পক্ষিরাজের ডানা (দেশ):
ভাইজ্যাগে কিছুদিন
সহেলী চট্টোপাধ্যায়
বিশাখাপত্তনম, ভাইজ্যাগ আর ওয়ালটেয়ার। একই জায়গার অনেকগুলো নাম। ঠিক যেমন আমাদের এক এক জনের অনেকগুলো নাম থাকে। তোমার স্কুলের আর বাড়ির নাম নিশ্চয় এক নয়। তবে কোনও জায়গার এতগুলো নাম থাকলে বেশ মজা লাগে। গত ২৭ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটা পয়তিরিশ মিনিটে বিশাখাপত্তনম স্টেশনে নেমেছিলাম। ২৭ ডিসেম্বর রাত একটায় চেন্নাই মেলে চড়ার অভিজ্ঞতা কখনও ভোলার নয়। ট্রেন ভীষণ লেটে চলছিল। শুনলাম প্রায়ই নাকি লেটে চলে। গোটা রাস্তা বেশ বোর লাগছিল। এক সময় ক্লান্তি উধাও হয়ে গেল। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখি হঠাৎ করেই পৌঁছে গেছি পাহাড়ের রাজত্বে। পাহাড়ের কোলে বেশ ছোটো ছোটো শহর গড়ে উঠেছে। সে দেখতে ভারি মজার। জানলা দিয়ে তাই দেখতে দেখতে চলেছি। এরকম জায়গায় একটা বাড়ি হলে বেশ ভালো হত। এখানে বাড়িগুলো খুব সুন্দর দেখতে। দেশলাই বাক্সের মত দূর থেকে মনে হচ্ছে। পাহাড় আমার খুব প্রিয় বরাবর। একসময় বিশাখাপত্তনমে তো নামলাম। বিশাখাপত্তনম নাম এসেছে দেবী বিশাখার নাম থেকে। তা এই নিয়ে অনেক মত প্রচলিত আছে। পূর্বঘাট পর্বতমালা এবং বঙ্গোপসাগর বিশাখাপত্তনমকে ঘিরে রেখেছে।
ভারী সুন্দর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন স্টেশন চত্বর। কাছেই পাহাড় আছে। ঠাণ্ডা নেই তেমন, বরং বেশ আরামদায়ক আবহাওয়া। স্টেশনের বাইরে এসেও বেশ অবাক হয়ে গেলাম। দারুণ ঝকঝকে রাস্তা সব। তাতে গাড়ি চলছে। তবে কলকাতার মত এত গাড়ির লাইন নেই। ট্রাফিক জ্যামের সমস্যা নেই। দোকান-পাট, মানুষ জন সবই আছে কিন্তু জনসমুদ্র নেই। এই ভাইজ্যাগে এসেই সন্তু আর কাকাবাবু হারিয়ে গেছিল। সন্তু কোথায়? কাকাবাবু কোথায়? তোমরা হয়ত অনেকেই পড়েছ এই দারুণ অ্যাডভেঞ্চার।
সাবমেরিন মিউজিয়াম |
স্টেশন থেকে হোটেল বেশ কাছেই ছিল। খুব ভালো না হলেও চলনসই ছিল। সামনের বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যেত। একজন লোক সকাল থেকে একটা ঠেলা গাড়িতে চপ, সিঙ্গারা আর জিলিপি ভাজত। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। রাস্তা দিয়ে যারা চলাচল করত তাদের লক্ষ্য করতাম। জীবন যেন চলতে থাকে নদীর স্রোতের মত। এখানে সবই ভালো কিন্তু বাইক আরোহীরা হেলমেট ব্যাবহার করে না কেন বুঝলাম না। আর পুলিশও এই নিয়ে কোনওরকম কড়াকড়ি করে না। আমি খুঁজছিলাম বই-এর দোকান। মা খুঁজছিল মিষ্টির দোকান। যার যেটা ভালো লাগে।
পরের দিন সকালেই ছিল সিমাচলম মন্দির। নৃসিংহ দেবতার মন্দির হল সিমাচলম। বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে একটা হল এই নৃসিংহ অবতার। মুখটা সিংহের কিন্তু দেহটা মানুষের। পুরাণে আছে ভক্ত প্রহ্লাদ এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। প্রহ্লাদ খুব ছোটোবেলা থেকেই বিষ্ণুর আরাধনা করতেন। এর জন্য তাঁকে নিজের বাবা হিরণ্যকশিপুর কাছে প্রচুর অত্যাচারিত হতে হয়েছিল। বিষ্ণু শেষে নরসিংহ রূপ ধারণ করে হিরন্যকশিপুকে হত্যা করেন।
