গল্প:: জবর জবর তিন বর - অদিতি ঘোষ দস্তিদার


জবর জবর তিন বর
অদিতি ঘোষ দস্তিদার

স্কুল থেকে ফেরার সময় পুকুরপাড়ের পায়ে চলা রাস্তাটা ধরল মলি।
আমি আজ এইদিক দিয়ে চলে যাচ্ছি রে!
কেন রে? চল না আমাদের সঙ্গে,” বীণা আর সুস্মিতা আবদার করল।
না, পা ব্যথা করছে, অতটা আর হাঁটতে ইচ্ছে করছে না।
আচ্ছা যা তাহলে, টা, টা, বাই, বাই, আবার যেন দেখা পাই! হাত নাড়ল ওরা।
শুকনো হেসে মলিও হাত নেড়ে বন্ধুদের বিদায় জানাল

পুকুরপাড়ের এই একচিলতে সরু রাস্তা দিয়ে একটুখানি গেলেই মলিদের বাড়ি, ঘুরে পিচের রাস্তা দিয়ে যেতে গেলে সময় লাগে অনেকটা। তবে বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করতে করতে এলে কখন যে সময় ফুরিয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না।
আজ মন ভালো নেই। এত পড়েছিল ইতিহাস আর জীবনবিজ্ঞান, তাও বিশাখা দুটোতেই বেশি নম্বর পেল। কিছুতেই ওকে হারানো যায় না। এত রাগ হয়। বীণা আর সুস্মিতাকে অবশ্য এসব কথা বলেনি ও। ওরা টায়েটুয়ে পাশ করে। এসব কথা ওদের বলে লাভ নেই।
এমনিতেও মনের কথা তেমন কাউকে বলে না মলি। মনের মধ্যে একটা বন্ধু আছে লুকিয়ে। তার সঙ্গেই আপনমনে কথা বলে।
ক-দিন একটানা বর্ষা হওয়ায় পুকুরপাড় পিছল ছিল, আজ একেবারে খটখটে শুকনো, তাই হড়কানোর ভয় নেই।
পুকুর পেরিয়ে ছোট্ট একটা বাঁশঝাড়, তারপরেই মলিদের বাড়ি। ক-দিন বৃষ্টি হলে পুকুরের জল বেড়েছিল। এখন জল নেমে গেছে। বাঁশগাছগুলোর গুঁড়ির চারপাশে জল জমে আছে জায়গায় জায়গায়। পড়ে আছে বেশ কিছু শামুকের খোল। মলি এগুলো জমায়। হাতের কাজের ভারী শখ তো। তেমন কিছু পায় না, তাও এই শামুকের খোলের গায়ে ফুটো করে চমৎকার ধূপদানি বানাতে পারে। একটু রং পেলে তো কথাই নেই!
মা যে বাড়িতে রান্না করে সেই জেঠিমার মেয়ে টুম্পাদিদির বিয়ে হয়ে গেছে। টুম্পাদিদির ছিল ছবি আঁকার শখ। তার পুরোনো রঙের অনেকগুলো কৌটো মলির জন্যে পাঠিয়ে দিয়েছে জেঠিমা।
ভালো সাইজের ক-টা শামুকের খোল কুড়িয়ে বেছে বেছে এক জায়গায় জড়ো করতে লাগল মলি।
আরে ওই বাঁশের গুঁড়ির কাছে চকচক করছে ওটা কী? প্লাস্টিক?
এগিয়ে গেল মলি।
ওমা! কী সুন্দর একটা গোলাপি ঝিনুক। এটা কোথা থেকে এল? জ্যান্ত? দুটো খোল তো জোড়া! থাক বাবা!
চারপাশ থেকে বেশ ক-টা মরা ঝিনুক আর গোল শামুকের খোল কুড়িয়ে একটু বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল মলি।
মনটা কেমন যেন করছে। দেখবে নাকি আর একবার সেই গোলাপি ঝিনুকটাকে?
মনের ভেতরে যে বন্ধুটা থাকে সে বলল, “যা না এগিয়ে আর একবার। ভয় কী? অমন সুন্দর ঝিনুকটা!
না দেখাই যাক। জ্যান্ত হলে তুলে নিয়ে আসবে। মারবে না। মরে গেলে ওটা সাজিয়ে রাখবে।
এটা যে কেন আগে মনে হয়নি। হাতের শামুক-ঝিনুকগুলো একটা শুকনো জায়গায় রেখে মলি সেই গোলাপি ঝিনুকটার কাছে গেল। সত্যিই কী সুন্দর! বাড়ি নিয়ে যাওয়াই ভালো! এই ভেবে হাতে তুলে নিতেই খুলে গেল ঝিনুকটা!

