প্রথম অর্জুন
রাজীব কুমার সাহা
তারিখঃ ৬ জুন ১৯৩৯ ইং, স্থানঃ নংলি, অমৃতসর, পাঞ্জাব, ভারতবর্ষ। এক শিখ পরিবারে মায়ের কোল আলো করে জন্ম হল ফুটফুটে এক সোনার ছেলের। পিতা তেহল সিং রণধাওয়া। শিখ রীতিনীতি মেনে যথাসময়ে ছেলের নাম রাখা হল গুরবচন সিং রণধাওয়া। পিতা তেহল সিং রণধাওয়া এবং অপর দুই ভাই হরভজন সিং রণধাওয়া এবং যোগীন্দর সিং রণধাওয়াও ছিলেন বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ। হরভজন ও যোগীন্দর ছিলেন যথাক্রমে অ্যাথলেটিক এবং ভলিবল প্লেয়ার। বিশেষত পিতার উৎসাহেই তিন ভাই ক্রীড়াজগতে নিজেদের পরিচিতি লাভ করেন। তবে এঁদের মধ্যে গুরবচন নিজের দক্ষতা প্রমাণ করে এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করেন যে তাঁকে ‘ভারতের জিম থর্প’ নামে ডাকা হয়। যদিও মিলখা সিং-এর মতো তাঁকে নিয়ে সিনেমা তৈরি করা হয়নি, তবুও তাঁকেই ‘ভারতবর্ষের সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সর্বোপরি ভারতবর্ষের ক্রীড়াজগতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে গুরবচন সিং রণধাওয়া ১৯৬১ সালে অ্যাথলেটিক বিভাগে প্রথম অর্জুন পুরষ্কারের অধিকারী হন। প্রথম ‘ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড’ ক্রীড়াবিদ হিসেবে তিনি অর্জুন পুরষ্কারের জন্য নির্বাচিত হন।
উনিশশো কুড়ি দশকের শেষ এবং ত্রিশ দশকের প্রথম দিকে এক যুবা শিখ ক্রীড়াবিদ হাই জাম্প, লং জাম্প, হাই হার্ডলস এবং লো হার্ডলসে অমৃতসরের খালসা কলেজ এবং লাহোরের সরকারি কলেজের ‘অ্যাথলেটিক ট্র্যাক’ দাপিয়ে নিজের প্রতিভার আলোকচ্ছটায় সকল ক্রীড়াপ্রেমীদের মুগ্ধ করতে লাগলেন। যেকোনো ইভেন্টেই তিনিই ছিলেন সেরা। নাম তেহল সিং রণধাওয়া। এই মহান ক্রীড়াবিদের যোগ্য সন্তান হচ্ছেন গুরবচন সিং রণধাওয়া।
গুরবচনের রক্তেই ছিল খেলাধুলোর দক্ষতা। প্রতিভা ছিল সহজাত। স্কুল এবং কলেজ জীবন থেকেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতা জিততে জিততে তাঁর মধ্যে খেলাধুলোর প্রতি নেশা ধরে যায় এবং প্রতিনিয়ত নিজের প্রতিভায় শান দিতে দিতে দক্ষতার চরম শিখরে চড়তে শুরু করেন। প্রথমে অমৃতসরের খালসা কলেজে এবং পরে লাহোরের সরকারি কলেজে অ্যাথলেটিক্সের সব ইভেন্টে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। আস্তে আস্তে গুরবচন অ্যাথলেটিক্সের দুনিয়ায় একজন সত্যিকারের অল রাউন্ডার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেন। শেষে নিজের প্রশিক্ষকের উপদেশে সব ছেড়েছুড়ে শুধুমাত্র ডিক্যাথলন-এ নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করেন। ডিক্যাথলন বা ক্রীড়াদশক হচ্ছে, দশটি খেলার সমবায়ে অনুষ্ঠিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, যেখানে প্রত্যেক প্রতিযোগীর সবগুলো খেলাতেই অংশগ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। ধীরে ধীরে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তারকা খেলোয়াড় হিসেবে চিহ্নিত হন এই গুরবচন। আজও গুরবচন সিংকেই ভারতের ক্রীড়াজগতে সবচেয়ে বহুমুখী ক্রীড়াবিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
মাত্র আঠারো বছর বয়সেই গুরবচন ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিকসের যোগ্যতা অর্জনকারী ইভেন্টে সর্বমোট ৬৫০০ পয়েন্ট নিয়ে ডিক্যাথলন ইভেন্টে অংশ নিতে রোম পাড়ি দেবার ছাড়পত্র আদায় করে নেন। কিন্তু রোম অলিম্পিকসে তেমন আশাপ্রদ ফল করতে পারেননি তিনি। অলিম্পিকসে মোট দুদিনের ইভেন্টে প্রথম দিনই নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ফেলেন অনভিজ্ঞ গুরবচন। ফলে প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দ্বিতীয় দিন খেলায় আর অংশগ্রহণ করতে পারেননি।
একুশ বছর বয়সে গুরবচন সিং জাতীয় স্তরে জীবনে প্রথমবারের মতো বড় ধরনের সাফল্যের স্বাদ আস্বাদন করেন। ১৯৬০ সালে দিল্লিতে আয়োজিত জাতীয় ক্রীড়া অনুষ্ঠানে ৫৭৯৩ পয়েন্ট অর্জন করে ডঃ চীমা এম মুথাইয়া-এর জাতীয় ডিক্যাথলন রেকর্ড ভেঙে দেন। এছাড়া দুদিনের মধ্যে হাই জাম্প, জেভলিন থ্রো এবং ১১০ মিটার হার্ডল রেসে মোট চারটি জাতীয় রেকর্ড ভেঙে নিজের কৃতিত্বের পরিচয় দেন গুরবচন। মুথাইয়া তখন ভারতীয় ক্রীড়া জগতে সাফল্যের মধ্য গগনে বিরাজ করছেন। পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সৈনিক হিসেবে সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফোর্সের মুখ উজ্জ্বল করার দায়িত্বও কাঁধে তুলে নেন গুরবচন।
১৯৬২ সালে জাকার্তায় আয়োজিত এশিয়ান গেমসে অত্যন্ত কঠিন ক্রীড়াদশক প্রতিযোগিতায় উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেন রণধাওয়া। ৬৭৩৯ পয়েন্ট অর্জন করে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাপানের শোশুক সুজুকি-কে ৫৫০ পয়েন্টে হারিয়ে সোনার মেডেল ছিনিয়ে নেন। তারপর ৬৯১২ পয়েন্ট ছিনিয়ে নিয়ে রণধাওয়া ডিক্যাথলনে জাতীয় রেকর্ড গড়েন যা পরবর্তী একযুগ পর্যন্ত সুরক্ষিত ছিল। শুধু তাই নয়, জাকার্তা এশিয়ান গেমসে তাঁকে ‘শ্রেষ্ঠ এশিয়ান গেমস অ্যাথলেট’ নামে অভিহিতও করা হয়। বলা হত, রণধাওয়া এতটাই প্রতিভাসম্পন্ন ছিলেন যে তিনি চাইলে তাঁর ইচ্ছেমত যেকোনও খেলাধুলোতেই চূড়ান্ত সফল হতে পারতেন। তদানীন্তন কালে গুরবচন ছাড়া ভারতীয় ক্রীড়া জগতে এতগুলো স্পোর্টস মীটে অংশ নিয়ে জিত হাসিল করার মতো আর এমন কোনও ক্রীড়াবিদ ছিলেন না। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে হেনরি রেবেলো (ব্যাঙ্গালুরু) ও মিলখা সিং (পাঞ্জাব)-এর পর তিনিই ছিলেন তৃতীয় ভারতীয় যিনি অলিম্পিক গেমসের ফাইনালে অংশ নেন।
কিন্তু জাকার্তা এশিয়ান গেমসের অব্যবহিত পরেই গুরবচন কাঁধে চোট পান। চোট সারিয়ে গুরবচন তাঁর অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া দিয়ে আকস্মিকভাবে ডিক্যাথলন ছেড়ে দিয়ে ১১০ মিটার হার্ডল রেসের দিকে ঝুঁকে পড়েন। হাঙ্গেরিয়ান কোচ জোজেফ কোভ্যাক্স-এর অধীনে চলে কঠোর অধ্যাবসায়। কোভ্যাক্স তখন পাঞ্জাবের পাতিয়ালায় অবস্থিত ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ স্পোর্টসের পরিদর্শন প্রশিক্ষক।
পঁচিশ বছর বয়সে হঠাৎ ইউরোপে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান গুরবচন সিং। ১৯৬৪ সালে টোকিও অলিম্পিকসের প্রাক্কালে এই ইউরোপ সফর তাঁকে ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করল। রয়েছে মাত্র চার বছর আগে রোম অলিম্পিকসে বিদেশের মাটিতে খেলার অভিজ্ঞতা। সব মিলিয়ে চোখে অন্তহীন স্বপ্ন। টগবগ করে ফুটে উঠছে তাজা তরুণ রক্ত। টোকিও অলিম্পিকসে গুরবচন শুধুমাত্র ১১০ মিটার হার্ডল রেসেই অংশ নেন। একমাত্র দেশের জন্যে মেডেল জেতার লক্ষ্যে বাকি সব ইভেন্টকে বিদায় জানিয়ে শুধুমাত্র ১১০ মিটার হার্ডল রেসের জন্যে হাড়ভাঙা অনুশীলন করেছেন গুরবচন। ফাইনালে মেডেল ছিনিয়ে নেওয়ার বাসনা হয়ে উঠল উদগ্র। কিন্তু কপালে দুর্ভাগ্য নাচলে যা হয়। সেমি-ফাইনাল ইভেন্ট শেষ হওয়ার পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যেই ফাইনাল শুরু হওয়ার কথা। হঠাৎ শুরু হল অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাত। টোকিওর তাপমাত্রা সহসা নেমে গেল ১৪ ডিগ্রিতে আর আর্দ্রতা পৌঁছে গেল ৯৬ শতাংশে। মাঠ অচিরেই বৃষ্টির জলে প্লাবনাকার ধারণ করে ফেলল। ট্র্যাকের অবস্থাও হয়ে পড়ল আশঙ্কাতীত খারাপ। তারপরও সাঁইত্রিশজন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে ১৪.০১ সেকেন্ডে রেস শেষ করে সেমি-ফাইনালে পৌঁছে গেলেন। তারিখটা ছিল ১৮ই অক্টোবর ১৯৬৪ সাল। শেষে এই প্রতিকূল অবস্থাতেই ফাইনাল ইভেন্ট আরম্ভ হয় এবং গুরবচন সেই ১৪.০১ সেকেন্ডেই পঞ্চম স্থান দখল করেন। প্রতিযোগীদের মধ্যে হারজিতের লড়াইটা এতটাই সূক্ষ্ম হয়েছিল যে শেষে ফটো ফিনিশের সাহায্য নিয়ে ফলাফল ঘোষণা করতে হয়। সোনার পদক জেতেন জোনস (ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা, ১৩.০৬ সেকেন্ড), রৌপ্যপদকের দাবীদার হন আরেকজন আমেরিকাবাসী লিন্ডগ্রেন (১৩.০৭ সেকেন্ড) এবং ব্রোঞ্জ মেডেল গলায় পরেন দুই যুগ্মবিজয়ী অ্যান্টলি মিখাইলেভ (ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক) এবং একজন ইতালীয় ক্রীড়াবিদ।
পরে এক সাক্ষাৎকারে গুরবচন বলেছিলেন, “হঠাৎ করে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হল আর তখনকার যুগে কোনও খেলার মাঠেই সিনথেটিক ট্র্যাকের ব্যবস্থা ছিল না। এই ট্র্যাকে খেলা আমাদের জন্যে সত্যিই খুব কঠিন ছিল। শেষ পর্যন্ত সবাইকে হতচকিত করে দিয়ে ১৪ সেকেন্ডে রেস শেষ করলাম এবং ফাইনালে উঠলাম।”
প্রথম ভারতীয় তো বটেই, প্রথম এশীয় ক্রীড়াবিদ হিসেবেও গুরবচন সিং রণধাওয়া কোনও অলিম্পিকের ফাইনালে ১১০ মিটার হার্ডলে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তী ঊনত্রিশ বছর অবধি এই রেকর্ডের অধিকারী ছিলেন তিনি। টোকিও অলিম্পিকে ভারতীয় হার্ডলারদের পুরোধা হিসেবে রণধাওয়ার হাতে গোটা ভারতীয় টীম দেশের জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিল ফ্ল্যাগ মার্চের জন্যে।
১৯৬৯ সালে গুরবচন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন জসবিন্দর নাম্নী এক কৃতী ডিসকাস থ্রোয়ার এবং শটপাটার-এর সাথে। খেলাধুলোয় অনেকবার নিজের বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন জসবিন্দর। তাঁদের সুযোগ্য পুত্র রণজিৎ রণধাওয়াও একজন প্রতিশ্রুতিবান হার্ডলার।
আজও ভারতবাসী অলিম্পিকে ‘অ্যাথলেটিক ট্র্যাক’-এ একটা মেডেলের জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছে। ষাটের দশকে গুরবচন সিং রণধাওয়া ছিলেন ‘স্বপ্নের ভারতীয় ক্রীড়াবিদ দল’-এর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় এটাও যে এই সোনার ক্রীড়াবিদ গুরবচন জাতির তরফ থেকে তাঁর অসামান্য প্রতিভার যোগ্যতম স্বীকৃতিটুকু তেমনভাবে উল্লেখযোগ্য নয় আজও। বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে ভারতীয় ক্রীড়াদলের এক সময়ের গর্ব এই গুরবচন সিং রণধাওয়া। তবে ২০০৫ সালে ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ গুরবচন সিং রণধাওয়াকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয়।
ভারতের উঠতি খেলোয়াড়দের সাহায্যার্থে গুরবচন পিতা তেহল সিং রণধাওয়ার নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন। শুধু তাই নয়, অর্জুন পুরষ্কার প্রাপক হিসেবে প্রতিমাসে পেনশনরূপে পাওয়া দু’হাজার টাকা পাঞ্জাবের একজন হকি খেলোয়াড় এবং তিনজন অ্যাথলেটিকের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে দান করে আসছেন ভারতবর্ষের প্রথম অর্জুন গুরবচন সিং রণধাওয়া। বছর ছিয়াত্তরের এই যুবক আজও দৃপ্তকণ্ঠে কৌতুক করে বলেন, “আমি এখনও অবসর নিইনি। রণধাওয়ারা কখনও রিটায়ার করে না।”
____________
তথ্যসূত্র ও ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment