ্ছা,
নিরুদ্দেশ হবার আগে রুহানের ব্যবহারে কিছু অদ্ভুত হাবভাব লক্ষ
করেছিলি?” তিতাসের প্রশ্নে নীহারের
চোখেমুখে ভয় দেখা গেল। সে বলল, “রুহান
নিরুদ্দেশ হবার আগে কয়েকদিন গাছে জল দেয়নি। আমরা যে রোজ গিটার আর উকেলেলে
বাজিয়ে গান করি, তাও করেনি। শুধু বিছানায় শুয়ে থাকত আর ফ্যানের
দিকে চেয়ে থাকত।
মাঝেমধ্যে কীসের ভয়ে যেন কেঁপে উঠত।” তিতাস কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আমার
মনে হচ্ছে রুহান এই বাড়িতেই আছে, কোথাও যায়নি।”
“ধ্যাত্,
এমন কী করে হবে?” নীহার
এ কথা বলে হো হো করে হাসল। তিতাস কিছু বলল না, শুধু একটু হাসল।
আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, “নে, হাসার পালা শেষ হয়েছে? যদি হয়ে থাকে, তাহলে হোটেলে চল।”
নীহার বলল, “আচ্ছা যা, কিছু হলে জানাব।”
রাতে খাওয়ার সময় তিতাস কোনো কথা বলছে না দেখে আমি বললাম, “তুই হঠাৎ করে কেন
বললি যে রুহান বাড়িতে আছে?”
“প্রমাণ দিতে
পারি, তবে কালকে। আজ
আর কিছু নয়।
নে, এখন ঘুম পাচ্ছে, বকাস না,” বলে তিতাস
চুপ করে গেল, তবে পুরোপুরি নয়, শুধু কী যেন বিড়বিড়
করতে লাগল। আমি
আর কথা না বাড়িয়ে খেতে লাগলাম। খেয়ে উঠে যখন বাথরুমে গেলাম তখনও
তিতাস কী যেন বিড়বিড় করেই চলেছে। শোওয়ার সময়ও একভাবে বিড়বিড় করে গেল,
তবে কী সেটা আর বোঝা গেল না।
“ওঠ, ওঠ,
তাড়াতাড়ি!” আমি চাদর-টাদর
শুদ্ধু বিছানা থেকে পড়েই গেলাম। চাদর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে
বললাম, “হলটা কী,
চেঁচাচ্ছিস কেন?”
“আরে বাবা,
সময় নেই।
তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে,” বলে তিতাস
দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গেল। আমি হতভম্বের মতন দাঁড়িয়ে রইলাম, কিন্তু কয়েক সেকেণ্ডে মাথা পরিষ্কার হতেই আমি এক লাফে
সুটকেসের কাছে গিয়ে একটা জামা টান মেরে বের করে দুই নম্বর বাথরুমের ভিতর ঢুকে
পড়লাম।
দশ মিনিটের মধ্যে আমরা রেডি
হয়ে গাড়িতে করে চললাম নীহারের বাড়ির
দিকে। সেখানে
পৌঁছোতেই তিতাস গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার দিকে
ছুটল।
আমিও তার পিছু পিছু দৌড়োলাম। তিতাস বলল, “কুইক,
বেসমেন্টে চল!”
সঙ্গে সঙ্গে আমি ছুটে গিয়ে বাড়ির পাশে একটা দরজার লোহার হাতল ধরে টানতেই সেই দরজা
খুলে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলাম কারা যেন কাঁদছে। তিতাস আর আমি ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ
করে দিলাম, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা গিয়ে একটা গোল
দরজার মধ্যে দিয়ে ঢুকে পড়লাম। তারপর
অন্ধকারের সঙ্গে মিশে মিশে খানিকটা যেতেই একটা ঘর
দেখা গেল।
সেখানে যা হচ্ছে, তা দেখে আমরা হাঁ হয়ে গেলাম। দৃশ্যটা এইরকম
-
নীহার দাঁড়িয়ে
আছে, হাতে রিভলভার,
পাশে মিসেস সুলতানা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নীহারের সামনে একজন পড়ে আছে। আমরা যা
শুনতে পেলাম তাতে আমার পিলে চমকে গেল। মিসেস সুলতানা বলছেন, “আর তোকে কিছুতেই বাঁচতে দেওয়া যাবে না।”
“কিন্তু কেন
মাম্মি?” নীহার বলল, তার গলায় কান্না কান্না ভাব।
“ছেড়ে দাও
আমাকে,” এবারের গলাটা একটা ছেলের। তিতাস
অস্ফুটভাবে বলল, “রুহান!”
“কর গুলি!!” মিসেস সুলতানা চেঁচালেন, “তারপর
মূর্তিটা সরাতে হবে।” ততক্ষণে তিতাসের হাতে রিভলভার চলে এসেছে।
“না, করব না,” নীহারের দৃঢ় স্বর শোনা গেল।
মিসেস সুলতানা চিত্কার করলেন, “কর!!”
“আপনি হয়তো মূর্তি সরাতে পারতেন কিন্তু তা আর হবে না। নীহার রিভলভার ফেলে দে,”
তিতাস অন্ধকারের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে, হাতে উদ্যত রিভলভার। নীহার তার নিজেরটা ফেলল না, কিন্তু
মিসেস সুলতানার দিকে ঘোরাল। মিসেস সুলতানা তার ওপর ঝাঁপিয়ে
পড়বার চেষ্টা করলেন, কিন্তু আমি ছুটে গিয়ে পিছন থেকে তাঁকে ধরে ফেললাম। ততক্ষণে তিতাস রুহানকে খুলে দিল। তারপর
তিতাস আর নীহার রুহানকে আর আমি মিসেস সুলতানাকে
ধরে বাইরে নিয়ে গেলাম।
বসার ঘরে বসে তিতাস বলল, “এসব করার কারণ কী, মিসেস
সুলতানা?”
মিসেস সুলতানা বললেন, “আমি কিছু বলব না।”
“আমি বলি?” রুহান এবার মুখ খুলেছে।
“রুহান!” মিসেস সুলতানা উঠে দাঁড়াতে
গেলেন, কিন্তু আমি তাঁকে আবার ধরে বসিয়ে দিলাম।
রুহান বলতে শুরু করল, “আমাদের বাড়িতে যে নটরাজের মূর্তিটা আছে, সেটা আমার দাদুর
আমল থেকে।
দাম অন্তত কুড়ি লাখ মতন। দাদু যখন
মারা গেলেন, তখন তাঁর সমস্ত জিনিস পড়ল আমাদের হাতে। কিছু
কিছু জিনিস অনেক টাকায় বিক্রি হয়ে গেল, কিন্তু বেশিরভাগ জিনিস বাড়িতে রয়ে গেল। তাদের
মধ্যে ছিল এই মূর্তিটা। কিন্তু কয়েকদিন ধরে দেখলাম, মাম্মি কীরকম অদ্ভুত আচরণ করা শুরু করে দিয়েছে। তারপর
একদিন দেখি, মূর্তিটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। তার কিছুদিন
পর একদিন রাতে আমি শুনতে পেলাম যে মাম্মি একজনের সঙ্গে
ফোনে কথা বলছে। যতদূর
শুনলাম, ফোনে যার সঙ্গে কথা হচ্ছিল তার নাম আভেরি আর
মূর্তিটা নাকি তার কাছেই আছে। আর তারপরের দিন রাতে আমায় ধরে বেসমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।”
তিতাস বলল, “এই মহিমা, তোর সঙ্গে মিসেস দে-র
দেখা হয়েছিল না?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ।”
সঙ্গে সঙ্গে তিতাস বলল, “চলি তবে।” তারপর
বেরিয়ে পড়ে আমি তার পিছু নিলাম। গাড়ি করে হোটেলে এসেই আমরা মিসেস
দে-র রুম নং জেনে সেই রুমে গিয়ে দরজা ঠক ঠক করলাম। মিসেস দে
বললেন, “আরে, এসো এসো। কী ব্যাপার?”
“অনেক
ব্যাপার আছে,” তিতাস বলল, “প্রথমত
বাচ্চাকে অত জড়িয়ে রাখা যায় না।”
আমি বললাম, “একবার বাচ্চাটাকে দেখতে পাব?”
মিসেস দে ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন। তিতাস গিয়ে
বাচ্চাটার কাপড় খুলতেই বেরিয়ে এল সেই নটরাজের মূর্তি। তিতাস
তখন মূর্তি হাতে নিয়ে বলল, “পুলিশে
ফোন কর, মহিমা।” আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোনে ১০০ ডায়াল করলাম। কিছুক্ষণের
মধ্যেই পুলিশ চলে এল। সবকিছু শোনার পর ইনস্পেকটর
সিনহা বললেন, “বেশ, মূর্তিটা তবে সুলতানের পরিবারের হাতেই তুলে
দেওয়া হবে।
হাজার হোক, পরিবারের সম্পত্তি তো! আর মিসেস সুলতানাকে আর মিসেস দে-কে এরেস্ট করা হচ্ছে। আমি কিছু
মহিলা কনস্টেবল-এর ব্যবস্থা করেছি, মিসেস সুলতানাকে ধরে নিয়ে
যাওয়ার জন্য।
ওহ্! এই তো তারা এসে গেছে,” বলে তিনি
জানলা দিয়ে তাকালেন। আমরা দেখি একটা পুলিশের গাড়ি এসে হোটেলের সামনে দাঁড়াল। আমরা সবাই
ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলাম। সেখানে গিয়ে দেখি গাড়িতে বসে আছেন
মিসেস সুলতানা। ইনস্পেকটর সিনহা মিসেস দে-কে দেখিয়ে মহিলা কনস্টেবলদের বললেন, “এই যে, এঁকেও নিয়ে যাও।”
তখন তারা এসে মিসেস দে-কে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল। ইনস্পেকটর সিনহা বললেন, “মিসেস
সুলতানা আর মিসেস দে স্কুলের দিনগুলো থেকে বন্ধু। তাঁরা
পড়াশোনাতে খুব ভালো, কিন্তু কিছুদিন ধরে তাঁরা চোরাকারবারির
দল তৈরি করবার প্ল্যান করছিলেন। ভাগ্যে
তোমরা এসে পড়লে, না হলে দলটা তৈরি হয়ে গেলে
নানারকমভাবে দেশের সর্বনাশ করে দিতে পারত। এইজন্য তোমাদের কিছু পুরস্কার দেব।”
সেদিন আমরা থানাতে মিষ্টির
প্যাকেট আর একটা করে ভালো পেন পেলাম। সেখান থেকে নীহারের বাড়িতে গিয়ে মূর্তিটা নীহারের
হাতে তুলে দিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। রাতে তিতাস বলল, “কী রে, তোর মুখটা
অমন কেন? কিছু বলবি?”
আমি বললাম, “না না, কী আবার বলব? শুধু বল, কবে ফিরছি আমরা?”
তিতাস বলল, “কাল ভোরে।”
পরদিন ভোরে হোটেল থেকে চেক
আউট করে গাড়িতে উঠছি, তখন তিতাস বলল, “ইস্, একবার
দেখলে হত, মূর্তিটা আসল না নকল!”
আমি গম্ভীরভাবে বললাম, “কাল রাতে আমি তাই ভাবছিলাম।”
“অত ভাবা ভালো নয়,” বলে তিতাস
আমার দিকে চেয়ে হঠাৎ হেসে উঠল।
আমি বললাম, “হয়েছে, এবার চল।”
তিতাস গাড়ি চালাতে শুরু করল। আমি পিছনে
তাকালাম।
ধীরে ধীরে ইন্দ্রপ্রস্থম্ হোটেল কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেল।
----------
ছবি - লেখক
দারুণ
ReplyDelete