আকন্দপুরের সেই রাত
সুদেব ভট্টাচার্য
১
সন্ধেটা যেন ঝুপ করেই নেমে গেল। অবশ্য গ্রামের দিকে সন্ধেটা তাড়াতাড়িই নামে। ভ্যানে করে আসবার পথেই চোখে পড়েছিল সারা রাস্তার দুই ধারে আকন্দ আর ঘেঁটু ফুলের বাড়-বাড়ন্ত। তাই হয়ত প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এ গ্রামের নাম কেউ রেখেছিল আকন্দপুর। গ্রামটার সেরকম কোনও পরিচিতি যে নেই তা বলাই বাহুল্য – একেবারে ধ্যাধধেড়ে গোবিন্দপুর। সারাদিনে মোট তিনটে ট্রেন আসা যাওয়া করে। আর তারপর একমাত্র ভরসা এই সাইকেল ভ্যান। এরকম একটা প্রত্যন্ত গ্রামের কথা কোথা থেকে যে জোটাল মল্লারদা কে জানে। অবশ্য এটাই প্রথমবার নয়। আগেও শুটিংয়ের লোকেশন দেখতে আমাদের বহুবার নানা জায়গায় যেতে হয়েছে। এটা আমাদের কাজের মধ্যেই পড়ে। আমরা মানে আমি আর সৌভিক। আমরা হলাম টলিউড-খ্যাত ডিরেক্টর মল্লার বসুর বাম এবং ডানহাত। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রতিবারই ওনার হুকুম মাথায় করে শুটিংয়ের লোকেশন দেখতে নেমে পড়ি।
আমাদের এবারের স্থল হল একটি প্রাচীন জমিদারবাড়ি। সেখানেই যাচ্ছিলাম আমরা দুই জগাই মাধাই মিলে। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আমাদের ভ্যান জমিদারবাড়িটার সামনে এসে থামল। পেল্লাই প্রাচীন এক অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা দুজনেই কেমন বেকুব বনে গেলাম। এ হেন অর্বাচীন আকন্দপুরে এরকম একটি ইমারত যেন বেখাপ্পাই শুধু নয়, অহৈতুকীও বটে। সারা গ্রামে এরকম দোতলা বাড়ি হাতে গুনে চার পাঁচটার বেশি নেই। ভ্যানওলাকে পয়সা মিটিয়ে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। আগে এককালে সিংহদুয়ারে প্রকাণ্ড গেট ছিল, এখন আর ওসবের বালাই নেই। উঠোন থেকেই আগাছা শুরু হয়েছে এবং প্রশ্রয় পেয়ে তা এখন ভিতরেও ঢুকতে শুরু করেছে। উঠোনে একটা পাথরের মেয়ে মুখভার করে কবে থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একসময় তার মুখ থেকে ফোয়ারা বেরোত হয়ত। এখন কালের নিয়মে কিছুই নেই আর। এই বাড়ির একমাত্র জীবিত শরিক বিদেশে চলে গেছেন বহুকাল আগে। তাঁর থেকেই পারমিশন করিয়ে শুটিংয়ের আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সামান্য কিছু আলো থাকতে থাকতেই আমরা বাড়ির পরিত্যক্ত ঘরগুলো দেখতে শুরু করলাম। সৌভিক নীচের ঘরগুলো দেখতে লাগল। আমি সটান সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে এলাম। দোতলাতে বারান্দার পাশে সারি বেঁধে মোট পাঁচটা ঘর। আলো হাওয়ার অভাবে প্রতিটাই প্রায় স্যাঁতস্যাঁতে। আবর্জনা, আগাছা, ধুলো আর মাকড়সার জাল ছাড়া ঘরগুলোর আর তেমন কোনও সম্বল অবশিষ্ট নেই। প্রতিটা ঘরই একই রকম ধাঁচে তৈরি আর একটুও বাসযোগ্য নয়। কিন্তু শেষের ঘরটার সামনে এসে আমাকে থামতেই হল। এই ঘরটি অন্যঘরগুলোর তুলনায় অনেক বড় এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলাম এই ঘরে তেমন ময়লাও নেই। বেশ পরিষ্কার, যেন সদ্য ব্যবহার করা হয়েছে। আমি ভিতরে ঢুকলাম। আমার মাথার ওপর একটা ভাঙা ঝাড়বাতি স্থির হয়ে রয়েছে। ঘরের দেওয়ালে অনেকগুলো প্রবীণ রাজার তৈলচিত্র রয়েছে। একটা তৈলচিত্রে আমার চোখদুটো আটকে গেল এসে। এটা একটা নারীর ছবি। নাচের কোনও বিশিষ্ট ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে। তার কপালে একটি সাপের মতো আকারের সিঁদুরের টিপ তার মুখটাকে আরও রহস্যময়ী করে তুলছে। তার কাজল-কালো চোখদুটি ভীষণরকম জীবন্ত, যেন এখুনি পট থেকে বেরিয়ে আসবে। আমি বেশ আশ্চর্য হলাম। এই ঘরটা কি তাহলে কেউ ব্যবহার করে? এরকম ঘরে আগে সাধারণত নাচগানের আসর বসত আর নরম গদিতে ঠেস দিয়ে গোলাপ শুঁকতে শুঁকতে জমিদাররা মজলিস করতেন। কিন্তু আমি তো জানতাম কেউই এই বাড়িতে আর থাকে না। অন্তত তেমনটাই বলা হয়েছিল আমাদের। আমি নীচে ছুটে গিয়ে সৌভিককে ব্যাপারটা জানাতে ও তেমন গুরুত্ব দিল না। ওর বক্তব্য, হয়তো কেউ ক’দিন আগে এসে থেকেছিল এই পরিত্যক্ত বাড়িটায়।
নীচের ঘরগুলোর তো আরও খারাপ অবস্থা। শ্যাওলা ধরে গেছে। কেন্নো আর আরশোলার ডিপো পুরো। আমরা ওপরের ঘরটাতেই রাত কাটাব ঠিক করলাম। আমাদের সঙ্গে বিস্কুট, মুড়ি, জল, টর্চ, মোম সবই আছে। একটা রাতের তো ব্যাপার মোটে। কোনওরকমে কেটে গেলে হয় ভালোয় ভালোয়। থাকার পক্ষে ওই শেষের ঘরটাই পারফেক্ট। ওটাকেই বেছে নিলাম। বেশি পরিষ্কারও করতে হবে না। আমরা ঘরটাকে সামান্য ঝাড়পোঁছ করে শতরঞ্চি বিছিয়ে নিলাম। দুটো মোমও জ্বালালাম। বাথরুমের বালাই নেই। রাতে প্রকৃতির ডাক পেলে নীচে নেমেই বাথরুম করতে হবে। মুড়ি বাতাসা চিবোতে চিবোতে আমি আর সৌভিক আমাদের এই বাড়িটা নিয়ে অবজারভেশনগুলো আলোচনা করতে লাগলাম।
কিন্তু এরকম পরিবেশে কতক্ষণ আর গল্প করা যায়। মোবাইলে টাওয়ারও নেই। সবে রাত ন’টা, অথচ বাইরে তাকালে মনে হচ্ছে যেন রাত একটা বেজে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইরে নিস্তব্ধতার সুর হয়ে একটানা ঝিঁঝিঁ ডেকেই চলেছে। কোথা থেকে পাগল করা হাসনুহানার গন্ধও নাকে আসছে। আমাদের দুজনের চোখ ঘুমে যেন বুজে আসতে লাগল।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। একটু পরেই সৌভিকের ডাকে আমি ধড়মড়িয়ে উঠলাম। বেচারা খুব হাঁপাচ্ছে।
“কি রে, কী হয়েছে?”
সৌভিক হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ভাই, নীচে বাথরুম করতে গেছিলাম। ওখানে আমি জঙ্গলের মধ্যে স্পষ্ট দেখলাম কিছু রয়েছে। আমাদের বাড়ির আশেপাশে কেউ আছে রে! জায়গাটা সুবিধের নয়।”
আমি বললাম, ‘‘কেন, কী দেখেছিস তুই? কোনও লোক এত রাতে এখানে কী করবে?’’
সৌভিক বলল, “না না, কোনও লোক নয়। ভাই তুই বিশ্বাস করবি না, আমি অন্য জিনিস দেখেছি! দেখলাম, গাছগুলোর আড়ালে কতগুলো জ্বলন্ত নীল চোখ আমাকে চেয়ে দেখছে। আর পরক্ষণেই সেগুলো মিলিয়ে গেল।”
“কীসব পাগলের মত বকছিস? তুই কি ভূতের গল্প খাড়া করার চেষ্টা করছিস?”
সৌভিক গুম মেরে গেল। শেষমেশ ওর মুখচোখের অবস্থা দেখে আমি বললাম, “ঠিক আছে দাঁড়া, আমি দেখে আসছি একবার। শান্তি তো?”
আমি একটা টর্চ নিয়ে নীচে গেলাম। জঙ্গলটার দিকে টর্চ মেরে দেখলাম কতগুলো আকন্দ, বাবলা আর বাঁশঝোপ শুধু ভূতের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফিরেই আসছিলাম, হঠাৎ একটা ঝুনঝুন আওয়াজ আমার কানে এসে লাগল এবং সেটা এল বাড়ির পেছনদিক থেকে। আওয়াজটা অনেকটা ভারী নূপুরের মতো শোনাল। শব্দটা লক্ষ্য করে আমি আলো ফেললাম। না, এবারেও কিছু নেই। শুধু জংলা ঝোপ। কিন্তু লক্ষ্য করলাম কয়েকটা ঝোপের পাতা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। এখনও অল্প অল্প ভাঙা আকন্দের ডালটা দোল খাচ্ছে। অথচ বিকেল থেকে একটুও হাওয়া দিচ্ছে না আজকে। খুবই মেঘলা আর গুমোট একটা পরিবেশ। চাঁদটাও ঢাকা পড়ে গেছে মেঘের আড়ালে। তবে কি কেউ ঝোপের মধ্যে দিয়ে এখুনি পালাল? তাই পাতাগুলো নড়ছে?
মনের মধ্যে একটা অজানা খটকা নিয়েই ওপরে উঠে এলাম। সৌভিক জেগেই রয়েছে। ওকে বললাম ব্যাপারটা। আমাদের দুজনেরই মনে হল জায়গাটা নিরাপদ নয়। তাই আজ রাতটা আমরা জেগেই কাটিয়ে দেবার প্ল্যান করলাম। এখন রাত প্রায় বারোটা। মোটামুটি ভোরের আলোটুকু ফোটার জন্য আমরা ঠায় জেগে রইলাম।
মিনিট পনেরো বাদে, হঠাৎ ছাদের ওপর ধুপধাপ শব্দ শোনা গেল। আমাদের এবারে বুক বেশ জোরে জোরেই ঢিবঢিব করছে। নীল চোখের মতো আলো, নূপুরের শব্দ, নোংরা পরিত্যক্ত রাজবাড়ির পরিষ্কার নাচঘর – এ সবই আমাদের মনে মানুষের থেকেও অন্য কিছুর ভয়টাই বাড়িয়ে তুলল। তবে কি সেই তৈলচিত্রের নর্তকীর অতৃপ্ত আত্মা আমাদের ওপর সর্বক্ষণ নজর রেখে চলেছে? আমি একবার তাকালাম ছবিটার দিকে। যে চোখ আমাকে বিকেলে মুগ্ধ করেছিল, এখন সেটাই মোমের আলোয় আরও রহস্যজনক মনে হতে লাগল। আমরা জড়সড় হয়ে বসে রইলাম। বুঝতে পারছিলাম না, আমাদের ছাদে যাওয়াটা ঠিক হবে কি না।
একটু পরেই আরও জোরে শব্দ হতে লাগল। এবারে পায়ের সঙ্গে নূপুরের শব্দটিও খুব জোরালোভাবে কানে আসছে। তারপর সব সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে আমাদের বুকে ছ্যাঁত করে ছ্যাঁকা দিল একটা নারীকন্ঠের অট্টহাসি। হ্যাঁ, আমরা দুজনেই স্পষ্ট শুনলাম সেই হাসি। সৌভিক দরদরিয়ে ঘামছে। ওর নাকি পূর্বে অতিমানুষিক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই ও জোর গলাতেই বলল, “এই বাড়িতে আর রাত কাটানো ঠিক হবে না।”
আমিও যে খুব সাহসী তা নয়, তবু ওপরটা একবার না দেখে বাড়িটা ত্যাগ করতে মন সায় দিল না যেন। আমি সৌভিককে কোনওমতে মানিয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। এক একটা সিঁড়ি পা টিপে টিপে উঠছি আর বুকের ঢিবঢিবানি যেন আরও বেড়ে চলেছে। প্রতিটা সেকেণ্ডেই জোরালো হচ্ছে নূপুরের আওয়াজ। শেষ সিঁড়িতে পৌঁছে ছাদের দরজা থেকে টর্চের আলো ফেলতেই মনে হল কেউ যেন দৌড়ে চলে গেল ছাদের গা লাগোয়া কৃষ্ণচূড়ার দিকে। তারপর সেই গাছের পাতায় অন্ধকারের মধ্যে যেন মিলিয়ে গেল। ডালটা এখনও কাঁপছে। এ কী দেখলাম? নিজের চোখকেই তো বিশ্বাস করতে পারছি না। ছাদে ঢুকব কিনা ভাবছি, এমন সময় একটা নারী ছায়ামূর্তি ছাদের দরজা জুড়ে দাঁড়াল। তার অনেকটা লম্বা খোলা চুলে তার মুখ ঢেকে গেছে প্রায় আর তার দু’পায়ে বাঁধা রয়েছে মল। আমাদের মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। সৌভিকের মুখ থেকে বেড়িয়ে এল, “ভূ... ভূ...”
