গল্প:: ছায়া যেখানে সিঁড়ি চড়ে - আলেখ্য রায়


ছায়া যেখানে সিঁড়ি চড়ে
আলেখ্য রায়

Not all shadows follow you. Some wait at the edge of forgotten stairs, whispering secrets you were never meant to hear.”

রুদ্রর বয়স বারো শান্ত, বইপাগল ছেলেটা বাবার বদলির চাকরির জন্য সদ্য এসেছে দার্জিলিং-এর এক পুরোনো ব্রিটিশ বাংলোয় বাড়িটার সামনে বিশাল পাইন গাছ, পেছনে ঝরনার শব্দ আর মাঝখানে পাথরের তৈরি এক অদ্ভুত সিঁড়ি, যে সিঁড়ির উপরের দিকটা কুয়াশায় হারিয়ে যায়
রুদ্র প্রথম দিন এসেই ওটা দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, “এই সিঁড়িটা কোথায় যায়?”
মা হেসে বলেছিলেন, “ওটা পুরোনো বাগানের রাস্তা এখন আর কেউ যায় না ওখান দিয়ে

মায়ের কথা শুনে তখনকার মতন বিষয়টা মেনে নিলেও ভেতরে ভেতরে একটা কৌতূহল কিন্তু থেকেই গিয়েছিল রুদ্রর সেদিন রাতেই ঘরে বসে বই পড়ার সময় এক অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পেল রুদ্র টিপ... টিপ... টিপ... ঠিক যেন কারও চপ্পলের শব্দ ওদের পাথরের সিঁড়িতে পড়ছে
সে উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল, কিন্তু তাকিয়ে সে কিছুই দেখতে পেল না চারপাশটা শুধুই কুয়াশায় ঢেকে গেছে কিন্তু তখনও শব্দটা আসছে কোথাও থেকে আর এসেই একটা সময় পর মিলিয়ে যাচ্ছে সেই রাতটা এভাবেই কেটে গেল
দ্বিতীয় রাতে আবারও সেই একই শব্দ পাওয়া গেল এবার শব্দটা আরও স্পষ্ট, যেন কেউ নিঃশব্দ পায়ে উঠে আসছে রুদ্র ভয় পেয়েছিল সে রাতে খুব, কিন্তু পরদিন সকালে সাহস করে নীচে গিয়ে সে দেখল, সিঁড়ি একদম শুকনো, মসৃণ, সেখানে কিছুই নেই, যেন কিছুই হয়নি

সেখানেই কাজ করতেন একজন কেয়ারটেকারকেয়ারটেকার দাদুকে রুদ্র জিজ্ঞেস করল, “এই সিঁড়িতে রাতের বেলায় কেউ কী ওঠে?”
দাদু একটু চুপ করে থেকে বললেন, “অনেক বছর আগে এখান থেকে একটা মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল ওই সিঁড়ি বেয়ে ওর নাম ছিল সুহা কেউ ওকে খুঁজে পায়নি লোকে বলে, ওই সিঁড়ি ভুল সময়ে ভুল মানুষকে ডাকে
রুদ্রর গা ছমছম করে উঠল কিন্তু তার মন খুঁতখুঁত করছিল ওখানে কী আছে সেটা জানার জন্যে

রাতগুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিল কুয়াশা, শব্দ আর উত্তেজনার মধ্যে এক রাতে সে সিদ্ধান্ত নিল, সে বেরোবেই বাবার টর্চ আর ডায়েরি নিয়ে রাতের অন্ধকারে চুপিসারে নিজের ঘর থেকে কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল রুদ্র সেই সিঁড়ির দিকে
ঘড়িতে তখন রাত ঠিক বারোটা সিঁড়িতে পা রেখেই সে থমকে দাঁড়াল
হঠাৎ কুয়াশার ভিতর থেকে এক কিশোরীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল — “তুই কী আমার ডায়েরি পেয়েছিস?”
রুদ্র চমকে উঠল সামনে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে, সাদা জামা, বেণী করে বাঁধা চুল আর ওর হাতে একটা খালি খাম
তুমিইইই... সুহা?” রুদ্র জিজ্ঞেস করল
মেয়েটি হাসল — “হ্যাঁ তুই আমার গল্পটা জানিস?”
রুদ্র সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল
আমার একটা ডায়েরি ছিল জানিস,মেয়েটি বলল, “ওই ডায়েরিতে আমি যা যা দেখতে পেতাম ভবিষ্যৎ, ভুল, সত্য সব লিখতাম স্কুলে সবাই আমাকেপাগলিবলত তারপর একদিন... আমার সেই ডায়েরিটা হারিয়ে গেল সেই রাতেই আমি হারিয়ে গেলাম
রুদ্র ফিসফিস করে বলল, “তুমি কী... ভূত?...”
মেয়েটি কাঁদল না, হেসেও উঠল না শুধু বলল, “ভূত না আমি এখন ছায়া যে ছায়া নিজের ছায়া খুঁজে পায় না সেই আমি তুই যদি আমার ডায়েরি ফেরত দিস, তাহলে আমি সারাজীবনের মতন এখান থেকে চলে যাব
রুদ্র ভাবল, তো মজার ব্যাপার! সত্যিই যদি ডায়েরি খুঁজে পাওয়া যায়...

সে পরদিন থেকে লুকিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করল বাড়ির পুরোনো ঘর, কেয়ারটেকার দাদুর বুকশেলফ, লুকোনো তাক... অবশেষে একদিন বাংলোর স্টোররুমে এক পুরোনো সিন্দুকের ভিতর থেকে পাওয়া গেল একটা বাদামি চামড়ার ডায়েরি
তার প্রথম পাতায় লেখা — “সুহার স্বপ্ন
রুদ্র ডায়েরি খুলে পড়তে শুরু করল একটা পাতায় লেখা — “২০২৩ সালের আগস্ট মাসে নতুন একটা ছেলে আসবে এই বাড়িতে ওর নাম রুদ্র আমাকে খুঁজে পাবে আর তারপর... নিজেও হারিয়ে যাবে
রুদ্র ওটা পড়ে আতঙ্কে বইটা বন্ধ করল
এটা কীভাবে সম্ভব? এইসব আবার কী লেখা?” তার মাথা ঘুরছে

সেই রাতে রুদ্র আবার সেই সিঁড়ির কাছে গেল আর আবার সেই মেয়েটা এল ওখানে
তুই ডায়েরিটা পেয়েছিস?”
রুদ্র ডায়েরিটা বাড়িয়ে দিল ওর দিকে
মেয়েটি বলল, “তুই জানিস তো, সত্যি জানলে কী হয়?”
কী... কী হয়?”
সেই সত্য তোকে তার নিজের কাছে নিয়ে নেয়” - কথাটি বলেই এক পৈশাচিক হাসি হাসে মেয়েটি আর তারপর হঠাৎ সে ঝুঁকে পড়ে রুদ্রর দিকে আর তারপর চারদিক যেন সব গলতে শুরু করে কুয়াশা, গাছপালা, বাড়ি সব যেন মিলিয়ে যেতে লাগল একের পর এক
রুদ্র চোখ খুলে দেখল, সে এক বইয়ের ভিতর আছে অনেক লেখার মাঝে তার নাম, তার কথা, তার পদক্ষেপ...
সে চিৎকার করে উঠল — “আমি কোথায়? আমি বের হতে চাই...”
একটা গলা শুধু খসখসে গলায় পাশ থেকে বলল — “তুই এখন ডায়েরির ভেতর রয়েছিস যেভাবে সুহা ছিল তুই ওকে মুক্তি দিয়েছিস এখন তোর পালা...”

পরদিন সকালে রুদ্রর বাবা-মা ঘুম থেকে উঠে দেখে, রুদ্রর ঘরে রুদ্র নেই শুধু টেবিলের ওপর একটা পুরোনো ডায়েরি রাখা, তাতে প্রথম পাতায় লেখা — “ছায়া যেখানে সিঁড়ি চড়ে, সেখানে সত্য রূপ বদলায়
আর নীচে ছোটো করে লেখা এক লাইন — “লেখিকাসুহা
----------
নীতিকথা “প্রকৃত সাহস শুধু রহস্যে পা বাড়ানো নয়, সত্যের ওজন বইবার প্রস্তুতিও বটে
ছবি - মেটা এআই

No comments:

Post a Comment