গল্প:: লোককথা: পৃথিবী সৃষ্টির গল্প - বুমা ব্যানার্জী দাস


পৃথিবী সৃষ্টির গল্প
(কানাডার লোককথা)
বুমা ব্যানার্জী দাস

পৃথিবীর প্রায় সমস্ত প্রাচীন সভ্যতাই পৃথিবী সৃষ্টির রহস্যকে ব্যাখ্যা করেছে নানা লোককথার মধ্য দিয়ে কিছুটা রূপকের মাধ্যমে, কিছুটা রহস্য-ছলে বলা সেসব গল্প কখনও বহন করে গভীর অন্তর্নিহিত অর্থ, লোকশিক্ষা; কখনও তা আবার স্রেফ উর্বর কল্পনাশক্তির প্রকাশমাত্র
কানাডার সভ্যতা তেমন প্রাচীন না হলেও ইউরোপীয়রা এদেশে পৌঁছোনোর বহু আগেই এখানকার আদি বাসিন্দারা প্রকৃতির কাছাকাছি বসবাস করতেন তাঁদের আমরা ফার্স্ট নেশন বলি এখন কানাডার গভীর জঙ্গল, বন্যপ্রাণী, অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল তাঁদের লোককথা অবশ্যই পৃথিবীর সৃষ্টিরহস্য ছিল এইসব লোককথার অন্যতম উপজীব্য অন্য সব দেশের মতোই লোককথার গল্প মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ত এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে দিনের শেষে আগুনের ধারে এসে বসতেন গোষ্ঠীর বয়স্করা, আর তাঁদের ঘিরে বসত কচিকাঁচার দল গল্পের ভেতর দিয়ে সঞ্চারিত হত লব্ধ জ্ঞান, উপদেশ, বা কল্পলোকের গল্পকথা হয়তো দূর জঙ্গল থেকে ভেসে আসত বল্গা হরিণের ডাক, বুনো ঘোড়ার পাল হাওয়ায় গা ভাসিয়ে অদৃশ্য হত বনের গভীরে, তাদের খুরে খুরে শব্দ উঠত খটাখট্ খটাখট্ কখনও পরির নিশ্বাসের মতো শব্দ তুলে তুষার ঝরে পড়ত পাহাড়ি পাইনের ওপর টুপটাপ করে ঝরে পড়ত পাইনের বীজ এমন পরিবেশ না হলে কী আর সেসব গল্প মানায়! মজার ব্যাপার হল, পৃথিবীর সৃষ্টিরহস্য নিয়ে ফার্স্ট নেশনদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর আলাদা আলাদা গল্প আছে কিছু মিল থাকলেও প্রতিটা গল্পই আলাদা

ইরোকোইয়ান গোষ্ঠীর গল্পে শোনা যায় অথই জলের অনেক ওপরে থাকা এক গগন-রাজ্যের কথা সে রাজ্যে কারও কোনো দুঃখ নেই, জন্ম-মৃত্যুও নেই সেখানে সেখানের প্রধান মানুষদের মধ্যে ছিলেন এক গগন-সুন্দরী একদিন কী একটা ব্যাপার নিয়ে তাঁর স্বামীর সঙ্গে ভীষণ অশান্তি হল তাঁর সেই ক্রুদ্ধ স্বামী রাগের চোটে গগন-রাজ্যের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল জীবনবৃক্ষ উপড়ে ফেললেন এর ফলে তৈরি হল এক মস্ত গর্ত গগন-সুন্দরী গর্তের ধারে এসে উঁকি মেরে অনেক, অনেক নীচে বিস্তীর্ণ জলরাশি দেখতে পেলেন এদিকে তাঁর স্বামীর রাগ তখনও মেটেনি তিনি গর্তের মুখে ঝুঁকে থাকা গগন-সুন্দরীকে দিলেন এক মোক্ষম ঠেলা গর্ত দিয়ে গড়িয়ে গিয়ে গগন-সুন্দরী তো পড়তে থাকলেন গভীর জলের দিকে জলে পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে দুটো পাখি উড়ে এসে তাঁকে ধরে ফেলল কিন্তু মানুষকে কি আর পাখি ধরে রাখতে পারে? বিপদ বুঝে এগিয়ে এল এক সামুদ্রিক কচ্ছপ পাখিরা সেই কচ্ছপের পিঠের ওপর গগন-সুন্দরীকে যত্ন করে বসিয়ে দিল কিন্তু গগন-রাজ্যে তো এত জল ছিল না, মাটি ছাড়া হাঁফিয়ে উঠলেন গগন-সুন্দরী সামুদ্রিক প্রাণীদের ডেকে মাটির ব্যবস্থা করতে বললেন তিনি তাদের মধ্যে সবচেয়ে গভীরে সাঁতার দিতে পারত এক জলের ইঁদুর, বা মাস্কর‍্যাটতাকেই সবাই সমুদ্রের তলা থেকে মাটি নিয়ে আসার ভার দিল। মাস্কর‍্যাট সাধ্যমতো মাটি নিয়ে এলে বাকি প্রাণীরা কচ্ছপের পিঠের ওপর তা বিছিয়ে দিলগগন-সুন্দরীর তো খুব আনন্দ, তিনি মাটির ওপর হাঁটতে থাকলেনঅবাক কাণ্ড! তিনি যত হাঁটেন, কচ্ছপের পিঠের খোলা তত বড়ো হয়ে ওঠে। বাড়তে বাড়তে সেটাই একসময়ে আমাদের পৃথিবীর আকার নিল। গগন-সুন্দরী সুখে-শান্তিতে সেখানে বাস করতে থাকলেনগগন-রাজ্য থেকে পড়ে যাওয়ার সময়ে তিনি সন্তানসম্ভবা ছিলেনযথাসময়ে তিনি এক কন্যার জন্ম দিয়েছিলেন, তাঁর নাম ছিল ধরিত্রীতাঁরও আবার তিনটি কন্যা জন্ম নিয়েছিল পরবর্তী সময়ে— ‘ভুট্টা, ‘শিম আর কুমড়োনাম হিসেবে অদ্ভুত হলেও মনে রাখতে হবে, ফার্স্ট নেশনদের প্রধান সবজি কিন্তু এগুলোই ছিল। তাই হয়তো ধরিত্রীমাতার সন্তানরূপে এই তিন কন্যার কল্পনা করা হয়েছিল। যমজ পুত্রও ছিল ধরিত্রীরতাদের মধ্যে একজনের মন ভালো, আর একজনের মন কুটিলতায় ভরা। ভালো মনের পুত্রটি চাঁদ, সূর্য আর অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারদের সৃষ্টি করেছিল মাটির মধ্যে পাওয়া নানা উপাদান থেকে নানা জাতির মানুষও তৈরি করেছিল সে। কিন্তু বদবুদ্ধির পুত্রটি সেই নানা জাতির মধ্যে লড়াই-ঝগড়া সৃষ্টি করেছিল। বাধ্য হয়ে ভালো মনের পুত্র পৃথিবীর আলাদা আলাদা অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন জাতিকে রেখে এসেছিল, আজও তারা সেইভাবেই আছে। সামুদ্রিক কচ্ছপ এখনও পৃথিবীকে পিঠে নিয়ে গভীর সমুদ্রে সাঁতরে চলেছে।

ব্ল্যাকফুট গোষ্ঠীর গল্পটা অনেকটাই আলাদা। এক বুড়ো ভেলায় করে জন্তু-জানোয়ার নিয়ে ভেসে চলেছিলঅনেকদিন এমন ভেসে বেড়ানোর পর বুড়োর ডাঙায় ওঠার ইচ্ছা হল খুব। কিন্তু কোথায় ডাঙা, মাটির চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। সে তখন নিজের জন্তু-জানোয়ারদের জলের তলা থেকে মাটি আনতে পাঠাল। দিন যায়, মাটি আর কেউ খুঁজে পায় না! অবশেষে বুড়ো হঠাৎ দেখে, একজনের থাবায় মাটি। আহ্লাদে