তাহাদের কথাঃ স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো
মণিমালা চক্রবর্তী
কখনও খেয়াল করে দেখেছ কি, 'মহালয়া' ভাবলেই কানে বেজে ওঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গমগমে গলা? ঠিক তেমনি, টিভির পর্দায় যখনই চোখে পড়ে ঘুম-জড়ানো আলসে এক স্লথ গা এলিয়ে আছে গাছের ডালে, কারাকোরামের দুর্গম প্রান্তে কোনও তুষারচিতা দাঁড়িয়ে রাজকীয় ভঙ্গিমায় কিংবা রাক্ষুসে এক হাঙ্গর ছুটেছে টুনা মাছের ঝাঁকের দিকে মহাভোজের আশায়, তখনি মনে পড়ে বিশেষ ভঙ্গীর সেই বর্ণনা, David Attenborough-র ভীষণ চেনা গলায়। ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে এই মানুষটি বারবার আমাদের শিখিয়ে চলেছেন বণ্যপ্রাণ আর প্রকৃতিকে নতুন করে ভালবাসতে।
David Attenborough-র জন্ম (১৯২৬) আর বেড়ে ওঠা ইংল্যান্ড-এ। ছোট্ট বেলা থেকেই তাঁর ছিল ফসিল (জীবাশ্ম) সংগ্রহের নেশা। যখন তাঁর প্রায় ১০ বছর বয়স, সেই সময় একবার সংরক্ষণবিদ Grey Owl (Archibald Belaney)-এর বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয় তাঁর, যা তাঁকে প্রায় মুগ্ধ করে ফেলে। আর একটু বড় হয়ে তাই পড়াশোনা শুরু করেন কেমব্রিজ-এর Clare College-এ, প্রিয় বিষয় প্রকৃতিবিজ্ঞান নিয়ে। তাঁর পরিবেশনা (Presentation) ও প্রযোজনা (Production)-র সূত্রপাত BBC-র স্টুডিওতে, যেখানে অতিথি হয়ে আসত চিড়িয়াখানার সব বাসিন্দারা। তবে তাঁর আসল অভিযান শুরু হয় Zoo Quest নামের এক অনুষ্ঠান দিয়ে, লণ্ডন চিড়িয়াখানার জন্য পশু পাখি সংগ্রহ করাই ছিল যার উদ্দেশ্য। ১৬ মিলিমিটার ফিল্মে সাদা-কালোয় রেকর্ড করা না-দেখা সব জঙ্গল-পাহাড় আর পশুপাখির দৃশ্য, তা সে ইন্দোনেশিয়ার কোমোডো ড্রাগনই হোক বা নিউ গিনির বার্ড অফ প্যারাডাইস, এর আগে তো তাদের হাল-হকিকত-রোজনামচা নিয়ে বেশির ভাগ লোকের কোনও মাথা ব্যথাই ছিলো না! তার সঙ্গে আবার Attenborough-র অপূর্ব বর্ণনার ভঙ্গি। সেই শুরু তাঁর জমজমাট জনপ্রিয়তার। এরপর ষাটের দশকে সাদা-কালো সরিয়ে এল রঙিন ছবির যুগ। তা রঙের কথাই যদি বলি, প্রকৃতির থেকে রঙিন আর কী বা হতে পারে? তাই তিনি শুরু করলেন ১৩ পর্বের তথ্যচিত্র, বিষয়? "Life on Earth". সারা পৃথিবীর ৩০টি দেশে ঘুরে শুট করা হয় এই ছবি, আর তার দর্শক ছিলেন সবসুদ্ধ ১০০টি দেশের ৫০ কোটি মানুষ! বন্য জীবন যেন তাঁর হাত ধরে ঢুকে পড়ল সব্বার মনে। টিভির পর্দায় Attenborough মানে যেন ঘরের মধ্যেই বর্ষাবন বা গভীর নীল সমুদ্র কিংবা রোদ-ঝাঁ-ঝাঁ কালাহারি। রঙিন থেকে HD আর এখন 3D, সবরকমের ঝাঁ-চকচকে প্রযুক্তিই তিনি চটজলদি রপ্ত করে ফেলেছেন। অসম্ভব জনপ্রিয় এই ভদ্রলোক বানিয়েছেন আরও অজস্র তথ্যচিত্র। আর সেসব বানাতে গিয়ে উঠে আসে বহু অজানা তথ্য আর এমন অনেক ছবি যা তার আগে কখনও কারোর মুভি ক্যামেরায় ধরা পড়েনি। যেমন ধর, সুমাত্রার জঙ্গলের পেল্লায় ফুল 'Titan Arum'-এর পরাগমিলনের রহস্য, 'The Private Life of Plants' বানাতে গিয়েই তো তার সমাধান সামনে এলো। 'Life on Earth' দিয়ে শুরু হয় BBC-র 'Life Series'. The Trials of Life, The Private Life of Plants, Life of Birds, এমনি ৯টি তথ্যচিত্রের সারি। BBC-র সাড়া জাগানো 'Planet Earth' এও শোনা যায় তাঁরই কন্ঠস্বর। কী আছে সেগুলোতে? সে আমি আর বলছি না, নিজেরাই দেখে নিও। তাঁর পুরস্কার আর সম্মানের লিস্টিটাও নয় নাই লিখলাম। সে দেখতে গেলে তো চোখ উল্টে যাওয়ার জোগাড় হবে। শুধু এইটুকু বলে রাখি, বেশ কিছু প্রজাতির গাছ আর প্রাণীর নাম রাখা হয়েছে তাঁর নাম-এ। তথ্যচিত্রগুলোতে তিনি বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন পরিবেশ, প্রকৃতিকে সুস্থ, স্বাভাবিক রাখা কতটা জরুরি। টিভির পর্দার বাইরেও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ নিয়ে তিনি সমান ভাবে কাজ করে চলেছেন। তাঁর আত্মজীবনীর নাম "Life on Air: Memoirs of a Broadcaster".
বয়স এখন তাঁর প্রায় ৯০ বছর। কিন্তু এখুনি যদি গুগল-এ খোঁজ লাগাও তাঁর নাম দিয়ে, দেখবে ২-১ দিন বা ২-১ মাসের মধ্যেই পৃথিবীর কোনও-না-কোনও প্রান্তে, কোনও-না-কোনও বন্যপ্রাণ নিয়ে বানানো অনুষ্ঠানে তিনি হাজির থাকবেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তা হবে নাই বা কেন? বয়স শুধুমাত্র একটা সংখ্যা বৈ তো আর কিছু না। এই তো ৮-ই মে তিনি নামলেন সাবমেরিন-এ চড়ে অস্ট্রেলিয়া-র Great Barrier Reef এর গভীরে। আর অস্ট্রেলিয়ার জাদুঘরে বসে সেই অনুভূতি পাওয়া গেল Virtual Reality-র মাধ্যমে। সে অনুষ্ঠানে তুমিও হাজির ছিলে কিনা আমি নিশ্চিত না, যদি না থাকতে পারো তবে এই বেলা ভালো কথা বলে রাখি শোনো। পড়াশোনা, হোমওয়ার্ক শেষ করে নাও বেলাবেলি। তারপর আজ বরং একটা 'Attenborough' দেখে ফেললে মন্দ কি!
_________
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment