
হামাদা
প্রতীক কুমার মুখার্জি
তখন অনেক রাত, ঘড়ির কাঁটা প্রায় সাড়ে
এগারোটার ঘরে ঢুকে পড়বে-পড়বে
করছে। আবছা অন্ধকার ঘরটায় শোনা যাচ্ছে
ফ্যান ঘোরার একঘেয়ে একটা গুনগুন শব্দ। ইজেলের ওপরে
রাখা একটা ফাঁকা ক্যানভাসের সামনে থম মেরে বসে আছে ক্লাস সিক্সের টাপুর। তার ডান হাতে একটা তুলি, যেটাতে এখনও কোনো রং লাগেনি। প্রায়
মিনিট কুড়ি ধরে সে একইভাবে বসে - সামনের ক্যানভাসে এখনও তুলির একটা আঁচড় পর্যন্ত পড়েনি! আর আধঘণ্টা পরেই শুরু হয়ে যাবে আরও একটা
জন্মদিন! টাপুরের মনে ভিড় করে আসে ছোটোবেলার অনেক কথা...
পাঁচ বছর ধরে আঁকা শিখছে টাপুর। বেশ কিছু কম্পিটিশনে সে প্রাইজও পেয়েছে, বেশ কিছু ম্যাগাজিনে তার আঁকা ছবিও
বেরিয়েছে বহুবার। কিন্তু সে তো সব অয়েল প্যাস্টেলে! আজকের ছবিটা যে তাকে আঁকতে হবে ওয়াটার কালারে, তাও আবার বর্ষাকালের থিমের ওপরে - এটাই এই কম্পিটিশনের অন্যতম শর্ত! নীল রংটা কোনোকালেই ম্যানেজ করতে পারে না
টাপুর! এই কম্পিটিশনে তাকে আঁকা দিতে হবে
শুধু বাবা-মায়ের কথা ভেবে - আর তার হামাদার
জন্য। কম্পিটিশনটা যে হামাদার নামে! কাল
যে হামাদার পনেরোতম জন্মদিন!
তোমাদের নিশ্চয় হামাদার কথা মনে আছে? আরে, তাদাশি হামাদার কথা বলছি! যে-হামাদা তার ছোটো ভাই
হিরোর জন্য তৈরি করেছিল ‘পার্সোনাল হেলথ্ কেয়ার
কম্প্যানিয়ন’ বেম্যাক্সকে!
তারপর এক ভীষণ দুষ্টু সায়েন্টিস্ট কালাঘানের শয়তানির ফলে ল্যাবরেটরিতে আগুন লেগে
যে-হামাদা মারা যায়? পরে, তার তৈরি মাইক্রোচিপের সাহায্যে ছোট্ট হিরো বেম্যাক্সের ভোল পালটে তৈরি করে এক সুপারহিরোকে, বন্ধুদের
সঙ্গে নিয়ে দুষ্টু লোকটাকে ধরিয়ে দিয়ে তার দাদার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়!
অনেক ছোটোবেলায় দাদাই জোরজার করেই টাপুরকে
এই ‘বিগ হিরো সিক্স’ মুভিটা দেখিয়েছিল। দাদাইয়ের হাতটাকে বালিশ বানিয়ে, দাদাইয়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে প্রথমবার দেখেই টাপুর হিরোর দলবলের ভক্ত হয়ে
গিয়েছিল। মুভির শেষে দাদাই যখন তাকে
জিজ্ঞেস করে, “বল দেখি
ডুবলি, কে সবচেয়ে ভালো?” ঠোঁট
ফোলাতে ফোলাতে, ভেজা গাল মুছতে মুছতে ডুবলি আধো আধো বুলিতে জানিয়েছিল, “দাদাই, আমাল
হামাদা! আমাল বেম্যাচ, আমাল পুচকি রোবোত!” তখন টাপুরের বয়স মাত্র চার! সেই থেকেই দাদাই হয়ে গেল
ডুবলির হামাদা!
