গল্পের ম্যাজিক:: কাল সমুদ্রের যাত্রী - পুষ্পেন মণ্ডল


কাল সমুদ্রের যাত্রী
পুষ্পেন মণ্ডল

‘স্কাইপি’টা চালু করে পিউ বলল, “নাও, এবারে শুরু করো। আমরা রেডি।”
পাশ থেকে রন্টি উঁকি মেরে বলল, “আগের দিনেরটা কিন্তু ঠিক জমেনি।”
এই হয়েছে সমস্যা। আজকালকার বাচ্চাগুলোর আইকিউ এত বেশি যে সামান্য উনিশ বিশ হলেই না পসন্দ। আর আমিও পড়েছি জাঁতাকলে। বাড়ি থেকে যত দূরেই থাকি না কেন, হাইস্পিড ইন্টারনেটের যুগে কোনও নিস্তার নেই। ছুটির দিনে নিয়ম করে ভাইপো ভাইঝিদের গল্প শোনাও। তাও জমাটি প্লট না থাকলে এখন আর রিস্ক নিই না। বলে দিই কাজের ভীষণ চাপ, আজকে হবে না। কিন্তু এই একই অজুহাতও তো আর খুব বেশিদিন চলে না। হাতে একটা ডায়রি নিয়ে বললাম, “আজকে একটা অদ্ভুত জাহাজডুবির গল্প বলব।”
জাহাজডুবির কথা শুনে ওরা চোখ বড় বড় করে বলল, “টাইটানিকের মতো?”
“না, টাইটানিক ছিল যাত্রীবাহী জাহাজ। আর আমি যে ঘটনাটা বলব সেটা কার্গো অর্থাৎ মালবাহী জাহাজ।” বলে আমি শুরু করলাম, “মাস ছয়েক আগে চেন্নাইয়ের এক খবরের কাগজের ভিতরের পাতায় একটা ছোট্ট নিউজ বেরিয়েছিল আর. আর. চোলামন্ডালমনামে একটি ভারতীয় মালবাহী জাহাজ ভারত মহাসাগরে সামুদ্রিক সাইক্লোনের কবলে পড়ে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা জীবিত উদ্ধার হয়েছিল মাত্র একজন তার নাম সিন্ধুনীল দাস। খবরটায় চোখ পড়তেই মনে পড়ল আমার ছোটবেলার সহপাঠী সিন্ধুনীল দাসও তো জাহাজের কাজ করত। যদিও বহুদিন তার সাথে কোনও যোগাযোগ নেই অন্যান্য বন্ধুদের মতফেসবুকবাহোয়াটস অ্যাপ-এ সে আসত না কলকাতায় তাদের পুরনো পাড়ায় অরিজিৎ থাকে তাকে ফোনে জিজ্ঞাসা করতে সে খোঁজখবর করে জানাল যে সেই ডুবে যাওয়া জাহাজের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি নাকি আমাদেরই বন্ধু সিন্ধুনীল কিন্তু সে এখন কোনও এক মানসিক হসপিটালে ভর্তি কারণ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার ভয়ঙ্কর স্মৃতি তাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে সে নাকি এখন কাউকেই চিনতে পারে না তার বাবা মা আগেই গত হয়েছেন বাড়ির অন্য লোকের সাথে কোনও যোগাযোগ নেই
যাই হোক, এই মর্মান্তিক ঘটনার বেশ কয়েকমাস পরে একদিন চেন্নাইয়ের রাস্তায় হঠাৎ সিন্ধুনীলের সাথে দেখা মুখে একরাশ কাঁচাপাকা দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে চলেছে এত বছর পরে হঠাৎ করে দেখে আমার তাকে কোনওমতেই চেনা সম্ভব ছিল না, যদি না সে আমার সামনে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেত আর আমি তাকে তুলতে যেতাম ঘটনাটা একেবারেই কাকতালীয় কিন্তু কাছ থেকে তার মুখটা দেখেই আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল নাম ধরে ডাকতে সে আমার দিকে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ তারপর হন্তদন্ত হয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল আমিও কাজের তাড়ায় ছিলাম, তার পিছনে ধাওয়া করার ইচ্ছা থাকলেও সেটা হল না
কলকাতা ছেড়ে আমি তখন বেশ কিছুদিনের জন্য চেন্নাইয়েই আস্তানা গেড়েছি, আমার কাজের জন্য বন্ধুবান্ধব খুব বেশি জোটেনি ছুটির দিনগুলোতে কোনও কাজ না থাকায় ওদের কোম্পানিতে খোঁজখবর করে শেষে সিন্ধুনীলের চেন্নাইয়ের বাসার ঠিকানাটা জোগাড় করলাম তারপর একদিন হাজির হলাম সেখানে কিন্তু হতাশ হলাম দেখে বাইরে থেকে তালাবন্ধ বাড়িওয়ালা জানালেন, কখন সে ঘরে থাকে, আর কখন বাইরে, তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই আমি কী ভেবে পকেট থেকে আমার একটানেম কার্ডবের করে তাঁকে দিয়ে বললাম, যদি এর মধ্যে তার সাথে দেখা হয় তাহলে বলবেন এই ঠিকানায় যোগাযোগ করতে আমি তার ছোটবেলার বন্ধু
এই ঘটনার প্রায় মাসখানেক পরে আমার ঠিকানায় এসে পৌঁছাল একটা চিঠি আমাকে সম্বোধন করে ইংরাজিতে লেখা পড়ে দেখলাম, সেই বাড়িওয়ালা লিখেছেন, আপনার বন্ধুর এতদিন ধরে কোনও খোঁজখবর না পাওয়ার কারণে ঘরটি খালি করে দেওয়া হল যা কিছু জিনিসপত্র ছিল, এক সপ্তাহ রেখে দেওয়া হবে এর মধ্যে সেগুলো না নিয়ে গেলে কর্পোরেশনের আবর্জনায় স্থান পাবে পরের ছুটির দিনেই গিয়ে হাজির হলাম সেখানে জামাকাপড় আর কাগজপত্রের মধ্যে একটা ডায়েরি পেয়েছিলাম সেই ডায়েরিটা আমি তোদের পড়ে শোনাব বিশ্বাস করা বা না করা তোদের ব্যাপার
দেখলাম এতটা শুনে ওরা দুজনেই নড়েচড়ে বসেছে। আমি ডায়েরিটা খুলে পড়তে শুরু করলাম
আগের ডায়েরিগুলো মহাসমুদ্রে তলিয়ে গেছে তাতে আমার রোজনামচা লেখা থাকত অনেক কাজের ফাঁকে তখন ডায়েরি লেখাটা একটা অভ্যাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সাহিত্য বা লেখালিখির চর্চা আগে কোনও কালেই আমার ছিল না মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ে কলেজে আমার দু’একজন বন্ধু ছিল যারা কবিতা লিখত আমার কোনওদিন ওসব আসেনি বহু বছর পর ছন্দবিহীন জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে আমার এই ডায়েরি লেখা যারা সমতলে বাস করে তারা কখনওই কল্পনা করতে পারবে না যে যারা মাসের পর মাস জলে ভেসে বেড়ায় তাদের মানসিক অবস্থা কেমন হয় বছরে একবার হয়ত ছুটি মেলে অনেক সময়ে তাও নয় তবে সারা পৃথিবী ঘোরা যায় কত শহর দেখা যায়, অনেক মানুষের সাথে মেশা যায় জাহাজ যে ক’দিন বন্দরে নোঙর করে থাকে, তার মধ্যে কিছুটা সময় পেলেই আমরা শহর দেখে নিই তা সেই সাধারণ ডায়েরিগুলোর সলিল সমাধি হওয়ায় এত দুঃখের কিছু ছিল না, যদি না আমার জীবনে এরকম অদ্ভুত একটা ঘটনা না ঘটত। তাই শুরু থেকে আবার একবার গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করছি। জানি না শেষ পর্যন্ত সব কিছু ঠিকঠাক বোঝাতে পারব কিনা!

