তিতলি
রাজীব কুমার সাহা
“অর্ক, ইস! এই ছেলেকে নিয়ে আর পারছি না, উফ! এই এলি স্কুল থেকে। দু’সেকেন্ডের মধ্যেই টিভি খুলে বসে গেলি? ইউনিফর্মটা পর্যন্ত গায়ে রয়ে গেছে, মা গো! এই দস্যি ছেলে, গেলি?”
ভুরু কুঁচকে ঘাড় বাঁকিয়ে একবার তাকাল অর্ক মা’র দিকে। তারপর গাল ফুলিয়ে ধীর পায়ে ও ঘরে চলে গেল। মা আবার গলা চড়িয়েছে, “হাত মুখ ধুয়ে আয় তাড়াতাড়ি। টেবিলে খাবার রাখছি। চুপচাপ খেয়ে নেবে, বুঝলে? আমি বাথরুমে গেলাম।”
অর্ক খেয়ে এসে এবার ড্রয়িং নিয়ে মেঝেতে নামল। এতক্ষণ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে প্রজাপতিদের জীবনচক্র দেখছিল হাঁ করে ও। একটা ডিম থেকে প্রথমে লার্ভা, তারপর পিউপার একটা পাতলা খোলস থেকে দারুণ রঙিন একটা প্রজাপতি কীভাবে জন্ম নেয় দেখে অবাক লাগছিল ওর। ওটাই এখন আঁকবে ড্রয়িং খাতায়। কাল স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের দেখাবে। সায়েন্স টিচার সুস্মিতা ম্যাডাম দেখলেও খুশি হবে।
আঁকতে আঁকতে একটা হাই তুলে খাতার ওপর উপুড় হয়ে পড়ল অর্ক। হাতের আসল কাজ করতে হবে এখন। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর একটা প্রজাপতি আঁকতে হবে। চার পাঁচটা রং দেবে ডানাগুলোতে কমপক্ষে। খুব যত্ন করে শেষ রঙটা ভরে চোখদুটো ফুটিয়ে দিতেই একেবারে অবাক কাণ্ড! নিজের চোখদুটোকেই বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। প্রজাপতিটা ফরফর করে পাতলা পাতলা ডানা দুলিয়ে অর্কর ড্রয়িং খাতাটাকে চক্কর কেটে উড়ে বেড়াচ্ছে। গোল গোল চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ও।
পাশে গড়াগড়ি খাওয়া রং পেনসিলটার গায়ে এসে বসে দুটো ডানা এক করে ওপরের দিকে তুলে রাখল প্রজাপতিটা। অর্কর দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসল যেন। বলল, “আমরা আজ থেকে বন্ধু হলাম অর্ক। চলো কোথাও বেড়িয়ে আসি, যাবে?”
অর্ক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে একদম। ওরই আঁকা একটা প্রজাপতি জ্যান্ত হয়ে গিয়ে ওর সাথেই কথা বলছে! এমনও হয়! অনেক কষ্টে স্বর বেরোল গলা দিয়ে, “আ-আমরা বন্ধু? কিন্তু... আগে তো কখনও...”
“দেখবে কী করে, তুমি তো আগে আর আঁকোনি কখনও আমাকে। চলো ঘুরে আসি। আমি আবার এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে পারি না,” প্রজাপতিটা তাড়া দিল।
অর্ক আমতা আমতা করে বলল, “কিন্তু মা, মা বাথরুমে। বেরিয়ে এলে বলে যাব।”
“ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে যে! তাছাড়া মাকে বললে মা যেতে দেবে?”
“তুমি তো আমার নাম জান দেখছি। তোমার নাম কী?” অর্ক এতক্ষণে অনেকটা সহজ হয়ে গেছে।
“আমার নাম? সে তুমি যা ইচ্ছে ডাকো। তবে জীববিজ্ঞানীরা একটা গালভরা নাম উপহার দিয়েছেন বটে, রোপ্যালোসেরা। তার সাথে আমাদের শ্রেণী বা পরিবার অনুযায়ী কিছু শব্দ যুক্ত হয়ে আসল নাম হয়। তুমি আমায় নয় তিতলি বলেই ডাকো, কেমন?”
“বাহ, দারুণ নাম তো!” হাততালি দিয়ে ওঠে অর্ক। হিন্দিতে প্রজাপতিকে তিতলি বলতে অনেক শুনেছে ও।
“নাও, তাড়াতাড়ি আমার পিঠে চড়ে বসো। মা বেরিয়ে আসার আগেই আবার রেখে যেতে হবে তো তোমায়!”
তিতলি দরজার বাইরে এসেই সাঁই সাঁই করে এই এত্ত বড় হয়ে গেল। অর্কও অবাক চোখে পিঠে চড়ে বসল তিতলির। উড়ে চলল মেঘের দেশে। তুলোর মতো বিশাল একখণ্ড মেঘ ভেদ করতে চলেছে ওরা। অর্ক চোখ বন্ধ করে আরও জোরে পিঠ আঁকড়ে ধরল তিতলির। এই মেঘের সাথে ধাক্কা লাগলে চুরমার হয়ে যাবে মাথা এক নিমেষেই। তিতলি উড়েই চলেছে। তিতলির কোনও ভয় ডর নেই। হঠাৎ নাকে মুখে একটা হিমেল পরশ পেতেই চোখ খুলল অর্ক। আরে! কী আশ্চর্য! এ যে ঘন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে উড়ে চলেছে সে। মেঘ কী তবে শক্ত কোনও জিনিস নয়, যেমনটা মাটি থেকে মনে হয়!
মেঘের দেশটা পেরোতেই একটা ঝলমলে নতুন দেশ আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল অর্ক। এ কোন দেশ! এত সুন্দর ফোয়ারা, এত সুন্দর গাছগাছালি, একরাশ দুধের ধারার মতো ঝর্ণা, কচি কচি চারাগাছে কী বাহারি ফুল! তিতলি যতই নিচে নামছে ততই আরও বেশি স্পষ্ট আর সুন্দর মনে হতে লাগল দেশটাকে। এ যে এক স্বপ্নের দেশ! রূপকথার দেশ!
“এই তোমার দেশ নাকি তিতলি? কী নাম এর?” খুশিতে ডগমগ হয়ে জিগ্যেস করল অর্ক।
“হ্যাঁ গো! রাঙামাটি। এখানে সব রাঙা, সব রঙিন। তোমাদের ওখানকার মতো কোনও দূষণই নেই এখানে। তবে সুখ আছে, দুঃখ আছে। আছে হাসি, আছে কান্না।”
ততক্ষণে আকাশ থেকে নেমে একটা নাম না জানা গাছের ছায়ায় বসেছে দুজনে। একটু জিরিয়ে নিয়ে তিতলি বলল, “চলো, তোমায় ঘুরেফিরে দেখাই আমাদের রাঙামাটির দেশটা। চলো চলো।”
“আচ্ছা তিতলি, ওই যে ডানদিকে গাছের ডালে শুয়ে আছে, ও এমন কেন?”
“আর বলো না, রোজ রোজ বেলায় বেলায় ডিম খেয়ে ওর চেহারা এখন ডিমের মতো হয়ে গেছে। ওকে কেউ আর এখন খেলায় নেয় না। খেলতে নেমে শুধুই হাঁপায়। তাই মনের দুঃখে একা একা শুয়ে থাকে,” তিতলি গোমড়া মুখে জবাব দিল।
“আর ও? ওই যে কাঠের তক্তায় শুয়ে আছে?”
তিতলি ঘাড় ফিরিয়ে বলল, “ও? আর বলো না। হাবিজাবি, চপ কাটলেট, চিপস চকোলেট হরদম খেয়ে সাংঘাতিক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ডাক্তার কবিরাজ কেউই সুস্থ করে তুলতে পারছে না।”
অর্কর খুব খারাপ লাগছিল কথাগুলো শুনতে। ওরা হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলল যেদিকে দু’চোখ যায়। যতই দেখছে ততই মুগ্ধ হয়ে পড়ছে অর্ক রাঙামাটির সৌন্দর্যে। ডানাগুলোয় কী সুন্দর হরেক রঙের বাহার নিয়ে এক একটা প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। তাছাড়া সাদা কালো লাল নীল কমলা হলুদ ছোটছোট ফুরফুরে প্রজাপতি তো আছেই। গা ঘেঁষে ঘেঁষে ওড়াউড়ি করছে এ গাছ থেকে ও গাছে। দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়।
খানিকটা এগোতেই ও দেখল এক ঝাঁক প্রজাপতি আনন্দে লাফাতে লাফাতে আসছে মাঝখানে কাকে রেখে যেন। অর্ক বিস্ময়ভরা চোখে তাকাতেই তিতলি বলে উঠল, “মাঝখানে যে দেখছ, ওর নাম লালি। খুব ভালো ছেলে আমাদের। পড়াশুনো বলো, খেলাধুলো বলো, আচার আচরণ বলো সবেতেই খুব ভালো। ও কক্ষনও বাবা মায়ের, গুরুজনদের অবাধ্য হয় না। মিথ্যে কথা বলে না। তাই সবাই ওকে খুব ভালবাসে, রোজই কেউ না কেউ কিছু না কিছু উপহার দেয়। আর সবাই মিলে আনন্দ করে।”
চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল অর্কর। ঘুরতে ঘুরতে একসময় তিতলির বাড়িতে এসে উপস্থিত হল দুইবন্ধু মিলে। ঠিক অর্কর আঁকার বইয়ের ছবিগুলোর মতো সুন্দর তিতলির বাড়িটা। ঘরে ঢুকতেই সবাই দৌড়ে এল। তিতলির মা খুব আদর করল অর্ককে। হঠাৎ ওর হাঁটুর দিকে চোখ পড়তেই জিগ্যেস করল, “ওমা, ওখানে কী হল আবার বাছা? কীভাবে ব্যথা পেলে?”
অর্ক মনে মনে লজ্জা পেয়ে গেল। বলল, “পা পিছলে পড়ে গিয়ে...”
কিন্তু স্কুলে বিশালের দামি পেনসিলটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে বিশালের ধাক্কায় স্কুলের বারান্দার রেলিংয়ে ঘষটে গিয়ে যে জায়গাটা নীল হয়ে গেছে সে কথা বেমালুম চেপে গেল ও। কথাটা বলেই মুখটা ঘুরিয়ে নিল ও। পাশ ফিরে তাকাতেই থ বনে গেল একেবারে। একটা প্রজাপতি ঠায় বসে আছে একটা চেয়ারে। সুন্দর রঙগুলো বিবর্ণ হতে হতে ডানাগুলো ছিঁড়ে যেতে শুরু করেছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সামনের বন্ধ টিভিটার দিকে। পায়ের কাছে রিমোটটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অর্কর চোখের চাউনি অনুসরণ করে তিতলি বলে উঠল, “আমার ভাই। ভীষণ জেদি আর দুষ্টু ছিল। যখন তখন টিভি খুলে বসে পড়ত বলে বাবা একদিন বকাঝকা করতেই রিমোটটা ছুঁড়ে ফেলে ভেঙে ফেলল। সেই থেকে এই চেয়ারেই আটকে আছে। কিছু খেতে পারে না, কোত্থাও যেতে পারে না। টিভিটাও নষ্ট হয়ে গেছে,” বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তিতলি।
তিতলি এবার তাড়া দিল। অর্ককে এবার রেখে আসতে হবে। কথায় কথায় অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। কিন্তু অর্কর কিছুতেই মন চাইছে না ফিরে যেতে। তিতলিরা শুধু একবার মুখ ফুটে বললেই থেকে যাবে ও। কিন্তু তিতলি এক কথার প্রজাপতি। কথা মতো অর্কর মা স্নান সেরে বেরনোর আগেই পৌঁছে দেবে অর্ককে। একটু গাল ফুলিয়ে থেকেও কী একটা কিছু মনে পড়তেই ফিক করে হেসে উঠল অর্ক। তিতলি মুচকি হেসে বলল, “ভাবছ, অনেকক্ষণ তো কেটে গেছে। ঘণ্টা তিনেক তো হবেই। মা কি আর বাথরুমে আছে এখনও? কোন কালে বেরিয়ে হয়তো এদিক ওদিক খুঁজছে তোমাকে। কিন্তু বন্ধু, না। মা এখনও বাথরুমেই আছে। তোমাদের দশ মিনিট মানে আমাদের দশ ঘণ্টার সমান। আমাদের জীবনকাল তোমাদের চেয়ে অনেক কম কিনা।”
অর্ক আশ্চর্য হয়ে তিতলিকে বলল, “তাই নাকি! তবে তো আরও কিছুক্ষণ... উম... উম...উম...”
কথাটা শেষ করার আগেই কে যেন হঠাৎ এক চামচ মধু না কী একটা ঠেসে দিল জোর করে অর্কর মুখে। আস্তে আস্তে চোখের পাতা ভারী হতে হতে গাঢ় ঘুমে ডুবে গেল ও। ঘুমের ঘোরটা অচিরেই এত ঘন হয়ে এল যে পিঠে কে যেন জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে বুঝতে পেরেও সাড়া দিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। সারা শরীরের শক্তি এক করেও কুলোচ্ছে না যেন।
শেষে ঝাঁঝালো আওয়াজটা আরও জোরালো হতেই ধড়মড় করে উঠে বসল অর্ক। সামনে আঁকার খাতাটা খোলা। ফ্যানের বাতাসে পাতার একটা কোণা উঠি উঠি করেও উঠতে পারছে না রং পেনসিলগুলো আর রবারের চাপে। চোখ কচলে দেখল মা সমানে বকেই চলেছে, “হে ভগবান! কী অদ্ভুত ছেলে রে তুই অর্ক, অ্যাঁ? এই ঠাণ্ডা টাইলে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিলি! আর হাঁটুটা নীল হয়ে আছে কেন? আজকে আবার স্কুলে... উফ, বাবা গো, এই বিচ্ছু ছেলে আমায় মেরে ফেলবে গো।”
মা মাত্র স্নান সেরে এসেছে। বেলিফুলের মতো মিষ্টি একটা গন্ধ বেরোচ্ছে গা থেকে। এই গন্ধটা খুব ভালবাসে অর্ক। সব মায়েরই একটা আলাদা গন্ধ থাকে। এই বেলিফুলের গন্ধটাই অর্কর মা মা গন্ধ। ঝপ করে মা’র কোমর জড়িয়ে ধরে পিঠে মাথা ফেলে অর্ক বলল, “আমি আর স্কুলে দুষ্টুমি করব না মা, রোজ দুবেলা ডিম খেতেও বায়না ধরব না। আর গলি দিয়ে ওই ড্রেনের নোংরা জল দিয়ে বানানো আইসক্রিমওয়ালা গেলে দৌড়ে যাব না। বেড়ালের ল্যাজের চুল দিয়ে তৈরি শোনপাপড়ির দিকে তো তাকাবোই না। হোম ওয়ার্ক মন দিয়ে করে ফেলব, জ্বালাবো না মা, সত্যি বলছি। শুধু মাঝে মাঝে তিতলি এলে বেড়াতে যাব একটু। তখন কিন্তু তুমি আমি না ফেরা পর্যন্ত বাথরুম থেকে বেরোবে না একদম। কেমন?”
হাত বাড়িয়ে পেছন থেকে টেনে এনে ছেলের মুখের দিকে খানিক হাঁ করে তাকিয়ে থেকে মা জিগ্যেস করল, “কে তিতলি? নতুন বন্ধু বুঝি?”
তারপর হঠাৎ খাতাটার দিকে চোখ যেতেই বলল, “আরে দেখি দেখি, খাসা এঁকেছিস তো প্রজাপতিটা সোনা।”
বলেই চুকুম করে চুমু খেল অর্কর মা ওর গালে। অর্ক হালকা গা মুচড়ে বলল, “আহ, ছাড়ো না! ইস, চোখদুটো আঁকতে ভুলে গেছি, দাঁড়াও।”
____________
ছবি- পিয়ালী বন্দোপাধ্যায়
লেখক পরিচিতি - ত্রিপুরার মন্দিরনগরী উদয়পুরে জন্ম। বেড়ে ওঠা এবং স্থিতি গোমতী জেলার কাকড়াবনে। পেশায় একজন ফার্মাসিউটিক্যাল ডিস্ট্রিবিউটর। নেশা, বই পড়া, সিনেমা দেখা আর কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় অনেকদিন ধরেই লেখালেখি করছেন।