জোড়া-সাঁকো
প্রকল্প ভট্টাচার্য
১ - পাতার কথা
সেদিন একটা বিরাট কারখানাতে গেছিলাম। দেখলাম সারি সারি জলভর্তি গামলা রোদ্দুরে গরম হচ্ছে, তাতে বড় বড় চামচে করে মেশানো হচ্ছে সবুজ কী একটা পাউডার, আরও কী কী যেন। পাইপে করে তার মধ্যে ঝাঁঝালো একটা গ্যাস ছাড়া হচ্ছে বুগবুগ করে। ওইভাবে কী যেন তৈরি হচ্ছে। সব্বাই মুখে মুখোশ পরে, হাতে দস্তানা পরে ব্যস্ত হয়ে কাজ করে চলেছে, তবু একজনকে ধরলাম।
- ‘দাদা, এখানে কী হচ্ছে?’
- ‘দেখছ না, খাবার তৈরি হচ্ছে!’
- ‘খাবার! কার খাবার!’
- ‘সক্কলের। সমস্ত জীবজগতের।’
- ‘যাঃ! আমাদের খাবার তো মা তৈরি করেন রোজ!’
লোকটা মুখোশের আড়ালে হাসল একটু।
- ‘কী তৈরি করেন মা?’
- ‘কেন, ভাত, রুটি, নুডলস...’
- ‘সেগুলো তো তৈরি খাবার, উনি শুধু গরম করে, সিদ্ধ করে, তেল মশলা দিয়ে মুখরোচক করে দেন। আর গরু, ছাগল, ওরা খাবার কোথায় পায়?’
- ‘ওরা তো ঘাস পাতা খায়!’
- ‘হ্যাঁ, সেই খাবার সমস্ত এখানেই তৈরি হচ্ছে। এসো তোমাকে দেখাই। ওই দ্যাখো জলের পাইপ।’
- ‘জল কোথা থেকে আসছে? কর্পোরেশন-এর সাপ্লাই?’
- ‘হাহাহাহা, না না, মাটির তলা থেকে আমরা বিন্দু বিন্দু জল শুষে আনি।’
- ‘তারপর পাম্পে করে বুঝি...’
- ‘পাম্প কোথায়! ওই দ্যাখো ওপরে একজস্ট ফ্যান, ওখান দিয়ে অতিরিক্ত জল বেরোয়, সেই টানে নীচের জল ওপরে ওঠে!’
- ‘বাহ! তারপর? ওই কী গ্যাস মেশাচ্ছো?’
- ‘ওটার নাম কার্বন ডাই অক্সাইড। বিষাক্ত, তাই সবাই মুখোশ পরে আছি। খাবারের সঙ্গে ওই গ্যাসটাও অক্সিজেনে বদলে, ওই একজস্ট দিয়ে বেরিয়ে যাবে।’
- ‘আরে, অক্সিজেনেই তো আমরা নিঃশ্বাস নিই!’
- ‘একদম ঠিক। এখানেই একমাত্র বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড-কে বদলে অক্সিজেন তৈরি করা হয়।’
- ‘ওই পাউডারটা কী?’
- ‘ওটার নাম ক্লোরোফিল। ওটা অনুঘটকের কাজ করে। খুব দামী, তাই আমাদের স্পেশাল সেল এর গ্রানাম নামের ঘরে থাইলাকয়েডের বাক্সে রাখা থাকে। আরও কিছু খনিজ মেশানো হচ্ছে, সেগুলো মাটির তলা থেকে জলের সঙ্গেই আমরা যোগাড় করি।’
- ‘আর সূর্যের আলোয় রাখা কেন?’
- ‘সূর্যই তো এই রান্নার সমস্ত ইন্ধন দেয়! তাই এর আর এক নাম সালোকসংশ্লেষ, বা ফোটোসিন্থেসিস। ফোটো বা আলো ছাড়া এই সংশ্লেষ বা সিন্থেসিস, যাকে বলে যোজন, তা হবেই না!’
- ‘তার মানে রাত্তিরে রান্না বন্ধ? অক্সিজেন তৈরিও?’
- ‘বাঃ, বুদ্ধিমান তো তুমি! রাত্তিরে আলো জ্বেলে রান্না করা যায় বটে, কিন্তু হ্যাঁ, আলো না থাকলে রান্না বন্ধ। তখন আমরাও অক্সিজেন ব্যবহার করে কার্বন ডাই অক্সাইড বানাই। তাই রাত্তিরে আমাদের রান্নাঘরের কাছে আসা স্বাস্থ্যকর নয়।’
- ‘আচ্ছা, ওই ক্লোরোফিল ফুরিয়ে গেলে...’
- ‘আমাদের কারখানার রঙ সবুজ, দেখেছ তো? ফুরিয়ে গেলে সেটা আর সবুজ থাকবে না, আমাদেরও অন্যের ওপর নির্ভর করতে হবে রান্নার জন্যে!’
- ‘আর একটা প্রশ্ন, যদি জল কম আসে আর ওই একজস্টের ফুটো দিয়ে সব বেরিয়েই যায়...’
- ‘হ্যাঁ, সেটা হয় মরুভূমিতে। তখন রান্নাঘরের চ্যাপটা আকার বদলে, কাঁটার মতো করে নিতে হয় যাতে জল খরচ কম হয়।’
- ‘সমস্ত জীবজগতের খাবার বানানো, বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে প্রাণদায়ী অক্সিজেন বানানো, এছাড়া আর কী কী কাজ হয় এখানে?’
- ‘কিছু কারখানায় বীজ সঞ্চয় করা থাকে, যেমন পাথরকুচি। কেউ কেউ কুঁড়ি কে সুরক্ষা করে, কেউ আত্মরক্ষার কাজে লাগে। অনেক কাজ এখানে, অনেক দায়িত্ব!’
- ‘কিন্তু একটা জিনিস আমি এখনও বুঝতে পারছি না...’
- ‘কী, বলো?’
- ‘এত উপকারী, এত অপরিহার্য হওয়া সত্ত্বেও অনেকে ইচ্ছামতো এই কারখানাগুলো ছিঁড়ে, ভেঙ্গে নষ্ট করে কেন! এগুলোকে বাঁচায় না কেন! আরও কারখানা বসায় না কেন!!’
উত্তর পেলাম না, ম্লান হেসে সে চলে গেল নিজের কাজে। তোমরা কেউ কি জানো এর উত্তর?
২ - ক্ষত
ঠিক তখন বিকেল তিনটে বেজে পঞ্চাশ মিনিট। ঝনঝনিয়ে বেজে উঠলো মিঃ সিদ্ধান্তের সামনের চারটে ফোন, একই সঙ্গে।
মিঃ সিদ্ধান্ত হেড অফিসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ম্যানেজার, তাঁকে তৈরি থাকতে হয় এই ধরণের পরিস্থিতি সামলাতে। প্রথমে যে ফোনটা তুললেন, সেটা সেরিবেলাম অঞ্চল থেকে এসেছিল, মুহূর্তের অন্যমনস্কতায় সেট লেগেছিল, তাই পুরো সিস্টেমের ব্যালান্স নষ্ট হয়ে পড়ে গেছিল। রিকভারি টিম সাথে সাথেই সামলেছে, কিন্তু হাঁটুর কাছে একটা ডিস্টার্বেন্স হয়ে থাকতে পারে।
ঘটনার গুরুত্ব বুঝে সিদ্ধান্ত রিকভারি টিমকে ফলো আপ করতে বলেই, অন্য ফোনগুলো ধরলেন।
যা ভয় পাওয়া গেছিল, মাটিতে ঘষা খেয়ে হাঁটুতে একটা ওপেনিং হয়ে গেছে, আর সিস্টেমের চিরশত্রু জী-ভানু তার দলবল নিয়ে সেখান থেকে ঢুকছে।
প্রথম ফোন লোহিত কণিকার। “স্যার, যুদ্ধ লেগেছে, আমার আরও সাপ্লাই চাই। হিমোগ্লোবিন কিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে... ”
- “ঠিক আছে, কিন্তু আগে তো জী-ভানুর দলের ঢোকা বন্ধ করতে হবে!”
- “রাইট স্যার, অণু চক্রবর্তী তার টিম নিয়ে নেমে গেছে। কোয়াগুলেশনের কাজ আরম্ভ হয়ে গেছে।”
- “ওক্কে, শ্যাল গেট ব্যাক টু ইয়ু।” বলেই সিদ্ধান্ত কল ব্যাক করলেন অণু চক্রবর্তীকে।
- “হোয়াটস দ্য সিচুয়েশন?”
- “স্যার, আর একটু প্লাজমা পেলে ভালো হয়। মাল্টিপল এন্ট্রি, ক্লটিংএ সময় লাগছে।”
- “ওক্কে, দেখছি। কতক্ষণ লাগবে?”
- “আর এক মিনিট, ম্যাক্স।”
আরও এক মিনিট!! চট করে ঘড়িটা দেখে নিলেন সিদ্ধান্ত। তিনটে তিপ্পান্ন। সর্বনাশ, শ্বেতকণিকার ডিফেন্স টিম এখনও লড়ছে! পরের ফোন শ্বেতকে।
- “কী অবস্থা আমাদের ফোর্সের?”
- “স্যার, উই আর হোল্ডিং অন... কিন্তু এক্সটারনাল সাপোর্ট দরকার। অলরেডি অনেককে হারিয়েছি আমাদের টিম-এর!”
- “হাউ স্যাড! আচ্ছা আমি সিগন্যাল পাঠাচ্ছি, যাতে এক্সটারনাল সাপোর্ট চলে আসে অ্যাট দ্য আর্লিয়েস্ট।”
ফোনটা নামাতেই অণু চক্রবর্তীর ফোন, “স্যার, কোয়াগুলেশন কমপ্লিট। এক্সট্রা প্লাজমা পেয়েই আমরা সব এন্ট্রি বন্ধ করে দিয়েছি।”
- গ্রেট জব ডান!”
যাক, একটা নিশ্চিন্ত। তিনটে চুয়ান্ন, সাপোর্ট চাই এক্ষুণি! সিগন্যাল পাঠাতে লাগলেন তিনি। প্রথমে যন্ত্রণার সেন্স দিয়ে, তারপর উইকনেস দিয়ে। তারই মধ্যে খবর নিতে থাকলেন। “লোহিত, তোমার সাপ্লাই চালিয়ে যাও!”
- “ইয়েস স্যার, আমরা ডাবল স্পীড সাপ্লাই দিচ্ছি হিমোগ্লোবিনের।”
- “আমরা রেসিস্ট করে যাচ্ছি, কিন্তু ধুলোবালির সঙ্গে জী-ভাণুর দল অনেক স্ট্রং হয়ে আসে। স্যার, আর্জেন্ট সাপোর্ট লাগবে!”
বলতে না বলতেই টিম অ্যান্টিসেপ্টিক এসে হাজির। “হ্যালো মিঃ সিদ্ধান্ত, আমরা এসে গেছি!”
- “থ্যাঙ্কস মাচ, মিঃ অ্যান্টিসেপ্টিক! ইয়ু নো হোয়াট টু ডু, আগে ধুলোবালিগুলো সরাতে হবে।”
-“ইয়েস, এরিয়াটা ক্লিন করে একটা ড্রেসিং দরকার। উইল গেট ইট ডান ইন নো টাইম। প্লিজ ডোন্ট প্যানিক!”
ঘড়িতে তিনটে পঞ্চান্ন। জাস্ট ইন টাইম। সাপোর্ট টিম আসতে দেরী হলে এই একটা রোড ইঞ্জুরিও খুব মারাত্মক আকার নেয়। এনিওয়ে, অল ইজ ওয়েল নাউ, দ্য সিচুয়েশন ইজ ওয়েল আণ্ডার কন্ট্রোল। নিশ্চিন্ত হয়ে বসলেন মিঃ সিদ্ধান্ত। কিন্তু বেশীক্ষণ নয়। সেরিবেলামের কাছ থেকে একটা রিপোর্ট নিতে হবে। এইরকম ভুল তো ও করে না! যে কোনও অছিলায় জী-ভাণু ঢুকে পড়তে পারে সিস্টেমে। সক্কলকে তৈরি থাকতে হবে, সব সময়!!
____
বাহ অসাধারণ! দারুন লাগলো!! আরো এমন পড়তে চাই
ReplyDeletePrakalpa Selam Selam Selam banglay bachcha der jonne biswaporichoy er moto Akta series lekho na pls .... Tomra na likhle ar kara likhbey bolo..
ReplyDeleteবাহ্ ।।। শুধু বাহ্ ... আর কিছু নয় ।।।
ReplyDelete