প্রায় চার বছরের ছোটো-বড়ো ভাই-বোনের মধ্যে এক অদ্ভুত টান! ‘দাদাই’ যেন দাদা নয়, সে যেন ডুবলির আসল অভিভাবক! ডুবলি-অন্ত প্রাণ দাদাই। আর দাদাই হল টাপুরের ‘হামাদা’ - তার মুশকিল আসান! যে-কোনো দুষ্টুমি, এক্সপেরিমেন্টে, যে-কোনো অ্যাডভেঞ্চারে দুজনে ছিল ‘পার্টনার্স
ইন ক্রাইম!’ দুজনের
কাণ্ডকারখানা দেখে বাবা-মাকে সকলে অবাক হয়ে বলত, “ভাই-বোনের মধ্যে ভালোবাসার টান অনেক দেখেছি, কিন্তু এরকমটি আর কোথাও দেখিনি!”
কিন্তু ডুবলির হামাদা যে এভাবে কাউকে না বলে-কয়ে বরাবরের মতন চলে যাবে - আজও ভাবতে পারে না
টাপুর! তার আট বছরের জন্মদিনে সবাই মিলে যখন দীঘায় যাওয়া হয়েছিল, হঠাৎ করে ধেয়ে-আসা একটা টাইডাল ওয়েভ মুহূর্তের মধ্যে সিমেন্ট বাঁধানো বিচওয়াকে
বসে-থাকা দাদাইকে গিলে নিয়েছিল কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই। চিরকালের মতো হারিয়ে গিয়েছিল দাদাইয়ের সেই প্রাণের ডাক –
‘ডুবলি’!
পরে আরও অনেকবার টাপুর মুভিটা দেখে একা-একাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে! কী করবে সে - কোথায় পাবে তার হামাদাকে? চোখের সামনে সেই দুর্ঘটনা ঘটার পরেও,
টাপুর আজও বিশ্বাস করে না সেকথা - সে জানে হামাদা ঠিক তার ওপরে নজর রাখছে, যে-কোনো প্রবলেমে সে টাপুরকে ঠিক বাঁচিয়ে নেবে!
পাঁচ মিনিট পরে চোখভরতি জল নিয়ে টাপুর আস্তে আস্তে মাথা তুলল ঘরের দেয়ালের
একটা বিশেষ অংশের দিকে - বিশাল একটা কার্বন ব্ল্যাক ফ্রেমের মধ্যে থেকে তার দিকে
হাসিমুখে তাকিয়ে আছে হামাদা - তার দাদাই। টাপুরের
হাতেই তৈরি এই অয়েল প্যাস্টেল পোর্ট্রেট
থেকে অদ্ভুত জীবন্ত দুটো চোখে ডুবলিকে দেখছে সে। ব্যাজার মুখে ঠোঁট ওলটায় টাপুর! “ডুবলি ইন প্রবলেম, হামাদা! কী করে আঁকব বলো তো?” হামাদা একইভাবে চেয়ে থাকে তার দিকে। ছবির নীচে ম্যান্টেলপিসের আদলে তৈরি একটা ফ্রেমের ওপরে জ্বলতে থাকা থামের মতো বিশাল সবুজ মোমের আলোয় হামাদার চোখদুটোয় যেন আলোর ঝিলিক খেলে যায়!
বর্ষার দিনে গাড়িতে, বাবার
পাশের সিটে বসে স্কুলে যাওয়ার সময়ে
বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া রাস্তাঘাটের চেহারাটা মনে পড়ে যেতেই পাঁচ-ছ-টা রং পছন্দ করে আলাদা করে তুলে নিল টাপুর। প্রথমেই ক্যানভাসের ওপরে একটা রাফ স্কেচ করে নিল সে। একটা রাস্তার ফ্রেম, যার পাশে
পাশে তৈরি হল ক্রমশ ছোটো হয়ে যাওয়া লাইটের পোলের লাইন৷ আশেপাশে কিছু ঘরবাড়ি, মাঠ আর পুকুরের জন্য জায়গাও তৈরি হয়ে গেল। এগিয়ে-পিছিয়ে এসে তিন-চারবার
ফ্রেমটা দেখে নিয়ে মনে হল, ছবিটাতে
কী যেন একটা বাদ পড়ে যাচ্ছে। ভুরু কুঁচকে কিছুটা ভেবে নিয়েই অভ্যস্ত হাতে তৈরি হল দুটো মানুষের স্কেচ - স্কুলের ইউনিফর্ম পরা দুটো মানুষ! একটি ছেলে ও তার থেকে বেশ কিছুটা ছোটো একটা পুঁচকি মেয়ে - যারা হাত ধরাধরি করে রাস্তার পাশে জমা জলের ভেতর জল
ছপছপ করতে করতে চলেছে।
কপালের ঘাম মুছে একটু পিছিয়ে এসে ছবিটা দেখল টাপুর - বেশ লাগছে! এটা সেদিনের ছবি, যেদিন হামাদা আর ডুবলি স্কুল থেকে ফিরতে গিয়ে ভিজে একশা হয়ে
বাড়ি ঢুকেছিল। মায়ের কাছে বেশ খানিকটা বকাবকিও
জুটেছিল সেদিন। হামাদা সেদিনও সমস্ত দোষ নিজের
ঘাড়ে চাপিয়ে নিয়ে বোনকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল বরাবরের
মতোই।
ছবি থেকে হামাদা একইভাবে হাসিমুখে তাকিয়ে তখনও। পেন্সিল রেখে নিশ্চিন্ত মুখে তার দিকে তাকায় টাপুর। তারপর লম্বা কোঁকড়া চুলের গোছাটা বাঁধতে বাঁধতে জানলা খুলে দেয় - ঘরটা বেশ
গুমোট হয়ে উঠেছে এর মধ্যেই! বাইরের আকাশ তখন লালচে
হয়ে উঠেছে বর্ষার মেঘে। “স্টর্মস
কামিং, হামাদা! তবে ডুবলির রিয়েল প্রবলেম
স্টার্টস্ নাও। ওয়াটার কালার, তুই জানিস!”
প্রথমে লাইট গ্রে কালার দিয়ে রাস্তার অংশে রং চাপাতে বেগ পেতে হল না
টাপুরকে। আস্তে আস্তে সেজে উঠল রাস্তার
পাশে লাইটের পোল, দু-পাশে ছড়ানো-ছিটোনো ঘরবাড়ি, বাঁশের বেড়া, পুকুর আর হলদেটে মাঠঘাট। বারবার পিছিয়ে এসে ছবিটা দেখছিল টাপুর - বেশ লাগছে যা হোক! কিন্তু
আকাশটাকে নীল আর গ্রে-র বিভিন্ন শেডে সাজাতে
গিয়েই ঘটল বিপত্তি। নীল রঙের ছোপগুলো কেমন যেন ছড়িয়ে
পড়তে লাগল ক্যানভাস জুড়ে! আস্তে আস্তে সেগুলো ছবির ঘরবাড়ি, মাঠঘাট, পুকুর আর স্কুল-ফেরতা ছেলেমেয়েদুটোকে ঢেকে ফেলতে থাকল!
আলাদা করে তৈরি করে রাখা নীল, কালো ও গ্রে-র
বিভিন্ন শেডের মরিয়া পোঁচ লাগিয়েও সামাল দেওয়া গেল না। তাড়াহুড়োতে রং গুলে রাখা পাত্রটা বাঁ
হাতে তুলে নিয়ে টাপুর দাঁতে দাঁত চেপে ছবিটা বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা করতে থাকে। নতুন করে আঁকার সময় আর নেই! কাল ভোরেই বাবার ওটা কম্পিটিশনে জমা দিয়ে
দেওয়ার কথা! ঠিক তখনই ঝড়টা শুরু হল। জানলার
পাশে রাখা পেল্লায় ফ্লাওয়ার ভাসটা মাটিতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার প্রচণ্ড শব্দে চমকে গিয়ে টাপুরের হাতের পাত্র থেকে যাবতীয় শেডের রং সপাটে আছড়ে পড়ল
ক্যানভাসের ওপরে।
একমুহূর্তের জন্য পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে
পড়ল টাপুর। তার চোখদুটো ভরে যাচ্ছে জলে!