আটখানা হয়ে সে মাটি শুকিয়ে নিয়ে বুড়ো জলের ওপর ডাঙা বানাতে বসল। পাহাড়, গাছপালা, ঘাসজমি কী না বানাল সে! তারপর জন্তু-জানোয়ারদেরকে কোন অঞ্চলে তারা ভালো থাকবে, তা হিসেব করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে এল। সেসব সারা হলে বুড়ো এবার এক নারী আর এক শিশুকে বানাল। তাদের চলা, ফেরা, কথাবলার ক্ষমতাও দান করল তারপর। ভালোই কাটছিল; সেই নারী একদিন বুড়োকে জিজ্ঞেস করে বসল, “আচ্ছা, আমরা চিরকাল বাঁচব তো?” বুড়োর মুখে রা-টি নেই। শেষে অনেক ভেবেচিন্তে সে বলল, “এই যে আমার হাতে বাইসনের শুকিয়ে যাওয়া গোবরের টুকরো দেখছ, এটা আমি জলে ছুড়ব। যদি ডুবে যায়, তাহলে একদিন না একদিন মরতে হবে সবাইকে। কিন্তু এটা যদি ভেসে থাকে, তাহলে মৃত্যুর চারদিন পর আবার প্রাণ ফিরে পাবে তোমরা।তার সেই ছুড়ে-দেওয়া শুকনো গোবরের টুকরো তো ভেসে রইল জলে। সেই মহিলা কিন্তু এতে সন্তুষ্ট হল না। সে তর্ক জুড়ল, “এই পাথরটা জলে ছুড়ব আমি যদি ভাসে, তাহলে বুঝব আমরা অনন্ত জীবনের অধিকারী। বলা বাহুল্য, পাথর টুপ করে ডুবে গেল। বুড়ো তখন চটে উঠে বলল, “আজ থেকে এই নিয়ম চালু হল, তোমরা সবাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে একদিন না একদিন। দুর্ভাগ্যবশত শিশুটি কিছুদিন পর সত্যিই মারা গেল। সেই নারী কাঁদতে কাঁদতে বুড়োর কাছে এসে বলল, “আমার নিয়ম ফিরিয়ে নাও, তোমার সেই আগের নিয়মটাই চালু থাক। চারদিন পর প্রাণ ফিরে পাক আমার বাছা।বুড়ো নারাজ, একবার নিয়ম তৈরি হয়ে গেছে, সে আর তা পালটাতে রাজি নয়। তবে সে আরও মানুষজন বানিয়ে দিল। তাদের খাবার সংস্থানও করে দিল নানারকম। তবে তখনও কে কী খাবে, কেমন করে সে খাদ্য বানাবে, সেসব কিচ্ছু ঠিক হয়নি।
একদিন বুড়ো দেখে কী, একদল বাইসন মানুষ মেরে খাচ্ছে। ব্যাপারটা বিশেষ পছন্দ হল না তার মনে হল, উলটোটা হলে ঠিক হত। ধনুক তৈরি করে মানুষের হাতে তুলে দিল সে। কিছুদিনের মধ্যেই মানুষের দল তির ছুড়ে বাইসন মারতে ওস্তাদ হয়ে গেল। কিন্তু তারা বন্য জন্তুর মতো কাঁচা মাংস খাচ্ছে দেখে বুড়ো আগুন তৈরি করে কীভাবে মাংস ঝলসাতে হয়, দেখিয়ে দিল। তির-ধনুক দিয়ে বাইসন শিকার তো করা যাচ্ছিল, কিন্তু হাত দিয়ে মাংস ছেঁড়া বড়োই মুশকিল। এবার বুড়োর সাহায্য ছাড়াই মানুষেরা পাথর ঘষে ধারালো করে ছোটো ছোটো সরঞ্জাম বানাল, হাতুড়ি বানাল। খুঁটির ওপর বাইসনের চামড়া শুকিয়ে মেলে দিয়ে তাঁবুও বানালঝড়-বৃষ্টি-তুষারপাতের সময়ে আর কষ্ট রইল না তাদের।
বুড়ো তো এইসব দেখে মহা খুশি। সে পাঁচটা গোষ্ঠী বানিয়ে জমিজমা তাদের মধ্যে ভাগ করে দিল। বলল, “কেউ কারও অঞ্চলে ভাগ বসাবে না। সেরকম চেষ্টা করলে কিন্তু ভয়ানক যুদ্ধ হবে। আর যদি যুদ্ধ না লাগে, একে অন্যের অঞ্চলে ঢুকে যায়, তবে কিন্তু সে সমস্যার সমাধান কোনোদিন হবে না।
ব্ল্যাকফুট, ব্লাড (কাইনাই), পিগানি, গ্রোস ভেন্টর, সার্সি নামের সেই পাঁচ গোষ্ঠী আজও নাকি এই নিয়ম মেনে চলে।

হিউরনদের মধ্যে প্রচলিত গল্পের শুরুটা ইরোকোইয়ানদের মতোই কিন্তু এখানে মাস্কর‍্যাট নেই। মাটি আনতে গিয়ে বেশ কিছু প্রাণী মারা যাওয়ার পর একটা ব্যাং সাহস করে জলের তলায় নেমেছিল। সে ওঠে আর না শেষে হাঁকপাঁক করতে করতে উঠে এল একদিন, দম আটকে তখন তার প্রাণ বেরিয়ে যায় আর কী! হাঁ করে বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলছে, এমন সময়ে কচ্ছপ দেখেতার মুখের ভেতর খানিকটা মাটি জমে আছে। তাড়াতাড়ি সেই মাটি বের করে গগন-সুন্দরীকে এনে দিল সে। ইরোকোইয়ানদের লোককথার মতোই এখানেও গগন-সুন্দরী কচ্ছপের পিঠের ওপর সে মাটি বিছিয়ে ডাঙা বানালেন শহরের পর শহর তৈরি হতে হতে একসময়ে গোটা পৃথিবীটাই গড়ে উঠল কচ্ছপের পিঠের ওপর
এই গল্পে গগন-সুন্দরীর কন্যা নেই কোনো, আছে শুধু সেই যমজ পুত্রদ্বয় ভালোটির নাম টিজুস-কাহাআর মন্দটির নাম টাউইস-কারঙ মন্দটির জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হয় গগন-সুন্দরীর তাঁর দেহ মাটির নীচে শুইয়ে দিতে সেখান থেকে পৃথিবীর সব গাছগাছালির জন্ম হয়েছিল দুই ভাই এবার পৃথিবীর নানা কাজে বেরিয়ে পড়ল
বদবুদ্ধির ভাই ভয়ানক সব জন্তু বানানোর কাজে লেগে পড়ল নেকড়ে, ভালুক, মস্ত মস্ত সাপ, বিটকেল মশা ইত্যাদি বানানোর পর সে এমন একটা ব্যাং বানাল, যে পৃথিবীর সব পানীয় জল গিলে ফেলল সব মানে সব, কিছুই আর বাকি রাখল না সেসব জল সে জমিয়ে রাখল মন্দ ভাইয়ের রাজ্যে
ভালো ভাই বানাল পায়রা, মকিংবার্ড বা নকল পাখি, তিতির এইসব
তিতিরটা ভারী বুদ্ধিমান, সে টিজুস-কাহাকে সমানে বোঝায়, তার মন্দ ভাইয়ের সৃষ্টি করা ব্যাংবাবাজিই তার এলাকার সব জল খেয়ে বসে আছে টিজুস-কাহার সেসব বিশ্বাস হয় না মোটে একদিন বিরক্ত হয়ে তিতির উড়ে চলল টাউইস-কারঙের এলাকার দিকে টিজুস-কাহাও চলল তার পেছন পেছন সেখানে গিয়ে তার ভাইয়ের তৈরি জন্তুদের দেখে সে তো হাঁ সবার আগে সেই দৈত্যাকৃতি ব্যাংটাকে নিকেশ করল সে পৃথিবীর পানীয় জল আবার ফিরে গেল যথাস্থানে বাকি জন্তুদের আকারে অনেক ছোটো করে আনল টিজুস-কাহা, যাতে মানুষ তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারে
বলা বাহুল্য, টাউইস-কারঙ একেবারেই খুশি হল না এমন কাণ্ড দেখে দুই ভাই বুঝতে পারল, এক পৃথিবীতে তাদের দুজনের পক্ষে থাকা আর সম্ভব নয় এমনটা যে হবে, তা তাদের মা গগন-সুন্দরী আগেই টিজুস-কাহাকে বলে দিয়েছিলেন স্বপ্নে সে দেখেছিল, মা এসে বলছেনতাদের দুজনের মধ্যে পৃথিবীর মালিকানা নিয়ে ভীষণ লড়াই হবে তবে ওদের মৃত্যু সহজে আসবে না, তাও ঠিক একমাত্র শিমভরতি বস্তা দিয়ে পেটালে তবেই টিজুস-কাহাকে মারা যাবে, আর টাউইস-কারঙকে বধ করতে চাই হরিণের শিং
ধুন্ধুমার যুদ্ধ লাগল দুই ভাইয়ের মধ্যেশিমের বস্তা দিয়ে আঘাত করে করে মন্দ টাউইস-কারঙ ভালোমানুষ টিজুস-কাহাকে মেরে ফেলে আর কী হঠাৎ কোথা থেকে যেন শক্তি ফিরে পায় টিজুস-কাহা হরিণের শিং বাগিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করে দেয় টাউইস-কারঙের তবে, শরীরটাই শুধু ধ্বংস হয় তার তার দুষ্ট আত্মা পাড়ি দেয় সুদূর পশ্চিমে যাওয়ার আগে রাগে গরগর করতে করতে বলে যায়, “আমি চলে যাচ্ছি বটে, কিন্তু মৃতদের আত্মারা সবাই আসবে আমার সন্ধানে
হিউরনদের কাহিনির শেষ এখানেই


ক্রী-দের গল্প আবার আরও মজাদার তাদের লোককথা অনুযায়ী, একেবারে আদিতে কোথাও কিচ্ছু ছিল না হঠাৎ এক তীব্র আলোর ঝলকানির সঙ্গে ধরিত্রীমাতা দৃশ্যমান হলেন তাঁর অনেক সন্তানাদি একজনের নাম বিনায়-সিহ্’; সে রেগে গেলে আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গিয়ে বজ্রপাত আর মুশলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয়জন ইনা-কাকি’—সে ব্যাংদের দেবতা, পৃথিবীর সমস্ত পোকামাকড়কে সে নিয়ন্ত্রণ করে তৃতীয় সন্তানটি ধোঁকা দেওয়ার গুরুমশাই, তার নাম উইসাকেচাক সে ইচ্ছামতো রূপ ধরতে পারে, আকার পরিবর্তন করতে পারে এই উইসাকেচাককে নিয়ে বহু কাহিনি প্রচলিত আছে ক্রী গোষ্ঠীর ভেতরযাই হোক, উইসাকেচাকের আরও দুটো ছোটো ভাই আছে, নেকড়ে মা-হিগানআর বীভার আমিক ধরিত্রীমায়ের শরীর থেকে এরপর তৈরি হল গাছপালা, ফলফুল আর বাকি প্রাণীকুল তখনও মানুষ ছিল না পৃথিবীতে, সেসব পরে সৃষ্টি করেছিল উইসাকেচাক
যাই হোক, সবাই তখন পৃথিবী গড়ার কাজে বেজায় ব্যস্ত ধরিত্রীমাতা উইসাকেচাকের ওপর সমস্ত জন্তু-জানোয়ারদের ভার দিয়ে বলেছিলেন, “দেখো বাছা, এরা যেন নিজেদের মধ্যে লড়াই-ঝগড়া না করেতা দুষ্টুর শিরোমণি উইসাকেচাকের সেসব খেয়াল রাখতে বয়েই গেছে সুযোগ পেয়ে প্রাণীরা নিজেদের মধ্যে তুমুল ঝামেলা শুরু করে দিল ভারী অসন্তুষ্ট হলেন ধরিত্রীমাতা, উইসাকেচাককে সাবধান করে দিয়ে বললেন, “শান্তিরক্ষা করতে না পারলে তোমার সব ক্ষমতা কিন্তু কেড়ে নেব আমিউইসাকেচাক তাতেও কর্ণপাত করল না বরং নিত্যনতুন ফন্দিফিকির করে তাদের মধ্যে অশান্তি আরও বাড়িয়ে তুলল তাদের লড়াইয়ের চোটে পৃথিবী লাল হয়ে উঠল রক্তে ক্রুদ্ধ ধরিত্রীমাতা বিনায়-সিহের সাহায্যে ডেকে আনলেন তুমুল বৃষ্টিকে
সে কী ভয়ানক বৃষ্টি! ঝরছে তো ঝরছেই! নদী, খাল, বিল ভরে উঠে উপচে পড়ল সে বন্যায় তলিয়ে গেল সবাই, বেঁচে থাকল শুধু এক ভোঁদড়, এক বীভার আর এক মাস্কর‍্যাট। অনুশোচনায় উইসাকেচাকের দুই চোখে তখন নেমেছে জলের ধারা সে কেঁদেই চলে আকুল হয়ে, আর তার পাশে চুপচাপ বসে থাকে ওই তিন মূর্তি
অবশেষে একদিন চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ায় সে, মনে মনে স্থির করে আবার নতুনভাবে পৃথিবীকে গড়ে তুলবে নিজের চেষ্টায় কিন্তু গড়ার মাটি পাবে কোথায়? সব তো ডুবে গেছে ধরিত্রীমাতার সঙ্গে কথা বলার সাহস তার আর নেই চিন্তায় শুকিয়ে যেতে থাকে উইসাকেচাকধরিত্রীমাতার করুণা হয় এবার, তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন, “তোমাকে শক্তি দান করছি, জলের তলায় ডুবে থাকা পুরোনো পৃথিবীর মাটি ব্যবহার করোমহাখুশি উইসাকেচাক প্রথমে ভোঁদড়কে পাঠায় মাটি তুলে আনতে, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ভোঁদড় বিফল হয় বীভারও তাই কিন্তু সফল হয় মাস্কর‍্যাট। সেই মাটি দিয়ে অথই জলের ওপর দ্বীপ বানায় উইসাকেচাক
এরপর কিছু কাঠও খুঁজে পায় সে, আর মৃত পশুর হাড়ের টুকরো সেসব দিয়ে সৃষ্টি হয় গাছপালা, পশুপাখি পরে মানুষও তৈরি করে উইসাকেচাক কিন্তু ধরিত্রীমাতার বোধহয় তার ওপর পূর্ণ আস্থা ফিরে আসেনি আর তাই সৃষ্টিকার্য শেষ হলে তার সব শক্তি আবার ফিরিয়ে নেন তিনি, শুধু থেকে যায় উইসাকেচাকের ধোঁকা দেওয়ার ক্ষমতা

জলের তলা থেকে মাটি তুলে আনার ব্যাপারটা সবক-টা গল্পেই রয়েছে এছাড়া ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর সংস্কৃতি, বিশ্বাসের ছায়া পড়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা লোককথা আলাদা হয়েও কোথাও একটা যেন তারা একইরকম একটু খুঁটিয়ে ভাবলে ধরা পড়বেরূপকের ছলে গভীর কিছু চিরন্তন সত্য ধরা পড়েছে লোককথাদের ছত্রে ছত্রে যেহেতু গল্প বলা আর শোনার মধ্যে দিয়েই এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বয়ে চলছে লোককথার স্রোত, তাই আদি গল্পের কিছু না কিছু বদল তো নিশ্চয়ই হয়েছে তবে আসলে তা সমৃদ্ধই করেছে লোককথাকে
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment