ইচ্ছেশক্তি
চুমকি চট্টোপাধ্যায়
কেমন আছ তোমরা সবাই? নিশ্চয় খুব ভালো আছ। যারা ম্যাজিক ল্যাম্প পড়ে তারা কখনও খারাপ থাকতেই পারে না। আজ আমি তোমাদের আমার ছোটবেলার একটা ম্যাজিকাল গল্প শোনাব। গল্প বললে ভুল হবে, ঘটনাটা একশ ভাগ সত্যি।
আমার ঠাকুরদাদাকে আমি দাদুভাই বলতাম। তা সেই দাদুর ঘরে কাচের পাল্লা দেওয়া একটা শোকেস ছিল। তাতে পুরানো দিনের অনেক কাচের বাসন, পোর্সেলিনের নানান মূর্তি, ফুলদানি, গাড়ির আকারে পানের বাটা এবং আরও নানান জিনিসপত্র ছিল। আর ছিল শোকেসের পাল্লার কড়ায় একটা বড়সড় তালা।
এই শোকেসের দ্বিতীয় তাকের সামনের দিকে একটা এক বিঘত লম্বা ভারি সুন্দর কাচের পুতুল ছিল। গোলাপি রঙের ফ্রিল দেওয়া ফ্রক পরা আর মাথায় ধরা একটা ছোট্ট মিষ্টি ছাতা। এত সুন্দর পুতুল আমি আজ অবধি দেখিনি।
ওই পুতুলটা আমার খুউউউউব পছন্দ ছিল। অনেকবার মায়ের কাছে, পিসির কাছে বায়না করেছি। কিন্তু ‘ওটা ভেঙে যাবে, কাচের তো’ এই উত্তর পেয়েছি। কিছুতেই দেয়নি আমাকে। খুব কষ্ট পেতাম পুতুলটা না পেয়ে।
আমি কিন্তু ছোটবেলায় মোটেই দুষ্টু ছিলাম না। বেশ গুড গার্ল ছিলাম। বড়দের কথা শুনতাম। ঠিকঠাক হোম ওয়ার্ক করতাম। খাওয়া নিয়েও কোনও প্যাখনা ছিল না। তাহলে ভালো মেয়ে ছিলাম কিনা তোমরাই বলো? কিন্তু ওই কাচের পুতুলটার ওপর আমার প্রচন্ড আকর্ষণ ছিল। এত আকর্ষণ সে বয়সে আমি আর কিছুর প্রতি অনুভব করিনি বলেই মনে পড়ে। একটু হাতে নিয়ে দেখতে ইচ্ছে করত। কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে যে বার করে দেখব তার উপায়ও ছিল না। কারণ তালার চাবি থাকত দাদুর কাছে। অগত্যা কাচের ভেতর দিয়ে পুতুলটার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকতাম।
একটা কোনও ছুটির দিনে হল কি, সকাল থেকেই আমার ওই পুতুলটার জন্যে মন কেমন করতে লাগল। আমি যথারীতি মাকে বললাম এবং মৃদু ধমক খেলাম। সেদিন আমার মাথায় রোখ চেপে গেছিল। পুতুলটা আমাকে দিতেই হবে। ঘ্যানঘ্যানানি শুরু করলাম যা আমি কখনও করতাম না। কিন্তু মা, কাকীমা, পিসিরা সব রান্নাঘরে থাকায় আমায় পাত্তা দেবার কেউ ছিল না। আমি ওই আলমারিটার সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদেই চললাম।
আমার দাদুভাই ছিলেন কম কথার মানুষ। এক দু’বার জিগ্যেস করেছেন আমাকে যে আমি কেন কাঁদছি। কারণ জেনে চুপ করে গেছেন। আসলে ওই শোকেসের ভেতরের যা কিছু জিনিস, সবই আমার ঠাকুমার (আমি আম্মা বলতাম) খুব প্রিয় ছিল। তিনিই বিভিন্ন নীলাম থেকে কিনে কিনে সাজিয়েছিলেন। আম্মা মারা যাবার পর তাই ওগুলোতে আর কেউ হাত দেয় না। যত্ন করে রাখা আছে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর। স্নানের সময় হয়ে গেছে। মা ডাক দিয়েছে। যেতে হবে এবার স্নানে। উপায় নেই। আমি যে লক্ষ্মী মেয়ে। আর না গেলে মা এসে টেনে নিয়ে যাবে।
সকাল থেকে কাঁদছি তো! জল বেরোচ্ছে নাক দিয়ে। হাতের চেটো দিয়ে নাক চোখ মুছে আর একবার তাকালাম আলমারিটার দিকে। আর তখনই ম্যাজিকটা ঘটল!