মন্দির বেশ প্রাচীন আমলের। তবে বেশ ভিড় হয়। বাবা মায়ের হাত শক্ত করে ধরে থাকবে ভেতরে ঢোকার সময়। খুব ঠেলাঠেলি হয় তখন। মন্দিরের পরিবেশ খুব সুন্দর। এখানেও পাহাড় আছে। আসলে পাহাড় আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই চলছে।
সিমাচলম মন্দির |
এরপর আমাদের গন্তব্য ছিল কৈলাসগিরি। পাহাড়ের মাথায় একটা পার্ক আছে। শিব আর পার্বতীর বিশাল মূর্তি আছে। এখানে তোমরা ফটো তুলতে পারো। এটা একটা অদ্ভুত জায়গা। এখানে একটা ভিউ পয়েন্ট আছে, সেখান থেকে তুমি সমুদ্র দেখতে পারবে। অর্থাৎ পাহাড় আর সমুদ্রকে এক সাথে দেখতে পারবে। আর এটাই ভাইজ্যাগের বিশেষত্ব। পাহাড়ের ওপর থেকে দেখতে পাবে অনেক নীচে সমুদ্রের ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে আর অল্পদূরেই পাহাড়ের সারি।
পাহাড়ের ওপর থেকে নিচের শহরের দৃশ্য |
কৈলাসগিরি |
ভিউপয়েন্ট থেকে সমুদ্র আর পাহাড় |
পাহাড়গুলো যেন বুক দিয়ে আগলে রেখেছে সমুদ্রকে। আমি কখনও এমন দৃশ্য দেখিনি আগে। তাই মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম।
ডলফিনস নোজ |
এরপর হোটেলে ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে একটু রেস্ট। তারপর একটা অন্য রকম জায়গা ছিল। শুকনো মাছ তৈরির কারখানা। সমুদ্রকে কেন্দ্র করেই কত মানুষের কত রকম জীবিকা গড়ে উঠেছে। এখানে মাছের খুব দুর্গন্ধ ছিল। তবু একটা অন্য রকম জিনিস দেখা গেল বটে।
শুকনো মাছ এভাবেই তৈরি করে |
এখান থেকে গেলাম রামকৃষ্ণ বিচ। তখন সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। এখানে মা কালীর একটা মন্দির আছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও আছেন। ঋষিকোণ্ডা বিচটাও দেখার মত। আর ছিল সাবমেরিন মিউজিয়াম। এটা আমরা যেতে পারিনি। বন্ধ থাকে সোমবার। মাছের একটা মিউজিয়াম আছে সেটা অবশ্য দেখেছি। বিভিন্ন রকম মাছ দেখতে পাবে এখানে। বিভিন্ন রকম কচ্ছপও আছে। মৎস্যদর্শিনী এই মিউজিয়ামের নাম।
ভাইজ্যাগে দেখার আরও অনেক কিছু আছে। লাইট হাউস, বড়া গুহা বা বড়া কেভ, বিশাখা মিউজিয়াম, ইন্দিরা গান্ধী জুলজিক্যাল পার্ক, ডক্টর রামানাইডু ফ্লিম স্টুডিও এবং আরও অনেক কিছু। এছাড়া আছে কিছু প্রাচীন বৌদ্ধস্তূপ। যার মধ্যে বেশির ভাগ স্তূপ খুব সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। একসময় এখানে বৌদ্ধ ধর্ম জনপ্রিয় ছিল। কলিঙ্গর রাজ্যের অংশ ছিল বিশাখাপত্তনম। অনুমান করা শক্ত নয় যে সম্রাট অশোকের হাত ধরেই এখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন হয়েছিল। তাই হাতে সময় নিয়ে ভাইজাগে আসাই ভালো। না হলে কিন্তু আফসোস থেকে যাবে।
ভাইজ্যাগে একদিন শেষ হয়ে গেল। এবার আমরা রওনা দেব আরাকু ভ্যালির উদ্দেশে। পরের দিন খুব সকালে উঠতে হবে ট্রেন ধরার জন্য।
চল দেখি আরাকুতে আমরা কী কী দেখতে পাই।
ভোর বেলা উঠে আবার ট্রেন ধরা। এই ট্রেন বেশ মজার। কু ঝিক ঝিক করে চলে। তোমরা হাসছ, ভাবছ সব ট্রেনই তো তাই। কিন্তু তবু এর একটু অভিনবত্ব আছে। সবুজ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে। একটার পর একটা টানেল পার হচ্ছে। টানেলের ভেতর ট্রেন ঢুকলেই অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আর টানেল থেকে বেরুলেই ঝলমলে দিন। এটাই হল মজা। একবার আলো তো পরের মুহূর্তেই আঁধার। ঠিক আমাদের জীবনের মত। টানেলগুলো গুণে দেখো তো মোট ক’টা আছে। আমি আবার গুণতিতে খুব কাঁচা।
কু ঝিক ঝিক |
সবুজ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে কখনও কোনও ছোট্ট একটা স্টেশনে ট্রেনটা দম নেবার জন্য একটু থামছে। মাথায় ফলের ঝুড়ি নিয়ে ওঠানামা করছে গ্রাম্য কিছু নারী-পুরুষ। কেউ বাদাম, ঝালমুড়ি, চা এসবও বিক্রি করছে। আরাকু স্টেশানে আমরা নামলাম। এই ট্রেনজার্নিই এখানকার সব চেয়ে উপভোগ্য। আরাকু এখানকার হিল স্টেশান। বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। সবুজে সবুজ চারদিক। এখানে চা আর কফি বাগিচা আছে।
আরাকু |
সবুজ আরাকু ভ্যালি (গাড়িতে যেতে যেতে এক ঝলক) |
এখানে প্রধান দেখার জিনিস হল আদিবাসী মিউজিয়াম। এটা তোমাদের খুব ভালো লাগবে। আদিবাসীদের তৈরি বিভিন্ন জিনিস বিক্রি হচ্ছিল তবে দাম খুব বেশি। দরদাম করতে না পারলে ঠকে যাবে। এমনটাই আমাদের বললেন ট্যুর ম্যানেজার।
পরের দ্রষ্টব্য ছিল বড়া কেভ বা বড়াগুহালু। উইলিয়াম কিং ১৮০৭ সালে এই কেভ বা গুহা আবিষ্কার করেন। ভারতের বড় বড় গুহাগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম। ভেতরে ঢুকে অবশ্যই দেখবে। পুরোটা দেখে নেবে। এখানে প্রকৃতি নিজেই সৃষ্টি করেছে অনেক কিছু। যেমন শিবলিঙ্গ, বাঘের থাবা। তোমরা কল্পনা করে নেবে কোনটা বাঘের থাবা, কোনটা গণেশ ঠাকুর, কোনটা পদ্মফুল।
বড়া কেভ |
আরাকু ভ্যালিতে একরাত থাকতে পারলে ভালো হত। কিন্তু এই ট্যুরপার্টি বড় তাড়াহুড়ো করে সব জায়গায়। ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ে ঘেরা এই ছোট্ট জায়গায় আবার আসতে হবে। এবার এসে বেশ অনেকদিন থাকব। ভবিষ্যতের কত পরিকল্পনাই তো আমরা করি। স্বপ্ন দেখতে দোষ কি?
আরাকুর আরও কিছু দেখার জায়গা আছে। যেমন, কটিকি জলপ্রপাত, পদ্মপূরণ বোটানিক্যাল গার্ডেন, অনন্থগিরি পাহাড়, টায়ডা পার্ক, চাপারাই জলপ্রপাত এবং আরও অনেক কিছু। একদিনে এত কিছু দেখা সম্ভব নয়। তাই আরাকুতে দুদিন থাকতেই হবে। আমার বেড়ানোর গল্প আজ এখানেই শেষ করছি। কথা দিচ্ছি পরের বার আমি হায়দ্রাবাদ নিয়ে যাব তোমাদের।
নীল জলরাশি (ঋষিকোণ্ডা বিচ) |
___________
ছবি – আন্তর্জাল এবং লেখক
Darun
ReplyDelete