শেষ জমিদারের আখ্যান
ঋষভ চট্টোপাধ্যায়
এক
২০২১ সালের জুলাই
“আকাশের চোখ যেথা শায়িত মৃতপ্রায়,
যেথা নিজের মুখের আদল চেনার বড়ো দায়,
বিপ্রতীপে তার শূন্য জঠর-দ্বার
স্বর্ণযুগের সিন্দুকে শেষ অহংকার।”
পঙতি ক’টি নিবিড়ভাবে আরও বেশ কয়েকবার পড়ে শবর। এই নিয়ে গত সাতদিনে সম্ভবত পঞ্চাশতম বার। এ ক’দিনে এতবার পড়ার দরুন মুখস্তই হয়ে গিয়েছে লাইনগুলো ওর। এক একবার মনে হয় লাইনগুলো যে গুপ্তধনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাতে সন্দেহের অবকাশই নেই। বিশেষ করে ‘স্বর্ণ’, ‘সিন্দুক’ এই শব্দগুলো সেই ভাবনাকেই জোরদার করে। আবার পরক্ষণেই মনে হয় ধুর! একটা নিতান্তই নস্টালজিক কবিতাকে অহেতুক ধাঁধা বলে কল্পনা করে অলীক স্বপ্ন দেখছে সে। আর তখনই এই চল্লিশ ছুঁইছুঁই বয়েসে কলকাতার এন্টালি থেকে এই সুদূর দিনাজপুরের রতনপুর জমিদারি এস্টেটে আসার পুরো প্ল্যানটাকেই নির্ভেজাল বোকামি বলে ঠাহর হয় ওর। এস্টেট না ছাই! একটা পোড়ো ভগ্নপ্রায় দৈত্যের মতো অট্টালিকা। এদিক ওদিক কার্নিশ ভেঙে পড়েছে, কাঠের সিঁড়িগুলো নড়বড় করছে, ঠাকুদালানের দুটো থাম ভেঙে পড়েছে আর একটা ভাঙব ভাঙব করছে। বট অশত্থের চারা ফটকের পাশের পাঁচিল ফাটিয়ে মাথা তুলছে আকাশের দিকে। এরকমই একটি মনুষ্য-বিবর্জিত এবং সর্প-অধ্যুষিত বাড়িতে একটা মশারি আর ওডোমসকে সঙ্গী করে গত চারদিন ধরে রাত কাটাচ্ছে শবর।
স্বর্গত ভালোদাদুর উপর বেশ রাগই হচ্ছিল ওর। ভালোদাদু চলে যাওয়ার ক’দিন আগে যদি ওকে ডেকে না বলতেন এই রতনপুরের কথা, তাহলে তো আর ওকে এখানে এসে রাতের পর রাত মশাদের ব্লাড সাপ্লাই দিতে হত না।
একটা তীব্র মিষ্টি আতরের গন্ধে চিন্তায় ছেদ পড়ে শবরের। গন্ধটা এই চারদিনে চেনা হয়ে গিয়েছে। পুজোর সময় শোভাবাজার রাজবাড়ির বাইরের চাতালে বসে থাকা আতরওয়ালার কাছ থেকে একবার শখ করে আতর কিনেছিল সে। গন্ধটা কতকটা সেরকমই। কব্জি উলটে সময়টা দ্যাখে। হ্যাঁ, ঠিক রাত ন’টা। ভূত বাবাজির আসার সময় হয়ে গিয়েছে।
“এসেছেন?” নিঝুম বিশালাকার বাড়িটার জমাট বাঁধা নীরবতা ভেঙে বলে ওঠে শবর। দেয়ালের গায়ে মোমের ছায়া কাঁপিয়ে গমগমে গলায় উত্তর আসে, “এসেছি।”
“আপনি কিন্তু সময়ে বেশ পাক্কা। আর পাঁচটা বাঙালির মতো নন।”
“আর পাঁচটা বাঙালি?” তাচ্ছিল্যের সুরে শব্দ তিনটে বলে প্রেত কণ্ঠ। “যে বাড়িতে দাঁড়িয়ে রয়েছ, সেখানে স্বয়ং হাইকোর্টের ইংরেজ জজ অন্নগ্রহন করেছেন। খোদ বড়োলাটের সেক্রেটারি এ বাড়ির আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালে সামনে দিগন্ত অবধি যে জমি দেখা যায়, সে জমি এই বংশের ছিল। আশপাশের ছয়টা গ্রামের আটশো লোক সেখানে মুনিশ খাটত। এই বংশের কোনোকিছুই আর পাঁচটা বাঙালির মতো ছিল না হে ছোকরা।”
“উফফ! প্রতাপবাবু, আপনাকেও বলিহারি যাই। জমি গিয়েছে, ঠাট-বাট গিয়েছে, বংশের শেষ কুলপ্রদীপ অবধি নিভে গিয়েছে - তবু এত বছরেও জমিদারি মেজাজটা গেল না,” শবরের গলায় ব্যাঙ্গের সুর স্পষ্ট।
“ওটা যাবেও না। মরে ভূত হয়ে গিয়েছি দেখতেই তো পাচ্ছ। শরীর পুড়ে ছাই হয়ে গেল ওই ডালখোলার শ্মশানে, তা সে চিতার আগুন পারল কী এই মেজাজটা পুড়িয়ে দিতে?” আবারও সেই তাচ্ছিল্যের সুর ভেসে এল বাতাসে।
কয়েক সেকেন্ড সব চুপচাপ। তারপর সামনের নোনা ধরা দেয়ালটার উপর একটা আবছা মানুষের সিলুয়েট গড়ে উঠতে দেখল শবর। ধীরে ধীরে। কণ্ঠস্বর কানে এল তার একটু পরে। “যাক গে, ছাড়ো পুরোনো কথা। তা তুমি এই পোড়ো বাড়িতে ঠিক কোন ধান্দায় এসেছ বলো তো? সরকার বিপজ্জনক সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়ার পর তো আর কেউ এদিকপানে আসে না।”
“আপনি আন্দাজ করুন দেখি,” শান্ত গলায় বলে শবর।
“আমার আন্দাজ করার প্রয়োজন নেই। তুমি কেন এখানে এসেছ সে আমি ভালোমতোই জানি, কিন্তু সে উদ্দেশ্য তোমার পূরণ হবে না।” অদৃশ্য কণ্ঠের মৃদু আত্মতৃপ্ত হাসিটা নজর এড়ায় না শবরের। সে কণ্ঠ বলে চলে – “এই বাড়ির পুবে-পশ্চিমে প্রায় দশ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গ্রামাঞ্চল। তাতে শ’য়ে-শ’য়ে গরিব-গুর্বো মানুষের বাস। তুমি কী ভাব তোমার আগে কারোর নজর জমিদারবাড়ির দিকে পড়েনি? তারা সবাই হন্যে হয়ে নাওয়া খাওয়া ভুলে এই বাড়িতে পড়ে থেকেছে, এই বাড়ির দেয়ালে মাথা কুটে মরেছে, কিন্তু এক ফালি সোনার পাতও খুঁজে বের করতে পারেনি।” হো হো করে প্রবল পরিতৃপ্তির হাসি হেসে ওঠে প্রেতকণ্ঠ। হাসি থামতে ধীর স্বরে বলে ওঠে – “তোমার অদৃষ্টেও একই পরিণতি অপেক্ষা করছে।”
“বাব্বাহ! আপনি তো থট রিডিংও পারেন দেখছি মশাই। তা, গ্রামের লোকজন এই চত্বরে ঘেঁষে না নাকি আপনি ঘাড় মটকে দেবেন সেই ভয়ে?”
“ছি!” ধিক্কার ঝরে পড়ে বাতাসে। “মানুষকে ভয় দেখিয়ে মজা পাওয়া অত্যন্ত নিম্নরুচির প্রেতের পরিচয়। ওসব মুটে-মজুর ভূতেদের স্বভাব।”
ফের খানিকক্ষণ সব নিস্তব্ধ। তারপর ক্রমশ দূরে চলে যেতে থাকা একটা স্বর কানে আসে শবরের। “যে প্রতাপনারায়ণের একটা ডাকে ছয়-ছয়টা গ্রামের লোক একবাক্যে ছুটে আসত, তার মানুষকে ভয় দেখানোর দরকার পড়ে না। আমার যা করার আমি করেই মরেছি।”
দুই
বছর পঞ্চাশ আগের কথা
মন্দিরের উঠোনে বসে বাবুর পায়ে মাথা রেখে অঝোরে কেঁদে চলেছে হরিহর। এমন দিন যে তার এবং তার মতোই আরও শ’খানেক কর্মচারীর জীবনে নেমে আসতে পারে, দূর কল্পনাতেও ভাবেনি সে। বাবু তাদের সকলকে এক কথায় চাকরি ছেড়ে চলে যেতে বলবেন? যে বাড়িতে তিন প্রজন্ম ধরে কাজ করে এসেছে সেই বাড়ি ছেড়েও? এ কী করে সম্ভব?
হরিহরের মাথায় হাত রাখেন প্রতাপনারায়ণ। “ওঠ হরি, ওঠ। আমি বুঝতে পারছি তোর মধ্যে কী চলছে, কিন্তু আমাদের হাতে যে আর কিছুই নেই রে। সেরেস্তার হিসেব তো সব তুইই দেখিস। অফিসিয়াল চিঠিপত্রও সব তোর হাতেই আসে। খুব ভালো করেই জানিস সরকারের থেকে কী নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাহলে আর কেঁদে লাভ আছে কোনো?”
ধীরে ধীরে বাবুর দিকে মুখ তোলে হরিহর। কান্নাটা গলায় চেপে রেখে বলে, “আমি অতশত বুঝি না, বাবু। এই ছাব্বিশটা বছর আমি এই বাড়িটায় থেকেছি। দিনের পর দিন আশি একর ধান-জমি তদারক করেছি ঠায় রোদে দাঁড়িয়ে, বৃষ্টি-বাদলা মানিনি। ওই যে ওই সেরেস্তার ঘরটা - ওই ঘরটায় প্রতিটা সকাল কাটে আমার। ওই যে উপরের বারান্দাটা - ওই খানটায় বসে অষ্টমীর সন্ধিপুজোর পর মা ঠাকরুনের বেড়ে দেওয়া ভোগ খেয়েছি আমি...” কান্নাটা আর চেপে রাখতে পারে না হরিহর। আষাঢ়ে বৃষ্টির মতো কাঁদতে কাঁদতে দু-হাতে মুখ ঢেকে বলে ওঠে – “এই সবকিছু কেউ একটানে আমার হাত থেকে কেড়ে নেবে, এ আমি হতে দেব না বাবু।”
“পাগল ছেলে! তো কী করবি তুই? হরি, দেশ স্বাধীন হয়েছে। গণতন্ত্র এসেছে দেশে। আমাদের মতো রাজা-রাজড়াদের যুগ শেষ। রক্তের নিয়মে আর কেউ ক্ষমতায় থাকবে না। এখন ব্যালট কাগজ দিয়ে রাজা নির্বাচিত হয়, বুঝলি? সবই তো জানিস। জমিদারির পাট চুকেছে। আমাদেরও তাই এবারে মানে মানে বিদায় নেওয়ার পালা।”
“তা বলে, এত এত জমি সব সরকার এক কথায় কেড়ে নেবে?”
