গল্পের ম্যাজিক:: ভেক ভিকাই - বৈশাখী ঠাকুর


ভেক ভিকাই
বৈশাখী ঠাকুর

আধো ঘুম আধো জাগরণে ভোজনরসিক ভেক ভিকাই জবরদস্ত সব খানাপিনার স্বপ্ন দেখছিল। মশাদের ব্যাটার ফ্রাই, ঝিঁঝিঁ পোকার রোস্ট, উচ্চিংড়ের কাবাব - উল্লুস! আগাছা, শ্যাওলা দিয়ে তৈরি মুচমুচে বড়া। হঠাৎ মনে হল পায়ের তলায় কী যেন ফুটছে। ঘুমের চটকাটা ভেঙে গেল। ভিকাই  চোখ মেলে দেখল চারিদিকটা কেমন ঘোর অন্ধকারসে কি তবে ঘরে নেই? এক ফালি সরু গলিপথ মত জায়গা। তবে কি সে ফুটপাথে! চারিপাশে এ কী সব সরঞ্জাম - অদ্ভুত রকমের সব যন্ত্রপাতি, খোঁচা খোঁচা - এগুলো কী? চারিপাশটা দেখল ভাল করে ভিকাই। এবার বুঝি কিছু সে বুঝতে পারল। তার ঠাকুরমার কাছে সে শুনেছিল - মনুষ্যকুল তাদের কী সব কাজে যেন ব্যবহার করে! বিজ্ঞানের প্র্যাকটিকাল ক্লাস। সেই বায়োলজি বাক্সের এক কোণায় আপাততঃ তার ঠাঁই হয়েছে। ভিকাই প্রমাদ গুনল। তার বুঝতে একটুও অসুবিধে হল না যে সে আপাততঃ বন্দী। যাবজ্জীবন বন্দী। অতঃপর  মৃত্যুদণ্ড। আর যাবজ্জীবনই বা কী করে বলবে! কদিন নাকি কঘণ্টা! মৃদুমন্দ আওয়াজ ভেসে আসছিল বাইরে থেকে। নিঃশ্বাস যেন তার বন্ধ হচ্ছে মনে হচ্ছিল, এক্ষুণি সে মরে  যাবে। ঠিক তখনই  যেন অল্প ফাঁক হল বাক্সটা। এক ঝলক দিনের আলো — টাটকা হাওয়া — ওঃ! প্রাণটা বাঁচল ভিকাইয়ের। তাকে স্থানান্তরিত করা হল এক কৌটোয়। যাতে সে একদম মরে না যায়।
ভিকাইয়ের মনে পড়ল ওর বন্ধু ফ্রগসিরও এমন দশা হয়েছিল কিন্তু কপালগুণে সে বেঁচে গেছিল। তাকেও উপায় বের করতে হবে কী করে সে উদ্ধার করবে নিজেকে। তাদের অঞ্চলে বেশির ভাগ ব্যাঙেদেরই অকালমৃত্যু হয়েছে এই ছাত্রছাত্রীদের প্র্যাক্টিকাল ক্লাসের বলি হয়ে। প্রতিদিন কত শত ব্যাঙ যে মারা যাচ্ছে এই পরীক্ষা নিরীক্ষার ঠ্যালায় তার ইয়ত্তা নেই।
আগে তাদের বিরাট অঞ্চল জুড়ে পুকুর পাড়ে বাস ছিল। তাদের বাসস্থান চেনার পর থেকে রোজই ইস্কুল, কলেজের কোনও না কোনও ছেলেমেয়ে তাদের ধরে নিয়ে যায়। কমতে কমতে এখন মাত্র ক ঘর ওদের বাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সব নিয়ে মনুষ্য জাতির কিন্তু কোনও হুঁশ নেই। ধীরে ধীরে একদিন তারাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে। তখন তাদের টনক নড়বে। আইন-কানুন-সংরক্ষণ শুরু হবে। বাঘ-সিংহর মত তারা অত সুন্দরও না। কলেবরও বড় নয়। তাই বুঝি তাদের কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। যাকগে যাক, এইসব তত্ত্বকথা ভেবে ভিকাইয়ের কোনও লাভ নেই। তাকে বাঁচার রাস্তা বাতলাতে হবে।
পরদিন ভিকাই বুঝতে পারল তার অন্তিম লগ্ন উপস্থিত। একটা ব্যাগের ভেতর করে সে চলল ইস্কুলে। ছেলেটার নাম মৈনাক। দ্বাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞানের ছাত্র। যা কথাবার্তা কানে এসেছে তাতে এতটা উদ্ধার করেছে ভিকাই। গতকাল ছেলেটা ইস্কুল থেকে ফেরার সময়ই তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় টক করে তুলে বায়োলজি বাক্সে চালান করেছিল। আজ ইস্কুলে নিয়ে এসেছে মহা উৎসাহে। ক্লাসে এসে একটা টেবিলের ওপর তাকে রাখল। ভিকাই বসে রইল কৌটো বন্দী হয়ে। প্রায়ই তার বন্ধুরা আসছে যাচ্ছে আর সেই ফুটোটা দিয়ে তাকে দেখছে। একের পর এক ক্লাস হচ্ছে। ইংরাজির ক্লাস হচ্ছিল মনে হয়। মৈনাক তার বন্ধুদের বলল এর পরই তাদের ল্যাব যেতে হবে ব্যাঙদের নিয়ে। শুনে বুকটা ধক করে উঠল ভিকাইয়ের। সে অন্যমনস্ক থাকার চেষ্টা করল। স্যার পড়াচ্ছেন। সে কান পেতে তাই শুনছিল,