প্রবল রাগ, হতাশা ও অভিমানে আগাগোড়া নীলচে ধূসর হয়ে যাওয়া ক্যানভাসটার দিকে একবার
তাকাল সে। এইমুহূর্তে ক্যানভাস জুড়ে শুধু
নীল আর ধূসরের প্রলেপ - মুছে গেছে বাড়ি-ঘরদোরের
হালকা হলদেটে রং, পুকুরের
নীল, মাঠঘাট, এমনকি রাস্তাটাও! ছবির ছেলে আর
মেয়েটার পুরো শরীর এখন কালচে ধূসর! দেখা
যাচ্ছে শুধু তাদের পায়ের জুতোদুটি। বিভিন্ন ধরনের কালি-গোলা জল
ক্যানভাসের ওপর থেকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে
গড়িয়ে নীচের দিকে নামতে থাকে!
টাপুর অসহায়ভাবে তাকাল হামাদার দিকে - সে একইভাবে হাসি-হাসি মুখে ডুবলির দিকে তাকিয়ে রয়েছে! নিষ্ফল আক্রোশে
ফোঁপাতে ফোঁপাতে টাপুর ইজেল থেকে ক্যানভাসটা প্রায় ছিঁড়ে নিয়ে সেটাকে ছুড়ে ফেলে
দিল! তারপর সে হামাদার ছবিটার সামনে
দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থাকল। উত্তেজনা
কিছুটা কমলে ছবিতে পরম যত্নে কয়েকবার হাত বুলিয়ে, তার হামাদার কপালে, গালে অনেকগুলো হামি দিয়ে ঘর থেকে বড়ো বড়ো পা ফেলে বেরিয়ে গেল! ক্যানভাসটা
যে ঘরের কোন অংশে পড়ে রইল, সেদিকে
টাপুরের আর মনই ছিল না। তার মন এতটাই খারাপ যে, ঘরের জানলাটাও বন্ধ করতে সে ভুলে গেছে!
রঙে ভিজে ঢোল হয়ে যাওয়া ক্যানভাসটা পড়ে থাকল হামাদার পোর্ট্রেটের তলায়, ম্যান্টেলপিসের ঠিক নীচে রাখা সেন্টার টেবিলটার ওপরে। রাত
বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে ঝড়ের গতি! জানলা
দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া ঢুকে ঘরটা ওলট-পালট
করতে থাকে। ফ্যান চলতে থাকে, ঘরে বৃষ্টির জল
ঢুকতে থাকে! একটা সময় হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ার দমকে
বিশাল থামের মতো মোমবাতিটা উলটে পড়ে
ম্যান্টেলপিসের ওপরে - জ্বলন্ত অবস্থাতেই। রাতের
আকাশ আলো করা এক প্রচণ্ড বিদ্যুচ্চমকের সঙ্গে
সঙ্গেই ইলেকট্রিসিটি চলে যায়!
পরের দিন যখন টাপুর ঘুম থেকে উঠল, তখন সাড়ে ন-টা বেজে গিয়েছে। এই দিনটায় বাবা-মায়ের মুখ বর্ষার আকাশের মতোই ভারী হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই টাপুরেরও। টেবিলে
গিয়ে বসতে সে জানতে পারে, বাবা
দাদাইয়ের ঘর থেকে তার আঁকা ছবিটা নিয়ে ইতিমধ্যেই অফিসে বেরিয়ে গিয়েছেন! ওই নষ্ট
ক্যানভাসটা বাবা নিয়ে গিয়েছেন? মায়ের দিকে তাকাতে, তিনি প্রচণ্ড গম্ভীর গলায় বললেন, “বড়ো হচ্ছ, টাপুর! দায়িত্বজ্ঞান কবে হবে তোমার? জানলাটা বন্ধ করোনি কেন? বাবা খুব রাগ করেছেন। আজ তোমার কপালে দুঃখ আছে। বেরোবার আগেই তোমাকে ঘুম থেকে ওঠাতে যাচ্ছিলেন বাবা, নেহাত আজকের দিন বলে
কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলেন। কাল
তোমার জন্য সারাবাড়িতে আগুন ধরে যেত! আর একটা অঘটন - ভালোই হত...” আর বলতে পারলেন না মা! মুখে আঁচল
চাপা দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। টাপুর কোনোমতে উঠে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল - বর্ষার জলে চারদিক তখন ভেসে
যাচ্ছে বাইরে।
হামাদার ঘরে ঢুকে টাপুর নিজেই লজ্জা পেল! একটা সামান্য ছবির জন্য এতটা
উত্তেজিত হয়েছিল সে! ঘরটার লন্ডভন্ড অবস্থা! সারাঘরে ভাঙা কাচ, রঙের ছিটে, উলটে
পড়ে থাকা মোমবাতি, কাগজপত্র, তুলি - যাচ্ছেতাই অবস্থা! শুধু টাটকা রজনিগন্ধার মালা পরে
হামাদা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে! তার কপালে টাটকা পরানো দই আর ধানের টিপে সেই হাসি
আজ যেন আরও উজ্জ্বল, চোখগুলো যেন ডেকে কথা বলছে। টাপুর তার হামাদাকে আবার প্রাণপণে জড়িয়ে ধরতে তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল।
সেদিনের কম্পিটিশনে অনেক ভালো ভালো ছবি এসেছিল - পুরস্কৃত হয়েছিল নবীন
শিল্পীরা। কিন্তু বিচারকরা সেদিন একটি বিশেষ
পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাহুল
সরকারের স্মৃতিতে আয়োজিত অঙ্কন প্রতিযোগিতায় ব্যবস্থা করা হয়েছিল একটি বিশেষ
পুরস্কারের - ছবির নাম ‘বাড়ি ফেরা!’ শিল্পী টাপুর সরকার!
একবুক অবিশ্বাস নিয়ে যখন ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল টাপুর, সে নিজের চোখকে
বিশ্বাস করতে পারল না! সেই নষ্ট হয়ে যাওয়া ক্যানভাস জুড়ে জমে রয়েছে অগুনতি জলের
বিন্দু - ঠিক যেন গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনের
মধ্যে দিয়ে দেখা বৃষ্টিধোয়া রাস্তাঘাটের একটা জীবন্ত দৃশ্য! গড়িয়ে পড়া রং ও উঁচু হয়ে থাকা জলের বিন্দুগুলির মধ্যে থেকে ঝাপসা, কিন্তু আলাদাভাবে ফুটে উঠেছে বাঁশের বেড়া, রাস্তা, পুকুর, মাঠঘাট আর লাইটের পোলগুলো। ছবির ছেলে আর মেয়েটাকে পরিষ্কারভাবে বোঝা না গেলেও, যেখানে তাদের পাগুলি
রয়েছে, সেখানে যেন জমে রয়েছে অনেকটা
সবজেটে জল। মনে হচ্ছে, তারা সেই জমা জলের মধ্যে লাফিয়ে পড়ার পর, সেই জল ছিটকে
উঠে বৃষ্টির জলের ফোঁটাতে মিশে গিয়েছে।
ছবির ওই অংশটায় আঙুল ছোঁয়াতেই টাপুর বুঝতে পারে, ওগুলো আসলে সবুজ মোমবাতিটা
থেকে গলে পড়া মোমের ফোঁটা - যেগুলি পোর্ট্রেটের নীচের উঁচু ম্যান্টেলপিস থেকে টপ্ টপ্ করে ছবির ওই অংশে পড়ে কিছুটা
জমেছে, বাকিটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছে পুরো
ক্যানভাসটার ওপরে! সেখান থেকেই তৈরি হয়েছে
এই অভাবনীয় ভিস্যুয়াল এফেক্ট!
পুরষ্কার নিতে উঠে টাপুর একবার মঞ্চে সাজানো হামাদার অন্য একটা মালা-পরানো ছবির দিকে তাকাল - তার দাদাই, তার হামাদা হাসছে! তার ডুবলির দিকেই
তাকিয়ে হাসছে - গর্বের হাসি, আনন্দের হাসি, আদরের হাসি, প্রশ্রয়ের হাসি! মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগে টাপুর টের পেয়েছিল, দুটো হাত এসে তাকে শক্ত করে ধরে ফেলল - সে হাতের স্পর্শে
কোনো রাগ বা অসন্তুষ্টির ছোঁয়াচ ছিল না - হাতগুলো তার বাবার!
----------
(এই গল্পের চিন্তাধারা সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত। কোনো জীবিত অথবা মৃত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কোনোরূপ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যদি এই গল্পের কোনো ঘটনার মিল থেকে থাকে, তা সম্পূর্ণ কাকতালীয় ও অনিচ্ছাকৃত।)
----------
ছবি - সুকান্ত মণ্ডল
No comments:
Post a Comment