বায়োস্কোপ:: এক অন্য টিনটিনের ছবি - সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়

এক অন্য টিনটিনের ছবি
সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়

অন্য টিনটিন বলতে তোমরা কিন্তু ভেবো না আমি অন্য কারও কথা বলছি। ছেলেবেলায় পড়া সেই অসীম সাহসী তরুণ রিপোর্টার আর তার সাথীরা মানে ক্যাপ্টেন হ্যাডক, প্রোফেসর ক্যালকুলাস আর সেই ধব্‌ধবে সাদা বিশ্বস্ত ওয়্যার ফক্স টেরিয়ার কুকুর স্নোয়ি বা ফরাসী ভাষায় যাকে ‘মিল্যু’ বলে আদরের ডাকে ডাকতো তাঁতাঁ মানে টিনটিন তাদের নিয়েই ফরাসী ভাষায় জমজমাট দুটো ছায়াছবি তৈরি হয়েছিল গত শতাব্দীর ষাটের দশকে টিনটিনের জন্মভূমি বেলজিয়াম দেশেতবে এই গল্পগুলো টিনটিনের স্রষ্টা এরজে বা  জর্জ রেমির লেখা নয়। তা বলে ভেবো না আমাদের জানা সেই অ্যাডভেঞ্চার-এর মজা একটুও কম হয়েছে ছবিদুটোতে। আমার তো বাপু দিব্বি লেগেছিল দেখতে।  আজ চলো তোমাদের শোনাই এর মধ্যে প্রথম তৈরি হওয়া ছবিটার গল্প।

মূল ফরাসী ছবিটার পোষ্টার

১৯৬১ সালে মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবিটার নাম Tintin and the Mystery of the Golden Fleece (ফরাসী ভাষায় Tintin et le Mystère de La Toison d'or)Golden Fleece বা সোনালী ভেড়ার লোমের রূপকটা আসলে একটা প্রাচীন গ্রীক পুরাণ থেকে নেয়া। সে যাই হোক এই ছবিটা শুরুর সাথে সাথেই দেখতে পাই বেশ দুলকি চালে সাইকেলে করে আসছে পিয়ন, সাথে একটা চিঠি যা পাঠানো হয়েছে মার্লিনস্পাইক হলের ঠিকানায় ক্যাপ্টেন হ্যাডকের নামে। গেট পেরিয়ে সে যেই না ঢুকতে যাবে অমনি প্রোফেসর ক্যালকুলাসের (ফরাসীতে প্রোফেসর তুর্ণাসল) ল্যাবরেটরিতে এক প্রবল বিস্ফোরণের সাথে সাথেই প্রফেসর বীরদর্পে ঘোষণা করেন তার সাম্প্রতিক গবেষণার সাফল্য। একটু পরে ওই চিঠি থেকে জানা যায় যে দুর্ধর্ষ নাবিক পাপারানিক (ফরাসী উচ্চারণে অবশ্য ‘র’ টা ‘হ’ এর কাছাকাছি হবে) মৃত্যুর আগে তার উইলে বন্ধু ক্যাপ্টেন হ্যাডকের নামে আস্ত একটা জাহাজ দিয়ে গেছেন

টিনটিন (তাঁতাঁ) আর স্নোয়ি

সেই জাহাজের খোঁজে টিনটিন (মূল উচ্চারণে তাঁতাঁ), ক্যাপ্টেন হ্যাডক আর স্নোয়ি বা মিল্যু ইস্তাম্বুলে পৌঁছে দেখে ‘Golden Fleece’ আসলে এক পুরনো লঝঝড়ে মালবাহী জাহাজ। অথচ সেই ভাঙাচোরা জাহাজ কেনার জন্যই অ্যান্টন ক্যারাবিন নামে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বিশাল অঙ্কের এক টাকার প্রস্তাব দেন ক্যাপ্টেন হ্যাডককেনিজেকে তিনি পরিচয় দেন পাপারানিকের পুরনো বন্ধু বলে  আর দাবী করেন যে শুধুমাত্র বন্ধুর স্মৃতির সংরক্ষণের জন্য ওই জাহাজ কিনতে চান তিনিএই ব্যাপারটায় টিনটিনের সন্দেহ খুবই বেড়ে যায়রহস্য এরপর আরও জমাট বেঁধে ওঠে যখন ইস্তাম্বুলের প্রাচীন সৌধগুলোতে বেড়াতে গিয়ে টিনটিন আর ক্যাপ্টেনের ওপর বেশ বড়সড় একটা হামলা হয় যাতে দুজনেরই প্রাণসংশয় হতে পারত। এদিকে উইলের শর্ত অনুযায়ী ওই জাহাজটাকে নিয়ে ক্যাপ্টেন আর টিনটিনকে বেরিয়ে পড়তে হয় নতুন এক জলযাত্রায়। সাথে ওই জাহাজেরই তিনজন পুরনো খালাসী অ্যাঞ্জেলোপোলাস্‌, অ্যাটিলা আর ইয়েফিমা। তাদের ওপর ভার পড়ে বেশ কিছু কার্পেট অ্যাথেন্সের বন্দরে পৌঁছে দেবার জন্য। এরপর পদে পদে বিপদ আর অ্যাডভেঞ্চারের ছোঁয়া।

