আমার মুখোমুখি আমি
তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
মানুষের জন্মের উপর তার নিজের কোনো হাত থাকে না, কোথায় জন্মাবে আর কোথায় বড়ো হবে সেও তার আয়ত্তের বাইরে৷ আমার ভ্রুণের জন্ম তখনকার সাতক্ষীরা মহকুমার চাঁদা নামের গ্রামটিতে, ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম একই মহকুমায় কলারোয়া থানার গোপীনাথপুর গ্রামে, আমার মামার বাড়িতে৷ বাচ্চার জন্ম দিতে মেয়েরা চিরকালই আশ্রয় নেয় তাদের পিত্রালয়ে৷ অতএব আমার জন্মস্থান বলতে গোপীনাথপুরেই৷
আমার জন্মের পর–পরই ভারত দ্বিখণ্ডিত হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের সেই গ্রামে আমার আর বসবাস করা হয়নি৷ আমার পিত্রালয় ও মাতুলালয় – দুয়েরই পায়ের তলায় মাটি সরে যায়, দুই পরিবারের সদস্যরাই পুরোনো ভিটেমাটির মায়া ছেড়ে দিয়ে যাত্রা করেন নতুন ভারতের উদ্দেশে৷ দাদামশাই ননীগোপাল মুখোপাধ্যায় তাঁর ওপার বাংলার সম্পত্তি বিক্রি করে এপার বাংলায় হুগলি জেলার ডুমুরদহ গ্রামে কিনেছিলেন একটা বড়ো আকারের দোতলা বাড়ি৷
কিন্তু আমার ঠাকুরদা খগেন্দ্রনাথের এপার বাংলায় আসার গল্প একেবারেই ট্রাজেডি৷ ভারত ভাগ হওয়ার ঠিক এক মাসের মাথায় ঠাকুরদা তিনটে গরুর গাড়ি ভাড়া করেছিলেন খুবই গোপনে৷ একদিন কাউকে কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়ে তাতে তুলেছিলেন স্ত্রী ও পাঁচ পুত্র, সঙ্গে ছোট্ট আমি৷ পিতৃপুরুষের সেই ভিটেবাড়ি ছেড়ে নতুন পত্তন গড়তে চলে এসেছিলেন এপার বাংলায়৷ ঠাকুরদার হাতে তখন মাত্র চৌষট্টি টাকা সম্বল৷
বড়ো হয়ে অনুমান করেছি কীভাবে তিন মাস বয়সি ছোট্ট আমি গরুর গাড়িতে চড়ে, গাড়ির দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়ে মা বা অন্য কারও কোলে শুয়ে চলে এসেছিলাম এপারে৷ তিনটে গরুর গাড়ির ধুলোয় ভরে যাচ্ছে ওপার বাংলার ফেলে আসা পথ৷ নিশ্চয় বড়োরা সবাই মুখে আঁধার মেখে চুপটি করে বসে আছেন ছইয়ের মধ্যে৷ কারও মুখে কথা নেই, বুকের মধ্যে ফেলে আসা ভিটেমাটি আর জমিজমা ফেলে আসার অসম্ভব কষ্ট, একই সঙ্গে অচেনা গন্তব্যের কথা ভেবে চরম অনিশ্চয়তার শঙ্কা৷
যখন বুঝতে শিখেছি, দেখেছি এপার বাংলায় বসিরহাট মহকুমার বাদুড়িয়া গ্রামে ইছামতী নদীর কিনারে একটি পতিত জমিতে জঙ্গল কেটে বসতি গড়েছিলেন ঠাকুরদা৷ তবে বিপদের দিনে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন আরও দুটি পরিবার, একটি তাঁর বেয়াই চতুরানন মুখোপাধ্যায়ের, অন্যজন আমার ঠাকুরমার খুড়তুতো ভাই শিবদাস মুখোপাধ্যায়ের৷ তিনটি পরিবার কেউ একবিঘা কেউ দেড় বিঘা পতিত জমি উদ্ধার করে গড়ে তুলেছিলেন আশ্রয়৷
সেই বসতিনির্মাণের দিনগুলিতে তিনটি পরিবারের মানুষ কোথায় রাত্রিবাস করেছিলেন, কী খেয়েছিলেন তা নিশ্চয় এক অবর্ণনীয় কষ্টের অভিজ্ঞতা৷ কতদিন ধরে চলেছিল তাঁদের সেই দুর্গত জীবনযাপন তাও জেনে নেওয়া হয়নি কখনও৷
যাঁরা ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা, তাঁদের কাছে আমরা তিনঘর পরিচিত ছিলাম রিফিউজি হিসেবে৷ শব্দটায় চরম হীনমন্যতার গন্ধ–মাখানো৷ তবে তিনটি পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তার সূত্র থাকায় তাঁরা নিজেরাই গড়ে তুলেছিলেন এক নিজস্ব পৃথিবী৷
ঠাকুরদার হাতে একদিন দেখেছিলাম উদ্বাস্তু হিসেবে পঞ্জীভুক্ত হওয়ার একটি জীর্ণ সার্টিফিকেট, তাতে বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের নামের শেষে আরও একটি নাম লেখা ‘খোকা’, বয়স তিন মাস৷ অর্থাৎ সীমান্ত পেরোনোর সময় আমার নামকরণ হয়নি৷
প্রায় নিঃসম্বল অবস্থায় এত বড়ো একটি পরিবারসহ ঠাকুরদা খগেন্দ্রনাথকে নতুন করে জীবন শুরু করতে গিয়ে কী অপরিসীম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল তা আমি ভেবে কূল করতে পরিনি আজও৷ তিনি ওপারে সাতক্ষীরা কোর্টের মুহুরি ছিলেন বলে শুনেছি, তা ছাড়া আয় ছিল নিজস্ব ধানজমি থেকে৷ এপারে এসে প্রথমদিকে তাঁর কোনো রুজিরোজগার ছিল না, সম্ভবত বাবার পাঠানো টাকাই ছিল একমাত্র ভরসা৷ বাবা এপারে এসে কলকাতায় চাকুরির সন্ধানে ঘুরে কীভাবে যেন যুক্ত হয়েছিলেন কলকাতায় পূর্ণ সিনেমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে৷ কয়েক বছর পর পেয়েছিলেন একটি সরকারি চাকুরি৷
নিজের জীবন ও পৃথিবীকে বুঝতে শেখার পর আমি অবহিত হতে থাকি আমার পরিপার্শ্ব বিষয়ে৷ আমাদের বসতবাটি জমির চৌহদ্দির দক্ষিণ–পশ্চিম কোণে একটি মেটে ছ–চালা ঘর, যার ছাউনি গোলপাতার৷ বাড়ির সামনে একটা উঠোন, সেই উঠোনের একপাশে একটা ঝাঁকড়া তুলসীগাছ৷ সেই তুলসীগাছের সামনে দাঁড় করিয়ে বক্স–ক্যামেরায় আমার একটা ফটো তুলেছিলেন বাবা, সেই ফটোটা দেখে তিন বা চার বছরের ‘আমি’-টাকে চিনেছিলাম – গম্ভীর মুখ, ব্যাকব্রাশ করা চুল, গলায় একটা চেক–কাটা রুমাল বো–এর মতো করে বাঁধা৷
সেই বয়সের বাবা সম্পর্কে আমার খুব একটা ধারণা নেই, তখন তিনি কলকাতায় থাকতেন, বুঝেছিলাম ফটো তোলা ছিল তাঁর অন্যতম নেশা৷ তাঁর তোলা আর একটা ছবির কথা মনে আছে – একটি ঝাঁকড়া তুলসীগাছের সামনে দাঁড়িয়ে গাছকোমর করে বাঁধা শাড়ি–পরিহিত মায়ের ছবি৷ যেন মায়ের অনিচ্ছায় তোলা ছবি৷
ছ–চালা বসতবাড়ির বাঁ–দিকে একটি রান্নাঘর৷ বেড়ার দেয়ালের উপর মাটি–লেপা৷ চালে গোলপাতা৷ ঘরের ভিতরে একটি মাটির উনুন, যার মধ্যে কুচো কয়লা ও কয়লাগুঁড়ো দিয়ে তৈরি গুল দিয়ে রান্না হত ভাত–তরকারি৷ রান্নাঘরের ঠিক পিছন দিয়ে বয়ে চলেছে একটি ছোটো খাল৷ খালটি যুক্ত ছিল ইছামতীর সঙ্গে৷
ছোটোবেলায় বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিল ইছামতীর তীরে একটি খেয়াঘাট৷ খেয়াঘাটে সারাক্ষণ বাঁধা থাকত একটি বড়োসড়ো নৌকো, সারাদিন ওপারের লোক যাতায়াত করত সেই খেয়ানৌকোয় চড়ে৷ ঘাটের পাশে ছিল একটি ছোট্ট চালাঘর, কখনও দুপুরে খেয়ার যাত্রী না থাকলে সেই চালাঘরে বিশ্রাম নিত মাঝি৷ চালাঘরের অন্য পাশে ছিল একটি লম্বা বাঁশের মাচা, তার উপরে খড়ের ছাউনি দেওয়া৷ খেয়ানৌকো ওপারে গেলে এপারের যাত্রীরা এসে অপেক্ষা করত সেই মাচায় বসে৷
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আমরা ছোটোরা প্রায়শ গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতাম ইছামতীর কিনারে যতক্ষণ না জোয়ারের জল এসে ছুঁয়ে যেত আমাদের পায়ের গোড়ালি৷ ইছামতীর এপারে যেমন ছিল অসংখ্য গাছগাছালি, সরু মেঠো পথ ও পাখপাখালির ভিড়, তেমনই নদীর ওপারে ছিল এক মেটে পথ, সেই পথ ধরে দূরান্তরে উধাও হওয়ার হাতছানি৷
কখনও ছুটির দিনে দুপুরের দিকে খেয়াঘাটের মাচায় গিয়ে শুয়ে–বসে থাকতাম, বিশেষ করে গ্রীষ্মের ছুটিতে সেই খড়ের ছাউনির নীচে ছিল প্রাণ–জুড়োনো ঠান্ডা৷ ইছামতীর স্নিগ্ধ হাওয়ায় স্নিগ্ধতর হয়ে উঠত সেই বিশ্রাম৷
স্কুল যাওয়ার আগে সেই ইছামতীতে যেতাম স্নান করতে, সাঁতার কেটে ঝাঁপাই জোড়া ছিল আমাদের এক বিলাস৷ তবে শীতে কামট বেরোলে নদীতে সাঁতার কাটা বন্ধ রাখতে হত সেই দু–তিন মাস৷
ছোটোবেলার আর একটি ঘটনা আজও মনে পড়ে যা না লিখলেই নয়৷ তখন আড়াই কি তিন বছর বয়স, মা রান্নাঘরে বসে রাঁধছেন, আমি মায়ের পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে আছি মায়ের গলা, হঠাৎ রান্নাঘরের কোণে কী এক দৃশ্য দেখে চমকে উঠে বলেছিলাম, “মা, জুজু৷”
মা সেই দৃশ্য দেখে চমকে উঠে আমাকে দু–হাত ধরে তুলে নিয়ে একলাফে রান্নাঘরের বাইরের উঠোনে৷ চেঁচামেচি করে বললেন, “সাপ৷ সাপ৷”
বেশ নধর চেহারার সাপটি প্রায় লেজের উপর দাঁড়িয়ে মেলে ধরেছে বিশাল ফণা৷ এ জীবনে সেই প্রথম সাপ দেখা ও বস্তুটি যে বেশ ভয়ের তা উপলব্ধি করা৷
বাস্তসাপটিকে পরে আরও বহুবছর ঘুরে বেড়াতে দেখেছি বাস্তুভিটের এ–কোণে এ–কোণে৷ কখনও কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে থাকত কোনো বড়ো গাছের গোড়ায়৷ যেন পরম আরামে রোদ পোহাচ্ছে৷
আমাদের একবিঘের বাস্তুভিটেটি ছিল চৌকো আকারের৷ বসতবাটি ছাড়া বাকি জমিটা সবুজে সবুজ৷ বাড়ির পিছনদিকে ছিল অনেকখানি ফাঁকা জায়গা, সেই জমিতে একে একে পোঁতা হতে থাকল আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু ও নারকেল গাছ৷ তাদের সঙ্গে বেশ কিছু কাঁচকলা ও কাঁঠালিকলার ঝাড় ঘনবদ্ধ হয়ে বেড়ে উঠত খুব দ্রুত৷ কী করে যেন কিছু বিচিকলার ঝাড়ও মিশে গিয়েছিল তার মধ্যে৷ বিচিকলা পরিচিত ছিল ডয়রা কলা নামে৷ কাঁচা ডয়রাকলা রান্নার পর যেমন সুস্বাদু, পাকা ডয়রাকলা খোসা ছাড়িয়ে খাওয়ার মজাও ছিল কম নয়৷
সেই গাছগুলির পাশে পাশে কী করে যেন নিজে থেকে জন্মেছিল একটা তেঁতুল, গোটা দুই পেয়ারা – তার মধ্যে একটা ছিল কাশীর পেয়ারা যার ভিতরে ছিল লাল রঙের শাঁস৷ ছিল খুদেজাম, ফলসা ও করমচা গাছও৷ একটা ছিল গন্ধরাজ লেবুগাছ৷ বড়ো বড়ো অজস্র লেবু ধরত তাতে৷ সেই অল্প জমির মধ্যে মোটামুটি একটা অরচার্ড, যা সারা বছর নিখরচায় অনেক ফল দিত৷
ইছামতী থেকে তিন–চার মিনিট দূরত্বের এই বাড়িটার ভিতরে যথেষ্ট দৈন্য থাকলেও সেই বয়সে বুঝতে শিখিনি৷ এখনও চোখ বুজলে মনে হয় সে ছিল এক স্বপ্নের রাজত্ব৷ সারাদিন ঘরে আর থাকতাম কতটুকু, এলোমেলো ঘুরে বেড়াতাম বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে৷ ভাব করতাম সবুজের সঙ্গে৷
বাবা কলকাতায় থাকতেন বলে দেখা হত খুব কম৷ বাড়িতে আমার ঠাকুরদা ও ঠাকমা ছাড়া ছিলেন আমার মা ও চার কাকা৷ ভারত ভাগ হওয়ার কারণে আমার বাবাকেও যেমন পড়াশুনোয় ইতি দিয়ে ঢুকে পড়তে হয়েছিল চাকরিতে, অন্য ভাইরাও ওদেশের স্কুলের পাট চুকিয়ে দিয়ে এদেশে এসে ঘোর সমস্যায়৷ মেজোকাকা প্রমোদ ও সেজকাকা অজিত দুজনেই তখন কিছু একটা করে টাকা রোজগারের চেষ্টায়৷ ন–কাকা সুজিত ও ছোটোকাকা নির্মল ভরতি হয়েছিলেন হাই স্কুলে৷
একেবারে শৈশবে সেই বসতবড়িই ছিল আমার একমাত্র পৃথিবী৷ ক্রমে সেই বাউণ্ডুলেপনা ছেড়ে আমাকে শুরু করতে হয়েছিল লেখাপড়া৷ তখন কেজি–নার্সারির কোনো গল্প ছিল না, ছেলেমেয়েরা সরাসরি ভরতি হত কোনো প্রাথমিকের ক্লাস ওয়ানে৷ স্কুলে যাওয়ার আগে বাড়িতে বর্ণপরিচয়, ধারাপাত আর শ্লেট–পেনসিলের সঙ্গে শুরু হয়েছে আমার বন্ধুত্ব৷ কিছুকাল সেই বন্ধুদের সঙ্গে ভাব–ভালোবাসা চলার পর প্রাথমিকে ভর্তি করার কথা যখন ভাবা হচ্ছে, তখন কারও মনে পড়েছিল আমার হাতে খড়ি হয়নি৷ অতএব সরস্বতীপূজার দিন পুরোহিতমশাই যখন শ্লেট–পেনসিল নিয়ে আমাকে অ আ ক খ লেখাতে বসলেন, আমি বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছিলাম, “এগুলো তো আমার শেখা হয়ে গেছে,” বলে নিজেই লিখেছিলাম বর্ণপরিচয়ের কয়েকটি পাতা৷
সেই বছরেই ভরতি হয়ে গেলাম বাড়ি থেকে মিনিট দশেক হাঁটাপথের দূরত্বে, রথতলা পেরিয়ে বাণী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে৷ এখন হিসেব করে দেখেছি, সালটা ছিল উনিশশো একান্ন৷ ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুযায়ী তখন আমার বয়স সাড়ে চার৷
আমার পৃথিবীটা হঠাৎ সাবালক হয়ে গেল অনেকটা৷
স্মৃতিতে যেটুকু এখনও ধরা আছে, ওয়ানের ছাত্রছাত্রীরা বসত মেঝেয় বিছানো মাদুরে৷ সমস্বরে চেঁচিয়ে পড়তে হত বর্ণপরিচয় ও ধারাপাতের অক্ষরগুলি৷ যার গলায় যত জোর, সে পড়াশুনোয় তত মনোযোগী৷ শ্লেটে লেখার সময় লিখতে হত প্রায় উপুড় হয়ে৷ আর যিনি পড়াতেন তাঁর নাম ছিল নেদো মাস্টার৷ ঘটনাচক্রে তিনি ছিলেন পেশায় পুরোহিত৷ স্কুলে পড়ানোর সময় পরনে থাকত আধময়লা ফতুয়া ও আটহাতি ধুতি, কিন্তু বাকি সময় খাটো ধুতির উপর নামাবলি, হনহন করে চলেছেন কোনো বাড়িতে পুজো করতে৷
তাঁর এই পেশার কারণেই আমাদের সকালের প্রার্থনা ছিল একেবারে নিজস্ব৷ সরস্বতী-প্রণামের প্রায় সবটাই অন্য স্তোত্রের সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করেছিলেন প্রার্থনা অংশটি৷ প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি – সব ছাত্রছাত্রী রোজই একজায়গায় জড়ো হয়ে সুর করে বলতে হত নেদো মাস্টারমশাইয়ের তৈরি স্তোত্রপাঠ৷ পরবর্তী সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দিতে গিয়ে পুরোহিতমশাইদের অঞ্জলিমন্ত্র বলতে গিয়ে অবাক হয়ে বলে উঠতাম, এ কীরকম অঞ্জলির মন্ত্র, এই শ্লোকগুলোই তো রোজ প্রেয়ারের সময় বলতে হয় আমাদের!
ক্লাস টু–এ উঠে প্রথম বেঞ্চিতে বসে লেখাপড়া করা৷ অর্থাৎ আরও একটু বড়ো হয়ে গেলাম এক বছরের মধ্যে৷ প্রাথমিকের প্রধানশিক্ষক ছিলেন তারাপদ মাস্টার৷ অন্য দুই শিক্ষকের একজন সন্তোষ মাস্টার, তিনি সেকেন্ড মাস্টার৷ থার্ড মাস্টারের নাম জগন্নাথবাবু৷ আমরা যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে ডঠলাম, তখনই সন্তোষবাবু এসেছিলেন জীবিকার্জনের তাগিদে৷ এসেই প্রাথমিকে শিক্ষকতার চাকরি৷ সেই সঙ্গে গৃহশিক্ষকতা করতে আসতেন আমার পিসিমার বাড়িতে৷ পিসিমার চার ছেলে ছয় মেয়ে৷ তখনও পর্যন্ত তিন বা চারজন এসে বসত বইখাতা নিয়ে৷
পিসিমার বাড়ি আর আমাদের বাড়ি প্রায় গা–ঘেঁষাঘেঁষি হওয়ায় একদিন ঠাকুরমা আমাকে বললেন, তুইও তো ওদের পাশে গিয়ে বসতে পারিস৷ তোর যদি কোথাও ঠেকে যায় মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞাসা করলে উনি বলে দেবেন তোকে৷
সেই বয়সে আমি বুঝতে পারিনি মাস্টারমশাইয়ের বেতন যেহেতু পিসেমশাই দিয়ে থাকেন, আমার সেখানে যাওয়া উচিত নয়৷ আমি আমার বইখাতা নিয়ে বসতে শুরু করলাম, নিজের পড়া নিজেই করে নিতে পারতাম, তবু যদি কোনো সময় জিজ্ঞাসা করতাম, বেশ বুঝতে পারতাম তিনি বিরক্ত হচ্ছেন বেশ৷ সেই ক্ষুদ্র জীবনে আমার মান–অপমান জ্ঞানের শুরু৷ কিছুদিন পরে আমি বন্ধ করে দিলাম যাওয়া৷
সেই প্রাথমিকে পড়ার দিনগুলিতে অঙ্কখাতার পৃষ্ঠায় হঠাৎ একদিন এক বৃষ্টির দুপুরে লিখেছিলাম একটি চার লাইনের ছড়া৷ ছড়াটি এরকম - ‘বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম/ চলল গাড়ি দমদম/ পথে উঠল একজন মন্ত্রী/ সঙ্গে যতেক যন্ত্রী৷’ এই শেষ পঙক্তিটি লিখতে অনেক সময় লেগেছিল, কারণ মন্ত্রীর সঙ্গে কোন শব্দ দিয়ে মেলানো যায় এমন ভাবতে ভাবতে যন্ত্রী শব্দটি গোঁজামিল দিয়ে মিলিয়েছিলাম কোনোক্রমে৷
আমার লেখালিখির সেই শুরু৷ আমার সেই ছড়াপ্রতিভা দেখে একটি হাফ–ডিমাই আকারের ডায়েরি পাঠিয়েছিলেন বাবা৷ কী ভেবে দিয়েছিলেন জানি না, কিন্তু সেই খাতাটি ক্রমে ভরে ওঠে অজস্র ছড়ায়৷ তখন কীভাবে এটা ঘটেছিল জানি না, কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে বা অন্য কোথাও কোনো কবিতা পড়লেই মনে হত, চেষ্টা করলে এরকম বোধহয় আমিও লিখতে পারি৷
তারপর এক আশ্চর্য স্বপ্নের মোড়কে বন্দি হয়ে নানা খাতায় লিখে গেছি একটার পর একটা ছড়া৷ ছড়া থেকে কবিতায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম আরও অনেক পরে, বোধহয় তখন আমি সেভেন বা এইটে ডঠেছি৷ তখন পাঠ্যপুস্তকে কবিতা পড়ছি, দু–চারটে ছোটোদের পত্রিকা হাতে আসছে, সেখান থেকে শিখছি কবিতা লেখার ধাঁচ৷ আমার দারিদ্র্য, আমার একাকীত্ব, বাবা–মায়ের সঙ্গ না–পাওয়া কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি সেই কবিতা লেখা থেকে৷
প্রাথমিকের পাট শেষ হলে হাইস্কুলে যাত্রা৷ প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল এক কিলোমিটার দূরত্বে, কিন্তু হাইস্কুলে যেতে হত দু–আড়াই কিলোমিটার হেঁটে৷ তার মধ্যে এক কিলোমিটারের মতো কাঁচা রাস্তা, সেই রাস্তায় বর্ষায় জমত হাঁটুসোর কাদা৷ স্কুলে যেতে–আসতে কসরত করতে হত রীতিমতো৷ কখনও এঁটেল কাদায় আছাড় খাওয়ার ঘটনা ঘটলে সেই কর্দমাক্ত পোশাকেই স্কুলে যাওয়া ছিল স্বাভাবিক৷
বিরাশি নম্বর বাসটা বসিরহাট থেকে রওনা দিয়ে খোলাপোতায় বাঁক নেয় লম্বভাবে, সেখান থেকে মাইল তিনেক এলে মাথাভাঙা স্টপেজ৷ বাঁদিকে তাকালেই একটা সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ৷ দু-পাশে দুটো গোলপোস্ট৷ মাঠের উত্তরে যে পুব–পশ্চিমে লম্বা বাড়িটা ওটাই বিখ্যাত ‘মাথাভাঙা স্কুল’ – অর্ধেক দেয়াল ইটের, অর্ধেক বাঁশের চটার, ছাউনি অ্যাজবেস্টসের৷ এই নামটাই চালু বহুদিন ধরে, যদিও তার পোশাকি নাম বাদুড়িয়া লন্ডন মিশনারিজ সোসাইটিজ হাইস্কুল৷ আমরা যারা এই স্কুলে পড়তাম তারা বলতাম ‘এল এম এস’৷ এই স্কুলেই কেটে গেছে আমার শৈশব–কৈশোরের ছ-ছ’টা বছর৷ আজও এই স্টপেজে বাস দাঁড়ালেই সেই ছোট্ট ‘আমি’-টাকে দেখতে পাই স্পষ্ট৷ হয় ক্লাসে ঢুকছে, না হয় বেরোচ্ছে, অথবা টিফিন পিরিয়ডের ঘণ্টা পড়লেই দুদ্দাড় করে ছুটছে সামনের মস্ত মাঠটায় গুলি খেলবে বলে৷
বাসটা আরও একটু এগোলেই ডাইনে শ্মশান৷ আমরা কেন যেন বলতাম সীতেনাথ৷ কারও উপর কেউ রেগে গেলে গাল পাড়ত ‘তোকে সীতেনাথে দিয়ে আসব’৷ স্কুল থেকে ফেরার পথে এখানে পৌঁছোলেই গা–টা ছমছম করে উঠত হঠাৎ৷ শীতের দিনে ঘনিয়ে আসত সন্ধে৷ শরীর জুড়ে আরও শিরশিরানি৷ তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে পেরিয়ে যেতাম শ্মশানের চটলা–ওঠা বাড়িটা৷ তার মাঝের দরজাটার দিকে তাকাব না ভেবেও চোখ পড়ে যেত নির্ঘাত৷ দরজার ওপাশে ফাঁকা চত্বরে একটা না একটা চিতা জ্বলতই৷
শ্মশান পেরোলে বাঁয়ে বাদুড়িয়া মিউনিসিপালিটি, তার ঠিক উলটোদিকে ডানদিকে থানা৷ এই জায়গাটাই প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু হলেও বাদুড়িয়ার আসল প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছোতে হলে আর একটু এগোতে হবে৷ প্রথমে বাসস্ট্যান্ড, এখান থেকেই জমজমাটি এলাকা শুরু৷ তারপরই বাজার এলাকা৷ বাদুড়িয়ার মস্ত বাজারে বহু দোকানপাট, কিন্তু বাজারের আসল মাহাত্ম্য বুঝতে হলে চাই মঙ্গল বা শুক্রবারের উপস্থিতি৷ এই দু-দিন বাদুড়িয়ার হাট৷ আশপাশের বিশ–তিরিশটা গাঁ থেকে এসে পৌঁছোয় আনাজপাতি থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিস৷ ধান–চালের আড়তে যেমন বেচাকেনা চলত পাইকার ও খুচরো বিক্রেতাদের মধ্যে তেমনই পাটের আড়তে উপচে পড়ত ভিড়৷ দাঁড়িয়ে থাকত রাশি রাশি ট্রাক, তাতে পাটের বাণ্ডিল বোঝাই–চলত হেঁইও হেঁই হেঁইও শব্দে৷ সেই হেঁইও সুর আমরা আওড়াতাম অবসর পেলেই৷ আনাজের হাটটাই সবচেয়ে রঙিন আর টাটকা গন্ধে উপচানো৷ আলু–কুমড়ো–পটল–বেগুন, সঙ্গে থিকথিক করত মানুষজনের মাথা৷ দেখে যে কোনো অচিন আগন্তুকের মনে হতেই পারে এত মানুষ শোয় কোথায়?
আরও খানিকটা এগোলে সাব–রেজিষ্ট্রি অফিসের মোড়৷ সাব–রেজিষ্ট্রি অফিস থেকে এই পথটাও আমার ভারী আশ্চর্য লাগত৷ পিচপথ তো নয়ই, এমনকী ইট–বিছানো পথের কথাও ভাবতে পারিনি কখনও৷ তখন ছিল মেটেপথ৷ গ্রীষ্মে ধুলো উঠত বেদম, বর্ষায় হাঁটুসোর কাদা৷ আষাঢ়–শ্রাবণের দিনগুলিতে সেই কাদা ভেঙে সাব–রেজিষ্ট্রি অফিসের স্টপ পর্যন্ত আসতে রীতিমতো কসরত৷ সেই পথের দু-ধারে নুয়ে থাকে সবুজ গাছগাছালির ডালপাতা৷ কত না রকমারকম গাছ৷ কত না রকমারকম ফুলফল৷ তার মধ্যে এক একটা দেবদেবীর আস্তানা৷ প্রথমেই বাঁয়ে রক্ষাকালীতলা৷ শান–বাঁধানো ছোট্ট বেদিটার কাছে এলে হাত জোড় করে প্রণাম করাই রীতি৷ মাথার উপরে বিশাল অশ্বত্থগাছটা অবশ্য আমাদের কারণ ছিল ভীতির৷ তার লম্বা লম্বা ঝুরি বেয়ে নেমে আসে অশরীরী কেউ - এটা ভাবতেই অভ্যস্ত ছিলাম৷ একটা মস্ত ব্রহ্মদৈত্য যে পাকাপাকিভাবে বাস করত তার মগডালে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না আমাদের৷ তার ঝুলিয়ে বসে থাকা গোদা পায়ে ঠুল খেয়ে ভিরমি খেয়েছে এরকম মানুষের সংখ্যা কম ছিল না আমাদের গাঁয়ে৷
আমার পিসেমশাই তো একবার তার ঝোলানো পা দেখে সাইকেল নিয়ে নেমে গিয়েছিলেন পাশের খানায়৷ কী করে যে তিনি সেই ব্রহ্মদৈত্যের চাউনি পেরিয়ে প্রাণে বেঁচে ফিরেছিলেন সেটাই ছিল আমাদের ছেলেবেলার আলোচ্য বিষয়৷ সন্ধে পেরিয়ে গেলে সেই জায়গাটা আমরা কেউ একা ফিরতাম না৷ অপেক্ষা করতাম অন্য পথচারীর৷
তারপর একটা ছোট্ট জেলেপাড়া৷ প্রায় প্রতি বাড়িতে জাল শুকোতে দেখে অনুমান করতাম হয়তো সোঁদরবনের দেশে মাছ ধরতে গিয়েছিল দল বেঁধে৷ তাদের মাছ ধরা নিয়ে কত না গল্পগাথা লোকের মুখে মুখে ঘোরে৷ জেলেপাড়া শেষ হতে না হতে আর এক বিশাল অশ্বত্থগাছ৷ তার ঝাঁকড়া মাথা প্রায় আকাশ ছুঁই–ছুঁই৷ তার নীচে একদিকে দুর্গামণ্ডপ, অন্যদিকে শ্মশানকালীতলা৷ বছরে একবারই মহা ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হয় মণ্ডপে৷ সে সময়ে যেখানে যত প্রবাসী থাক না কেন সবাই ঘরে ফিরে আসে৷ সবার সঙ্গেই দেখা হবে সপ্তমী থেকে দশমী এই চারদিন৷
আর শ্মশান নেই এখানে, তবু কী কারণে যেন ছোট্ট মাটির বেদিটাকে শ্মশান কালীতলা বলে উল্লেখ করা হত৷ এই বেদিটা বিশেষভাবে খ্যাত এই জন্যে যে, সূর্যাস্তের পর শুরু হয় কাঠখড় আর মাটি দিয়ে প্রতিমা তৈরির কাজ৷ মধ্যরাতে কাঁচা রং লাগানো প্রতিমার পুজো শুরু৷ ভোরের মধ্যে তার বিসর্জন৷ সারা রাত কাটে কালীমার বেদির সামনে৷ এই তিথিতেও সারা পাড়ার মানুষ এসে জোটে কালীতলায়৷ ঘরে ফেরে প্রবাসীরাও৷
বাঁড়ুজ্জেপাড়ার সীমানা যেখানে শেষ, সেখানে একটা মুচুকুন্দ ফুলের গাছ খুব চমৎকৃত করত আমাকে৷ পাঁচ আঙুলের মতো ছড়ানো থাকে মুচুকুন্দ ফুলের হলুদ পাপড়ি৷ শুধু দেখতেই সুন্দর তাই নয়, হাত বা পা মচকে গেলে তার রস ছিল অব্যর্থ ওষুধ৷ শুধু কি মুচুকুন্দ ফুলই মুগ্ধ করত আমাকে! কোথাও চাঁপা, কোথাও কাঠটগর, কোথাও রক্তকরবীর ঝাড় আলো করে রাখত পথের দু-পাশ৷ একটা কদম ফুলের গাছ তো দেরি করিয়ে দিত স্কুলের হাজিরার সময়৷ আজও ভুলতে পারিনি বকুল ফুলের কথাও৷ মর্নিং স্কুল যাওয়ার পথে গন্ধে ভুরভুর করত গোটা বকুল গাছটাই৷ নিচু হয়ে একটা একটা করে বকুল কুড়িয়ে ভরে ফেলতাম জামার কোঁচর৷ সারা শরীর ভরে থাকত বকুলের সুবাসে৷
এত এত ফুলের রাশ একরকম লোভী করে তুলত, কিন্তু পথের দু-ধারে কত যে ফলের গাছও আর রকম লোভী করত আমাকে! পেকে থাকত কালো টুসটুসে করমচার থোক, কিংবা ফলসার গাছে ফলসায় লালচে রং ধরতেই ঝাঁপিয়ে পড়তাম তার ডালে, কিংবা পথের পাশে উঁকি দিত জামরুলের উপচানো রস৷ কোথাও বড়ো বড়ো কালোজামের থোকা সুড়সুড়ি দিত জিবের গোড়ায়৷ বেশিরভাগ গাছই ওই বাঁড়ুজ্জেদের৷ চাইলে কি দিত? ফলে না–বলে নেওয়াটাই ছিল মজার৷ বাবুদের কুকুর ছিল না, ফলে তাড়াও করেনি কখনও, ‘দে হাওয়া চাগিয়ে কাপড়’ করতে হয়নি৷ তবে হ্যাঁ, উড়ে চাকর ছিল৷ তার নাম ছিল নটবর৷ তার চোখ এড়ানো খুব কঠিন ছিল না৷
আর ছিল শীতের রাতে গায়ের চাদর খুলে রেখে কাঁপতে কাঁপতে খেজুরগাছে ওঠা৷ সেই অনেক উপরে উঠে টাঙানো ভাঁড়ে পাটকাঠির নল ডুবিয়ে চোঁ চোঁ করে নলেন রস টেনে খাওয়ার আনন্দ৷ হ্যাঁ, রস খাওয়াও চুরি করে৷ চাইলেও পাওয়া যেত, কিন্তু চুরি করে খাওয়ার যে মজা তা কি চেয়ে খেয়ে পাওয়া যায়?
ক–বছর পরে এমন হয়েছিল বাবা–মা আমার কাছে ক্রমশ দূরের মানুষ হয়ে ডঠেছিলেন৷ তাঁরা বছরে এক বা দু-বার আসতেন এ–বাড়ির অতিথির মতো, চার–পাঁচদিন কাটিয়ে আবার চলে যেতেন চাকুরিস্থলে৷ তাঁদের সঙ্গে আমার এমনই দূরত্ব ঘটে গিয়েছিল যে, তাঁদের এই যাওয়া–আসা তেমন স্পর্শ করতে পারত না আমাকে৷ ছোটো থেকেই ঠাকুরদা–ঠাকুমাই ছিলেন আমার বাবা–মায়ের মতো৷ আমার নাবালক কাকাদের সঙ্গে বড়ো হয়ে ওঠার সুবাদে আমিও যেন ছিলাম তাঁদের আর একটি ভাই৷ ন–কাকা ছিলেন আমার ছোটোখাটো আবদারের অভিভাবক, ছোটোকাকা প্রায় বন্ধুর মতো, কিন্তু আমার শোওয়ার জায়গা ছিল ঠাকুরদা ও ঠাকুমার মাঝখানে একটি হাইফেনের মতো৷
আমার অবশ্য প্রায়ই মনে হত তাঁর অন্য নাবালক পুত্রদের চেয়ে আমার প্রতিই ছিল তাঁর বেশি টান৷ ঠাকুরদার যেমন আমি পাশে না শুলে ঘুম আসত না, তেমনই ঠাকুমারও৷ তবে আমার জীবনে ঠাকুমার ভূমিকা ছিল একেবারেই অন্যরকম৷ খুব ছোটো থেকে পড়ার বইয়ের চেয়ে বাইরের বইয়ের প্রতিই ছিল আমার প্রবল আকর্ষণ, কিন্তু সেই ছোট্ট গ্রামে কোনো লাইব্রেরি না–থাকার কারণে গল্পের বই পাওয়া ছিল খুব কঠিন৷ তার ফলে প্রতি রাতে বিছানায় শুয়েই ঠাকুমার সঙ্গে আমার প্রথম কথা ছিল, একটা গল্প বলো৷
আমার ঠাকুমার লেখাপড়ার দৌড় কত ছিল তা জানা ছিল না, তবে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র পড়তেন, শরৎচন্দ্র তো বটেই, কিন্তু তাঁর ভাঁড়ারে ছিল প্রচুর রূপকথার গল্প৷ সেই গল্প তিনি কোথা থেকে শুনেছিলেন কে জানে, কিন্তু রাতে শোওয়ার পর তিনি শুরু করতেন রাজপুত্র–রাজকন্যার গল্প৷ কোনোদিন লালকমল–নীলকমলের গল্প, কোনোদিন দুধকুমারের গল্প, কিন্তু গল্প বলতে গিয়ে তিনি প্রতিদিন যে–সমস্যার সম্মুখীন হতেন তা হল আমাকে একই গল্প দু-বার বলা চলবে না৷ যদি কোনোদিন তিনি কোনো গল্পের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাইতেন, দু–চার লাইন শোনার পরই আমি চেঁচিয়ে ডঠতাম, ‘আ রে, এই গল্পটা তো সেদিন বললে’৷ তিনি তৎক্ষণাৎ গল্পের মোড় ঘুরিয়ে ফাঁদতেন নতুন গল্প৷
পরবর্তীকালে আমি ভেবে দেখেছি, গ্রামের একজন স্বল্পশিক্ষিত মহিলার পক্ষে রাতের পর রাত এত অসংখ্য গল্প বলে চলা খুবই দুরূহ কাজ, তা সত্ত্বেও এত–এত গল্প কীভাবে বানাতেন ও বলতেন অকাতরে, কীভাবে গল্পের বাঁক নিয়ে যেতেন এক প্লট থেকে অন্য প্লটে তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়ের৷ আমার এখন মনে হয় গল্প–উপন্যাস লিখতে আমাকে যে অহরহ কল্পনাশক্তির আশ্রয় নিতে হয় তা ছিল তাঁর থেকে জিন–সূত্রে পাওয়া৷
আমি যখন সপ্তম শ্রেণির অ্যানুয়ালের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, সেসময় আমার ঠাকুরদা মাত্র আটান্ন বছর বয়সে অর্শে ভুগে ভুগে, প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন হঠাৎ৷ আমার মনে হল আমার মাথার উপর থেকে সরে গেল এক বিশালকায় ছাদ৷ আমিও কাকাদের মতো পিতৃহীন হলাম৷
শুধু আমারই মনে হয়েছিল তাই নয়, আমার বাড়ির সবাইকার, এমনকি আত্মীয়স্বজনেরও সেরকমই মনে হয়েছিল, না হলে শ্রাদ্ধের সময় বাবা–কাকাদের যেমন মস্তক মুণ্ডন করা হয়েছিল, সেই সঙ্গে আমারও মস্তক মুণ্ডন করা হয়েছিল কেন!
এই পিতৃহীন হওয়ার বিষয়টি আমার মনে এমন গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছিল যে, পরে যখন আমার বাবার মৃত্যু হয়েছিল, তাঁর শ্রাদ্ধের সময় আমার মস্তক মুণ্ডন করতে দিইনি, কারণ একজন মানুষ তো দু-বার পিতৃহীন হতে পারে না৷
ক্লাস টেনে ওঠার পর দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল যা আমার জীবনে খুবই তাৎপর্যময়৷ সেসময় আমার ন–কাকা কপিইস্টের চাকরি পান সাবরেজিস্ট্রি অফিসে৷ তাঁর সহায়তায় ও আমার বহু কষ্টে সংগৃহীত কয়েকটি টাকা দিয়ে একটি ‘সঞ্চয়িতা’ কিনেছিলাম যে–বই হাতে পাওয়ার পর মনে হয়েছিল এই হল জীবনের শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্য৷ সেই বই ছিল আমার সারাদিনের সঙ্গী, এমনকি রাতে শুতে যাওয়ার সময় বালিশের পাশে রাখতাম বইটি, তার মলাটে হাত রেখে ঘুমোতাম ও পরদিন সকালে মনে হত হাজার হাজার অক্ষর সঞ্চারিত হয়েছে আমার মেধায়৷ সে–বছরই ভাগ্যক্রমে গ্রাহক হয়েছিলাম রবীন্দ্র রচনাবলীর, খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত রবীন্দ্র–ঐশ্বর্য হাতে পাওয়া আমার লেখক–জীবনের আর একটি বাঁক৷
মুদ্রিত অক্ষরের প্রতি এই অপরিসীম মোহ আজও আমাকে তাড়া করে বেড়ায় সর্বগ্রাসী প্রেমের মতো৷
----------
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment