আগের পর্বগুলি: প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব

মহাভারতের এক তেজস্বিনী মেয়ের কথা
সুমনা সাহা
পঞ্চম পর্ব
মণিপুরে চিত্রাঙ্গদা
ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নানা কাজে। পিতাকে পূর্ণমাত্রায় সহযোগিতা করে সে। সেইসঙ্গে চলে
পুত্রের শিক্ষাদান। কোমরে কটিবন্ধ, মাথায় শিরস্ত্রাণ ও অঙ্গে কঠিন বর্মের আচ্ছাদন ঢেকে
রাখে তার নারীদেহ। কিন্তু মনটা ঢাকা পড়ে না কোনো আচ্ছাদনে। গভীর রাতে যখন
নিশ্বাসের শব্দও বজ্রের মতো মনে হয়, একাকিনী চিত্রাঙ্গদা শিরস্ত্রাণের বন্ধন থেকে
মুক্তি দেয় তার ঘন কুঞ্চিত কেশদাম, অযত্নের রুক্ষ ত্বকে খেলা করে কুসুমগন্ধবাহী
বসন্ত-পবন, তার মনে পড়ে দূরবাসিনী সখীর কথা। সে কেমন আছে? এতদিন মনে পড়েনি কেন
তাকে?
নাগলোকের প্রাসাদে জলের
ছলাৎ-ছল শুনতে শুনতে
তন্দ্রাহীন উলুপীর মনে হয় কে যেন ডাকছে, “সখী! কেমন আছ ভাই?” সে যত্ন করে লেখে একটি
চিঠি, “সখী চিত্রা, কতদিন হল তোমার সংবাদ পাইনি। তোমরা কেমন আছ? আমার পিতা বড়োই
অসুস্থ, শয্যাশায়ী একপ্রকার। হয়তো তিনি বেশিদিন আমাদের মধ্যে থাকবেন না। আমার
ভাইটি অপরিণত-বুদ্ধি, জানোই তো সেকথা।
তাই সমস্ত রাজ্যের ভার আমার ওপরে। তা না হলে সেই ছেলেবেলাকার মতো হঠাৎ করে গিয়ে
হাজির হতাম তোমার দেশে। মনে পড়ে, কেমন সেবার লুকিয়ে চলে গিয়েছিলাম বাণিজ্যতরিতে?
সখী, তোমাকে দেখতে বড়োই ইচ্ছা করে। একবার আসবে? তোমার রাজ্য হয়তো তাদের রাজকন্যার
অভাব কিছুদিনের জন্য মেনে নেবে। কিন্তু আমার যে একেবারেই রাজ্য ছেড়ে বের হওয়ার
উপায় নেই। এই পত্র পেয়ে চলে এলে খুব খুশি হব। ইতি তোমার নাগলোকবাসিনী সই, উলুপী।”
তরির সঙ্গে ভাসতে ভাসতে
সেই পত্র যেদিন এসে পৌঁছোল মণিপুর রাজ্যে, সেদিন চিত্রাঙ্গদাও সখীকে একখানি পত্র
লিখেছে, “সই উলুপী, তোমার কথা ক-দিন ধরে মনে পড়ছে। যদি
রাগ করো, এতদিন খোঁজ নিইনি কেন ভেবে, তা তুমি করতেই পারো। কিন্তু সই, আমি যে আর
তোমার আগের সেই কিশোরী চিত্রা নই! আমার একটি ছেলে হয়েছে। নাম, ‘বভ্রুবাহন’। এক ভিনদেশের পথিক এসে
পড়েছিলেন ঘুরতে ঘুরতে আমার রাজ্যে। তাঁকেই এই পোড়া মন দিয়ে বসলাম। যতই তিরন্দাজি
করি না কেন, ভেতরে তো আমি একটি বোকা মেয়ে। তিনি একটি দেশের রাজার ছেলে। তাঁর শর্ত
ছিল, আমার সঙ্গে চিরকাল থাকতে পারবেন না। সব জেনেও আমি তাঁকে বিয়ে করেছি। আমাদের সন্তানকে
তিনি আমার পিতাকে সমর্পণ করে গেছেন, এ রাজ্যের ভাবী রাজা হিসেবে। এখন বলো, সইয়ের
ছেলেকে তুমি কি একটিবার দেখবে না? তোমাকে না দেখালে যে আমার প্রাণে শান্তি নেই!
তোমার চিরসখী, চিত্রাঙ্গদা।”
তার স্বামী যে
হস্তিনাপুরের রাজপুত্র মধ্যম পাণ্ডব অর্জুন, একথা কেন যে চিত্রাঙ্গদা তার সইকে
বলতে পারল না, সে নিজেই জানে না। মানবমন বড়ো বিচিত্র। কিন্তু এ-পত্র পাঠাবার আগেই উলুপীর
পত্র পৌঁছোল তার হাতে। সে আর দেরি করল না। বাবার অনুমতি নিয়ে বভ্রুবাহনের হাত ধরে
নায়ে চেপে বসল, যাত্রা করল নাগলোকের উদ্দেশে। সখীর পিতা শীঘ্রই দেহত্যাগ
করবেন। সখী বড়োই একলা হয়ে পড়বে। তার তো ছেলে আছে, ছেলে পিতার অভাব বোধ করার ফুরসত
পায় না। কারণ তার মাতা ও পিতা চিত্রবাহন বভ্রুকে আদরে-শাসনে ভরিয়ে রেখেছেন। রাজা
কৌরব্যের তুলনায় চিত্রবাহনের বয়স অনেক কম। তিনি এখনও যৌবনের প্রান্তসীমায়। নাতির
সঙ্গে তাঁর দারুণ সখ্য। বভ্রু কখনও পিতা সম্পর্কে প্রশ্নও করে না। সে চিত্রবাহনকেই
পিতার স্থানে বসিয়েছে। সে হবে মণিপুরের ভবিষ্যৎ রাজা। অতএব অত্যন্ত যত্নে চলছে তার
অস্ত্রশিক্ষা ও অন্যান্য বিদ্যাশিক্ষা। কিন্তু তবুও পিতার কাছ থেকে ছেলেকে সে
কিছুদিনের জন্য ছিনিয়ে নিল নিজের কাছে, তাকে যেতেই হবে সখীর কাছে। যেকথা সে মাকে
বলতে পারে না, পিতাকে তো নয়ই, দাসীদের, সখীদের কাউকেই বলতে পারে না; মনের ভেতরে গুমরানো সেই
ব্যথাটুকু তার সখীকে দেখাতেই হবে। তাই সে চলেছে নাগলোকে। দুই সখীর দেখা হওয়া
একান্তই প্রয়োজন। সময় জানে তা। তারা কিন্তু জানে না।
সখী আসছে—এ সংবাদ পৌঁছে
গেছে দ্রুত উলুপীর কানে নাগলোকের মাঝিমাল্লা, বণিকদের মাধ্যমে। সে রোজ এসে
প্রতীক্ষা করে গঙ্গাদ্বারে। অবশেষে সখীর তরি দেখা দিল। দুই সখী পরস্পরকে আলিঙ্গন
করে চোখের জলে ভেসে গেল।
চিত্রাঙ্গদাকে তার
প্রাসাদে নিয়ে গেল উলুপী। সেখানে একটি চমক তার অপেক্ষায় ছিল। সেটি একটি নিষ্পাপ
বালক—ইরাবান। উলুপীর সন্তান। চিত্রাঙ্গদা নির্বাক হয়ে শুনে চলল উলুপীর কথা। সেও তো
সখীর কাছে মনের ভার মেলে ধরতেই চেয়েছিল, তাই তো পত্রে এত করে আসতে লেখা। রানি
উলুপী মুছে গেল। পড়ে রইল অবিরাম অশ্রুবর্ষণকারিণী এক দুঃখিনি মা, সন্তানকে যে
দেখাতে পারেনি তার পিতার মুখ, যার স্বামী চলে গেছে সন্তানসম্ভবা উলুপীকে একলা ফেলে
রেখে, কোনোদিন ফিরে আসেনি আর।
উলুপীর বুকের সবটুকু মেঘ
কান্না হয়ে ঝরে গেলে চিত্রাঙ্গদা সখীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি আর আমি একই
অশ্রুনদীর দুটি তীর। আমাদের দুজনকেই স্পর্শ করে বয়ে গেছে সেই নদ, যার নাম ‘অর্জুন’, কুন্তীপুত্র বীর
অর্জুন!” চমকে ওঠে উলুপী। এবার তার শোনার পালা। তারপর সেও বুকে জড়িয়ে ধরে সখীকে,
“ঠিক সখী, তুমিও তাঁকে ধরে রাখতে পারোনি, আমিও না। তাঁকে যেতেই হত। তবুও তোমার এইটুকু সুখ
যে, তোমার সন্তান তার পিতার উপস্থিতিতে জন্মেছে, আমি সেই ভাগ্য থেকে বঞ্চিতা।” দুই
মা যখন তাদের দুঃখের ভার পরস্পরের কাছে নিঃশেষে ঢেলে দিয়ে শান্ত হয়, তখন আকাশে
অস্তরাগের লালিমা। বাগানে তখন দুই ভাই খেলায় মেতে উঠেছে। ওরা জীবনের কটু ফল এখনও
চেখে দেখেনি। ওদের চোখে পৃথিবী এখনও পরতে পরতে অপার বিস্ময় মেলে রেখেছে। ওদের এখনও
কর্তব্যের বোঝা বইতে বাধ্য হতে হয়নি, ওদের জগতে দৈন্য আসেনি, দুঃখের তীব্র গরল
ওদের স্পর্শ করেনি। মাটিতে ঝরে পড়া ফুলের মতো ধুলায় গড়াগড়ি দেওয়া দুটি বালকের অমলিন
হাসি সন্ধ্যার বাতাস ভরিয়ে তুলছিল, ওদের মায়েরা সেদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল।
নাগলোকে কয়েকটি দিন চোখের
পলকে অতিবাহিত হল। চিত্রাঙ্গদার কাছে যেটা সবচেয়ে আনন্দের, তা হল, ছেলে বভ্রু উলুপীর
বড়োই ন্যাওটা হয়ে পড়েছে। আর উলুপীও যেন তাকে পেয়ে নিজের দ্বিতীয় পুত্রের মতো স্নেহে-যত্নে কতই না গোপন বিদ্যা
অনুশীলন করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সত্যি বলতে কী, সখী বলে, “ভাই, আমার নিজের ছেলেকে
আমি এমন করে কাছে টানতে পারিনি, ও যেন কেমনধারা, একটু অন্যরকম। ঠিক বুঝতে পারি না
আমি ওকে। হয়তো বাবার টানে একদিন না একদিন ও নাগলোক ছেড়ে হস্তিনাপুরে চলে যাবে, আমি
আটকাতে পারব না। কিন্তু ভাই, তোর ছেলেটি যুদ্ধবিদ্যা শিখতে বেশ আগ্রহী। ওকে
মাঝেমধ্যে পাঠিয়ে দিস আমার কাছে।” চিত্রাঙ্গদা হাসে, বলে, “পাঠাব ভাই। তুমি যে কত
গুণী, সে কি আর আমি জানি না?
তোমার কাছে এলে বভ্রু অনেক কিছু শিখতে পারবে।”
খেলার মাঝে ইরাবান বলে,
“ভাই, তুই বাবাকে দেখেছিস?”
বভ্রুবাহন আনমনে চেয়ে
থাকে, “কী জানি, আমার মনে পড়ে না।”
ইরাবানের চোখে স্বপ্নের
মেদুরতা, সে জলের স্রোত দেখতে দেখতে উদাস দৃষ্টি মেলে বলে, “যেতে চাস না বাবার
রাজ্যে?”
বভ্রুবাহন দ্রুত মাথা
নেড়ে বলে, “না, আমি মণিপুর ছেড়ে কোত্থাও যেতে চাই না। তুমিও সেখানে চলো না, দাদা?
দেখবে আমাদের রাজ্য কত সুন্দর!”
ইরাবান বলে, “আমি
অর্জুনের পুত্র ইরাবান। আমাকে তাঁর কাছে যেতেই হবে।”
“তাহলে তোমার মায়ের যে
মনখারাপ হবে?”
“না, তিনি তো রাজকাজে
ব্যস্ত থাকেন, এখন আরও ব্যস্ত থাকবেন। আমি হস্তিনাপুরে যাব, বাবার সঙ্গে, আমার আরও
ভাইদের সঙ্গে দেখা করব। বাবাকে দেখাব আমার তিরন্দাজি। আর আমি দ্বারকার মহারাজ
কৃষ্ণের সঙ্গেও দেখা করব। শুনেছি তিনি খুব বীর। আর তেমনই সুন্দর। তাঁর রাজ্যও খুব
সুন্দর। আমি সে সমস্ত দেখতে চাই। এখানে এই নাগলোকে পড়ে থাকলে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে
কোনো সংযোগই থাকে না।”
বভ্রুবাহন তার এই দাদাকে
বুঝতে পারে না। অর্জুনের দুই পুত্র তাঁর দুই সত্তা পেয়েছে। যুদ্ধ দুজনেরই প্রিয়।
কারণ তাদের পিতার মতো মায়েরাও যোদ্ধৃ স্বভাবের। কিন্তু বভ্রু পেয়েছে ঘরের টান, আর
ইরাবানের প্রাণে বেজেছে সুদূরের বাঁশি।
ওদিকে চিত্রবাহন অস্থির
হয়ে উঠেছেন তাঁর নাতির অপেক্ষায়। মণিপুর রাজ্য যেন শূন্য বোধ হয় রাজা-রানি উভয়েরই, ওই তেজি কুমারের অভাবে।
তাই ঘনঘন সংবাদ পাঠান তরি ভরে নানা সামগ্রীর সঙ্গে, “অনেকদিন তো দুই সখীতে কাটালে
একসঙ্গে, এবার ফিরে এসো!” ইতোমধ্যে রাজা কৌরব্যের দেহান্ত হয়ে গেল। তাঁকে শেষ
প্রণাম জানিয়ে চিত্রাঙ্গদা ছেলেকে নিয়ে ফিরে এল মণিপুরে।
কেটে গেল অনেক দিন। নাকি
অল্পদিন? কে জানে? নাগলোকে ও মণিপুরে দুই অর্জুনপুত্র এখন দৃপ্ত যুবক। তেজে,
শৌর্যে, বীর্যে, পরাক্রমে তারা হস্তিনাপুরের যুবরাজ বলার যোগ্য। আর তাদের বড়ো করে
তোলার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তাদের মায়েদেরই। দুজনেই তেজস্বিনী, দুজনেই নানা
অস্ত্রচালনায় পারদর্শিনী। তারা কেউ ভীরু, দুর্বল নয়; তারা শক্ত হাতে দুটি রাজ্যের
শাসনভার দক্ষভাবে সামলায়। ওদিকে হস্তিনাপুরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চলেছে বিচিত্র
পরিবর্তনের স্রোত। অর্জুন ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পরেই প্রতিশ্রুতিমতো রাজসূয় যজ্ঞের
আয়োজন করা হয়েছিল। সেই যজ্ঞে দেশের সব রাজ্যের রাজারাই আমন্ত্রিত হয়েছিলেন,
উলুপীদের রাজ্যে এবং মণিপুরেও পৌঁছেছিল আমন্ত্রণপত্র। কিন্তু তারা কেউ যেতে
পারেনি। ইন্দ্রপ্রস্থে পাণ্ডবদের ঠাঁটবাট, সম্পদ ও সাফল্যে তাঁদের কুরুভাইরা
হিংসায় জ্বলতে লাগল। তারা শকুনিমামার সঙ্গে পরামর্শ করে পাণ্ডবদের আবার পাশা
খেলার নিমন্ত্রণ জানাল। খেলায় হেরে গিয়ে পঞ্চপাণ্ডব দ্রৌপদীসহ আবার বনগমন করলেন।
এবার বারো বছর বনে বনে কাটিয়ে তেরোতম বছরটি অজ্ঞাত পরিচয়ে কাটাতে হবে, এমনই ছিল
খেলার শর্ত। অনেক দুঃখের রাত্রি পেরিয়ে অবশেষে তেরো বছর পূর্ণ করে যখন তাঁরা
হস্তিনাপুরে ফিরে এলেন, তখন তাঁদের ইন্দ্রপুরীর চেয়েও সুন্দর ইন্দ্রপ্রস্থের
রাজপ্রাসাদে দুর্যোধন জাঁকিয়ে বসেছেন। তিনি পাণ্ডবভাইদের আর এককণাও বাসভূমি দিতে
চান না। গুরুজনেদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল। যুদ্ধ ঘোষিত হল। এই যুদ্ধ ইতিহাসে এক
অনন্য নজির সৃষ্টি করতে চলেছে—যুযুধান দুই পক্ষ সম্পর্কে ভাই। অধর্মের বিরুদ্ধে
ধর্মের যুদ্ধ। দুই পক্ষই যুদ্ধের প্রস্তুতিতে লেগে পড়ল। নানা রাজ্যের রাজাদের কাছে
সাহায্যের আবেদন চেয়ে সংবাদ গেল। এই সংবাদ নাগলোকেও এসে পৌঁছোল। এতদিনে ইরাবানের
অভীষ্ট পূর্ণ হওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হল। মন তার নেচে উঠল, সে বলল, “মা, আমি এই
যুদ্ধে পিতার পক্ষে যোগ দিতে চাই। তুমি কি আমাকে যাওয়ার অনুমতি দেবে না?” সুযোগ্য
পুত্র পিতাকে সাহায্য করতে চায়—উলুপী তাতে বাধা দেওয়ার মতো অধর্ম করতে পারে না। শুধু
সে তার বিচক্ষণতা দিয়ে মনে করল, একেবারে সরাসরি অর্জুনের কাছে উপস্থিত না হয়ে
পুত্র আগে তার পিতামহ ইন্দ্রদেবের কাছে বরং যাক। ইন্দ্রদেবের সঙ্গে নাগলোকের রাজা
কৌরব্যের বন্ধুতা ছিল। তাই সেই সুবাদে ইন্দ্রদেব ইরাবানকে অবশ্যই আতিথেয়তা
প্রদর্শন করবেন। মাতার পরামর্শে ইরাবান ইন্দ্রলোকে যাওয়া মনস্থ করল। শুভদিনে সে
নাগলোক ত্যাগ করে ইন্দ্রলোকের উদ্দেশে রওনা হল। পুত্রের মাথায় আশিসচুম্বন দিয়ে
উলুপী তার যাত্রা নির্বিঘ্ন হওয়ার প্রার্থনা জানাল, আর চেয়ে রইল যতদূর চোখ যায়
ছেলের যাত্রাপথের দিকে। ইরাবান নির্ভয়ে রওনা হল, ভবিতব্য তাকে দুর্বার বেগে টানছে।
পিতার সঙ্গে মিলনের আনন্দে পথের কষ্ট ও অজানা ভবিষ্যতের চিন্তা তার মনে ছায়া
ফেলেনি। ইন্দ্রলোকে পৌঁছে সে জানতে পারল, তার পিতা সেই সময়ে সেখানেই অবস্থান
করছেন। ইন্দ্রদেব ইরাবানকে খুবই আদর-যত্ন করলেন। তারপর তাকে হাজির করালেন অর্জুনের
সামনে। পিতা-পুত্রের সাক্ষাৎকারের কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি উপস্থিত হল। পরম কান্তিময়
সুপুরুষ তরুণ ইরাবানকে দেখে অর্জুন প্রসন্নচিত্তে তাকে আলিঙ্গন করলেন। বললেন,
“তুমি অতি শুভ সময়ে এসে পড়েছ! এই বিপদের সময়ে তোমার সাহায্য আমার একান্ত প্রয়োজন।
তুমি আমার পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করো।” ইরাবানের মনপ্রাণ আনন্দে ভরে গেল। তার মনে
এতদিন পিতার প্রতি যে অভিমানের মেঘ জমেছিল, এক লহমায় তা কোথায় উধাও হল।
শয়নে-স্বপনে যে-বীরপুরুষের কল্পনায় তার
শৈশব ও কৈশোর কেটেছে, চাক্ষুষ তাঁকে দেখে সে যেন ধন্য হয়ে গেল। পিতার মুখে
দুশ্চিন্তার ছায়া যেন সে নিজের জীবন দিয়েও মুছিয়ে দিতে চায়, তাঁকে প্রাণ দিয়ে
সর্বপ্রকারে সাহায্য করার জন্য যেন সে অন্তর থেকে তাগিদ অনুভব করছে। পিতা কোমল
স্বরে তাকে মাতা উলুপীর কথা জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর ইন্দ্রদেবের সামনেই তার মাতার
বীরত্ব, সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা ও দয়ালু স্বভাবের অকুণ্ঠ প্রশংসা করতে লাগলেন।
ইরাবানের সমস্ত মন যেন পিতার প্রতি আনুগত্যে পূর্ণ হয়ে গেল। সে তখনই পিতার সঙ্গে
হস্তিনাপুর রওনা হতে প্রস্তুত হয়ে গেল।
(ক্রমশ)
----------
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment