ম্যাজিক ল্যাম্প:: এপ্রিল ২০১৬

প্রথম বর্ষ।। তৃতীয় সংখ্যা।। এপ্রিল ২০১৬।।


প্রচ্ছদ সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং চিরঞ্জিত সামন্ত
_____

সম্পাদকীয়:: এপ্রিল ২০১৬


ম্যাজিক ল্যাম্পের প্রিয় বন্ধুরা,

কেমন আছ সবাই? খুব গরম পড়েছে তাই না? তাই বলে মন খারাপ করে বসে থেক না কুলফি মালাই খেতে খেতে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেল ম্যাজিক ল্যাম্প আমার মন খারাপ থাকলে বা কিছু ভালো না লাগলে আমি মজার মজার গল্প আর ছড়া পড়ি মাঝে মাঝে বেশ অন্যরকম একটা সুর করে জোরে জোরে ছড়া আওড়াই তোমরাও ট্রাই করে দেখো বেশ মজা লাগবে ও... তোমাদের নববর্ষের শুভেচ্ছা তো জানানোই হয়নি জানো তো পয়লা বৈশাখ এলেই আমার ছোটবেলার কথা বেশি করে মনে পড়ে
পয়লা বৈশাখ মানে আমার কাছে হলুদ গোলাপী ফুলছাপ জামা বাবা যেটা বানাতে দিত সুতির ছিট কিনে আর আমি প্রতিদিন দর্জি কাকু-কে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম " কাকু জামা হল?"
সেই জামাটা বাড়িতে এলেও আমার আদেখলাপনা ঘুচত না কাকুর দোকানে পুজো শুরু হয়েছে, দাঁত মেজেই ওই জামাটা পরার জন্যে ঝুলোঝুলি তারপর তিড়িং বিড়িং ছাগলছানার মতো লাফাতে লাফাতে এসে প্রসাদের জন্যে আদেখলাপনা
টক কমলাটা না, ওই মন্ডা-টা, কয়েকটা আঙ্গুর, আপেলের টুকরো, এগাল ওগাল করে মনে পড়ল এই রে.... বাবা , মা কাউকেই তো প্রণাম করা হয়নি
সন্ধ্যে বেলা বাবার হাত ধরে দোকান, সে দোকান মিষ্টির প্যাকেট, লাড্ডু, নিমকি, চপ সিঙ্গাড়াও থাকত এক দুটো প্যাকেট খোলার আগে আদেখলাপনা গন্ধ শুঁকে... হুম, এটাতে কী থাকতে পারে? কিন্তু বাড়ি আসার আগে খোলা যাবে না খুলবে মা এইরকম অনেক টুকরো টুকরো ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে
তোমাদের জন্যে ম্যাজিক ল্যাম্প-এর তরফ থেকে নতুন বছরে অনেক ভালবাসার উপহার নিয়ে এসেছি আমরা উপহারের মোড়ক খুলে নিজেরাই দেখে নাও এবারে অনেক নতুন নতুন সারপ্রাইজ আছে তোমাদের জন্যে রংবাহারি গল্প কবিতায় ম্যাজিক ল্যাম্প যেন নতুন জামায় সেজে উঠেছে অনেকগুলি গল্প পাঠ আবৃত্তিও আছে, এছাড়া বহুরূপী, কমিক্স, ভ্রমণ, অপরাজিত, বায়োস্কোপ, হাওয়াকল আর অন্যান্য বিভাগ তো আছেই খুব মজা করে পড়, দেখো, আর আমাদের অবশ্যই জানাও কেমন লাগলো
এই নতুন বছরে তোমরা খুব ভালো থেক নিজের সঙ্গে অন্যদেরও ভালো রেখো তোমার নতুন জামা তো হয়ই প্রতিবছর আর ওই ছেলে মেয়ে গুলো যারা রাস্তার ধারে, বস্তিতে এই প্রচণ্ড গরমে কষ্ট পাচ্ছে, পারলে তাদের একটু খেয়াল রেখো দেখবে তোমার বুকের ভেতরটা এই গরমেও খুব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে

ভালবাসা নিও
ইতি,
জিনি

__________

গল্পের ম্যাজিক:: ভেক ভিকাই - বৈশাখী ঠাকুর


ভেক ভিকাই
বৈশাখী ঠাকুর

আধো ঘুম আধো জাগরণে ভোজনরসিক ভেক ভিকাই জবরদস্ত সব খানাপিনার স্বপ্ন দেখছিল। মশাদের ব্যাটার ফ্রাই, ঝিঁঝিঁ পোকার রোস্ট, উচ্চিংড়ের কাবাব - উল্লুস! আগাছা, শ্যাওলা দিয়ে তৈরি মুচমুচে বড়া। হঠাৎ মনে হল পায়ের তলায় কী যেন ফুটছে। ঘুমের চটকাটা ভেঙে গেল। ভিকাই  চোখ মেলে দেখল চারিদিকটা কেমন ঘোর অন্ধকারসে কি তবে ঘরে নেই? এক ফালি সরু গলিপথ মত জায়গা। তবে কি সে ফুটপাথে! চারিপাশে এ কী সব সরঞ্জাম - অদ্ভুত রকমের সব যন্ত্রপাতি, খোঁচা খোঁচা - এগুলো কী? চারিপাশটা দেখল ভাল করে ভিকাই। এবার বুঝি কিছু সে বুঝতে পারল। তার ঠাকুরমার কাছে সে শুনেছিল - মনুষ্যকুল তাদের কী সব কাজে যেন ব্যবহার করে! বিজ্ঞানের প্র্যাকটিকাল ক্লাস। সেই বায়োলজি বাক্সের এক কোণায় আপাততঃ তার ঠাঁই হয়েছে। ভিকাই প্রমাদ গুনল। তার বুঝতে একটুও অসুবিধে হল না যে সে আপাততঃ বন্দী। যাবজ্জীবন বন্দী। অতঃপর  মৃত্যুদণ্ড। আর যাবজ্জীবনই বা কী করে বলবে! কদিন নাকি কঘণ্টা! মৃদুমন্দ আওয়াজ ভেসে আসছিল বাইরে থেকে। নিঃশ্বাস যেন তার বন্ধ হচ্ছে মনে হচ্ছিল, এক্ষুণি সে মরে  যাবে। ঠিক তখনই  যেন অল্প ফাঁক হল বাক্সটা। এক ঝলক দিনের আলো — টাটকা হাওয়া — ওঃ! প্রাণটা বাঁচল ভিকাইয়ের। তাকে স্থানান্তরিত করা হল এক কৌটোয়। যাতে সে একদম মরে না যায়।
ভিকাইয়ের মনে পড়ল ওর বন্ধু ফ্রগসিরও এমন দশা হয়েছিল কিন্তু কপালগুণে সে বেঁচে গেছিল। তাকেও উপায় বের করতে হবে কী করে সে উদ্ধার করবে নিজেকে। তাদের অঞ্চলে বেশির ভাগ ব্যাঙেদেরই অকালমৃত্যু হয়েছে এই ছাত্রছাত্রীদের প্র্যাক্টিকাল ক্লাসের বলি হয়ে। প্রতিদিন কত শত ব্যাঙ যে মারা যাচ্ছে এই পরীক্ষা নিরীক্ষার ঠ্যালায় তার ইয়ত্তা নেই।
আগে তাদের বিরাট অঞ্চল জুড়ে পুকুর পাড়ে বাস ছিল। তাদের বাসস্থান চেনার পর থেকে রোজই ইস্কুল, কলেজের কোনও না কোনও ছেলেমেয়ে তাদের ধরে নিয়ে যায়। কমতে কমতে এখন মাত্র ক ঘর ওদের বাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সব নিয়ে মনুষ্য জাতির কিন্তু কোনও হুঁশ নেই। ধীরে ধীরে একদিন তারাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে। তখন তাদের টনক নড়বে। আইন-কানুন-সংরক্ষণ শুরু হবে। বাঘ-সিংহর মত তারা অত সুন্দরও না। কলেবরও বড় নয়। তাই বুঝি তাদের কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। যাকগে যাক, এইসব তত্ত্বকথা ভেবে ভিকাইয়ের কোনও লাভ নেই। তাকে বাঁচার রাস্তা বাতলাতে হবে।
পরদিন ভিকাই বুঝতে পারল তার অন্তিম লগ্ন উপস্থিত। একটা ব্যাগের ভেতর করে সে চলল ইস্কুলে। ছেলেটার নাম মৈনাক। দ্বাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞানের ছাত্র। যা কথাবার্তা কানে এসেছে তাতে এতটা উদ্ধার করেছে ভিকাই। গতকাল ছেলেটা ইস্কুল থেকে ফেরার সময়ই তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় টক করে তুলে বায়োলজি বাক্সে চালান করেছিল। আজ ইস্কুলে নিয়ে এসেছে মহা উৎসাহে। ক্লাসে এসে একটা টেবিলের ওপর তাকে রাখল। ভিকাই বসে রইল কৌটো বন্দী হয়ে। প্রায়ই তার বন্ধুরা আসছে যাচ্ছে আর সেই ফুটোটা দিয়ে তাকে দেখছে। একের পর এক ক্লাস হচ্ছে। ইংরাজির ক্লাস হচ্ছিল মনে হয়। মৈনাক তার বন্ধুদের বলল এর পরই তাদের ল্যাব যেতে হবে ব্যাঙদের নিয়ে। শুনে বুকটা ধক করে উঠল ভিকাইয়ের। সে অন্যমনস্ক থাকার চেষ্টা করল। স্যার পড়াচ্ছেন। সে কান পেতে তাই শুনছিল,
“Promise me you’ll always remember – you’re braver than you believe and stronger than you seem, and smarter than you think.”
Christopher Robin বলেছিলেন কথাগুলো। মনে হল যেন তার উদ্দেশেই বলা। ভিকাইয়ের মনে একটা বিরাট আলোড়ন তুলল উক্তিটা। সেও অসীম শক্তির অধিকারী। যথেষ্ট সাহসী। ভিকাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল যে করেই হোক তাকে বাঁচতেই হবে।
ল্যাবে রুমে গিয়ে তাকে  উন্মুক্ত করা হল। তার বহু জাতভাইয়ের সাথে দেখা সবারই কাঁচুমাচু মুখ। সবাই মৃত্যুপথযাত্রী! শোকে-আতঙ্কে-মৃত্যুর চিন্তায় কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ সব ফুলে গেছে। ভিকাই দেখল একটা বড় ট্রে পাতা রয়েছে। সাদা একটা পুরু মোমের আস্তরতার ওপর সব  ব্যাঙদের উল্টো করে রাখা। চারটে পা টেনে টেনে বোর্ড পিন দিয়ে আটকে দিচ্ছে ল্যাবের যিনি সহকারী আছেন তিনি। ঐ ট্রেতে ওঠানোর আগেই একটা কী দিচ্ছে আর ভিকাইয়ের সতীর্থরা  তৎক্ষণাৎ ইহলোক ত্যাগ করছে। তারপর জোর কদমে জলে ধুয়ে ট্রেতে সাজানো। আর বুঝি শেষ রক্ষা হল না। ভিকাই চারিদিকে তাকাল। কটা জানালা? কটা দরজা? তার দ্রুত নিঃশ্বাস পড়ছে। ভেবে পাচ্ছে না কী করবে। মাথা ঠাণ্ডা করে সে চিন্তা করার চেষ্টা করল। কিন্তু চিন্তা করবে কী, কোথা থেকে একটা উটকো বোলতা এসে ভ্যান ভ্যান করে ঘরময় ঘুরতে শুরু করে দিলসারা ঘরময় উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কত ফুর্তি তার মনে। ভিকাইয়ের মত দশা হলে টের পেত। এর কাছে গিয়ে ওর কাছে গিয়ে সারা ক্লাসটাকে তটস্থ করে রেখে দিয়েছে।
হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল ভিকাইয়ের। দৃষ্টি আকর্ষণ করল বোলতাটার। সাংকেতিক ভাষায় কিছু একটা বলার চেষ্টা করল। আর দুটো ব্যাঙের পরেই ভিকাই ঐ ট্রেতে অধিষ্ঠান করবে। অতঃপর বুঝি তার মৃত্যুর ঘণ্টা বাজল। ঠিক সেই সময় ভিকাইয়ের ইশারায় বোলতাটা এসে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের হাতের আঙ্গুলে সজোরে হুল ফুটিয়ে দিল চীৎকার করে উঠল সে। কালবিলম্ব না করে ভিকাই এক লাফ মারল টেবিল থেকে পেছনের জানলায়। তার পরই জানলা দিয়ে উন্মুক্ত পৃথিবীতে। ভাগ্যিস! মনুষেরা সত্যি সত্যি পশুপাখির কথা বুঝতে পারে না। ঐ রূপকথার জগতেই সেটা সীমিত। না হলে শেষ রক্ষা আজ আর হত না। বাইরে এসে ভিকাই অপেক্ষা করল বোলতা বন্ধুর জন্য। তার সেই স্বপ্নের মহাভোজটা সম্পন্ন করতে হবে। আর তাতে বোলতা বন্ধু না থাকলে তো সেটা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। তাই না! তার পুনর্জন্মটা যে মহা আড়ম্বরে উদযাপন করতেই হবে!
_______________
ছবি- পুস্পেন মণ্ডল

লেখক পরিচিতি - বৈশাখী ঠাকুর বেশ কিছুদিন ধরেই লিখছেন। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় উনিশ কুড়ি পত্রিকায়। তারপর থেকে নিয়মিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখছেন। ছোটো এবং বড় উভয়ের জন্যই লেখেন।

গল্পের ম্যাজিক:: তিতলি - রাজীব কুমার সাহা


তিতলি
রাজীব কুমার সাহা

“অর্ক, ইস! এই ছেলেকে নিয়ে আর পারছি না, উফ! এই এলি স্কুল থেকে। দু’সেকেন্ডের মধ্যেই টিভি খুলে বসে গেলি? ইউনিফর্মটা পর্যন্ত গায়ে রয়ে গেছে, মা গো! এই দস্যি ছেলে, গেলি?”
ভুরু কুঁচকে ঘাড় বাঁকিয়ে একবার তাকাল অর্ক মা’র দিকে। তারপর গাল ফুলিয়ে ধীর পায়ে ও ঘরে চলে গেলমা আবার গলা চড়িয়েছে, “হাত মুখ ধুয়ে আয় তাড়াতাড়ি। টেবিলে খাবার রাখছি। চুপচাপ খেয়ে নেবে, বুঝলে? আমি বাথরুমে গেলাম।”
অর্ক খেয়ে এসে এবার ড্রয়িং নিয়ে মেঝেতে নামলএতক্ষণ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে প্রজাপতিদের জীবনচক্র দেখছিল হাঁ করে ও। একটা ডিম থেকে প্রথমে লার্ভা, তারপর পিউপার একটা পাতলা খোলস থেকে দারুণ রঙিন একটা প্রজাপতি কীভাবে জন্ম নেয় দেখে অবাক লাগছিল ওর। ওটাই এখন আঁকবে ড্রয়িং খাতায়। কাল স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের দেখাবে। সায়েন্স টিচার সুস্মিতা ম্যাডাম দেখলেও খুশি হবে।
আঁকতে আঁকতে একটা হাই তুলে খাতার ওপর উপুড় হয়ে পড়ল অর্ক। হাতের আসল কাজ করতে হবে এখন। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর একটা প্রজাপতি আঁকতে হবে। চার পাঁচটা রং দেবে ডানাগুলোতে কমপক্ষে। খুব যত্ন করে শেষ রঙটা ভরে চোখদুটো ফুটিয়ে দিতেই একেবারে অবাক কাণ্ড! নিজের চোখদুটোকেই বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। প্রজাপতিটা ফরফর করে পাতলা পাতলা ডানা দুলিয়ে অর্কর ড্রয়িং খাতাটাকে চক্কর কেটে উড়ে বেড়াচ্ছে। গোল গোল চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ও।
পাশে গড়াগড়ি খাওয়া রং পেনসিলটার গায়ে এসে বসে দুটো ডানা এক করে ওপরের দিকে তুলে রাখল প্রজাপতিটা। অর্কর দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসল যেন। বলল, “আমরা আজ থেকে বন্ধু হলাম অর্ক। চলো কোথাও বেড়িয়ে আসি, যাবে?”
অর্ক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে একদম। ওরই আঁকা একটা প্রজাপতি জ্যান্ত হয়ে গিয়ে ওর সাথেই কথা বলছে! এমনও হয়! অনেক কষ্টে স্বর বেরোল গলা দিয়ে, “আ-আমরা বন্ধু? কিন্তু... আগে তো কখনও...”
“দেখবে কী করে, তুমি তো আগে আর আঁকোনি কখনও আমাকে। চলো ঘুরে আসি। আমি আবার এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে পারি না,” প্রজাপতিটা তাড়া দিল।
অর্ক আমতা আমতা করে বলল, “কিন্তু মা, মা বাথরুমে। বেরিয়ে এলে বলে যাব।”
“ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে যে! তাছাড়া মাকে বললে মা যেতে দেবে?”
“তুমি তো আমার নাম জান দেখছি। তোমার নাম কী?” অর্ক এতক্ষণে অনেকটা সহজ হয়ে গেছে।
“আমার নাম? সে তুমি যা ইচ্ছে ডাকো। তবে জীববিজ্ঞানীরা একটা গালভরা নাম উপহার দিয়েছেন বটে, রোপ্যালোসেরা। তার সাথে আমাদের শ্রেণী বা পরিবার অনুযায়ী কিছু শব্দ যুক্ত হয়ে আসল নাম হয়। তুমি আমায় নয় তিতলি বলেই ডাকো, কেমন?”
“বাহ, দারুণ নাম তো!” হাততালি দিয়ে ওঠে অর্ক। হিন্দিতে প্রজাপতিকে তিতলি বলতে অনেক শুনেছে ও।
“নাও, তাড়াতাড়ি আমার পিঠে চড়ে বসো। মা বেরিয়ে আসার আগেই আবার রেখে যেতে হবে তো তোমায়!”
তিতলি দরজার বাইরে এসেই সাঁই সাঁই করে এই এত্ত বড় হয়ে গেল। অর্কও অবাক চোখে পিঠে চড়ে বসল তিতলির। উড়ে চলল মেঘের দেশেতুলোর মতো বিশাল একখণ্ড মেঘ ভেদ করতে চলেছে ওরা। অর্ক চোখ বন্ধ করে আরও জোরে পিঠ আঁকড়ে ধরল তিতলিরএই মেঘের সাথে ধাক্কা লাগলে চুরমার হয়ে যাবে মাথা এক নিমেষেই। তিতলি উড়েই চলেছে। তিতলির কোনও ভয় ডর নেই। হঠাৎ নাকে মুখে একটা হিমেল পরশ পেতেই চোখ খুলল অর্ক। আরে! কী আশ্চর্য! এ যে ঘন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে উড়ে চলেছে সে। মেঘ কী তবে শক্ত কোনও জিনিস নয়, যেমনটা মাটি থেকে মনে হয়!


মেঘের দেশটা পেরোতেই একটা ঝলমলে নতুন দেশ আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল অর্ক। এ কোন দেশ! এত সুন্দর ফোয়ারা, এত সুন্দর গাছগাছালি, একরাশ দুধের ধারার মতো ঝর্ণা, কচি কচি চারাগাছে কী বাহারি ফুল! তিতলি যতই নিচে নামছে ততই আরও বেশি স্পষ্ট আর সুন্দর মনে হতে লাগল দেশটাকে। এ যে এক স্বপ্নের দেশ! রূপকথার দেশ!
“এই তোমার দেশ নাকি তিতলি? কী নাম এর?” খুশিতে ডগমগ হয়ে জিগ্যেস করল অর্ক।
“হ্যাঁ গো! রাঙামাটি। এখানে সব রাঙা, সব রঙিন। তোমাদের ওখানকার মতো কোনও দূষণই নেই এখানে। তবে সুখ আছে, দুঃখ আছে। আছে হাসি, আছে কান্না।”
ততক্ষণে আকাশ থেকে নেমে একটা নাম না জানা গাছের ছায়ায় বসেছে দুজনে। একটু জিরিয়ে নিয়ে তিতলি বলল, “চলো, তোমায় ঘুরেফিরে দেখাই আমাদের রাঙামাটির দেশটা। চলো চলো।”
“আচ্ছা তিতলি, ওই যে ডানদিকে গাছের ডালে শুয়ে আছে, ও এমন কেন?”
“আর বলো না, রোজ রোজ বেলায় বেলায় ডিম খেয়ে ওর চেহারা এখন ডিমের মতো হয়ে গেছেওকে কেউ আর এখন খেলায় নেয় না। খেলতে নেমে শুধুই হাঁপায়। তাই মনের দুঃখে একা একা শুয়ে থাকে,” তিতলি গোমড়া মুখে জবাব দিল।
“আর ও? ওই যে কাঠের তক্তায় শুয়ে আছে?”
তিতলি ঘাড় ফিরিয়ে বলল, “ও? আর বলো না। হাবিজাবি, চপ কাটলেট, চিপস চকোলেট হরদম খেয়ে সাংঘাতিক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ডাক্তার কবিরাজ কেউই সুস্থ করে তুলতে পারছে না।”
অর্কর খুব খারাপ লাগছিল কথাগুলো শুনতে। ওরা হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলল যেদিকে দু’চোখ যায়। যতই দেখছে ততই মুগ্ধ হয়ে পড়ছে অর্ক রাঙামাটির সৌন্দর্যে। ডানাগুলোয় কী সুন্দর হরেক রঙের বাহার নিয়ে এক একটা প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। তাছাড়া সাদা কালো লাল নীল কমলা হলুদ ছোটছোট ফুরফুরে প্রজাপতি তো আছেই। গা ঘেঁষে ঘেঁষে ওড়াউড়ি করছে এ গাছ থেকে ও গাছে। দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়।
খানিকটা এগোতেই ও দেখল এক ঝাঁক প্রজাপতি আনন্দে লাফাতে লাফাতে আসছে মাঝখানে কাকে রেখে যেন। অর্ক বিস্ময়ভরা চোখে তাকাতেই তিতলি বলে উঠল, “মাঝখানে যে দেখছ, ওর নাম লালি। খুব ভালো ছেলে আমাদের। পড়াশুনো বলো, খেলাধুলো বলো, আচার আচরণ বলো সবেতেই খুব ভালো। ও কক্ষনও বাবা মায়ের, গুরুজনদের অবাধ্য হয় না। মিথ্যে কথা বলে না। তাই সবাই ওকে খুব ভালবাসে, রোজই কেউ না কেউ কিছু না কিছু উপহার দেয়। আর সবাই মিলে আনন্দ করে।”
চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল অর্কর। ঘুরতে ঘুরতে একসময় তিতলির বাড়িতে এসে উপস্থিত হল দুইবন্ধু মিলে। ঠিক অর্কর আঁকার বইয়ের ছবিগুলোর মতো সুন্দর তিতলির বাড়িটা। ঘরে ঢুকতেই সবাই দৌড়ে এল। তিতলির মা খুব আদর করল অর্ককে। হঠাৎ ওর হাঁটুর দিকে চোখ পড়তেই জিগ্যেস করল, “ওমা, ওখানে কী হল আবার বাছা? কীভাবে ব্যথা পেলে?”
অর্ক মনে মনে লজ্জা পেয়ে গেল। বলল, “পা পিছলে পড়ে গিয়ে...”
কিন্তু স্কুলে বিশালের দামি পেনসিলটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে বিশালের ধাক্কায় স্কুলের বারান্দার রেলিংয়ে ঘষটে গিয়ে যে জায়গাটা নীল হয়ে গেছে সে কথা বেমালুম চেপে গেল ও। কথাটা বলেই মুখটা ঘুরিয়ে নিল ও। পাশ ফিরে তাকাতেই থ বনে গেল একেবারেএকটা প্রজাপতি ঠায় বসে আছে একটা চেয়ারে। সুন্দর রঙগুলো বিবর্ণ হতে হতে ডানাগুলো ছিঁড়ে যেতে শুরু করেছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সামনের বন্ধ টিভিটার দিকে। পায়ের কাছে রিমোটটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অর্কর চোখের চাউনি অনুসরণ করে তিতলি বলে উঠল, “আমার ভাই। ভীষণ জেদি আর দুষ্টু ছিল। যখন তখন টিভি খুলে বসে পড়ত বলে বাবা একদিন বকাঝকা করতেই রিমোটটা ছুঁড়ে ফেলে ভেঙে ফেলল। সেই থেকে এই চেয়ারেই আটকে আছে। কিছু খেতে পারে না, কোত্থাও যেতে পারে নাটিভিটাও নষ্ট হয়ে গেছে,” বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তিতলি।
তিতলি এবার তাড়া দিল। অর্ককে এবার রেখে আসতে হবে। কথায় কথায় অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। কিন্তু অর্কর কিছুতেই মন চাইছে না ফিরে যেতে। তিতলিরা শুধু একবার মুখ ফুটে বললেই থেকে যাবে ও। কিন্তু তিতলি এক কথার প্রজাপতি। কথা মতো অর্কর মা স্নান সেরে বেরনোর আগেই পৌঁছে দেবে অর্ককে। একটু গাল ফুলিয়ে থেকেও কী একটা কিছু মনে পড়তেই ফিক করে হেসে উঠল অর্ক। তিতলি মুচকি হেসে বলল, “ভাবছ, অনেকক্ষণ তো কেটে গেছে। ঘণ্টা তিনেক তো হবেই। মা কি আর বাথরুমে আছে এখনও? কোন কালে বেরিয়ে হয়তো এদিক ওদিক খুঁজছে তোমাকে।  কিন্তু বন্ধু, না। মা এখনও বাথরুমেই আছে। তোমাদের দশ মিনিট মানে আমাদের দশ ঘণ্টার সমান। আমাদের জীবনকাল তোমাদের চেয়ে অনেক কম কিনা।”
অর্ক আশ্চর্য হয়ে তিতলিকে বলল, “তাই নাকি! তবে তো আরও কিছুক্ষণ... উম... উম...উম...”
কথাটা শেষ করার আগেই কে যেন হঠাৎ এক চামচ মধু না কী একটা ঠেসে দিল জোর করে অর্কর মুখে। আস্তে আস্তে চোখের পাতা ভারী হতে হতে গাঢ় ঘুমে ডুবে গেল ও। ঘুমের ঘোরটা অচিরেই এত ঘন হয়ে এল যে পিঠে কে যেন জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে বুঝতে পেরেও সাড়া দিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। সারা শরীরের শক্তি এক করেও কুলোচ্ছে না যেন।
শেষে ঝাঁঝালো আওয়াজটা আরও জোরালো হতেই ধড়মড় করে উঠে বসল অর্ক। সামনে আঁকার খাতাটা খোলা। ফ্যানের বাতাসে পাতার একটা কোণা উঠি উঠি করেও উঠতে পারছে না রং পেনসিলগুলো আর রবারের চাপে। চোখ কচলে দেখল মা সমানে বকেই চলেছে, “হে ভগবান! কী অদ্ভুত ছেলে রে তুই অর্ক, অ্যাঁ? এই ঠাণ্ডা টাইলে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিলি! আর হাঁটুটা নীল হয়ে আছে কেন? আজকে আবার স্কুলে... উফ, বাবা গো, এই বিচ্ছু ছেলে আমায় মেরে ফেলবে গো।”
মা মাত্র স্নান সেরে এসেছে। বেলিফুলের মতো মিষ্টি একটা গন্ধ বেরোচ্ছে গা থেকে। এই গন্ধটা খুব ভালবাসে অর্কসব মায়েরই একটা আলাদা গন্ধ থাকে। এই বেলিফুলের গন্ধটাই অর্কর মা মা গন্ধ। ঝপ করে মা’র কোমর জড়িয়ে ধরে পিঠে মাথা ফেলে অর্ক বলল, “আমি আর স্কুলে দুষ্টুমি করব না মা, রোজ দুবেলা ডিম খেতেও বায়না ধরব না। আর গলি দিয়ে ওই ড্রেনের নোংরা জল দিয়ে বানানো আইসক্রিমওয়ালা গেলে দৌড়ে যাব না। বেড়ালের ল্যাজের চুল দিয়ে তৈরি শোনপাপড়ির দিকে তো তাকাবোই না। হোম ওয়ার্ক মন দিয়ে করে ফেলব, জ্বালাবো না মা, সত্যি বলছি। শুধু মাঝে মাঝে তিতলি এলে বেড়াতে যাব একটু। তখন কিন্তু তুমি আমি না ফেরা পর্যন্ত বাথরুম থেকে বেরোবে না একদম। কেমন?”
হাত বাড়িয়ে পেছন থেকে টেনে এনে ছেলের মুখের দিকে খানিক হাঁ করে তাকিয়ে থেকে মা জিগ্যেস করল, “কে তিতলি? নতুন বন্ধু বুঝি?”
তারপর হঠাৎ খাতাটার দিকে চোখ যেতেই বলল, “আরে দেখি দেখি, খাসা এঁকেছিস তো প্রজাপতিটা সোনা।”
বলেই চুকুম করে চুমু খেল অর্কর মা ওর গালে। অর্ক হালকা গা মুচড়ে বলল, “আহ, ছাড়ো না! ইস, চোখদুটো আঁকতে ভুলে গেছি, দাঁড়াও।”


____________
ছবি- পিয়ালী বন্দোপাধ্যায়

লেখক পরিচিতি ত্রিপুরার মন্দিরনগরী উদয়পুরে জন্ম। বেড়ে ওঠা এবং স্থিতি গোমতী জেলার কাকড়াবনে। পেশায় একজন ফার্মাসিউটিক্যাল ডিস্ট্রিবিউটর। নেশাবই পড়াসিনেমা দেখা আর কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় অনেকদিন ধরেই লেখালেখি করছেন।