একটু ভাবি (এপ্রিল) - তন্ময় বিশ্বাস


একটু ভাবি
তন্ময় বিশ্বাস

প্রত্যেকটা বাড়িতেই একটা গন্ধ থাকে গন্ধটা বাড়ির না বাড়ির মানুষের, সেটা বলতে পারব না কিন্তু দেখবেন থাকে ঠিক সেই বাড়িতে ঠিক ওই গন্ধটা এসে নাকে চাবুক মারে প্রথমে একটু অস্বস্তি হয়, তারপর সয়ে যায় তবে এই বারোতলার দুশো স্কোয়ার ফুটের গন্ধটা আমার তেমন সহ্য হয় না গন্ধটাও বিদঘুটে টাইপ কেমন একটা শ্যাওলা আর তেজপাতার মেশানো গন্ধ বেশ ধক! তা এই তেজি-শ্যাওলাকে একটু সামলে-সুমলে নিলে প্রথমেই চোখে পড়বে বেশ ছিমছাম একটা ঘর ওপরে একটা এলিডি বাল্ব আর তার পাশে একটা উদাসী টিকটিকি আর নিচে ছোট্ট একটা ছায়া তিন কী চার বয়স হবে গলায় একটা ওয়াটার বোতল ঝুলিয়ে ঘরময় 'বুউউউউউউ....' করে বেড়াচ্ছে ইনি কাল প্রথম স্কুল যাবেন তাই এখন প্র্যাকটিস চলছে প্রথম স্কুলে যাওয়ার ঠিক আগের দিনটা এমনিই হয় উৎসাহ টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি স্কুলে যাওয়া অবধি একদম ওক্কে! তারপর ক্লাসে ঢুকে হঠাৎ করে মা মা গন্ধটা একটু কেটে যেতেই শুরু হয়ে যায়! একদম চার্জ  ছাড়া নোকিয়া ব্যাটারি সবাই যে বাড়ির জন্য মন কেমন বা খুব একটা কারণে কাঁদে তা নয় ব্যাপারটা অনেকটা চেন রিয়াকশনের মত একটা খালি স্টার্টার দরকার তারপর এই সব মক্কেলরাই ক্লাস সিক্স-সেভেনে গিয়ে রচনা লিখবে 'স্কুলে আমার প্রথম দিন' - "ক্লাসে ঢুকে আমি প্রচণ্ড আনন্দ পেয়েছিলাম। মাস্টার দিদিমণিরা খুব ভালো ছিলও। তবে ক্লাসের বাকি সবাই খুব কাঁদছিল বোকার মত। আমি কাঁদিনি। এত আনন্দে কেউ কাঁদে নাকি!"
'চিকুউউ, দাঁড়া এদিকে আয়।'
ওয়াটার বোতলের নাচ থেমে গেল। চিকুর মা কী একটা জিনিস পরিয়ে দিল চিকুর গলায়।
'এতা কী মা?’
'এটা? এটা হচ্ছে মুন স্টোন!'
'মুন স্তোন!’
দুধের দাঁতে কথাগুলো পিছলে যায়।
'হ্যাঁ তো। চাঁদমামা দিয়েছে। চিকুকে সায়েন্টিস্ট হতে হবে তো। এটা গলা থেকে খুলবে না কিন্তু। প্রমিস?’
চিকু মায়ের মুখে একটা ছোট্ট থাবা দিয়ে বলে 'প্রমিচ।'
দুজনেই রিনরিনে গলায় হেসে ওঠে। কোনও কারণ নেই, এমনি। বা হয়তো আছে।