এ কী! সত্যি দেখছে মলি?
চোখদুটো বন্ধ করে আবার খুলল।
নাহ্‌! একই তো! ঝিনুকের মধ্যে বসে বাইরে পা দোলাচ্ছে একটা প্রজাপতির মতো ছোট্ট পরি! ডানাদুটো পাতলা ফিনফিনে, ফড়িংয়ের মতো, কিন্তু গোলাপি।
ওমা! কী যেন বলছে!
শিগ্‌গিরি বর চাও তিনটে!
বর! পেটের মধ্যে কেমন গুড়গুড় করছে! সেই ভূতের রাজার বর? এক-দুই-তিন?
শিগ্‌গিরি বলো। ও হ্যাঁ নিজের জন্যে নয়, তিনজনের জন্যে বর চাও যাদের একটুও তুমি পছন্দ করো না! ক্ষতি চেয়ে নয়, ভালো কিছু চাও!
এ আবার কেমন বর! যাদের পছন্দ করি না তাদের জন্যে বর! সে আবার হয় নাকি!
কিছু না ভেবেও প্রথমেই মনে ভেসে উঠেছে বিশাখা!
না! না! একেবারেই নয়! বিশাখার জন্যে কিচ্ছু চাইবে না মলি! তাহলে ও আরও নম্বর বেশি পেয়ে যাবে।
তড়বড় করে বলে উঠল, “আমার বর চাই না! বাড়ি যাচ্ছি!
বর তোমাকে চাইতেই হবে, না চাইলে তোমাকে একটা ব্যাং বানিয়ে দেব!
মলির বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। সামনে তাকিয়ে দেখল বাঁশগাছের গোড়ায় একটু জমা জলের মধ্যে একটা ব্যাং বসেওর পাশে গিয়ে কি মলি বসবে বর না চাইলে? কী হবে? খুব খুব কান্না এল!
সময় কিন্তু খুব অল্প! শিগ্‌গিরি বলো!
তিনজন?” কাঁপা কাঁপা গলা মলির।
হ্যাঁ, শুরু করো একে একে!
একটুও না ভেবে কাঁদোকাঁদো গলায় উত্তর দিল মলি, “আমার বন্ধু বিশাখা, সবেতে আমার চেয়ে বেশি নম্বর পায়, সব দিদিমণিরা ওকে বেশি ভালোবাসে, আমার একটুও পছন্দ নয় ওকে। ও খুব অঙ্ক করতে ভালোবাসে, ও যেন অনেক অঙ্কের বই পায়! সামনেই ওর জন্মদিন, তার উপহার!
বেশ, তাই হবে! এবার দু-নম্বর কে!
এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়েছে মলি। বুদ্ধি খাটিয়ে বেশ ভালো বর বেছে নিয়েছে বিশাখার জন্যে। মরুক এখন অঙ্ক কষে কষে! তাহলে ইতিহাস আর জীবনবিজ্ঞানটা কম পড়বে!
কী ভাবছ? বলো!
কার কথা বলবে এবার মলি? ও মনে পড়েছে! স্কুলের সামনের মোড়ে ওই যে একটা ভিখিরি বুড়ি বসে, ম্যাগো, কী কুচ্ছিৎ! একটা চোখ ছোটো, মলিকে দেখেই হাসে! আরও বিচ্ছিরি লাগে। আর মলির ওকে অপয়া মনে হয়। তাই ওই মোড়ের মাথাটা চোখ বুজে একছুটে পার হয়ে যায়।
ওর অনেক টাকা-পয়সা হলে মনে হয় আর ওই মোড়ে বসে ভিক্ষে করবে না আর মলিকেও চোখ বুজে হাঁটতে হবে না!
ইস্কুলের সামনের ওই ভিখিরি বুড়িকে বড়োলোক করে দাও!
তোমার তো খুব দয়া! যাকে অপছন্দ করো তাকে ধনী বানিয়ে দিচ্ছ! তুমি খুব ভালো মেয়ে! এবার তিন নম্বর!পরির গলা এখন কী মিষ্টি!
মলির বুকের মধ্যে কেমন মোচড় দিচ্ছে। সত্যি সত্যি ও তো আর ওদের ভালো মন থেকে চায়নি!
কই গো তিন নম্বর বলো! সময় যে বয়ে যায়!

এবার একটু থমকাল মলি। সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে যাকে তার কথা কি সত্যি সত্যিই বলা যায়?
একবার ঢোঁক গিলল। গলাটা একেবারে শুকনো। নাহ্‌! বলতে তো হবেই! নইলে যে
নাহ্‌! কিছুতেই ভালো চাইবে না ওই লোকটার! ওর জন্যেই তো সব অশান্তি! নয়তো মা তো ঠিক চালিয়ে নেয়! মলিও কিচ্ছুটি চায় না, তাও সব সময় রেগে আগুন হয়ে থাকবে, একটুতেই গালমন্দ করবে, না না কক্ষনো ওর জন্যে বর চাওয়া নয়! তার চেয়ে ব্যাং হয়ে যাওয়াই ভালো!
হঠাৎ মায়ের মুখটা ভেসে উঠল মলির। মনের ভেতরে যে বাস করে সেই বন্ধুটা বলে উঠল, “তোকে যে খুব খুঁজবে তোর মা মলি!”
না! না! মাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবে না মলি! মুখ থেকে আর্তনাদের মতো বেরিয়ে এল, “আআআমার বাবা তিন নম্বর!”
বাবাকে অপছন্দ করো! ভালোবাসো না? সত্যি? আচ্ছা বেশ! কী দিতে চাও তাকে!”
বাবাকে ভালোবাসো না?” কথাটা এমন তিরের মতো বুকে বিঁধল কেন? কেন গলায় কী যেন উঠে চোখ জ্বালা করে উঠল!
না বাসে না ভালো মলি বাবাকে! কেন বাসবে? বাবা কি কখনও একটু ভালো করে কথা বলে? এই তো মাস কয়েক আগে ফাইভ থেকে সিক্সে মলি সেকেন্ড হয়ে উঠলবাবা রেজাল্ট দেখে কী করল! বলল, “কী হবে লেখাপড়া শিখে। যা বাসন মাজ, দুটো পয়সা আসবে!”
অথচ বাবা নাকি খুব লেখাপড়ায় ভালো ছিল, মা বলেছে। তাহলে?
বাবা মাঝে মাঝে যখন বাড়ি থাকে না, তখন বাড়িটা শান্ত থাকে। নইলে বাড়িতে ঢুকতেও ভালো লাগে না মলির। জোরে জোরে পড়লেও বাবা রেগে যায়!
কী দিলে বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকবে না বাবা!
আরে! মাথায় খেলেছে বিদ্যুতের চমক! সত্যি সেই সময় তো সংসারে এত ঝামেলা ছিল না! বাড়িতে থাকতই না বাবা! একেবারে সন্ধের মুখে ফিরত! হাতে থাকত কোনোদিন শিঙাড়া, কোনোদিন চপ, বাড়ি এসেই মলিকে কোলে নিত! তখন টিভিটাও ছিল! একসঙ্গে মা-বাবা টিভি দেখত। তারপর খেয়ে-দেয়ে ঘুম!
আমার বাবার কারখানাটা খুলে দাও!”
এই শুধু! আচ্ছা! তাই হবে! তুমি খুব ভালো মেয়ে, লোভ নেই একটুকুও! খুব ভালো হবে তোমার!”
পরি ডানা মেলে উড়ে সামনে যেন কোথায় মিলিয়ে গেল!

কিছুক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল মলি! স্বপ্ন ছিল কি?
না! এই তো হাতে ধরা গোলাপি ঝিনুক। খোলা!
বরগুলো কি সত্যি ফলবে? পাবে বিশাখা অঙ্কের বই, বুড়িটা অনেক টাকা-পয়সা আর বাবার কারখানা খুলবে? কিন্তু মলির কী হবে? মলি তো কিচ্ছু পাবে না!
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবল মলি। মনের বন্ধুটা মনের মধ্যে গুনগুন করল, “যাক বাবা ব্যাং তো হতে হয়নি! আর তুই তো ভালোই করেছিস সবার!”
বিশাখা অঙ্কের বই পেলে অনেক অঙ্ক কষবে আর অনেক অনেক পরীক্ষায় পাশ করে যাবে। তারপর ওর নাম কাগজে বেরোবে! আহা! হোক! ওর মা নেই তো, বাবা অনেক দূরে চাকরি করে। মামার বাড়ি থাকে! ওর ভালো হোক! আগে এসব ভাবেনি মলি, আজ মনের মধ্যে বুদবুদের মতো ভালোলাগাটা উঠছে। নাহ্‌, বেশ ভালো লাগছে।
আকাশটা লাল হয়ে গেছে। এই রে! অনেক দেরি হয়ে গেছে আজ! মা খুঁজতে বেরোয়নি তো! মলি ফিরলে মা জেঠিমার বাড়ি রুটি করতে যাবে।
হাতে গোলাপি ঝিনুকটা নিয়ে তাড়াতাড়ি পা বাড়াল মলি। বাকি শামুক-ঝিনুক পরে নিয়ে গেলেই হবে। আজ আর মন বসছে না কিছুতে!

বাড়ি এসে কাউকে কিচ্ছু না বলে তাড়াতাড়ি সকালের রান্না ডাল-ভাত খেয়ে শুয়ে পড়েছে মলিএক ঘুমে সকাল।
কী রে শরীর খারাপ? কাল এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলি? ইস্কুলের পড়া করে নে!”
চারদিকে তাকিয়েও বাবাকে দেখতে পেল না।
বাবা কোথায় মা?”
কে জানে, সকালে উঠে চা খেয়েই তো জামা গায়ে বেরোল, কী সব নাকি মিটিং আছে, জানি না বাপু, যাক গে, আমি চললুম। তুই সাবধানে যাস!”

স্কুলের সামনে আজ বুড়িটাকে দেখতে পেল না মলি। আজ আর চোখ বন্ধ করে আসেনি। কাল বুড়িটাকে স্কুল থেকে বেরোবার সময় দেখে ফেলেছিল, কিন্তু দিনটা তো খুব খারাপ যায়নি। পরির দেখা মিলেছিল। আর কিছু না হোক, গোলাপি ঝিনুকটা তো পাওয়া গেছে, কী সুন্দর!
প্রার্থনাসংগীতের পর বড়োদিদিমণি সব মেয়েদের মাঠে যেতে বললেনকী যেন জানাবেন সবাইকে।
তোমরা সবাই হয়তো বেশ কয়েক মাস ধরে আমাদের স্কুলের সামনে এক বয়স্কা ভদ্রমহিলাকে বসে ভিক্ষা করতে দেখেছ! তিনি আসলে এক বিরাট ব্যবসায়ীর মা! এক দুর্ঘটনায় সব ভুলে গেছিলেন। ওঁর ছেলেমেয়েরা আর বাড়ির লোকেরা অনেকদিন ধরে খুঁজে তাঁকে খুঁজে পেয়েছেন! স্কুলের সামনে এসে মাকে পেলেন বলে ওঁর স্বামী অনেক টাকা স্কুল লাইব্রেরির উন্নতির জন্য দান করে গেছেন! তোমাদের যদি কিছু বই-এর দরকার থাকে, দিন দশেকের মধ্যে লিস্ট করে যার যার ক্লাস টিচারের কাছে দেবে। আমরা সাধ্যমতো তোমাদের ইচ্ছে পূরণের চেষ্টা করব!”
পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বিশাখা! ফিস ফিস করে মলি বলল, “তোর যা যা অঙ্কের বই চাই ওই কী সব পরীক্ষা দেওয়ার জন্যে, লিস্টি করে দিয়ে দে! পেয়ে যাবি সব দেখিস!”
সত্যিই তো! আমার মাথাতেই আসেনি! তুই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু রে মল্লিকা!”
আমাকে অঙ্ক শিখিয়ে দিবি তো! অঙ্কটাতেই আমার বড্ড ভয়!”
সে আর বলতে!” বলেই মলিকে জড়িয়ে ধরল বিশাখা।

ক্লাসের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মলি ভাবল তিন নম্বর বরটাও ফলবে, ফলবেই!
----------
ছবি - শুভ্রা ভট্টাচার্য

No comments:

Post a Comment