“ওরে, কেড়ে তো আর এমনি এমনি নিচ্ছে না। সাধারণ চাষীদের যাতে উপকার হয়, তাদের একটু আয় বাড়ে, সেইজন্যই তো নেওয়া। আমাদের দিন গিয়েছে রে হরি, এখন তোদের দিন। আর তাছাড়া, এই বাড়ি আর জমিটুকু ছাড়া আমাদের আর ছিলটাই বা কী বল তো? দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই তো খাজনা নেওয়া বন্ধ হয়ে গেল। স্বাধীন দেশে সবাই শুধু সরকারকে খাজনা দেয়। এই জমিটুকুর ফলনের টাকায় টিমটিম করে এই জমিদারি চলছিল। তোদেরকে মাইনে দিচ্ছিলাম। এখন এই জমিটুকুও চলে গেলে...” একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের কোন গভীর থেকে উঠে আসে প্রতাপনারায়ণের গলায়।
একটু থেমে হরিহরের দিকে ম্লান দৃষ্টিতে তাকান তিনি, “সময়ের নির্দেশ বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে হয় রে হরি। এই কথাটা আজীবন মনে রাখবি।”
ঠিক এই সময় বাইরে তুমুল হই-হট্টগোলের আওয়াজ শোনা যায়। যে আওয়াজটা বেশ কিছুক্ষণ ধরেই অনেক দূর থেকে কানে আসছিল, সেটা এখন জমিদারবাড়ির একেবারে কাছে এসে পড়েছে। পঞ্চাশ-ষাট জনের একটা মিছিল। কারোর কারোর হাতের মশালের লেলিহান শিখা সন্ধ্যার গ্রামীণ অন্ধকার পুড়িয়ে দিচ্ছে। তালসারির মাঠের পিছনের দিগন্ত সেই আলোয় লাল। সমবেত কণ্ঠ আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে স্লোগান দিচ্ছে।
“জমিদারের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।”
“জমির মালিক চাষি নিজে, জমিদারি মানব না।”
কয়েক মিনিট পর মিছিলটা জমিদারবাড়ি ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল। সেই উর্দ্ধগামী স্ফুলিঙ্গের দিকে তাকিয়ে প্রতাপনারায়ণ বললেন, “ওই দেখ হরি - সময় নির্দেশ দিয়ে গেল। দেখলি?”
হরিহর কী বলবে কিছু খুঁজে পায় না। ছলছলে চোখে নির্বাক তাকিয়ে থাকে।
প্রতাপনারায়ণ শান্ত গলায় বলেন, “হ্যাঁ রে, হরি, আমি যদি খুব ভুল না করি তাহলে ওই মশালধরা হাতের মধ্যে দুটো হাত আমাদের শ্যামাপদর, না রে?”
লজ্জায়, যন্ত্রণায় মাথা নীচে ঝুঁকে আসে হরিপদর। নিজের গালেই চড় মারতে ইচ্ছে করে তার। “কী বলব বলেন কর্তাবাবু? নিজের ছেলেই যদি বেইমানি করে, তাহলে কোথায় যাই? বলি, তোর বাপ্-ঠাকুরদা তিনজন্ম এই বাড়ির নুন খেল, কর্তাবাবুর যোগাযোগে রায়গঞ্জের বড়ো স্কুলে পড়াশুনা করলি, সেসবের কী কোনো দাম নেই তোর কাছে?”
“আঃ! অকারণ নিজের ছেলেকে শাপ-শাপান্ত করিসনে হরি। সে এ যুগের ছেলে। বাপ্-ঠাকুরদা যুগ যুগ ধরে জমিদারের গোলামি করবে এ তার পছন্দ নাই হতে পারে।” ছাল-চামড়া উঠে যাওয়া বেতের পুরোনো লাঠিটা ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন প্রতাপনারায়ণ। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে ফেলে হরিহর। পরম যত্নে তাঁকে দালানের সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে সাহায্য করে। প্রতাপ বলে চলেন, “আর পছন্দ হবেই বা কেন বল? এই এত বড়ো জমিতে এতগুলো মানুষ হাড়ভাঙা খাটে, লাভের গুড় বেশিটাই চলে যায় আমাদের পেটে, ওরা পায়ই বা কতটুকু? আমিও কোনোকালে এসব নিয়ে ভাবিনি, জানিস? বাপ্-ঠাকুরদার নিয়ম মুখ বুজে মেনে নিয়েছি।”
“কিন্তু বাবু, এই গরিব মানুষগুলো তো আপনাকে খালি সমীহ করে না, ভালোও তো বাসে। আর সে ভালোবাসা কিন্তু বিনা কারণে নয়, কর্তাবাবু। সেবার যখন নদীর বাঁধ ভাঙল, বছরের সব ফসল গেল ডুবে, আপনি এক কথায় সব খাজনা মুকুব করে দিলেন। উপরন্তু রাজকোষ থেকে ক্ষতিপূরণ দিলেন সব চাষিকে। এ কী বড়ো মুখের কথা? কতজনের মেয়ের বিয়ে হত না, কতজন বেঘোরে কলেরায় মরত আপনি পাশে না দাঁড়ালে। মানুষ কী সেসব কথা ভোলে কর্তাবাবু? সেসব হিসাব কী সরকার করে? করে
না।”
“বছর পঞ্চাশ বয়েস হল। আর ঢাক পেটাসনি তো! শুধু আমার হিসাব তো হিসাব নয় রে। যেবার মন্বন্তর হল, তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। আমি সবে গদিতে বসেছি। শুনেছিলাম ওই চরম দুঃসময়েও মালদার জমিদাররা চাল-ডাল ভাঁড়ার ঘরে মজুত করে রাখছে, আর কঙ্কালসার গ্রামের লোকজন তাদের দুয়ারে আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়ে ফ্যান ভিক্ষা চাইছে।” বড়ো করে একটা শ্বাস নেন প্রতাপ। ধীর পায়ে হেঁটে ফটকের দিকে এগিয়ে যান। পিছন পিছন আসে হরিহর। তেরচাভাবে এসে পড়া প্রদীপের আলোয় ম্লান ফটকের কারুকার্যের উপর পরম যত্নে হাত বোলাতে থাকেন। সেদিকে চোখ স্থির রেখেই বলেন, “জানিস হরি, দাক্ষিণাত্য থেকে শিল্পী এনে ফটকের এই কারুকাজগুলো করা হয়েছিল। কে করিয়েছিলেন বল তো?”
হরিহর একটু সময় নেয় ভাবতে – “যতদূর শুনেছি দাদুর থেকে আপনার প্রপিতামহ মানে আদিত্যনারায়ণ করিয়েছিলেন।”
মৃদু হেসে হরির দিকে ফিরে আলগোছে মাথা নাড়েন প্রতাপ। “তখন আমি নিতান্তই বালক বুঝলি? দাদুকে নিজের হাতে ভরা এজলাসে পনেরো জন চাষিকে বেত মারতে দেখেছিলাম। মানুষগুলো ছটফট করছে, তাদের মেয়ে-বউ-রা পায়ে পড়ছে। তবু দাদুর চণ্ডাল রাগ শান্ত হয় না। ওদের অপরাধ কী ছিল জানিস?”
“কী কর্তাবাবু?”
“সেবার বড়ো সুখা হয়েছিল গ্রামে। বৈশাখের শুরুতেই সব ক’টা পুকুর শুকিয়ে কাঠ। খবর এল গ্রামের কিছু লোক নাকি জমিদারবাড়ির পুকুর থেকে লুকিয়ে জল চুরি করছে। ব্যস!” ক্লান্ত চোখে হরির দিকে তাকান প্রতাপ, “অত্যাচার তো আমরাও কম করিনি রে। পতন তো হওয়ারই ছিল।”
খানিক পরে মুখ খোলে হরিহর। তার কর্তাবাবুকে অতীত থেকে বর্তমানে নিয়ে আসতে চায়। “কর্তাবাবু, এই জমি সরকার নিয়ে নিলে, তারপর আপনি, মা-ঠাকরুন কী করবেন?”
“আমরা দুজনে ঠিক করেছি বেনারস চলে যাব। ওখানে বাবা বিশ্বনাথের কাছেই জীবনের বাকিটুকু কাটিয়ে দেব। শুনেছি ওখানে অনেক আশ্রম আছে।”
“আর সমুবাবা?” উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞেস করে হরিহর।
“আমাদের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় আছে না কলকাতায়? বেনেটোলায় থাকে। ওরাই সমুকে কাছে রাখবে কথা দিয়েছে।”
“কেন বাবু? সমু আমার কাছে থাকবে। ওর হরিজেঠু কী মরে গিয়েছে? আপনি আমাকে ভরসা করেন না কর্তাবাবু?”
