বুটুদাদুর গল্প
রুচিরা মুখোপাধ্যায় দাস
গোগোল, রিমলি, ঝিকাই,
তুতুন, টুকাইয়ের আজ খুব আনন্দ। বেশ যেন হালকা
লাগছে মনটা। আজ থেকে যে ওদের গরমের ছুটি! বুটুদাদুর কাছেও পড়ার ছুটি। কিন্তু
গল্পের ছুটি নয়। রোজ সন্ধ্যায় অঙ্ক করানোর আগে বুটুদাদু একটা করে গল্প বলে।
কিন্তু আজ আর অঙ্ক নয়। শুধু গল্প হবে। তাই অধীর অপেক্ষায় তাকিয়ে সবাই। ধৈর্য
হারিয়ে তুতুন জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, “বুটুদাদু, আজ আমাদের কীসের গল্প বলবে?”
মুচকি হেসে বুটুদাদু বলল, “আজ বলব আমার ছোটোবেলার
গল্প। তখন আমি তোমাদের মতোই ছোটো।”
বুটুদাদুকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে গোগোল বলল, “তার মানে তখন
তুমি ক্লাস থ্রিতে পড়?”
সজোরে হেসে উঠে বুটুদাদু বলল, “আমি প্রথম
স্কুলে যাই ক্লাস ফোরে।”
অবাক হয়ে ঝিকাই বলল, “কী বলছ বুটুদাদু!”
উত্তেজনার সঙ্গে টুকাই বলে উঠল, “কী মজা ছিল
তোমার! পড়াশোনাও করতে হত না। মা পড়তে বসতেও বলত না। শুধুই খেলতে।”
সজোরে হেসে বুটুদাদু বলতে শুরু করল –
মজা যে ছিল সেটা সত্যি। তবে পড়াশোনা ছিল না তেমনটা
কিন্তু নয়। রোজ সকাল-সন্ধে আমরা মায়ের কাছে পড়তে বসতাম। পড়াশোনা করিয়ে মা
আমাকে বেশ ভালোই তৈরি করে দিয়েছিল ক্লাস ফোরের এডমিশন টেস্টের জন্য। পরীক্ষার আগে
মা-বাবাকে প্রণাম করে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মা বারবার বলে দিল, ‘খোকা, সব প্রশ্ন লিখবে কিন্তু। একটাও ছাড়বে না।’
আমিও ঘাড় নেড়ে বাধ্য ছেলের মতন সব প্রশ্ন লিখে
বাড়ি ফিরে এলাম। মা আবারও জিজ্ঞেস করল, ‘খোকা, সব প্রশ্ন
লিখেছিস তো?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ মা, একটাও
ছাড়িনি। সব লিখেছি।’
দিন দিনের নিয়মেই কেটে গেল। সময় হল রেজাল্টের। আমি
শূন্য পেলাম। মার মুখ গম্ভীর। চোখ ছলছল। ফেল করায় আমার যেন কিছুই এল গেল না। বরং
মনে হল, বেঁচে গেলাম। স্কুলে আর যেতে হবে না। সারাদিন আগান-বাগান
ঘুরে ঘুরে খেলে বেড়ানো যাবে। শুধু মায়ের মুখটা দেখে কষ্ট হল খুব। বাবা ছিল ওই
স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বাবা বাড়িতে এলে মা বাবাকে দুঃখ করে বলল, ‘এত করে পড়ালাম। সব বিফলে গেল!’
বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর থেকে বাবা বলল, ‘তাই তো দেখছি!’
মা বিষণ্ণ সুরে বলল, ‘সবচেয়ে কষ্ট হয়েছে খোকা আমাকে
মিথ্যে বলল বলে।’
বাবা অবাক হয়ে বলল, ‘কেন! খোকা কী মিথ্যে বলেছে?’
মা বলল, ‘আমি জিজ্ঞেস করলাম, খোকা সব প্রশ্ন লিখেছে কিনা! বলল লিখেছে। কিন্তু লিখলে কি আর শূন্য পায়!’
বাবা জলের গ্লাসটা হাতে নিয়ে জল খেতে খেতে বলল, ‘খোকা তোমার
সত্যি কথাই বলেছে। তাই দুঃখ পেয়ো না। ও সব ‘প্রশ্ন’ লিখেছে। কিন্তু কোনো প্রশ্নের ‘উত্তর’ লেখেনি।’
মা চোখ ছানাবড়া করে বলল, ‘সে কী!’
বাবা হো হো করে হেসে উঠল।
মা আমাকে শেখাল কেমন করে প্রশ্নের উত্তর লিখতে হয়।
পরীক্ষা দিতে হয়। তারপর আমি আবার পরীক্ষায় বসলে সেকেন্ড হলাম। ফলাফল জেনে আনন্দে
নেচে উঠলাম এই ভেবে যে,
মায়ের মুখটা আর থমথমে থাকবে না। এবার মা খুশি হবে। বাড়ি ফেরার আগে
বাবার সঙ্গে স্কুলে দেখা করলাম। বললাম, ‘আমাকে দুটো পয়সা
দেবে বাবা! মায়ের জন্য রাজভোগ কিনে নিয়ে যাব।’
বাবা খুশি হয়ে আমায় পয়সা দিল। আমি দুটো বড়ো বড়ো
রাজভোগ কিনে বাড়ি ফেরার পথে পা বাড়ালাম। স্কুল থেকে আমাদের বাড়ি ছিল বেশ কিছুটা
দূরে। পায়ে হেঁটেই যেতাম। রাজভোগের হাঁড়িটা হাতে নিয়ে এগিয়ে চলেছি আর মাঝে
মাঝে রাজভোগের হাঁড়ির ঢাকনা সরিয়ে রাজভোগ দুটো দেখছি। বেশ কিছুটা এগিয়ে আর লোভ
সামলাতে পারলাম না। ভাবলাম রসটা একটু চেখে দেখি। রসটা জিভে লাগাতেই লোভ যেন আরও
বেড়ে গেল। হাঁড়ির ঢাকনাটা আলতো করে ফাঁক করে দু-আঙুল ঢুকিয়ে রাজভোগের একটু কোনা
ভেঙে খেলাম। আহ কী স্বাদ! দু-পা এগিয়ে আরও একটু ভেঙে খেলাম।
যত খাই লোভ যেন ততই বেড়ে যায়। দু-পা করে এগোই আর হাঁড়ির
ঢাকনা ফাঁক করে একটু কোনা ভেঙে খেতে থাকি। এইভাবে চলতে চলতে হঠাৎ হাঁড়ি ফাঁক করে
হাত ঢুকিয়ে রাজভোগ আর কোথাও খুঁজে পাই না! হাঁড়ির ঢাকনা পুরো খুলে ফেললাম।
দেখলাম হাঁড়ি ফাঁকা! ফাঁকা হাঁড়ি দেখে ভয়ে শিউরে উঠলাম। কী বলব মা-বাবাকে! তবে
কী মায়ের থমথমে মুখটা দেখাই ভাগ্যে আমার! নিজের হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ যেন নিজেই
শুনতে পেলাম এবার। ভয়ে ঘরে আর ঢুকতে পারলাম না। মায়ের থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখার
জন্য গোয়াল ঘরে ঘাপটি মেরে চুপটি করে বসে বসে মশার কামড় খেতে লাগলাম। এদিকে সন্ধে
হয় হয়। মায়ের গলা কানে এল। মা বিরক্তির সুরে চিৎকার করে বলছে, ‘বাড়িতে এমন কোনো
পুরুষমানুষ নেই যে শ্যামাকে গোয়ালে এনে রাখে। সাত কাজে আমি আর পারি না!’
শ্যামা হল আমাদের বাড়ির কালো গরু। যার দুধ ছিল
মধুর মতন মিষ্টি, ঘন। আর সে ছিল অসম্ভব রাগী। বাবা আর দাদা ছাড়া কারও কাছেই সে মাথা নত করত
না। গোয়ালে বসেই মায়ের গলার আওয়াজ কানে আসতে হঠাৎ নিজেকে পুরুষমানুষ হিসেবে
প্রমাণ করার ইচ্ছে জাগল। আর সেই সঙ্গে ভাবলাম, এই তো সুযোগ!
শ্যামাকে গোয়ালে আনতে পারলে মাকে তুষ্ট করতে পারব। তাহলে রাজভোগ খাওয়ার অপরাধে
মায়ের বকুনি থেকেও বাঁচব। এক ছুটে গেলাম মাঠে। দূর থেকে
শ্যামাকে দেখে মনে একটু সাহস জোগানোর চেষ্টা করলাম। তারপর শ্যামার সামনে দাঁড়িয়ে
সাহসী পুরুষমানুষের মতো বললাম, ‘চল শ্যামা, আজ তোকে আমি গোয়ালে
নিয়ে যাই।’
আমার কথা শুনে শ্যামা হাম্বা হাম্বা করে ডেকে উঠল। মনে হল আমার সঙ্গে যেতে
তার আপত্তি নেই। গাছের গোড়ায় পোঁতা খুঁটি যেই না দিলাম খুলে ওমনি শ্যামা লেজ
তুলে আমার দিকে ছুটে এল। তার লম্বা লম্বা শিংগুলো যেন সবার আগে আমার দিকে এগিয়ে
আসতে লাগল। আমি ছুটতে শুরু করলাম। ছুটতে ছুটতে আমাদের বাগানে পেয়ারা গাছের
চারদিকে ঘুরে চললাম। শ্যামাও আমার পিছনে পিছনে ঘুরতে লাগল। কখনও শ্যামার পিছনে আমি
আবার কখনও আমার পিছনে শ্যামা! এইভাবে চলল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর এক লাফে উঠে পড়লাম
পেয়ারা গাছের মাথায়। উঠে দেখলাম শ্যামা লেজ তুলে মাথা উঁচু করে আমার দিকে বড়ো বড়ো
চোখ করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের পলক তার পড়ছে না যেন! যেন আমি গাছ থেকে ধপ করে
পড়লেই ও খপ করে আমায় খাবে! বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল এমনি করে। তারপর হঠাৎ একটা জোর
ধমকে চমকে উঠলাম। দেখলাম বাবা সামনে দাঁড়িয়ে। বাবার গলার আওয়াজ পেয়ে শ্যামা
আস্তে আস্তে তার লেজটা নামিয়ে নিল। তারপর আমার চোখ থেকে ওর চোখটা সরিয়ে মাথা
নিচু করে সোজা গোয়াল ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
শ্যামার হাত থেকে তো সে যাত্রা বাঁচলাম! কিন্তু
মা-বাবার বকুনির হাত থেকে বাঁচব কেমন করে! বাবার পিছু পিছু আমি আস্তে আস্তে
বাড়িতে ঢুকে দরজার কাছে লুকিয়ে বসে রইলাম। বাবা বাড়িতে ফিরে চিৎকার করে মাকে
ডেকে বলল, ‘কী গো, কোথায় গেলে! তোমার তো আজ পোয়া বারো। বলি,
নিজেই সব খেয়েছ? নাকি আমার জন্য কিছু অবশিষ্ট
আছে?’
মা কোনো একটা কাজে তখন ব্যস্ত ছিল। বাবার মুখে এসব
শুনে বেশ অবাক হয়ে রেগে বলল, ‘সারাদিন খাটুনির পর তোমার মশকরা শুনলে গা জ্বলে যায়।
আমার আবার পোয়া বারো কীসে?’
বাবা বলল, ‘অত বড়ো রাজভোগ খেলে, তাও তুমি...’
বাবার কথা শেষ করতে না দিয়ে মা বলল, ‘রাজভোগ! রাজভোগ
কোথায় পাব!’
বাবা অবাক হয়ে বলল, ‘সে কী! খোকা তোমায় রাজভোগ দেয়নি?
সেকেন্ড হয়েছে বলে আমার কাছ থেকে পয়সা নিল! বলল তোমায় রাজভোগ
কিনে খাওয়াবে!’
মা অবাক হয়ে বলল, ‘কোথায় তোমার খোকা আর কোথায় তার
রাজভোগ!’
আমি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছি আর ভয়ে থরথর
করে কাঁপছি। বাবা বলল,
‘এই তো একটু আগে পেয়ারা গাছে বসেছিল শ্যামার ভয়ে। গেল কোথায়!’
চিৎকার করে বাবা আমায় ডাকতে শুরু করল। আমি ভয়ে
কাঁপতে কাঁপতে বাবা-মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাবা গর্জন করে বলে উঠল, ‘পয়সা নিয়ে কী করেছ? সত্যি বল। সত্যি বললে বকব না।’
চোখ তুলে দেখলাম বাবার চোখগুলো শ্যামার চেয়েও যেন
ভয়ংকর। ভয় পেয়ে আমি আমতা আমতা করে সব সত্যি কথা বাবা-মাকে বলে দিলাম।
আর পিঠ পেতে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে রইলাম মার খাওয়ার অপেক্ষায়। আমার কথা শুনে বাবা
সজোরে হেসে বলল, ‘তুমি সত্যি বলেছ। তাই তোমায় আজ বকলাম না।’
মা মুচকি হেসে পিঠে হাত বুলিয়ে কোলে টেনে নিল।
বুটুদাদুর গল্প শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। বেশ কিছুক্ষণ পর ঝিকাই
বলল, “আমার মা-বাবাও আমি সত্যি বললে বকে না। মিথ্যে বললে বকে।”
রিমলি, টুকাই, তুতুন,
গোগোলও একসঙ্গে বলে উঠল, “আমার মা-বাবাও তাই। তাই আমরা সব সময় সত্যি কথাই বলি। দুষ্টুমি করলেও স্বীকার করি।”
বুটুদাদু মুচকি হেসে বলল, “সত্যিটাই যে
সবচেয়ে সুন্দর। সবচেয়ে সহজ। আর সহজ-সুন্দরকেই যে আমরা ভালোবাসি।”
----------
ছবি - সুজাতা চ্যাটার্জী
সত্যিই সুন্দর।
ReplyDelete