তারপর ও সিঁড়ির ওপরেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
২
“আরে কী হল, কিছু করুন! আরে, ও দাদা।”
আমি চমকে উঠলাম। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি পুরো। ঘটনার আকস্মিকতায় মাথা কাজ করছে না। তবু মনে হল যেন সেই ছায়ামূর্তি নারীই যেন বলছে কথাগুলো আমাকে।
এবার আমার গায়ে ঠেলা মেরে সে বলল, “আরে দাদা, কী হল আপনার, অমন করে দেখছেন কী? আপনার বন্ধুটাকে ঘরে নিয়ে চলুন। ওনার মুখে চোখে জল দিতে হবে। আমি ভূত বা চোর নই।”
ভূত নয়? আমি এবার একটু স্থিত হয়েছি। তবু কী যে ঘটল কিছুই বুঝতে পারছি না। কিন্তু ওই নারীমূর্তির কথাগুলোই মেনে চলেছি যন্ত্রের মত। সৌভিককে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে এসে ওর মুখে জল দিলাম কয়েক ঝাপটা। এমন সময় কোথা থেকে একটা বাচ্চা মেয়েও এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের ঘরের দরজার সামনে। মহিলাকে দেখে সে গিয়ে তার পিছনে লুকিয়ে পড়ল। সৌভিকের পালস-বিট ঘোড়ার গাড়ির মত দৌড়চ্ছে। একটু পরে আবার “ভু... ভু...” করতে করতেই তার জ্ঞান ফিরল। ঘরে এক মহিলা আর বাচ্চাকে দেখে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।
মহিলাটি হেসে বললেন, “কিছু মনে করবেন না, আমার এত খারাপ লাগছে! আপনারা শুধু শুধু বড্ড ভয় পেয়ে গেছেন।”
আমি একটা হাসি বহু কষ্টে ঠোঁটে এনে বললাম, “ব্যাপারটা কি একটু খুলে বলবেন?”
মহিলা বললেন, “আমি পাশের বাড়িতেই থাকি। ঠিক এই জমিদারবাড়ির লাগোয়া।”
“কিন্তু এখানে তো কোনও বাড়ি দেখলাম না আসার পর!”
“আসলে আমাদের বাড়িটা এই বাড়িটার ঠিক পেছনে। তাই দেখা যায় না সামনে থেকে। আর ওদিকে বড় বড় কয়েকটা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া আছে, সেইজন্যেও ঢাকা পড়ে যায় বাড়িটা।”
“কিন্তু আপনি এত রাতে এখানে এলেন কী করে?”
মহিলা হেসে বললেন, “এই জমিদার বাড়ির এতটাই কাছে আমাদের ছাদের একটা অংশ যে আমরা প্রায়ই ছাদ টপকে এই ছাদে চলে আসি। ওই কৃষ্ণচূড়ার পেছনেই বাড়িদুটো প্রায় একে অন্যের সঙ্গে লাগোয়া। কাল সকালে ছাদে গেলেই দেখতে পাবেন। একটু আগেই তো আমার মেয়ে মিনি আপনার টর্চের আলো দেখে ওইভাবে ছাদ টপকে পালিয়েছিল।”
আমরা তো অবাক। একটু আগে তার জন্যেই পাতাগুলো নড়ছিল? আমাদের মুখের অবস্থা দেখে বাচ্চা মেয়েটাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
মহিলা আবার বললেন, “আসলে আমার শ্বশুরবাড়িতে কেউ নাচ পছন্দ করেন না। কিন্তু এদিকে নাচ হল আমার জীবন। শহর থেকে এই অজপাড়াগাঁয়ে বিয়ে হয়ে আসার যন্ত্রণা পদে পদে বুঝতে পারছি। তবে আমারও জেদ চেপে বসল যে আমি নাচ ছাড়ব না এবং আমার মেয়েকেও তা শেখাব। তাই সারাদিনের কাজ, পড়াশুনা, খাবার-দাবারের পর আমি আমার মেয়েকে এই বাড়িতে নিয়ে আসি। এইখানে এই ঘরটা পরিষ্কার করে আমরা দুজনেই এভাবে নাচি, আমি ওকে তালিম দিই। তারপর আবার ছাদ টপকে ফিরে যাই।”
তারপর তিনি ওই নর্তকীর তৈলচিত্রটা দেখিয়ে বললেন, “ওই যে ছবিটা দেখছেন, ওটি কিন্তু এই রাজবাড়ির সম্পত্তি নয়। আর উনি কোনও রাজনর্তকীও নন। উনি হলেন আমার নৃত্যগুরু। উনিই আমার রক্তে নাচের বীজ বুনে দিয়েছেন। এই বছর দশেক হল উনি মারা গেছেন। তাই কলকাতা থেকে ওনার চিত্র আঁকিয়ে এখানে টাঙিয়ে রেখেছি। এই নির্জন পরিত্যক্ত নাচঘরটাই এখন আমার মন্দির বলতে পারেন। আর উনি আমার দেবতা।”
আমাদের কাছে এখনও সব অবিশ্বাস্য ঠেকছে। এরকমও হয় নাকি? তবে সৌভিকের মুখটা দেখে আমার সেই অবস্থাতেও হাসি আটকানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছিল।
মহিলা বলতে লাগলেন, “একটু আগে আমার মেয়ে নীচের বাগানে আপনাকে লুকিয়ে দেখেছিল। বাইরের লোক দেখলে ও খুব লজ্জা পেয়ে যায়। তাই দেখতে পেয়ে ছুটে এসে আমাকে বলে যে আমাদের নাচের ঘরটাতে আপনারা এসে উঠেছেন। আমিও আপনাদের বিরক্ত করব না ভেবে আজকে ছাদেই ওকে নাচ শেখাচ্ছিলাম।”
এবারে বুঝলাম কেন নীচের বাগানের ডালগুলো নড়ছিল। মিনি নামক ওই ছোট্ট ডানপিটে মেয়েটার সাহসের কাছে আমার সমস্ত বীরত্ব যেন গ্যাসবেলুনের মতো ফুস হয়ে গেল।
এবারে সৌভিক বলে উঠল, “কিন্তু ওই যে নীল চোখের আলো? আমি তো নিজের চোখে স্পষ্ট দেখেছি।”
মহিলা এবারে খিলখিলিয়ে হেসেই উঠলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “ওহো! ওটা কিছু নয় ভাই, আলেয়া। ওদিকটায় একটা বাঁশঝাড় রয়েছে। কিছুদিন আগেই বর্ষা গেল তো, তাই পাতা পচে বাঁশবাগানে অনেক জৈব গ্যাস তৈরি হয়েছে। সেই আলেয়ার দপদপানিকে তুমি ভূতের চোখ বলে ভেবে বসলে নাকি?”
আমি বললাম, ‘‘ও ওইরকমই। আমাদের জন্য আপনারও নাচের ক্ষতি হয়ে গেল। আসলে এরকম অভিজ্ঞতা আগে হয়নি তো।”
মহিলা বললেন, “না না, একদম ভাববেন না এই নিয়ে। আচ্ছা, আমি এখন উঠি। অনেক রাত হল। মিনির বাবা আবার চিন্তা করবে। কালকে একবার আসুন না সকালে আমাদের বাড়িতে। একটু চা খাওয়া যাবে সবাই মিলে। কী বলেন?”
আমি বললাম, “নিশ্চয়ই যাব। নমস্কার।”
মহিলা আমাদের বিদায় জানিয়ে আবার ছাদে চলে গেলেন। হয়ত যেভাবে এসেছিলেন সেই অভিনব উপায়েই ফিরে গেলেন ছোট্ট মিনিকে নিয়ে। আমি আর সৌভিক এবার নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমের ব্যবস্থা করতে লাগলাম। তবে ঘুম কি আর সহজে আসে? এই অজপাড়াগাঁয়ে এক মহিলার অসামান্য জেদ আর তার শিল্পের প্রতি ভালবাসা আমার মনটাকে এক অজানা তৃপ্তিতে ভরিয়ে তুলল। শুয়ে শুয়ে শুধু তাকিয়ে রইলাম তৈলচিত্রটার দিকে। কেন জানি না, আগের সেই ভয় চলে গিয়ে পুরনো মুগ্ধতা আবার আমাকে গ্রাস করল। আবার ভালো লাগতে লাগল সেই কাজল-কালো চোখ। অদ্ভুত সুন্দর সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চোখ বুজে এল একসময়। মনে মনেই গুরু-শিষ্যের প্রতি আমার মনের সবটুকু শ্রদ্ধা উজাড় করে দিলাম।
________________
ছবি - লেখক
No comments:
Post a Comment