“ধুর পাগল। তা নয় রে। আসলে এই গ্রামের স্কুলে সমুর পড়াশুনো ঠিক করে হচ্ছে না বুঝলি? আমার আত্মীয় বলেছে ওকে কলকাতার হিন্দু স্কুলে ভর্তি করে দেবে। ভালো স্কুলে পড়লে যদি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হতে পারে। সমুর তো অংকে মাথাটা ভালো।”
কর্তাবাবুর সিদ্ধান্তে অসম্মতি সত্ত্বেও মাথা নাড়ে হরি।
“আচ্ছা, শোন, যে জন্য তোকে ডাকা সেটাই এতক্ষণ বলা হয়নি,” গলা নীচু করে বাকি কথাগুলো বলেন প্রতাপনারায়ণ। কথার শেষে যোগ করেন, “তোর অবর্তমানে এই ধনদৌলত এই সরকার বংশের উত্তরাধিকারের হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব তোর বংশধরের। আর যদি এই বংশের প্রদীপ কখনও নিভে যায়, তাহলে এই ধনদৌলতের উপর একমাত্র অধিকার তোর বংশের। কাল নিরঞ্জন উকিলকে ডেকে এই মর্মে আমি উইল করে দিয়েছি।”
“আপনি কোনো চিন্তা করবেন না কর্তাবাবু। এই বংশের জিনিস বুক দিয়ে আগলে রাখব আমি।”
লাল শালুতে মোড়া একটা মোটা খাতা হরিহরের হাতে দিয়ে বললেন, “এটা যত্ন করে রেখে দিস। আসল চাবিকাঠি এখানেই রয়েছে।” স্নেহের কর্মচারীটির কাঁধে হাত রাখেন রতনপুর এস্টেটের শেষ জমিদার প্রতাপনারায়ণ সরকার।
তিন
‘আকাশের চোখ’! আকাশের আবার চোখ হয় নাকি? আর সেই চোখ আবার মড়ার মতো শুয়েই বা থাকবে কেন?
মোড়ের দোকানটা থেকে লুচি-ঘুগনি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে জমিদারবাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবে শবর। ফিরে এসে গত চারদিনের মতো আজও সকাল থেকে হন্যে হয়ে বাড়িময় গুপ্তধন খোঁজায় লেগে পড়ে। আজ গেল তেতলার ঘরগুলোয়। ভাঙা আলমারি, মরছে পড়া দেরাজ, ক্ষয়ে যাওয়া লজারাসের খাটের তলা - সোনাদানা লুকিয়ে রাখার মতো সম্ভাব্য কোনো জায়গাই বাদ দেয়নি, কিন্তু কপালে না থাকলে আর হবেটাই বা কী? রাত নামতেই রোজদিনের মতো জমিদার-ভূতের বিদ্রুপ সহ্য করতে হবে!
“হিরে-জহরত না হোক, সঙ্গে করে ম্যালেরিয়া বয়ে নিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে।” সহসা গম্ভীর গলার আওয়াজে চমকে ওঠে শবর। একটু ধাতস্ত হয়ে বলে, “উফফ! আপনি আজকাল দিনের আলোতেও উদয় হচ্ছেন দেখছি!”
“তোমার করুণ অবস্থা দেখতে বেশ মজাই লাগছে,” সেই এক ব্যাঙ্গের হাসি সহযোগে বলেন প্রতাপ, “শোনো হে ছোকরা, রক্তের একটা দাম আছে, বুঝেছ? তা না থাকলে জমিদার আর মুটে-মজুর এক হয়ে যেত। এই বাড়িতে সাতদিন কেন, সাত বছর, সাত জন্ম পড়ে থাকলেও আমার লুকোনো ধনদৌলত কারোর পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব না। সে কাজ একমাত্র ক্ষত্রিয় মগজের দ্বারাই সম্ভব।”
প্রতাপ অসহায়। কথাগুলো গায়ে লাগলেও পালটা দেওয়ার মতো কোনো কথাই নেই তার কাছে। এই অদৃশ্য কণ্ঠের সঙ্গে যে অদৃশ্য লড়াই চলছে আজ পাঁচদিন ধরে, সেটায় সে সত্যিই গো-হারান হারছে।
চার
হতাশ মন নিয়ে ইতিউতি তেতলার বারান্দায় হেঁটে বেড়াচ্ছিল শবর। বিকেলের রোদ পশ্চিম দিগন্ত চুইয়ে নেমে আসছে। বাবাকে খুব মিস করছে সে এই মুহূর্তে। এক কালের দুরন্ত স্পোর্টসম্যান আজ প্যারালাইসিসে ভুগে একটা জংধরা সত্তরের শরীর নিয়ে বিছানায় এক কোণে পড়ে থাকেন। ভালোদাদু কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে স্রেফ অক্সিজেন না পেয়ে মারা গেলেন। অতিমারির পর বিনা দোষে চাকরি থেকে ছাঁটাই হতে হয়েছে শবরকে। বারোশো টাকার অক্সিজেন সিলিন্ডার বারো হাজারে কেনার সামর্থ্য হবে কোথা থেকে?
হঠাৎ একটা তীব্র আলোতে চোখটা ধাঁধিয়ে গেল। হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে ঘরের মধ্যে তাকাতে একটা অদ্ভুত জিনিস নজরে পড়ল। ঘরটা বেশ বড়ো, জমিদারের বিশ্ৰামকক্ষ ছিল বলে মনে হয়। বারান্দার উলটো দিকের দেয়ালে একটা কাঠের আয়তাকার ফ্রেম থেকে আলগোছে কয়েক টুকরো কাচ ঝুলছে। তাতেই প্রতিফলিত হয়ে বিকেলের রোদ তার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে। একটু কাছে এগিয়ে যেতে বুঝতে পারল, কাচের টুকরোগুলো ধূলিধূসর হলেও তাদের ঝিলিক এখনও পুরোপুরি যায়নি। এই ফ্রেমটাকে দেখে তো আয়না বলেই মনে হচ্ছে।
মুহূর্তেই বিদ্যুৎ খেলে গেল শবরের মাথার মধ্যে। ‘নিজের মুখের আদল চেনার বড়ো দায়!’ নিজের মুখের আদল তো আয়নাতেই চেনা যায়। কিন্তু ‘আকাশের চোখ’? পশ্চিম দিগন্তের ম্লান আলোর দিকে তাকিয়ে এটাও স্পষ্ট হয়ে যায় শবরের কাছে। আকাশের চোখ মানে সূর্য, ‘শায়িত মৃতপ্রায়’ ইঙ্গিত করছে অস্তমিত সূর্যের দিকে। অস্তমিত সূর্যের আলো এসে পড়ছে আয়নার উপর। তার উলটোদিকে ‘শূন্য জঠর-দ্বার’। ‘জঠর’ মানে পেট। তাহলে কী আয়নার উলটোদিকের দেয়ালের ভেতরটা ফাঁপা?
উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে উলটোদিকের দেয়ালটায় জোরে জোরে টোকা মারতে থাকে শবর। ঠিক এক মিনিট পরেই দেয়ালের একটা বিশেষ জায়গা থেকে একটা ঢপ ঢপ আওয়াজ শুনতে পায়। উন্মাদের মতো ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নীচে নেমে আসে সে। বাগানের কাছ থেকে একটা ভাঙা পাথরের চাঁই তুলে নেয়। ওই ভারী চাঁইটা নিয়ে অনেক কষ্টে আবার তেতলায় উঠে আসে সে। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করতে শুরু করে দেয়ালের ওই জায়গায়। অযত্নের দেয়াল বেশিক্ষণ আঘাত সহ্য করতে পারে না। চুন-সুরকিসহ দু-তিনটে ইট খসে পড়ে মাটিতে।
আর তার ফলে দেয়ালের মধ্যে দেরাজের আকারের যে গর্তটা তৈরি হয়, তার মধ্যে একটা সোনালি রঙের সিন্দুককে বসে থাকতে দেখতে পায় শবর। অতি যত্নে ধীরে ধীরে সেটা টেনে বের করে আনে সে।
পাঁচ
সিন্দুক থেকে গহনা আর পাথরগুলোকে বের করে আলাদা ভাবে প্লাস্টিকের মধ্যে মুড়ে নিজের ঢাউস ব্যাকপ্যাকে চালান করছিল শবর। এত দামি জিনিস বুকে আগলে কলকাতা অবধি নিয়ে যেতে পারলে তবেই শান্তি। তারপর সোজা ব্যাংকের লকারে চালান করে দেবে।
কাল রাতে দেখা মেলেনি জমিদার-ভূতের। আপন পরাজয়ের শোক পালন করছেন বোধহয়। মনে মনে হাসে শবর। বেরোনোর আগে কী মনে হতে শেষবারের মতো গলা তুলে বলে, “কী মশাই? যাওয়ার আগে একবার বিদায় জানাবেন না? এই আপনাদের রাজা-রাজড়াদের ভদ্রতার নমুনা বুঝি?”
কিছুক্ষণ সব চুপ। তারপর বিষণ্ণ, ধীর গলায় জবাব আসে, “কাজটা তুমি ঠিক করছ না, হে ছোকরা।”
“কোন কাজটা? আপনাকে হারিয়ে দেওয়াটা? কী করি বলুন তো? আপনার অহংকার দেখে রোখ চেপে গেল। তাহলে দেখলেন তো - মগজের জোর ক্ষত্রিয় রক্ত বা উচ্চ বংশের উপর নির্ভর করে না। সাধারণ মানুষেরও সেই জোর থাকে।”
“কিন্তু যেটা তুমি করছ, সেটাকে কিন্তু চুরি-ই বলে।”
একটা বড়ো করে শ্বাস নিয়ে কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রাখে শবর। “বেশ তাহলে শুনেই নিন সবকিছু। আপনার এই গুপ্তধনের সন্ধান আমি কোনোভাবেই পেতাম না যদি না আমার কাছে আপনারই লেখা চার লাইনের পদ্যটি থাকত। আমার আগে যারা এসেছে তারাও সন্ধান পায়নি ঠিক এই কারণেই। এখন কথা হচ্ছে এই পদ্যটি আমি কোথায় পেলাম? মাস কয়েক আগে আমার ভালোদাদু মারা গিয়েছেন। মারা যাওয়ার দু-দিন আগে আমাকে এই রতনপুর এস্টেটের কথা বলেন, এখানে লুকিয়ে থাকা গুপ্তধনের কথা বলেন। আর বলেন সযত্নে রেখে দেওয়া লাল শালু মোড়া খাতাটার কথা। শ্রাদ্ধের কাজ মেটার পর আমি ভালোদাদুর নির্দেশমতো পুরোনো ট্রাঙ্ক ঘেঁটে খাতাটা খুঁজে পাই। গুপ্তধনের সংকেতটা ওখানেই ছিল,” একটু দম নেয় শবর, তারপর শান্ত গলায় বলে, “আমার ভালোদাদুর নাম জানেন প্রতাপবাবু?”
“এতদিন জানতাম না, এখন জানি,” একটা ক্ষীণ হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠে উত্তর আসে, “হরিহর মণ্ডল।”
“একদমই তাই। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম যে, আপনার পুত্র সোমেন্দ্রনাথ পাঁচ বছর আগে গত হয়েছেন। অতএব, আমি যা করছি, তা বেআইনিও নয়, বেইমানিও নয়। চলি।”
চৌকাঠ টপকে বেরোতে যায় শবর।
“দাঁড়াও,” ডাক আসে পিছন থেকে, “এতকিছু যখন করেছ, তখন শেষ একটা কাজ করে যাবে?” শবরের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বলে চলেন প্রতাপ, “এই বাড়িতে লুকোনো সব ধনদৌলতের খোঁজ তুমি এখনও পাওনি। যার খোঁজ তুমি এখনও পাওনি, তার দাম হয়তো সোনাদানায় হবে না, তবু আমি চাই তুমি সেটাও নিয়ে যাও। যদি সম্ভব হয় তাহলে তাকে জনসমক্ষে নিয়ে এসো।”
“আপনি কী বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“দোতলায় উঠে পুবদিকের ঘরটায় যাও। ঘরের মাঝখানের আবলুস কাঠের টেবিলের দেরাজ খুলে যা তুমি পাবে, সেটাই এই বাড়ির শেষ গুপ্তধন।”
জমিদারি নির্দেশ মেনে দোতলার ঘরে আসে শবর। এই ঘরটা দেখে তো লাইব্রেরি বলেই মনে হচ্ছে। আবলুস কাঠের টেবিলের কাছে গিয়ে দেরাজের মরচে ধরা হাতল ধরে টান মারে শবর। কয়েক তাড়া কাগজ একসঙ্গে সুতলি বেঁধে রাখা আছে। তার জায়গা জায়গা উইয়ে খেয়েছে। তার প্রথম পৃষ্ঠায় বড়ো বড়ো করে লেখা আছে – ‘শেষ জমিদারের আখ্যান’ - প্রতাপনারায়ণ সরকার।
----------
ছবি - নচিকেতা মাহাত