**************

আমাদের জাহাজ তখন বালি দ্বীপের শহর ডেনপাসারেরবেনোয়াবন্দরে নোঙর করেছে এখানে মাল নামানো হচ্ছে। তারপর খালি জাহাজ এখান থেকে চেন্নাই যাবে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার যাত্রাপথ সময় লাগবে আনুমানিক এক সপ্তাহ আমাদের এই মাঝারি মাপের কার্গো জাহাজকে বলে প্যানাম্যাক্স এর দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ন’শো ফুট, বড় বড় কন্টেনারে ভর্তি কোম্পানির অর্ডার অনুযায়ী পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের বন্দরে গিয়ে হাজির হতে হয় তারপর মাল নিয়ে আবার ভেসে পড়া হাজার হাজার মাইল দূরে অন্য কোনও বন্দরের উদ্দেশ্যে
আমাদের ক্যাপ্টেন মিঃ রমেশ রেড্ডি তামিলনাড়ুর লোক আমার সাথে সম্পর্ক খুবই ভালএমনিতে তিনি খুবই ভদ্র এবং বিনয়ী মানুষ কিন্তু আজকে তাঁর যে চেহারা দেখেছি তা ভোলার নয় সকালে ফাঁকা সময় পেতেই বললেন, “চলো দাস, একটু শহরটা দেখে আসি
আমিও উৎসাহ নিয়ে তাঁর সাথে বেরিয়ে পড়লাম
বেনোয়াবন্দর থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমরা শহর দেখতে বের হলাম বালি হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার একটা ছোট দ্বীপ একে বলা হয়আইল্যান্ড অফ গড’, মানে ঈশ্বরের দ্বীপ এখানের প্রতিটা জিনিসই যেন অভিজ্ঞ শিল্পীর হাতে তৈরি সমুদ্র, পাহাড়, নদী, সবুজ গাছপালা, সব মিলেমিশে এক নৈসর্গিক দৃশ্য আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, পাথরের তৈরি প্রায় হাজার বছরের পুরনো কারুকার্যমণ্ডিত বহু হিন্দুমন্দির রয়েছে এখানে ছোটবেলায় ইতিহাস বইতে পড়েছিলাম, বাংলার আর দাক্ষিণাত্যের রাজারা দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার ফিলিপিন্স পর্যন্ত সমুদ্রপথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আসত
ক্যাপ্টেন বললেন, “মূলত চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র চোলের আমলে মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ, জাভা, সুমাত্রা, বালি, সব জায়গায় ভারতীয় উপনিবেশ ছিল তাঁর সেনাপতিরা বিশাল বড় নৌবহর নিয়ে এসে এইসব রাজাদের বশ্যতা স্বীকার করাতেন আমরা জানি ইংরেজরা আমাদের দেশ থেকে বহু ধনরত্ন লুঠ করে নিয়ে গেছে কিন্তু আজ থেকে হাজার বছর আগে ভারতীয় রাজারা এইসব উপনিবেশ থেকেও লুঠতরাজ কম করেনি অবশ্য শুধু নিয়ে যায়নি, দিয়েও গেছে অনেক কিছু ধর্ম, সংস্কৃতি, শিল্প, ভাস্কর্য এখানে যা কিছু দেখছ তার অনেকটাই আমাদের দেশের
প্রথমে আমরা গেলাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে বালিবাসির শৌর্যের প্রতীকবজ্রসন্ধি মনুমেন্টদেখতে তারপর কুড়ি কিলোমিটার দূরে সমুদ্রের তীরে এক মন্দিরে, নামটানাহ লট টেম্পল মিঃ রেড্ডি বললেন, “এই জায়গাগুলো আমার আগে ঘোরা।”
দেখলাম অদ্ভুত সুন্দর এক মন্দির দূর থেকে মনে হবে জলের উপরে ভাসছে ক্যাপ্টেন জানালেন, ষোলশ শতাব্দীতেডাং ইয়াং নিরারথাএই মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন মন্দিরের গায়ে ক্রমাগত সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে রাশি রাশি সাদা ফেনা আর নোনা জল ছিটিয়ে দিচ্ছে চারিদিকে তবু এত শো বছর ধরে কী করে দাঁড়িয়ে আছে সেটাই আশ্চর্য সবুজ শেওলায় মোড়া কালো পাথরের এই অপূর্ব ভাস্কর্য থেকে চোখ সরানো মুশকিল আমি তন্ময় হয়ে দেখছি আর ক্যামেরায় যত পারি ছবি তুলে নিচ্ছি
“গুড আফতারনুন স্যারপেছন থেকে ডাক শুনে ঘুরে দেখি এক স্থানীয় বয়স্ক মহিলা হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরাজিতে তিনি বললেন, “আমার কাছে কিছু পুরনো মুদ্রা, মূর্তি, পাথর এসব আছে আপনারা কি দেখবেন?”
আমার দেখার ইচ্ছা ছিল কিন্তু মিঃ রেড্ডি বললেন, “না, ধন্যবাদ, ওসব জিনিসে আমাদের কোনও আগ্রহ নেইতারপর আমাকে বললেন, “চলো, আমরা সমুদ্রের ধার থেকে একটু ঘুরে আসি
আগ্নেয় শিলায় তৈরি পাহাড় খাঁজে খাঁজে উঠে গেছে সমুদ্রতট থেকে সেই খাঁজেই গজিয়ে উঠেছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য এখানে ছোট বানরের সংখ্যা চোখে পড়ার মত আর আছে প্রচুর সাদাবালি ময়না’, এদের চোখের পাশে আর লেজের শেষে কালো ছোপ
লক্ষ্য করলাম সেই মহিলা আমাদের পিছু পিছু আবার আসছেন স্যার, আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে ভারতীয় আমার কাছে প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রা আর ভগবানের মূর্তি রয়েছে আপনারা চাইলে একবার দেখে যেতে পারেন
“আপনাকে তো বললাম আমাদের এই ব্যাপারে কোনও আগ্রহ নেই কেন আমাদের পিছু নিয়েছেন? বেশি বিরক্ত করলে আমরা কিন্তু পুলিশে কমপ্লেন করবমিঃ রেড্ডি একটু কড়া করে ধমক দিতে মহিলা মাথা নিচু করে চলে গেলেন আমার মন বলছিল, ওনার কথা শুনে একবার জিনিসগুলো দেখে নিলেই হত কেনা না কেনা তো আমাদের কাছে মহিলাকে দেখে অভাবী বলেই মনে হয় তাছাড়া মিঃ রেড্ডির এই রেগে যাওয়াটা আমার কাছে একটু অন্যরকম ঠেকল
যাই হোক, আমরা সমুদ্রের পাড় ধরে অন্যদিকে চলে গেলাম এদিকটা বেশ নির্জন পশ্চিম আকাশ লাল টকটকে হয়ে উঠছে ক্রমশ লাল পলাশের মত সূর্য সমুদ্রের ঘন নীল জলে ডুব দিচ্ছে ধীরে ধীরে নিস্তব্ধতা ভেঙে শুধু সমুদ্রের গর্জনের শব্দ। আমরা হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এসেছিলাম আলো কমে আসতে ফেরার পথ ধরেছি জুতোগুলো হাতে আর প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটুর উপরে ছপাস ছপাস করে হাঁটছি জলের উপর দিয়ে
হঠাৎ সমুদ্রের তীরে একটা শেওলায় মোড়া পাথরখণ্ডে আমার চোখ আটকে গেল ভাল করে লক্ষ্য করলাম, মুষ্টিবদ্ধ হাতের মত এক ফুট লম্বা একটা পাথরের টুকরো আগ্রহ ভরে তুলে নিলাম সেটা বেশ ভারি মিঃ রেড্ডিও এগিয়ে এলেন আমার হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিলেন জিনিসটা। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলাম লম্বা লম্বা সবুজ সামুদ্রিক শেওলা ঘন হয়ে এঁটে রয়েছে গায়ে আঙ্গুলের চাপে শেওলাগুলো সরিয়ে মিঃ রেড্ডির চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল। দেখলাম সেটা একটা শিবের মূর্তি একটা পঞ্চমুখী সাপ তার ফণার মধ্যে শিবলিঙ্গটিকে ধরে আছে সম্ভবত কোনও মন্দির থেকে ভাঙা অংশ সমুদ্রে তলিয়ে গিয়েছিল সম্প্রতি হয়তো মাছ ধরার জালের সাথে উঠে এসেছে পাড়ে মিঃ রেড্ডির চোখমুখ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, বললেন, “দাস, তাড়াতাড়ি ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নাও কেউ দেখে ফেললে আর নিয়ে যাওয়া যাবে না
একজন জেলে আমাদের লক্ষ্য করেছিল দূর থেকে তারপর দেখি গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে পিঠের ব্যাগে ঢোকানোর আগেই জেলেটা দৌড়ে এসেগিভ ইট টু মিবলেই ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর আমি কোনওরকমে তাকে ঠেলে জলে ফেলে দিলাম আবার উঠে আক্রমণ করল এবার আমি ধরাশায়ী হলাম আর হাত থেকে মূর্তিটা ছিটকে পড়ল এমন অতর্কিতে ব্যাপারটা ঘটল, আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি জেলেটা মাথা দিয়ে প্রচণ্ড জোরে গোঁত্তা মারল আমার থুতনিতে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে মুখ দিয়ে যন্ত্রণায় মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। নিজেকে সামলাতে আমার হয়তো কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছে। হঠাৎ আর্তচিৎকার করে মাথায় হাত দিয়ে সে জলে পড়ে গেল
আমি উঠে দেখলাম, রাগে মিঃ রেড্ডির চোখমুখ লাল হয়ে গেছে বললেন, “ব্লাডি নিগার!”
বুঝলাম সেই ভারি পাথরটা তুলে প্রচণ্ড জোরে মেরেছেন তার মাথায় ব্রহ্মতালু থেঁতলে গেছে রক্তে ভেসে যাচ্ছে দেখে আমার গা-হাত থরথর করে কাঁপতে শুরু করল
তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে চারপাশে একবার চোখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, “চলো, কেউ এসে পড়ার আগে আমরা বেরিয়ে যাই
আমি কোনওরকমে ঢোঁক গিলে বললাম, “সে কি! ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে না হলে মারা যাবে তো!”
“আর ইউ ম্যাড! ও হয়তো এমনিতেই মারা যাবে হসপিটালে নিয়ে গেলে আমাদের পুলিশ এরেস্ট করবে আর স্থানীয় লোকেরা দেখতে পেলে আমাদের পিটিয়ে মেরে ফেলবে চলো এখান থেকে
আরও কিছুক্ষণ তর্ক বিতর্ক হল আমার সাথে ক্যাপ্টেনের চোখের সামনে লোকটা ছটফট করে মারা যাবে আমি মেনে নিতে পারছিলাম না আবার বিপদের গন্ধও পাচ্ছিলাম বিদেশে এসে খুনের কেসে একবার ফেঁসে গেলে কী হবে, সেটা ভেবে বুকটা কেঁপে উঠল। শেষে ক্যাপ্টেনের কথায় রাজি হয়ে অন্ধকারের মধ্যে তাকে ফেলে রেখে চলে এলাম
এই ঘটনার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই আমাদের জাহাজবেনোয়াবন্দর ছেড়ে জলে ভেসে পড়ল একবার আন্তর্জাতিক জলসীমার মধ্যে প্রবেশ করলে আর ভয় নেই আমার আঘাতটা গুরুতর হয়নি শুধু একটা দাঁত নড়ে গেছে কিন্তু মনটা বিষাদে তেতো হয়ে রইল সারাক্ষণ।

