মাছ
বিপুল দাস
এক
কাল রাতে মুশলধারায় বৃষ্টি
হয়েছে। কাল সারাদিন আকাশ ছিল কালো মেঘে ঢাকা। মনে হচ্ছিল যে-কোনো সময় হুড়মুড় করে আকাশ ভেঙে নামবে। সমুর খুব ইচ্ছে ছিল স্কুলে যাওয়ার। পথে
যদি ঝেঁপে বৃষ্টি নামে, তবে বন্ধুদের সঙ্গে ভিজে ঝুপ্পুস হয়ে স্কুলে পৌঁছোলে নির্ঘাত রেনি-ডে হয়ে যাবে। তখন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ছিপ নিয়ে পুঁটিমারি খালের নতুন কালভার্টের পাশে
গিয়ে বসবে। নতুন জল পেলে মাছগুলো খলবল করে স্রোতের উলটোদিকে যেতে থাকে। চ্যালা,
সরপুঁটি, কই, মাগুর। যদিও পুঁটিমারি খালের ওদিকটা বেশ নির্জন, নতুন পথে মাঝে মাঝে
একটা দুটো গাড়ি শুধু আসা-যাওয়া করে, লোকজন এখনও নতুন পথ রপ্ত করেনি – সমুর সেসব
চিন্তা নেই। একবার ছিপ ফেলে বসলে তার কাছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তুচ্ছ হয়ে যায়। রোদ,
বৃষ্টি, ঝড়, তুফান – সব মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। তার কোনো হুঁশ থাকে না। কিছুই টের
পায় না। সমস্ত মনোযোগ স্থির হয়ে থাকে ফাত্নার
ওপর। কখন টিপ দেবে, কখন সাঁ করে তলিয়ে যাবে। হ্যাঁচকা টানে জলের গভীর থেকে সমুর
ছিপে উঠে আসবে অ্যাত্ত বড়ো একটা কইমাছ।
মাছ ধরার জন্য বাড়িতে তাকে
কম বকাঝকা শুনতে হয় না। কোথায় কোথায় সে চলে যায়। এ অঞ্চলের এমন কোনো পুকুর, দিঘি, খাল, বিল নেই, যেখানে সে তার ছিপ ফেলেনি। বাবা একবার তার সব
ছিপ-বঁড়শি ফেলে দিয়েছিল। কিছুদিন মন খারাপ করে বসে থাকার পর লুকিয়ে লুকিয়ে আবার সব
তৈরি করে নিয়েছে। তাদের রান্নাঘরের পেছনে লাউমাচায় লুকিয়ে রেখেছে সব। “মা, আমি
মাঠে খেলতে যাচ্ছি” - বলে চুপি চুপি ছিপ নিয়ে
বেরিয়ে গেছে। ফিরে এসে আবার যথাস্থানে ছিপ রেখে ভালোমানুষের মতো মুখ করে হাত-পা
ধুয়ে পড়তে বসেছে।
কাল রাতে তার মাথার কাছের
জানালা খোলা ছিল। সমু বৃষ্টির গন্ধ পাচ্ছিল। নিশ্চয় দূরে কোথাও বৃষ্টি নেমেছে। সূক্ষ্ম
জলকণাগুলো কুয়াশার মতো হাওয়ায় ভেসে তার ঘরে ঢুকে পড়েছে। একটু বাদেই সমু শুনতে পেল
যেন অনেক ঘোড়সওয়ার ক্লপ ক্লপ শব্দে তীক্ষ্ণ বৃষ্টির বল্লম নিয়ে এদিকে ছুটে আসছে।
তাদের ঘরের টিনের চালের ওপর আমকাঁঠালের ডাল লুটোপুটি খাচ্ছে হাওয়ার দাপটে। তারপর
আকাশভাঙা বৃষ্টি নামল একেবারে হুড়মুড় করে। সেই বৃষ্টির ঝংকার শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে
পড়েছিল সমু। সকালে ঘুম ভেঙে উঠে দেখল আকাশে এখনও ভারী কালো মেঘ জমে আছে। গুঁড়ি
গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। জল জমে আছে তাদের উঠোনে, রাস্তায়। বাড়ির পাশের নয়ানজুলি দিয়ে
জল বয়ে যাচ্ছে প্রবল স্রোতে। সমুর বুকের ভেতরে যেন একঝাঁক নতুন জলের কই খলবল করে
উঠল। আজ শিয়োর রেনি-ডে হয়ে যাবে। আজ স্কুলে যেতেই হবে।
সাড়ে দশটা নাগাদ স্নান করে
ভাত চাইল সমু। স্কুলের পোশাক পরে নিয়েছে, ব্যাগ রেডি।
“মা, খেতে দাও। স্কুলের
দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“এই
দুর্যোগ মাথায় নিয়ে আজ তোর স্কুলে যেতে হবে না। শেষে জলে ভিজে স্নান করে এসে জ্বর
বাঁধাবি। চুপচাপ ঘরে বসে থাক।”
“ধুস্, এরকম ওয়েদারে ঘরে
বসে থাকতে ভালো লাগে নাকি। যাই না মা, মনে হয় স্কুল ছুটি হয়ে যাবে। মনে হচ্ছে আকাশ
পরিষ্কার হয়ে যাবে, বৃষ্টি আর হবে না।”
“সে, দিন ভালো হলে তখন
বেরোস। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছিস? যে-কোনো সময় আবার নামবে।”
আস্তে আস্তে মেঘ কেটে
যাচ্ছিল। ছেঁড়া কালোমেঘের পাড়ে যেন রুপোলি জরি বসানো। মেঘের ভারী চাদর ভেঙে ভেঙে বড়ো বড়ো জানালা-দরজা তৈরি হচ্ছিল।
আর, আরও বেশি আলো এসে পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা ম্লান আলো সরিয়ে উজ্জ্বল করে তুলছিল
ঘরবাড়ি, গাছপালা। বারোটা নাগাদ সমু লুকিয়ে ছিপ-বঁড়শি আর টোপ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল নতুন
কালভার্টের দিকে। বাইরে ঝলমল করছে আশ্বিনের আলো। এখন আকাশ নীল, মাঝে মাঝে সাদা
মেঘের ভেলা ভেসে চলেছে। পুজোর গন্ধ নাকে এল সমুর।
দুই
বাজার, স্কুল ছাড়িয়ে
মহাদেব মণ্ডলের বিশাল ধানখেত। নতুন পথ না ধরে ধানখেতের ভেতর দিয়ে আলপথ ধরল সমু।
শর্টকাটে একেবারে পুঁটিমারি খালের পারে গিয়ে উঠবে। তারপর পিচঢালা নতুন পথ ধরে একটু
এগোলেই কালভার্ট। সেখানে ছাতিম গাছের নীচে সমুর একটা নির্দিষ্ট জায়গা আছে। অনেক পুরোনো
গাছ। তার শিকড়বাকড় মাটির তলা দিয়ে এগিয়ে
এগিয়ে মোটা মোটা আঁকাবাঁকা দড়ির মতো খালের দিকে নেমে গেছে। প্রথমদিন দেখে সমুর কেমন যেন অস্বস্তি হয়েছিল। হঠাৎ তার মনে হয়েছিল ছাতিম
গাছের নীচে দৈত্যের মতো চেহারার কোনো মানুষ রয়েছে। অনেকদিন আগে তাকে মাটির নীচে
কবর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার হাত আস্তে আস্তে জলের দিকে এগিয়ে গেছে। গোপনে মাটির
তলা দিয়ে একটু একটু করে হাত এগিয়ে দিয়েছে খালের জলের দিকে। শক্তসমর্থ, দীর্ঘদেহী
মানুষের হাত যেমন পেশিবহুল হয়, নীল শিরা ফুলে ওঠে টানটান চামড়ার ওপর – একটা মোটা
শিকড় আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসা উপ-শিকড়গুলো দেখলে অবিকল সেই হাত আর কঠিন আঙুল মনে
হয়। যেন প্রাণপণে এগিয়ে যেতে চাইছে একটু জলের ছোঁয়া পাবে বলে। যেন বহু বছর ধরে
প্রবল জলের তেষ্টায় মাটির নীচে কাতর হয়ে রয়েছে তার প্রকাণ্ড শরীর।
শিকড়ের আঙুলগুলো যেখানে
খালের জল ছুঁইছুঁই, ঠিক সেখানে জল বেশ গভীর। খালের অন্য কোথাও তেমন গভীরতা নেই।
শুধু এখানেই অনেক গভীর। সমু এখানেই ছিপ ফেলে অপেক্ষা করে। তার কেন যেন একটা ধারণা
হয়েছে ওই গভীর জলের নীচে বড়ো মাছের বাসা আছে। তার বঁড়শিতে একদিন ঠিক মস্ত একটা
বোয়াল, কি শোল উঠবে। প্রথম দিন অবশ্য ওই শিকড়ের দিকে তাকিয়ে তার একটু ভয় করে
উঠেছিল। সত্যিই যেন একটা প্রকাণ্ড হাত তার কঠিন আঙুলগুলো ছড়িয়ে কিছু একটা আঁকড়ে
ধরতে চাইছে। পরে অবশ্য ভয় কেটে গেছে। বুঝেছে ওগুলো আসলে গাছের শিকড় ছাড়া আর কিছু
নয়। অনেক সময় এরকম চোখের ভুলে মানুষ চাঁদের আলোয় কলাপাতার বাতাসে দোলা দেখে ভূত
মনে করে। সমুর ভয়ডর একটু কম। দূরের পুকুরদিঘিতে মাছ ধরতে ধরতে সন্ধে লেগে গেছে।
ছিপ-বঁড়শি আর হাতের খালুইতে মাছ নিয়ে একা একা ফিরে এসেছে নির্জন মাঠঘাট ডিঙিয়ে। সে
অবশ্য গল্প শুনেছে রাতে মাছ নিয়ে ফেরার সময় নির্জন পথে নাকি অশরীরী আত্মারা ‘এঁকটা
মাঁছ দেঁ নাঁ’ বলে বায়না করে। তখন মাছ দিতে নেই। দিলেই তোমার মরণ। কই, সমু তো
কতদিন সন্ধের পরে খালুইয়ে মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। কোনোদিন কেউ তার কাছে ওরকম খোঁনা
স্বরে মাছ চায়নি। যতসব বাজে গল্প।
তবে সমুও ভয় পায়। সেটা
অবশ্য ভূতপ্রেত নয়। সাপে তার বড়ো ভয়। বেশি ঝোপজঙ্গল থাকলে সেখানে সে বসে না। একবার
লাহিড়িদের পোড়ো বাড়ির পেছনের পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে সে কোনোমতে প্রাণে বেঁচে
এসেছিল। কে জানে কেন, এ পুকুরে কেউ ছিপ বাইতে আসে না। সবাই এড়িয়ে চলে। লাহিড়িদের
পুকুরের কথা উঠলে সবাই কেমন যেন রহস্যময় ভাবভঙ্গি করে। সমুর কানে এসেছিল পুকুরে
মাছ নাকি কিলবিল করে। কেউ ছিপ ফেলে না, জাল মারা হয় না। মাছ বেড়েই চলেছে।
কোনো এক উজ্জ্বল দুপুরে
সমু দস্তুরমতো প্রস্তুত হয়ে মনসাতলা পার হয়ে লাহিড়ি পুকুরের দিকে রওনা হল। সে ছিল
এক ভাদ্রমাসের গুমোট গরমের দুপুর। আকাশ থেকে আগুনে গোলার স্রোত পুড়িয়ে দিচ্ছিল
বাতাস। গরম বাতাসের ভেতর দিয়ে দূরের ঘরবাড়ি, নারকেল-সুপারি গাছ, ভেরেণ্ডা গাছ – সব
ভেঙেচুরে যাচ্ছিল। পুকুরপারে সমু যখন পৌঁছল, তখন ঘেমে একেবারে স্নান করে উঠেছে।
প্রথমেই সমু দেখল পুকুরপাড়ে
কোনো ঝাঁকড়া গাছ আছে কিনা। আজ রোদে দাঁড়িয়ে মাছ ধরা অসম্ভব। পুকুরে তাকিয়ে দেখল
ওপরের জল ঢেকে আছে ঘন সবুজ শ্যাওলার আস্তরণে। পাড় জুড়ে ঘন ঝোপজঙ্গল। শুধু যেখানে
এককালে ঘাট ছিল, সেখানে কিছুটা পরিষ্কার। ইট-সিমেন্ট বাঁধানো বলেই হয়তো জঙ্গল
গজায়নি। আছে, একটা বড়ো গাছ ডালপালা মেলে দিয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছায়া দিয়েছে। বকুল
গাছ। বাড়তে বাড়তে বিশাল হয়েছে। তার ছায়া এসে পড়েছে ঘাটের পইঠার ওপর।
সেখানে কিছুটা জায়গা
ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করে বসার জায়গা করে নিল সমু। তখনই দেখল জলে একটা বড়ো মাছ ঘাই
দিল। সবুজ আস্তরণ কিছুটা সরে গেল। তারপর আস্তে আস্তে আবার শ্যাওলাদাম সেই ফাঁক
বন্ধ করে দিল। তাহলে লোকজন মিছে বলে না। বড়ো মাছ আছে এই পুকুরে। কপাল ভালো থাকলে
সমু আজ খেল দেখাবে।
ঘাটের সামনেই ছিপ ফেলল
সমু। সাদা ফাত্না উঁচু হয়ে রয়েছে। ঘাটের একধাপ নীচে বসেছে সে। চারপাশটা অদ্ভুত
নির্জন। কোথাও একটা পাখির ডাক নেই, মাছরাঙা নেই, ফড়িং নেই, প্রজাপতি নেই। মিনিট দশেক বসে থাকার পর কেমন একটা
অস্বস্তি টের পেল সমু। অথচ তার কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই। পুকুরে মাছের নড়াচড়া টের
পাচ্ছে সমু। অনেকদিন বাদে পুকুরপাড়ে মানুষ দেখতে পেয়ে ওরাও হয়তো একটু চঞ্চল হয়ে
উঠেছে।
নিশ্চয়ই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে
একটা কিছু আছে। নইলে হঠাৎ পেছন ফিরে তাকাবে কেন সমু। বিপদের থেকে হয়তো কোনো তরঙ্গ
ছুটে যায় চারপাশে। কেউ টের পায়, কেউ পায় না। কেউ টের পেয়েও গ্রাহ্য করে না। বিপদ
তাদের গ্রাস করে নেয়। যাঁরা সতর্ক হয়, তাঁরা বেঁচে যায়। সমু সেদিন বেঁচে গিয়েছিল।
পেছনে তাকিয়েই সমু দেখল, যে গাছের ছায়ায় সে বসে আছে, সেই গাছের প্রতিটি ডালে ঝুলছে
কালো দড়ির মতো সাপ। গাছটা সাপে ভরতি, কিলবিল করছে অজস্র সাপ। একমুহূর্তে সমু বুঝতে পারল সে মাছ ধরে খালুইয়ে
রাখামাত্র আঁশটে গন্ধে ওরা নেমে আসবে। সপ্তরথীর মতো ঘিরে ধরবে তাকে।
আতঙ্কে সমুর মনে হল একমুহূর্তের
জন্য তার বুকের ধুকপুক বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু শরীর বোধহয় নিজেই তার বিপদের কথা
বুঝতে পারে। প্রাণ বাঁচানোর ব্যবস্থা সে নিজেই করে নেয়। তড়াক করে লাফিয়ে উঠল সমু।
প্রাণপণে একটা দৌড় দিল। পড়ে রইল ছিপ-বঁড়শি। অনেকটা দৌড়ে
এসে হাঁপাচ্ছিল সমু। বারে বারে মনে পড়ছিল কিলবিলে ওই
সাপগুলোর কথা। গা ঘিনঘিন করছিল তার। সঙ্গে ভয় ছিল। তারপর ওই পুকুরে আর কোনোদিন
ভুলেও যায়নি সমু। সেই সাপগুলোর কথা মনে পড়লে শরীর শিরশির করে উঠত, বুকের ভেতরে ভয়ে
ঠান্ডা হয়ে আসত।
পুঁটিমারি খালে সেই বড়ো
ছাতিমগাছের নীচে বসল সমু। দেখল আজ খালের জল অনেক বেড়ে গেছে। এ অঞ্চলের সমস্ত নালা-নর্দমার
জল বয়ে বয়ে এই খালেই এসে পড়ে। অন্য দিনের মতো কালো জল নয়, আজ খালের জলে ঘোলা জলের
ঢেউ। উঁচু পাড় থেকে পা পিছলে নীচে পড়লে স্রোতে ভেসে একেবারে ময়না নদীতে গিয়ে পড়তে
হবে।
হঠাৎ দেখল তার পাশে একটা
লোক দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা, সিড়িঙ্গে চেহারা। গায়ের সিল্কের পাঞ্জাবিতে আলো এসে
পড়েছে। ঝিলমিল করে উঠলে সমুর মনে হল অবিকল একটা চিতল মাছ তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
আঁশের ওপর আলো পড়ে চমকাচ্ছে। কখন নিঃশব্দে এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে, সমু টেরই
পায়নি।
“তোমার বুঝি খুব মাছ ধরার
নেশা?”
মেজাজ বিগড়ে গেল সমুর। মাছ
ধরার সময় অন্য লোক থাকলে তার মুড নষ্ট হয়ে যায়। নির্জনতায় যে মনঃসংযোগ আসে, লোক
থাকলে সেটা নষ্ট হয়ে যায়। নেশা না থাকলে কি আর একা একা এই বিজন খালের পাশে সে মাছ
ধরতে আসে। লোকটা মনে হয় তাদের ক্লাসের মধুর মতো কাটা ঠোঁট নিয়ে জন্মেছিল। পরে
অপারেশন করে জুড়ে নিয়েছে। সেই দাগ স্পষ্ট বোঝা যায়। কথার উত্তর দিল না সমু।
“খাবারের লোভ দেখিয়ে
জ্যান্ত মাছগুলো ডাঙায় টেনে তোলো, ওরা একটু বাতাসের জন্য মুখে ব্যথা নিয়ে ছটফট
করে, তোমার কষ্ট হয় না খোকা?”
সমু তাকিয়ে দেখল লোকটা
কেমন মরা মাছের মতো নিষ্প্রাণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন যেন একটু অস্বস্তি হল
সমুর। লোকটা থাকলে আজ তার মাছধরা বরবাদ হয়ে যাবে। কথার উত্তর দিলেই লোকটা কথা
বাড়াবে। এবারও চুপ করে রইল সে।
“ধরো তুমি, আমি আসি। তবে,
আজ বোধহয় তোমার বঁড়শিতে মাছ উঠবে না। মাঠঘাট থেকে জল এসে পড়ছে, সেখান থেকেই ওরা আজ
খাবার পেয়ে যাবে। তোমার টোপের গন্ধও শুঁকে দেখবে না।”
লোকটা চলে যাচ্ছে। সমু
তাকিয়ে দেখল যেন বাতাসের ভেতর দিয়ে মাছের মতোই সাঁতার কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। কে জানে
কোথা থেকে এসেছিল। তার মেজাজটাই খারাপ করে দিয়ে গেল। সমু তার বরাবরের পছন্দের
জায়গায় গিয়ে বসল। বঁড়শিতে টোপ গেঁথে সেই আঁকাবাঁকা শিকড়ের পাশেই ছিপ ফেলল। আজ
মাছগুলো নতুন জল পেয়েছে। উজিয়ে উত্তরদিকে যাওয়ার চেষ্টা করবে। দু-চারটে পুঁটি আর
চ্যালা উঠল তার ছিপে। কিন্তু তার মন বলছে আজ বড়ো মাছ উঠবে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে
ফাত্নার দিকে তাকিয়ে রইল সমু। প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছে এই বুঝি ফাত্না ডুবল।
এখন অন্য দিকে তাকানোর সময় নেই তার।
আচমকাই দেখল সাদা ফাত্না
সাঁৎ করে জলের নীচে চলে যাচ্ছে। ছিপে হ্যাঁচকা টান দিল সমু। বাপ রে, যেন ভারী কোনো পাথরে বঁড়শি আটকে গেছে। নিশ্চয় শোল কিংবা বোয়াল।
সমুর বুকের ভেতরে যেন ডিম-ডিম করে মাদল বাজছে। প্রাণপণে সুতোয় টান দিচ্ছে সে,
কিছুতেই নড়ছে না সেই বিশাল মাছ। উলটে যেন তাকেই আস্তে আস্তে জলের দিকে টানছে সুতো।
মনে হচ্ছে সমুর চেয়েও ওই মাছের গায়ের জোর বেশি। মাছ, নাকি দৈত্য রে বাবা। এত
টানাটানিতে তো তার সুতোই ছিঁড়ে যাবে।
এখন আর সমু টানছে না, বরং
তার জলের দিকের টান সামলাতে চেষ্টা করছে। আর একবার শেষ চেষ্টা করবে বলে জোরে টান
দিল সে তার ছিপে। জলের গভীর থেকেও একটা প্রবল উলটো টান এল। পটাং করে সুতো ছিঁড়ে
গেল। টাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড় করে পড়ল খালের জলে। গেরুয়া জলের ভয়ংকর স্রোতে
ভেসে যেতে যেতে খড়কুটোর মতো হাতের সামনে পেল সেই ছাতিম গাছের শিকড়গুলো। নাকে-মুখে
জল ঢুকে তখন বিষম খাচ্ছে সমু। কোনোরকমে মাথা জলের ওপরে রেখে বাতাস নেবার চেষ্টা
করছে।
হঠাৎ প্রচণ্ড ব্যথায় ‘আঃ’ বলে
চিৎকার করে উঠল সমু। যে শিকড় সে ধরে আছে, তারই একটা সরু অংশ অবিকল আঙুলের মতো
বেঁকে তার নীচের ঠোঁটে ঢুকে গেছে। ওই অবস্থায় গাছটা যেন তাকে ওপরে টেনে তোলার
চেষ্টা করছে। একদিকে ভয়ংকর ঘোলা জল তাকে স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে, অন্যদিকে
গাছের শক্ত শিকড় বঁড়শির মতো তার ঠোঁটে বিঁধে আছে।
আঃ। অসহ্য কষ্ট হচ্ছে
সমুর। ঠোঁট ছিঁড়ে যেন দু-টুকরো হয়ে যাবে। ব্যথায় আর আতঙ্কে সমুর মনে হচ্ছিল সে
এখনই অজ্ঞান হয়ে যাবে। তখনই শুনতে পেল কে যেন বলছে – “ভয় পেয়ো না। এদিকে হাতটা বাড়াও।” সমু দেখল
খালের পাড়ে অবিকল মাছের মতো একটা সিড়িঙ্গে লোক দাঁড়িয়ে আছে। সম্মোহিতের মতো হাত
বাড়িয়ে দিল সমু। লোকটা নীচে নেমে আসছে। তার সামনে এসে পরম যত্নে ঠোঁট থেকে সেই
শিকড়ের বঁড়শি খুলে দিল। তারপর মাছের পাখনার মতো হাত বাড়িয়ে বলল – “উঠে এসো।”
মাছধরা ছেড়ে দিয়েছে সমু।
পড়াশোনায় খুব মন দিয়েছে। ওর এই গল্প কেউ জানে না। শুধু মা জানতে চেয়েছিল – “কী রে,
নীচের ঠোঁটে ওভাবে কাটল কী করে?”
“ও কিছু নয়, বাঁশতলা দিয়ে
যাওয়ার সময় একটু খোঁচা লেগেছিল। সেরে গেছে।”
----------
ছবি - অতনু দেব
No comments:
Post a Comment