আমি অবাক হয়ে দেখলাম কড়ায় লাগানো তালাটা খোলা। মানে দুটো কড়ার মধ্যেই লাগানো, কিন্তু খোলা। দাদুভাইয়ের দিকে তাকালাম। দেখলাম শুয়ে আছেন উল্টোদিকে ফিরে। আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে তালাটা কড়া থেকে খুললাম সাবধানে। ছোট ছোট হাত তো! তাও খুব আস্তে খুলে পাশের টেবিলে রেখে দিলাম। এবার পাল্লা ফাঁক করলাম। ক্যাঁচ করে শব্দ হল। চমকে তাকালাম দাদুভাইয়ের দিকে। নাঃ, এদিকে ফেরেনি। মনে হয় ঘুমোচ্ছে।
এবার আমার সেই অতি প্রিয় পুতুলটা দুহাত দিয়ে ধরলাম। জামায় হাত বোলালাম, ছাতাটায় হাত দিলাম। একটু যেন মুচকি হাসল পুতুলটা। আমিও হাসলাম। ব্যস, শখ মিটে গেল। আবার রেখে দিয়ে পাল্লা ভেজিয়ে দে দৌড়। তালা আর লাগাতে মনে নেই উত্তেজনায়।
মন খুশ। পুতুল হাতে নিয়েছি। সব কাজ ঠিকঠাক করলাম আবার। এদিকে বিকেলে বাড়ির লোকেদের খেয়াল হয়েছে যে তালাটা খোলা। পড়ে আছে পাশের টেবিলে। কে খুলল? কে খুলল?
দাদুভাইকে জিগ্যেস করল সবাই। দাদুভাই দেখল চাবি ঠিক জায়গাতেই আছে। সেখান থেকে কেউ নিতে গেলে দাদুভাই টের পাবেই।
বেশ একটা হুলুস্থুলু পড়ে গেল বাড়িতে। এ কী রহস্য! আমিও অবাক হয়েছিলাম কী করে তালাটা খুলল ভেবে। কিন্তু ছোট ছিলাম বলে অত গভীরভাবে ভাবতে পারিনি। বড় হবার পর যখনই মনে পড়েছে ঘটনাটা, তখনই ভেবেছি, কী করে সম্ভব হয়েছিল?
আমার বাবা বলেছিল, তালাটা খোলাই ছিল, কেউ খেয়াল করেনি। কিন্তু আমি অনেকদিন ধরে তালাটা টানাটানি করেছি পুতুলটা নেবার জন্য। পারিনি। লাগানোই ছিল সেটা।
আজ এই বয়সে পৌঁছে যখন ভাবি, মনে হয় ইচ্ছেশক্তির জোরেই বোধহয় তালাটা খুলে গেছিল। অদম্য ইচ্ছেশক্তি থাকলে এবং লেগে থাকতে পারলে সেই কাজ বা সেই ইচ্ছেপূরণ হবেই হবে। এটা আমার জীবনের একটা বড় শিক্ষা। তোমরাও পরখ করে দেখতে পার।
লেখক পরিচিতি - কবিতা ক্লাবের সদস্যদের প্রেরণায় কলম ধরেন। পত্র ভারতীর সঙ্গে প্রায় তিরিশ বছরের সম্পর্ক। জনপ্রিয় ছোটোদের পত্রিকা কিশোরভারতীর সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত। সুযোগ পেলেই ছোটোদের জন্য লিখতে বসেন।
খুব ভালো লাগলো পড়ে :)
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeletejiboner govir onuvob die chitrito ei lekha vison orthoboho....aro likhun :)
ReplyDeleteVery touching
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো ।
ReplyDelete