সেদিন বাইরে রোদ ঝলমলে পরিষ্কার আকাশ আমাদের জাহাজ প্রায় তিরিশ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে এগিয়ে চলেছে দুদিন পরে আবার ডায়েরি লিখতে বসেছিলাম লেখার মতো মন আর বিষয় সবসময়ে থাকেও না বালি দ্বীপের সেই দুর্ঘটনাটা মনে পড়লে তখনও শিউরে উঠছি একটা কথা লেখা হয়নি যে জেলেটি মারা গিয়েছিল সে ঐ বয়স্ক মহিলারই ছেলে, যিনি আমাদের ভারতীয় কয়েন আর মূর্তি দেখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন যখন আমরাটানাহ লট টেম্পল-এর ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সিতে উঠছি তখন একটা হৈ হৈ কানে আসতে দেখলাম এ্যাম্বুলেন্সে করে সেই ছেলেটাকে কোলে নিয়ে মহিলা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন
সেই ঘটনার পর রাতে ঘুম আসছে না মিঃ রেড্ডির আচরণ আমার অদ্ভুত লেগেছিল প্রথমে তিনি বললেন তাঁর পুরনো জিনিসে কোনও আগ্রহ নেই তার কিছুক্ষণ পরেই সেই কুড়িয়ে পাওয়া পুরনো মূর্তিটা হস্তগত করার জন্য এক গরীব জেলেকে মেরে ফেললেন এবং তাতে তাঁর কোনও অনুশোচনাও নেই আশ্চর্য! ঐ মূর্তির মধ্যে কী এমন দেখেছিলেন তিনি? মূর্তিটাও তাঁর সাথে আমাদের জাহাজে করেই চলেছে

লক্ষ বছর আগে আমরা ভেলা তৈরি করেছিলাম তারপর সেই ভেলা কতরকমভাবে পরিবর্তিত হয়ে আজকের এই আধুনিক জাহাজে পরিণত হয়েছে একটা সময় ছিল যখন মানুষ পাল তোলা, হাল টানা বজরা বা নৌকা নিয়ে সমুদ্রে ভেসে পড়ত সূর্য আর নক্ষত্রের অবস্থান দেখে দিকনির্ণয় করত এখন স্যাটেলাইট জি.পি.আর.এস. ব্যবস্থায় জাহাজ অটোমেটিক তার গতিপথ ঠিক করে নেয় কয়েকটা কম্পিউটারের সামনে বসে আমরা গোটা জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি লোকবল আগের তুলনায় অনেক কম লাগে মানুষ এত উন্নত হয়েও কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃতির কাছে পরাস্ত হয়ে আছে বিজ্ঞান প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দিতে পারে কিন্তু এখনও তাকে আটকাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সে বিদ্যা এখনও আমাদের আয়ত্তে আসেনি
কম্পিউটারে একটা সামুদ্রিক ঝড়ের পূর্বাভাস দেখতে পাচ্ছিলাম সেই মুহূর্তে আমাদের অবস্থান সুমাত্রা থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে অর্থাৎ প্রায় সুমাত্রা আর শ্রীলঙ্কার মাঝামাঝি ভারত মহাসাগরের মাঝখানে ঝড়টা দেড়শ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসছে ঠিক আমাদের পিছন থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কোনও বন্দর বা দ্বীপ নেই বলাই বাহুল্য সারা আকাশ জুড়ে ঘন বজ্রগর্ভ মেঘ বাতাস জোরে বইতে শুরু করেছে আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হয়তো তাণ্ডব শুরু হয়ে যাবে
এর আগে প্রশান্ত মহাসাগর আর অ্যাটল্যান্টিক মহাসাগরে দুটো সাংঘাতিক ঝড়ের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে সে প্রচণ্ড প্রলয় যে নিজে না দেখবে তাকে বলে বোঝানো অসম্ভব মহাসমুদ্রের জল কোথাও আকাশচুম্বী উঁচু হয়ে যায়, আবার পরক্ষণেই পাতালপ্রবেশ ঘটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এইভাবে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে হয়, যতক্ষণ না সমুদ্র শান্ত হয় আমাদের করণীয় শুধু জাহাজের অভিমুখ ঢেউয়ের তরঙ্গের সাথে উল্লম্ব রাখা অর্থাৎ নব্বই ডিগ্রী কোণে যদি কখনও সেটা সমান্তরাল হয়ে যায় তবে জাহাজকে ওলটানোর হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না
বাইরে ঝড়ের বেগ ক্রমশ বাড়ছে কম্পিউটার থেকে যা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে বুঝতে পারছি পিছনে যে ঝড়টা আসছে সেটা খুবই প্রলয়ঙ্কর মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছি আমরা মনে হচ্ছে যেন সেই অভাগী মায়ের কান্না বিশাল একটা তাণ্ডবের চেহারা নিয়ে গিলে খেতে আসছে আমাদের
প্রসঙ্গক্রমে আর একটা কথা মনে আসছে আমার গত কয়েক মাসের মধ্যেই দু-দু’খানা যাত্রী বোঝাই এয়ার বাস এই অঞ্চলেই নিখোঁজ হয়েছে একটার ব্ল্যাক বক্স মহাসমুদ্রের অতল থেকে উদ্ধার করা গেছে আর প্রথমটার কোনও হদিশ নেই সম্ভবত মাঝ আকাশে এরকমই ঝড়ের মুখোমুখি হয়েছিল তারা ছোটবেলায় পড়া বারমুডা ট্রায়ংগেলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে যেখানে এরোপ্লেন আর জাহাজ একবার ঢুকে পড়লে আর বেরোতে পারত না
জাহাজ প্রচণ্ডভাবে দুলতে শুরু করেছে সেই দিনটা ছিল চব্বিশে মার্চ বিকাল পাঁচটার পরে প্রবল বিক্রমে সামুদ্রিক সাইক্লোন ‘হুপার’ ভারত মহাসাগরের মাঝখানে আমাদের জাহাজের উপর আছড়ে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা টের পেলাম যে আমরা যা ভেবেছিলাম এ সাইক্লোনের শক্তি তার থেকে অনেক বেশি আমাদের এত বড় জাহাজটাকে খোলামকুচির মতো নাস্তানাবুদ করে ফেলছে বিশাল জলরাশির মধ্যে যখন ঢুকে যাচ্ছি তখন মনে হচ্ছে আর উপরে উঠতে পারব না আবার সাঁ সাঁ করে ঢেউয়ের মাথায় উঠে পড়ছি যতদূর চোখ যায় সমুদ্র প্রচণ্ড বিক্রমে ফুঁসছে তার সাথে আকাশ কালো করে ঝমঝমে বৃষ্টি, কান ফাটানো বজ্রপাতের আওয়াজ আর ঝোড়ো হাওয়া একটা বিদ্যুতের রেখা এসে পড়ল জাহাজের এন্টেনায় কম্পিউটারসমেত সমস্ত স্যাটেলাইট সিস্টেম খারাপ করে দিল আমাদের সহকর্মীদের মধ্যে মৃত্যুভয় ঢুকে গেছে জাহাজের খোলে জল ঢুকছে হু হু করে সবক’টা পাম্প চালিয়েও সেই জল বাইরে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না আর কতক্ষণ এভাবে লড়াই করা সম্ভব?
ক্যাপ্টেন নির্দেশ দিলেন লাইফ জ্যাকেট পরে নিতে অর্থাৎ, জাহাজ যে কোনও সময়ে ডুবে যেতে পারে এস..এস. পাঠানো হল কাছাকাছি সমস্ত জাহাজে
জাহাজ ডুবেছিল কিনা মনে নেই, কারণ তার কিছুক্ষণ পরেই যখন আমি লাইফ জ্যাকেট পরে ডেকের উপরে ভিজে ঝড়ো কাকের মতো অবস্থায় লড়াই করছি, আমার পিছনেই বোমা পড়ার মত বজ্রপাত হল তারপর আমি জ্ঞান হারালাম
জ্ঞান ফিরতে চোখ চেয়ে দেখি, একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে কাঠের তক্তার উপরে শুয়ে আছি ঘরটা দুলছে অর্থাৎ এটাও একটা জাহাজ কিন্তু আমাদের জাহাজ নয় কিছুক্ষণ পর খেয়াল হল, এটা কাঠের তৈরি জাহাজের নিচে খোলের মধ্যে আমি শুয়ে আছি হাতটা পিছমোড়া করে বাঁধা খটকা লাগল আমাকে যদি কোনও জাহাজ উদ্ধারও করে তবে হাত-পা বেঁধে রাখবে কেন? উঠে বসে দেখলাম চারপাশে অনেক লোকজন ব্যস্ততার সঙ্গে দৌড়োদৌড়ি করছে পায়ের নিচে জল ঢুকছে হু হু করে অন্ধকারের মধ্যে কিছুটা ছাড়া একটা করে মশাল জ্বলছে এখানে দ্বিতীয় খটকা, এখনকার দিনে মশাল কোন দেশের জাহাজে ব্যবহার হয়? বেশ হৈ-হল্লার আওয়াজ কানে আসছে ঘরের মধ্যে অনেকগুলো বড় বড় কাঠের তালাবন্ধ বাক্স কৌতূহল চাপতে না পেরে ঘষে ঘষে এগিয়ে গেলাম কিছুটা। দেখি দু’দিকে সার বেঁধে প্রায় একশ লোক বসে হাল টানছে আশ্চর্য! একবিংশ শতাব্দীতে হাল টানা জাহাজ?
আরও কিছুক্ষণ পরে বুঝলাম, অবাক হওয়ার সবে শুরু দুজন লোক এগিয়ে এল আমাকে দেখে। কিন্তু তাদের ভাষা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না তারাও আমার কোনও কথা বুঝছে না পোশাক-আশাক ভারতীয় গ্রাম্য মানুষের মত। হাঁটুর উপরে খাটো ধুতি পেঁচিয়ে পরা। গায়ের রং কালো। কোমরে গোঁজা বড় বড় ছোরা। আমার কথা বুঝতে না পেরে লোক দুটি কাঠের সিঁড়ি দিয়ে আমাকে টেনে হিঁচড়ে উপরে নিয়ে এল উপরে এসে যা দেখলাম তাতে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না বিশাল বড় বড় মাস্তুল লাগানো কাঠের যুদ্ধ জাহাজ তবে অস্ত্রশস্ত্র সব প্রাচীনকালের বিভিন্নরকম তলোয়ার, বর্শা, তির-ধনুক এ জাহাজটাও ঝড়ের মধ্যে পড়েছে একইরকম অসহায়ভাবে লড়াই করছে ঝড়ের সাথে জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে দিচ্ছে সবকিছু জাহাজ বাঁচাতে সবাই ব্যস্ত
জাহাজের গায়ে বেশ কিছু শিবের মূর্তি খোদাই করা দেখলাম আরও বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করতে একটা কথাই কানে ঢুকলচোলা সারা গায়ে সোনা, মণিমুক্তাখচিত গয়না আর দামী সিল্কের ধুতি পরা লম্বা একটা লোকের কাছে আমাকে টেনে নিয়ে গেল ওরা তার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম হুবহু আমাদের ক্যাপ্টেন মিঃ রেড্ডি শুধু এনার কাঁচাপাকা চাপদাড়ি আছে। আমার পোশাক দেখে তাঁর হয়তো বিধর্মী মনে হয়েছে তিনিও চেষ্টা করে আমার ভাষা বুঝতে পারলেন না। এমনিতেই প্রচণ্ড সাইক্লোনের মধ্যে জাহাজ বাঁচানোই তখন সব থেকে বড় সমস্যা। তাই আমার মতো বাড়তি সমস্যাকে বহন করার কোনও প্রয়োজন নেই। এইসব ভেবে হয়তো আমাকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন হঠাৎ কী মনে হল, তাঁর পায়ের কাছে সটান শুয়ে পড়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘ওম নমঃ শিবায়
অবাক ব্যাপার, এই মন্ত্রে কাজ হল ম্যাজিকের মত তাঁর নির্দেশে হাতের দড়িও কেটে দেওয়া হল তারপর একটা অন্য ঘরে নিয়ে গেল আমাকে একজন বয়স্ক লোক আমার শরীর পরীক্ষা করলেন সম্ভবত তিনি কবিরাজ আমাদের মধ্যে ইশারায় কিছু কথার আদানপ্রদান হল। তিনি আমাকে বড় পাথরের পাত্রে একটা কড়া পাঁচন খেতে দিলেন সেটা খেয়ে মাথাটা ভোম হয়ে রইল বেশ অনেকক্ষণ।
তারপর মাথাটা পরিষ্কার হতে তাঁর কথাগুলো অল্পস্বল্প বুঝতে পারলাম। শুনে মনে হল, এটা সম্রাট রাজেন্দ্র চোলের নৌবহরের প্রধান নৌকা পিছনে আরও অনেকগুলো নৌকা আসছে সেনাপতি মহেন্দ্রের নেতৃত্বে যবদ্বীপে যুদ্ধ জয় করে ফিরছে এরা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শত্রুপক্ষের বহু লোক মারা গেছে ধনরত্ন বোঝাই এই নৌকার পেছনে অন্য নৌকাগুলোতে যুদ্ধবন্দী ক্রীতদাস নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিন্তু ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক ঝড়ে তার মধ্যে তিন চারটে নৌকা ডুবে গেছে জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে দিয়ে আমি কোনওভাবে এই জাহাজের মধ্যে এসে পড়েছি
আমি তাঁর কথা শুনে এত অবাক হলাম যে প্রত্যুত্তরে একটা শব্দও মুখ দিয়ে বের হল না। বের হলেও যে খুব একটা লাভ হত এমনটা নয়। মনে হল আমি আদৌ বেঁচে আছি তো? এমনও তো হতে পারে যে সলিল সমাধির পরে অজানা কোনও কালচক্রে পড়ে হাজার বছর পিছিয়ে গেছি।
মনের মধ্যে এইসব নিয়ে যখন প্রচণ্ড তোলপাড় চলছে হঠাৎ আগের মতো বজ্রপাতের একটা সাংঘাতিক জোরে আওয়াজ, আর সঙ্গে সঙ্গে কাঠের এত বড় রণতরী মাঝখান থেকে মড়মড় করে ভেঙে দু’ভাগ হয়ে গেল আমার গায়ে যেহেতু আগে থেকেই লাইফ জ্যাকেট ছিল তাই আবার কোনওরকমে ভেসে উঠলাম চোখের সামনে হাজার বছরের পুরনো রণতরী মাস্তুল সমেত ডুবে গেল। আবার চারিদিকে ঘন অন্ধকার প্রলয়ঙ্কর বৃষ্টি আর ঝড় তখনও সমানে চলছে
কতক্ষণ ঐভাবে ভেসে ছিলাম জানি না তারপর হয়তো চৈতন্য লোপ পেয়েছে আবার যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখি একটা জাহাজ আমাকে উদ্ধার করেছে
“হাউ আর ইউ ম্যান?” ভাষা শুনে আর পোশাক দেখে বুঝলাম এটা একবিংশ শতকের জাহাজ

সিঙ্গাপুর থেকে সেই কার্গো জাহাজটি চেন্নাই আসছিল আমাদের এস..এস. পেয়েছে ঘণ্টা চারেক আগে তারপরে আর কোনও খোঁজ নেই আমাকে এতক্ষণ পরে জল থেকে উদ্ধার করার সময় ভেবেছিল মৃতদেহ কিন্তু অবাক ব্যাপার আমার হৃৎস্পন্দন তখনও চালু ছিল
এরপর চেন্নাইয়ে একটা হসপিটালে ভর্তি ছিলাম বেশ কিছুদিন। ডাক্তাররা বলছেন, স্মৃতিভ্রমের মতো একটা দুরারোগ্য ব্যাধি হয়েছে এর কারণ হিসাবে বজ্রপাতকেই ওনারা দায়ী করছেন মাঝে মাঝে নাকি আমি কাউকে চিনতে পারি না নেশার ঘোরের মতো ভুলভাল কথা বলি

আজকে ভোরবেলা উঠে একটা ট্যাক্সি নিয়েগঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরমগিয়েছিলাম চেন্নাই থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে কোল্লিদাম নদীর তীরে হাজার বছরের পুরনো চোল সাম্রাজ্যের রাজধানী এখানে অনেক মন্দির, স্থাপত্য আর ভাস্কর্যের নিদর্শন এখনও স্ব-মহিমায় বিরাজ করছে আমাদের ক্যাপ্টেন মিঃ রেড্ডির বাড়িও এ অঞ্চলেই
এই ক’দিনে চেন্নাইয়ের ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে গিয়ে চোল সাম্রাজ্যের উপরে বেশ কিছু বই পড়ে ফেলেছি আর যত তথ্য ইন্টারনেট থেকে পাওয়া সম্ভব সবকিছু ঘেঁটে যা বুঝলাম, সেটা বেশ রোমাঞ্চকর নয়শো শতকের শেষের দিকে চোল সম্রাট রাজারাজা’ তখন সিংহাসনে তাঁর ছেলে যুবরাজ রাজেন্দ্র চোল বিশাল নৌবহর পাঠিয়ে ছিলেন যবদ্বীপ দখল করার জন্য যবদ্বীপ বা জাভার তখন রাজা ছিলেন শ্রী কেশরী ভার্মাদেব তিনি ছিলেন শান্তিপ্রিয়, বৌদ্ধধর্মাবলম্বী কিন্তু চোলরাজের চোখে বিধর্মী নৃশংসভাবে হাজার হাজার লোক মেরে প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে ফিরছিলেন সেনাপতি কিন্তু সামুদ্রিক ঝড়ে সেই নৌবহরের বেশিরভাগ রণতরী ডুবে যায়
প্রায় হাজার বছর পরে ভারত মহাসাগরের মাঝখানে কীভাবে আমি সেই রণতরীতে পৌঁছলাম? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর মনে হয় না কেউ দিতে পারবে
কিন্তু আর একটা জিনিস আবিষ্কার করে আশ্চর্য হলাম কোল্লিদাম নদীর তীরে সিরুকাট্টুর গ্রামে মিঃ রমেশ রেড্ডির পরিবারের সাথে দেখা করতে গিয়ে মিঃ রেড্ডিকে সরকার মৃত ঘোষণা করেছে তাই তার পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে যাওয়াটা আমার কর্তব্য গিয়ে দেখলাম এনারা বংশানুক্রমিক বিত্তবান আগে এনাদের বিশাল জমিদারী ছিল তাঁদের বংশের এক প্রাচীন শিবমন্দিরে গিয়ে আমি চোখের সামনে যেন কালের বিবর্তনটা পরিষ্কার দেখতে পেলাম
মন্দিরের মাঝখানে একটা বড় শিবলিঙ্গ আর চারটি কোণের মধ্যে তিনটি কোণে একই ধরনের মূর্তি চোখটা আটকে গেল চতুর্থ কোণে যে কোণটা ফাঁকা সেই জায়গাটা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করতে জানলাম, এটা বংশপরম্পরায় এরকমই আছে এর কোনও ইতিহাস তারা জানেন না অন্য তিনটি মূর্তিকে ভাল করে লক্ষ্য করলাম, পঞ্চমুখী নাগ তার ফণার মধ্যে শিবলিঙ্গ ধারণ করে আছে একদম হুবহু সেই একই মূর্তি যেটা আমরা বালি দ্বীপের সমুদ্রতীরে দেখেছিলাম শুধু সেটা ছিল গোড়া থেকে ভাঙা সামুদ্রিক শেওলায় মোড়া, আর এগুলো মন্দিরে পুজো হচ্ছে। তাহলে কি এই মন্দিরের ভাঙা অংশ আমরা পেয়েছিলাম বালির সমুদ্রতীরে? আর সেটা চিনতে পেরেই কি মিঃ রেড্ডি অত উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন? হয়তো তাই হবে।

*********

এই পর্যন্ত পড়ে আমি ডায়েরিটা মুড়ে রেখে দিলাম পাশে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে দেখলাম, পিউ আর রন্টি দুজনেই ঘোরের মধ্যে রয়েছে। কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে, রন্টি প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল, “তাহলে জাহাজের ক্যাপ্টেন মিঃ রেড্ডি কি চোল সাম্রাজ্যের সেনাপতি মহেন্দ্রর বংশধর?”
“একদম ঠিক ধরেছিস।”
“আচ্ছা, মন্দিরের ভাঙা অংশটা এখান থেকে বালি দ্বীপে গেল কীভাবে?”
“এটা তো আমি জানি না। হয়তো বহু বছর আগে যখন ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জগুলোতে ‘চোল’ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ ছিল, সেই সময়ে মিঃ রেড্ডির কোন পূর্বপুরুষ পুজো করার জন্য কুলদেবতার স্মারক হিসাবে মন্দিরের এই অংশটা নিয়ে যাচ্ছিল জাহাজে করে, আর সেই জাহাজ ডুবে যায়। আর এত বছর পর মাছ ধরার জালে আটকে উঠে এসেছিল বালি দ্বীপের পাড়ে।”
পিউ বলে উঠল, “কিন্তু এতদিন পরে মিঃ রেড্ডি সেটা পেয়েও বাড়ি নিয়ে আসতে পারলেন না।”

_____
ছবি - লেখক

2 comments:

  1. দারুণ গল্প। খুব ভালো লাগল পড়ে।

    ReplyDelete
  2. darun valo golpo.........ek niswas e porlam.......

    ReplyDelete