ক্যাপ্টেন হ্যাডকের পাশে চিন্তামগ্ন  টিনটিন

এর তদন্ত করতে গিয়েই ঘটনাচক্রে টিনটিনের হাতে এসে যায় একটা পুরনো খবরের কাগজের টুকরো যা থেকে বহুদিন আগে লাতিন আমেরিকার এক কাল্পনিক দেশ টেরাগুয়াতে ঘটে যাওয়া এক অভ্যুত্থানের খবর জানতে পারে সেখবরের সাথে ছিল পাঁচজনের একটা ফটোগ্রাফ যার মধ্যে যুবক পাপারানিক আর কারাবিনকে সহজেই চিনতে পারে টিনটিন রহস্যের পেছনে ধাওয়া করে টিনটিন পৌঁছে যায় ওই পাঁচজনের অন্যতম ফাদার আলেকজান্দ্রের কাছে যিনি তখন পাহাড়ের ওপরে এক মঠের সন্ন্যাসী। ওই সন্ন্যাসীর কাছ থেকেই পাওয়া সূত্র ধরে জানা যায় টেরাগুয়ার ওই ঘটনার সময় সেখানকার জাতীয় ব্যাঙ্ক থেকে পাওয়া এক বিরাট অঙ্কের সোনার লুঠ আর এই সোনার বখরাকে নিয়েই যত গোলমাল। ঠিক এই সময়েই টিনটিনের হাতে চলে আসে একটা ম্যাপ যা ওই লুকোনো সোনার হদিশ দিতে পারে। টিনটিন ওই গুপ্তধনের সন্ধান খুঁজে কি পাবে? এরপরটা আর ভাঙছি না।  আরও নানা রোমাঞ্চকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ ইয়োরোপে দুর্দান্ত অভিযান, পুরনো জলদস্যুদের পেছনে ধাওয়া করে এক টানটান উত্তেজনাকর গল্প তোমাদের মাতিয়ে রাখবে। সঙ্গে প্রাপ্তি পাপারানিকের কথা-বলা কাকাতুয়া রোমুলাসের সাথে স্নোয়ির খুনসুটি। টিনটিন বেশে জ্যঁ পিয়ের ট্যালবটের অভিনয় টিনটিনকে যেন গল্পের পাতা থেকে সিনেমার ফ্রেমে তুলে আনে। সাথে দুর্দান্ত সঙ্গত দিয়ে গেছেন ক্যাপ্টেনবেশী জর্জেস উইলসন্‌ আর ক্যালকুলাস জর্জেস ল্যারিয়ট। বাকিরাও সকলে বেশ ভালো। ছবির সংগীতে অ্যাডভেঞ্চারের রসটা দিব্বি ধরে রাখা হয়েছে, এছাড়া মধ্য ও দক্ষিণ ইউরোপের সহজিয়া লোকসুরের প্রয়োগও বেশ লেগেছে শুনতে

রোমুলাস আর টিনটিনের মাঝখানে ঝগড়া করছে ক্যাপ্টেন হ্যাডক আর প্রোফেসর ক্যালকুলাস
ক্যাপ্টেন হ্যাডককে কুর্নিস জানাচ্ছে টমসন্‌ আর থমসন্‌ (মূল ফরাসীতে দ্যুপঁ আর দ্যুঁপ)

এই সিনেমার ছবিগুলোকে নিয়ে টিনটিনের একটা বইও বেরিয়েছিল সেইসময় তবে তা এখন বেশ দুষ্প্রাপ্য। তবে মূল ছবির ডিভিডি এখন এদেশেও পাওয়া যায় এটাই বেশ আনন্দের খবর। এই ছবিটার সাফল্যের বছর তিনেক পর Tintin and the Blue Oranges বলে আর একটা ছবি তৈরি হয়েছিল, সেখানেও যথারীতি টিনটিনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন এই জ্যঁ পিয়ের ট্যালবট। পরে কোনও দিন আবার বলা যাবে সেই ছবিটার কথা।
_________

3 comments:

  1. সৌভাগ্যক্রমে এই ছবিটা দেখেছি। খুব ভালো আর বেশ লয়াল টু দ্য সোর্স।

    ReplyDelete
  2. দারুন লাগলো পড়ে, সিনেমাটা দেখতেই হবে।

    ReplyDelete
  3. ছবিটি দেখেছি এবং তোমার লেখাটি বেশ মনগ্রাহী ।

    ReplyDelete