আমি শুধু সোফার মধ্যে বহিরাগত হয়ে মিশে থাকি। বলতে বলতে হাঁপিয়ে গিয়ে চুপ করে থাকি। পৃথিবীতে অবিশ্বাসীদের জায়গা বড্ড কম! পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর জিনিসগুলোর মধ্যে একটা মা ছেলের হাসি মুখ। ভালোবাসা। যেখানে ভালোবাসা হয়ে মিশে থাকে স্নেহ, মমতা, শাসন, দায়িত্ব আরও অনেক কিছু। কিন্তু এখানে? একটু আগের তুচ্ছ-দামী ঘটনাটায় কি ভালোবাসা ছাড়া, আর কিছু ছিল না? ছিলও। অন্ধকার। আলোর ওপিঠের কালো অন্ধকার। ভালো বাংলায় যাকে বলে অন্ধবিশ্বাস।
       ওই যে চিকুর গলায় লাল কার থেকে ঝুলছে? পরলেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সায়েন্টিস্ট! আচ্ছা আমাদের শিক্ষাটা কি শুধু হাতে কলমে? শুধু পরীক্ষার খাতায়? চাকরির ইন্টার্ভিউ তে! নইলে ২০১৬তে  বসে একজন শিক্ষিত মা, তার শিক্ষিত করতে চাওয়া ছেলেকে কীভাবে বিশ্বাস করায়,  যে একটা পাথর গলায় পরলেই তোমার ভাগ্য একদম ইসপার টু উসপার হয়ে যাবে। তুমি স্টেশনে দাঁড়িয়ে ঝাল লজেন্স, সেফটিপিন বেচতে তার বদলে প্লেনে করে ফরেন ট্রিপে যাবে! এখানে চিকু একা বিক্ষিপ্ত নয়। চিকু একটা সংখ্যা মাত্র। আরও বিশাল সংখ্যায় এমন হচ্ছে। এমন হয়। আচ্ছা চিকুরা তো পড়াশুনা করবে। বড় হবে। 'প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান' লিখতে গিয়ে উপসংহার দেবে - 'বিশ্বের শুরুর কথা অজ্ঞান আর শেষের কথা বিজ্ঞান' তখন কি চিকু গলার চাঁদমামাকে ছুড়ে ফেলতে পারবে? ৯০% উত্তর হচ্ছে পারবে না। শিরদাঁড়া কটা জন্মায়? খুব কম। এক আধটা। এক আধবার! নির্লজ্জের মত আট আঙুলে আংটি গলিয়ে ফিজিক্স ক্লাস নেবে। আর নিউক্লিয়ার রিয়াক্টারের ষষ্ঠী পুজো করবে।
মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে, ক্যালেন্ডারের ২০১৬ আগে একটা মাইনাস (-) চিহ্ন দিয়ে দি। কি লাভ লোককে বলে? যে প্রত্যেক বছর আমরা একটা করে সংখ্যা এগোচ্ছি। এগোয় শুধু চারপাশটা, পিঠটা সেই অন্ধকারেই ঠেকে থাকে। সেই যুগেও জ্যোতিষীর দল ছক কেটে মানুষের ভাগ্য, দুর্ভাগ্য সব দেগে দিত আর এখন দাগছে ল্যাপটপের কি বোর্ড চালিয়ে। ফারাক নেই। শুধু ভণ্ডামি গুলোর ওপর কয়েক পোঁচ বিজ্ঞান দিয়ে গরমা গরম ছাড়ো। 'হনুমান ম্যাগনিফাইং যন্ত্র', 'মনসা কার্বলিক যন্ত্রম' একেবারে লিভার ড্রাই করে দেওয়া সব নাম!
আমি স্বভাবে কিছুটা তর্কবাজ (ইচ্ছে হলে এঁড়ে তর্ক বলতে পারেন) এক চান্সে কিছু মেনে নেওয়ায় আমার যথেষ্ট অ্যালার্জি। তা এই মাদুলি বাবা বা মাদুলি ধারণে ধন্য সন্তানদের সাথে আমার তর্ক লাগাটা বেশ পুরনো ব্যাপার। একটা খুব কমন জিনিস দেখেছি, এদের একটা বড় অংশেরই বিশ্বাস জন্মায় বাবার নানান অলৌকিক ক্ষমতা দেখে। যেমন জীবন্ত সমাধি, হাওয়ায় ভাসা, বা হাওয়া থেকে প্রসাদ বানানো।  পি. সি. সরকার যখন হাওয়ায় ভাসার খেলা দেখান, যখন কাগজ কেটে টাকা বানিয়ে ফেলেন, চোখ বেঁধে গড় গড় করে বোর্ডে লিখে যান, তখন? কই তখন তো তাকে ওপর ওয়ালার স্পেশাল বরপুত্র ভেবে বসেন না। কেন ভাবেন না? না উনি ম্যাজিক দেখানোর সময় বলেই দেন এতে মন্ত্র-তন্ত্র নেই, সবই বিজ্ঞান। ট্রিকস। একজ্যাক্টলি ট্রিকস! আপনার 'শ্রদ্ধেয়' মাদুলি বাবাও ঠিক তাই দেখাচ্ছে আপনাকে। ফারাকটা শুধু ভণ্ডামি তে। সে ওই মেঘের ওপারে থাকা কোনও একজনের নামে আপনাকে টুপি পড়াচ্ছে। একবার আমি এক জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিলাম। ভুল বললাম। আমার মাতৃ দেবীর পাল্লায় পড়ে বেশ কয়েকবার যেতে হয়েছে। তা সেই মক্কেল আমার হাত দেখে, ল্যাপটপের কি গুলোর আয়ু আরও কিছুটা কমিয়ে দিয়ে, যা যা বলল, সেটা অনেকটা এরকম - "আমি ছেলে ভালো। মাথা পরিষ্কার, মন পরিষ্কার। কিন্তু, এখন খুব সমস্যায় আছি। রেজাল্ট  খারাপ হচ্ছে। তবে চিন্তার কোনও কারণ নেই। একটা পাঁচরতির............." আমি শুধু মুখ ঘুরিয়ে নি। ওপরে ফ্যানের শব্দ আর মায়ের বড় হতে থাকা চোখের তলায় ধীরে ধীরে ভাসতে থাকে পাঁচ রতির গপ্প। পাঁচরতির ভণ্ডামি। আচ্ছা, এই কথাগুলো বলা কি খুব বেশি কঠিন? এত তো ডিটেকটিভ গল্প পড়েন। ফেলু-শার্লক গুলে খান। তাহলে? আপনিই বলুন না, সমস্যায় না পড়লে কোন ব্যাটা জ্যোতিষীর কাছে গল্প গুজব করতে যায়? এই বয়সের একটা ছেলের সমস্যা মানেই সেটা পড়াশুনা সংক্রান্ত, রেজাল্টে আক্রান্ত! আর মাদের একটা ধর্মই হল, কিছুটা অন্ধ হওয়া। 'ছেলে ভালো, মাথা পরিষ্কার' এই কথাগুলো পাঁচবার মাধ্যমিক ফেল করা ছেলের মা-কে গিয়ে বলুন। দেখবেন খুশি মনে মেনে নেবে। বেশি দরকার নেই। একটু শুধু চোখটা খোলা রেখে ভাবুন। পৃথিবীর মরচে ধরা অন্ধকার গুলোকে বাঁচিয়ে রাখার মধ্যে কোনও মাহাতাব নেই। আলোটা নিতে শিখুন।
পৃথিবীটা যখন আরও একটু অন্ধকার ছিল, সময় যখন আরও একটু নতুন ছিল সেই সময় যারা বলেছিল 'পৃথিবী স্থির নয়, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে' তাদের কাউকে জ্যান্ত কুশপুতুল হয়ে পুড়তে হয়েছিল, কাউকে হতে হয়েছিল অন্ধ। কিন্তু, তাতে সত্যি বদলায় নি। সত্যি বদলায় না। মিথ্যের আড়ালে মাঝে মাঝে চাপা পড়ে মাত্র।

সুনীল বাবু তার 'সর্বহারা অবিশ্বাসী' কবিতায় বলে গেছেন
"সবাই বিশ্বাসী, বিশ্বাসী, বিশ্বাসী.......
এক-একবার ভাঙা গলায় বলতে ইচ্ছে করে
অবিশ্বাসীর দল জাগো
দুনিয়ার সর্বহারা অবিশ্বাসীরা এক হও!"Top of FormBottom of Form
________
ছবি - লেখক

2 comments:

  1. খুব ভালো আর দরকারি লেখা। লেখককে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ লাগল পড়ে। অন্ধ বিশ্বাসগুলোর বিরুদ্ধে আমিও লড়ি সাধ্যমত। তাই আরও ভাল লাগল। লেখাটা পড়াব আরও কিছু মানুষকে। লেখকের সঙ্গে পরিচিত হতে পারলে ভাল লাগত।

    ReplyDelete