“Promise me you’ll always remember – you’re braver than you believe and stronger than you seem, and smarter than you think.”
Christopher Robin বলেছিলেন কথাগুলো। মনে হল যেন তার উদ্দেশেই বলা। ভিকাইয়ের মনে একটা বিরাট আলোড়ন তুলল উক্তিটা। সেও অসীম শক্তির অধিকারী। যথেষ্ট সাহসী। ভিকাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল যে করেই হোক তাকে বাঁচতেই হবে।
ল্যাবে রুমে গিয়ে তাকে  উন্মুক্ত করা হল। তার বহু জাতভাইয়ের সাথে দেখা সবারই কাঁচুমাচু মুখ। সবাই মৃত্যুপথযাত্রী! শোকে-আতঙ্কে-মৃত্যুর চিন্তায় কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ সব ফুলে গেছে। ভিকাই দেখল একটা বড় ট্রে পাতা রয়েছে। সাদা একটা পুরু মোমের আস্তরতার ওপর সব  ব্যাঙদের উল্টো করে রাখা। চারটে পা টেনে টেনে বোর্ড পিন দিয়ে আটকে দিচ্ছে ল্যাবের যিনি সহকারী আছেন তিনি। ঐ ট্রেতে ওঠানোর আগেই একটা কী দিচ্ছে আর ভিকাইয়ের সতীর্থরা  তৎক্ষণাৎ ইহলোক ত্যাগ করছে। তারপর জোর কদমে জলে ধুয়ে ট্রেতে সাজানো। আর বুঝি শেষ রক্ষা হল না। ভিকাই চারিদিকে তাকাল। কটা জানালা? কটা দরজা? তার দ্রুত নিঃশ্বাস পড়ছে। ভেবে পাচ্ছে না কী করবে। মাথা ঠাণ্ডা করে সে চিন্তা করার চেষ্টা করল। কিন্তু চিন্তা করবে কী, কোথা থেকে একটা উটকো বোলতা এসে ভ্যান ভ্যান করে ঘরময় ঘুরতে শুরু করে দিলসারা ঘরময় উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কত ফুর্তি তার মনে। ভিকাইয়ের মত দশা হলে টের পেত। এর কাছে গিয়ে ওর কাছে গিয়ে সারা ক্লাসটাকে তটস্থ করে রেখে দিয়েছে।
হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল ভিকাইয়ের। দৃষ্টি আকর্ষণ করল বোলতাটার। সাংকেতিক ভাষায় কিছু একটা বলার চেষ্টা করল। আর দুটো ব্যাঙের পরেই ভিকাই ঐ ট্রেতে অধিষ্ঠান করবে। অতঃপর বুঝি তার মৃত্যুর ঘণ্টা বাজল। ঠিক সেই সময় ভিকাইয়ের ইশারায় বোলতাটা এসে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের হাতের আঙ্গুলে সজোরে হুল ফুটিয়ে দিল চীৎকার করে উঠল সে। কালবিলম্ব না করে ভিকাই এক লাফ মারল টেবিল থেকে পেছনের জানলায়। তার পরই জানলা দিয়ে উন্মুক্ত পৃথিবীতে। ভাগ্যিস! মনুষেরা সত্যি সত্যি পশুপাখির কথা বুঝতে পারে না। ঐ রূপকথার জগতেই সেটা সীমিত। না হলে শেষ রক্ষা আজ আর হত না। বাইরে এসে ভিকাই অপেক্ষা করল বোলতা বন্ধুর জন্য। তার সেই স্বপ্নের মহাভোজটা সম্পন্ন করতে হবে। আর তাতে বোলতা বন্ধু না থাকলে তো সেটা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। তাই না! তার পুনর্জন্মটা যে মহা আড়ম্বরে উদযাপন করতেই হবে!
_______________
ছবি- পুস্পেন মণ্ডল

লেখক পরিচিতি - বৈশাখী ঠাকুর বেশ কিছুদিন ধরেই লিখছেন। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় উনিশ কুড়ি পত্রিকায়। তারপর থেকে নিয়মিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখছেন। ছোটো এবং বড় উভয়ের জন্যই লেখেন।

1 comment: