
নোহাদের বাড়ি
সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়
রোদ-না-ওঠা ঘন
শীতের দিনগুলোতে নোহার বিছানা ছাড়তে ইচ্ছেই করে না। জানলার ওপাশে খাড়া পাহাড়ের
গায়ে আটকানো ছোটো-বড়ো গাছ আর তাতে ঝুলে থাকা বাহারি ফুলের
থোকাগুলো ওর দিকে তাকিয়ে দুলে দুলে হাসে। নোহা জানে, গাছেদের
যখন হাসি পায়, তখন খুব হাওয়া দেয়। লোকে ভাবে, হাওয়ায়
গাছের পাতা নড়ছে, কিন্তু আসলে ওরা হাসে ওইভাবেই।
দাদিম্মা যখন ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে, বলে, “বাছারা, আরও বড়ো
হও, আরও পাখপাখালি, হরিণ, শিয়াল, খরগোশ নিয়ে
সংসার করো”, ওরা তখনও অমনি পাতা মেলে হাসে। কিন্তু যখন ওরা থম হয়ে থাকে, হাসেও না, নড়েও না, দাদি বলে—ওদের মন
খারাপ।
“মনখারাপ কেন, দাদিম্মা?”
“কেন আর! জানিস না, মানুষ বড়ো খারাপ হয়ে গিয়েছে। পাহাড়ে
বেড়াতে এসে নোংরা ফেলে যায়, দুষ্টু লোক পাহাড়ে এসে লুকিয়ে থাকে, দূষিত করে
দেয় চারিপাশ। তাতেই ওদের মাঝে মাঝেই এমন মনখারাপ করে রে।”
এসব বুড়ির নিজে চোখে দেখা। বলে নাকি একশো বছর আগের কথা। হবেও বা।
দাদিম্মা তো নোহার ঠাকুরদারও মা। সব জানে তাই। বলে, সে এক
ভয়ংকর দিন গিয়েছে চোখের ওপর দিয়ে। একবার খারাপ লোকের দল এসে ডেরা বাঁধল টুরাই আর
ফার্ফু গাঁয়েরও অনেক ওপরে। তারা সারাদিন মেশিন দিয়ে গাছ কাটত আর মোটা মোটা চালা
করে সেগুলোকে বেঁধে ঝরনায় ফেলত। ভেসে যেত কাঠের বোঝা। নীচে থাকত ওদেরই সঙ্গী-স্যাঙাৎ
দল। তারা ওই সব কাঠ জল থেকে তুলে বাজারে বেচে দিত। এই করতে করতে ওদের লোভ বাড়ল। শুধু
কাঠ চুরিই না, ওরা তখন আগুনের অস্ত্র দিয়ে হাতি আর ভাল্লুক মারতে লাগল। নীচে থেকে
আরও লোক আনাল, যাতে সবাই মিলে পাহাড়টা খালি করে ফেলতে পারে। একটা থেকে দুটো, দুটো থেকে
চারটে, চারটে থেকে ছ-টা তাঁবু পড়ল জঙ্গলে।
সে-সময়ে এত উঁচুতে নীচের থেকে মানুষ বেড়াতে আসত
না। শুধু পাহাড়ের ছেলেমেয়েরাই থাকত এখানে। দাদিম্মার পাঁচ বোন আর তিন ননদ দূরে দূরে
সংসার করত। জোর গলায় চেঁচিয়ে ডেকে সুখ-দুঃখের খোঁজখবর
নিত। ছোটো ছোটো ঘরে এঁটেসুঁটে রাতের বেলায় ঘুমোত সব্বাই। ঘন মেঘ নেমে আসত বাড়ির
উঠোনে এক-এক দিন। দুধরঙা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে কখনও কোনোদিন দেখা যেত গুম্ফার
রাজা এ-পথ দিয়ে যাচ্ছেন একটু ঝুঁকে, তাঁর মোটা
বাঁকা লাঠি হাতে নিয়ে। রাজার মুখে এক অদ্ভুত আলো। অমন আলো শুধু রোদের দিনের
সন্ধেবেলায় আকাশে দেখা যায়।
নোহা বলে, “রাজা, না
সন্ন্যাসী?”
দাদিম্মা বলে, “সন্নিসিই তো আসল রাজা। যিনি মানুষের
ভালো করেন, তিনি রাজা ছাড়া আর কী রে?”
নোহার অত ধৈর্য নেই। সে বলে, “আচ্ছা, তোমার
রাজার গল্প পরে বোলো। আগে বলো, আগুনের
অস্ত্রওয়ালা লোকগুলোর কথা।”
আসলে তো সে জানে গল্পের শেষটা। লোকগুলো অনেকদিন পাহাড়ের বুকে
দাপিয়ে সব ধ্বংস করছিল। শেষে দাদিম্মারা পাঁচ বোন আর তিন ননদ মিলে ছোটো গুম্ফার
সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল। হাতে ঘরে বানানো মোম আর বাগানের আপেল। মোমের আলো
জ্বেলে গুড়ি মেরে গুম্ফার মুখে রাখল, আপেল গড়িয়ে দিল ভেতর
দিকে। ছোটো গুম্ফার ভেতরটা তো ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইরের দিকে যতটুকু আলো পড়ে, তাতে দেখা
যায়—পাথরের গায়ে হরেক রকম আঁকিবুঁকি কাটা। সেই আঁকিবুঁকির ওপর হলুদ-ভেজানো কাপড়
রেখে মোম জ্বেলে সবাই মাথা নীচু করে কেবল বলতে লাগল, “প্রভু, এই খারাপ
লোকগুলোকে এখান থেকে তাড়িয়ে দাও। আমাদের ছেলেপুলেদের বাঁচাও আমাদের গাছপালা, পাখি, খরগোশ, হাতি, ভাল্লুক আর
বাঁদরগুলোকে রক্ষা করো, প্রভু।”
বলতে বলতে যখন দুপুরের সূর্য ঢাকা পড়ে গেছে পাইন গাছের মাথায়, যখন
পাহাড়ের গায়ের শ্যাওলাগুলো কালচে দেখাতে শুরু করেছে, তখন বাতাস
বইতে শুরু করল, পাতারা মাথা দুলিয়ে আওয়াজ দিতে লাগল, পাখিগুলো
অকারণ কিচির-মিচির জুড়ে পাহাড় সরগরম করে তুলল আর গুম্ফার ভেতর থেকে ক্ষীণ একটা
আলো দেখা গেল হঠাৎ। সে আলো একবার জ্বলেই নিভে গিয়েছিল। আকাশ ততক্ষণে ঢেকে গিয়েছে
কালো মেঘে, ছোটো ছোটো কাচের গুঁড়োর মতো বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে হঠাৎই।
বোনেরা আর ননদেরা তড়িঘড়ি জড়ামড়ি করে নেমে হাঁটা লাগিয়েছিল পাকদণ্ডি
ধরে। গাছগুলো তখন দুলে দুলে হাসছে, পাখিরা ডাকছে হইচই করে। তারপর সেই
রাতে সবাই যখন বার্লি দিয়ে কচি বাঁশের স্যুপ আর মোটা ভুট্টার রুটি খেয়ে শোওয়ার
তোড়জোড় করছে, তখন গুমগুম করে ঝরনার জল ফুলেফেঁপে নামতে শুরু করল ওপর থেকে।
বৃষ্টির দাপটে ঝাউ আর পাইনগাছগুলো যেন পাগল হয়ে উঠেছিল কোনোরকমে পাথুরে মাটিকে ধরে
রাখার জন্য। একথা বলতে বলতে দাদিম্মার কুঁচকোনো মুখখানা ঝকঝক করে ওঠে। বুড়ি বলে
চলে, “সে যে কী ভয়ংকর ঝড়বৃষ্টি আর থেকে থেকে আকাশ চিরে যেন
প্রভুর তরবারি ঝলসে উঠছে। আমরা ঠকঠক করে কাঁপছি আর দেবী তারাকে ডাকছি। এমন সময়ে
ঈশ্বরের আলোর তরবারিখানা আবার ঝলসে উঠল আর দুনিয়া কাঁপিয়ে আগুন নেমে এল পাহাড়ের
বুকে।”
নোহার চোখ জ্বলজ্বল করে এই গল্প শুনতে বসলেই। দাদিম্মার কাপড়খানা মুঠোয়
ধরে সে বলে, “ব্যস, সব শেষ তো?”
বুড়ি হাসে। বড়ো সুন্দর সে হাসি। বলে, “নয়তো কী? ওই এক
আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছিল ওপরের কত্ত গাছ। পুড়ে গেছিল শয়তানদের তাঁবু। দু-দিন ধরে
বৃষ্টি থামেনি একটুকুও। আমরা ঘর থেকে বেরোতেও পারিনি দুটো দিন। ঝরনা যেন ফেনা উগরে
উগরে ধুয়ে দিচ্ছিল পৃথিবী।”
আর সেই শয়তানগুলো?
সেগুলো তো পুড়ে কাঠ হয়ে ওপরেই মরে পড়ে ছিল তাঁবুর মধ্যে। এখনও হয়তো
তাদের আত্মা ঘুরে বেড়ায় ওখানে।
ভয় করে নোহার। বলে, “তাহলে লোকে এখনও ওখানে যায় কেন?”
দাদিম্মার বুকে ভয় নেই। বলে, “যাবে না? ও জায়গা যে
বড়ো পবিত্র! শয়ে শয়ে গাছ বুকে আগুন নিয়ে নিকেশ করল শয়তানদের। বিরাট একখানা গর্ত
হয়ে গেল পাহাড়ের গায়ে ওই আগুন গিলতে গিয়ে। তারপর আকাশের রাজা বৃষ্টির জল ঢেলে ঢেলে
ওখানে পবিত্র পুকুর তৈরি করে দিলেন আমাদের জন্য।”
নোহা ভাবে, যখন ও বড়ো হবে, আরও উঁচুতে
উঠে যাওয়ার মতো বড়ো, তখন যাবে সেই পবিত্র জলের পুকুর দেখতে। এখন বাবা
বোতলে ভরে নিয়ে আসে ওই জল। এনে রেখে দেয় উপাসনার ঘরে। যখন কেউ দূরে কোনো কাজে যায়, কী কারোর
বুকে সর্দি বসে বা জ্বর হয়, তখন দাদিম্মা ওই জল ছিটিয়ে দেয়
মাথায়। বলে, “যাও যাও, আর কোনো চিন্তা নেই।”
একদিন বড়ো হয়ে সেও ওই জল নিয়ে আসবে বাড়ির জন্য। ভাবতে ভাবতেই
বিছানায় উঠে বসে নোহা। জানলার বাইরে বান্টু লাফিয়ে লাফিয়ে পাখিদের তাড়া করছে। ওর
ঝামরানো ল্যাজটায় একটা নীল ফুল আটকে গেছে, কী করে কে
জানে।
নোহা বিছানা ছেড়ে বাইরে আসে।
“উঠেছিস? আয়, হাতমুখ
ধুয়ে আমার সঙ্গে একবার খেতে চল দেখি।” ঠাকুরদা নোহাকে
ডাক দেয়।
মা বড়ো ঝুড়িটা এগিয়ে দেয়। পাহাড়ের ধাপিতে ওদের খেত। কোথাও ভুট্টা, কোথাও
মটরের চাষ হয় অনেকটা জায়গা জুড়ে। লতানো পোলবিন্সের মাচা বেঁধেছে ঠাকুরদা। দূর থেকে একটা শব্দ ভেসে আসে। ভটভটি চড়ে পিংলা আসছে। পেছনে বড়ো
একটা বোঁচকা। নীচে থেকে জিনিসপত্র নিয়ে ফিরছে নিশ্চয়ই। আজকাল মাঝেমধ্যে ট্যুরিস্টরা এদিক
দিয়ে আরও ওপরে যায়। তাদের খিদে-তেষ্টা পায়। জিপ দাঁড় করিয়ে পথে এটা-ওটা কিনে
খায়। পিংলা ছোট্ট একটা ঝুপড়ি দোকান করেছে নিজের বাড়িতেই। সেখানে গরম মোমো আর আদা-দেওয়া চা
পাওয়া যায়। জল আর বিস্কুটও থাকে। লোকে আরও কত কী যে কিনতে চায়! কিন্তু
পিংলা অত জিনিস রাখে না। তাতে নাকি বড়ো বেশি টাকা দরকার। তবে সবাইকে বলে, “জল খেয়ে
বোতলটা রাস্তায় ফেলো না, কুড়াদানে ফেলবে।” ট্যুরিস্টরা সেসব কথা কানেই নেয় না। নইলে আজকাল রাস্তার ধারে
এত রঙিন প্যাকেট আর জলের বোতল পড়ে থাকে কেন!
বৃষ্টি আজ আর ধরবে না, ঠাকুমা মা’কে বলল, “এর মধ্যে
লিয়াম আসছে। আজ একটা বাঁধাকপি তুলে নিই, না কি? আর মোরগের
ঝোল করব রাতে।”
লিয়ামকাকা আসছে? নোহা খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। লিয়ামকাকা
আসা মানে বাড়িতে একটা উৎসব শুরু হয়ে যাবে। দাদিম্মার বোনেদের আর ননদদের ছেলেপুলে, নাতিপুতিরা
এসে জুটবে। সবাই মিলে জঙ্গলে যাবে গাছ চিনতে, মাটির গন্ধ
চিনতে। পাহাড়ে মাটির গন্ধ শুঁকে বোঝা যায়, কোথায় বুনো
জানোয়ার লুকিয়ে আছে, কোথায় মৌমাছি বাসা বেঁধেছে। লিয়ামকাকা আসা
মানেই দিনের বেলায় জঙ্গলে হাঁটা আর রাতে আগুন করে তাতে ভুট্টার আটার গোলা পুড়িয়ে সেটাকে
বেগুন-টমেটোর চাটনি দিয়ে খাওয়া।
লিয়ামকাকা বর্ডার পাহারা দেয়। জংলা খাঁকি পোশাক, মাথায় টুপি, হাতে
রাইফেল নিয়ে আসে বছরে একবার। সঙ্গে চকোলেট আনে। গতবার নোহা বলেছিল, “এবার যখন
আসবে, আমার জন্য একটা উইলো গাছের চারা এনে দেবে?”
“উইলো গাছ? কী করবি?”
নোহা ঠাকুরদার কাছে শুনেছে, উইলো
গাছের পাতা নাকি কেবল মাথা নীচু করে কাঁদে। তাই ওর নাম ‘উইপিং উইলো’। ওর খুব ইচ্ছা সেই গাছ দেখার। শুনে কাকা বলল, “কারোর
কান্নাই দেখতে নেই, নোহা। কান্না তো কেবল মনখারাপ করায়। তাছাড়া
পাহাড়ের এইদিকে উইলো গাছ জন্মায় না, মানে এখানের মাটি ওর জন্য নয়। শুধু শুধু একটা
চারাকে তার নিজের মাটি থেকে তোলা কি ভালো?”
যাক, সে আনুক বা না আনুক, কাকা নিজে
আসছে – এই-ই ভীষণ খুশির খবর।
“যা রে, একটা কপি তুলে নিয়ে আয়।” মা তাড়া দিল নোহাকে।
উপাসনা ঘরের দাওয়ায় দাদিম্মা মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। সামনে গরম
ধোঁয়া-ওঠা চা জুড়িয়ে যাচ্ছে। নোহা ভাবল, কপিটা
তুলে এনে চা খাইয়ে দেবে বাটিতে ঢেলে। আজকাল দাদিম্মা যেন মাঝে মাঝেই ঝিমোয়, গল্প বলতে
বলতে ঘুমিয়ে পড়ে হঠাৎ। বাবা বলে, “দাদি চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে
এবার।”
“কোথায় যাবে?” নোহা অবাক হয়।
বাবা বলে, “আরও অনেক দূরে যাবে। আকাশের ওইপারে, যেখানে
সবাইকে যেতে হয়।”
“তখন আমরা আর দাদিকে দেখতে পাব না তো!” নোহা কাঁদো-কাঁদো মুখে
বলে।
“আমরা পাব না, কিন্তু দাদিম্মা পাবে। বড়ো একটা
পতাকা উড়িয়ে রাখব আমরা, যাতে অনেক উঁচু থেকে দাদিম্মা
আমাদের বাড়িখানা চিনে আমাদের ওপর আশীর্বাদ দিতে পারে।”
নোহার মনটা খারাপ লাগে। কেউ দূরে যাবে ওদের এই বাড়িখানা ছেড়ে – এটা ও
ভাবতেই পারে না।
কপির খেতটা বাড়ির পেছন দিকে ঘুরে। ওখান থেকে নোহার ঘরটা দেখা যায়।
বান্টু নোহাকে দেখে ভুকভুক করে দৌড়ে এল। তারপরই লেজ উঁচিয়ে দৌড়ে গেল রাস্তার দিকে।
নোহা দেখল, ফাদার অ্যান্তেনিওর ভাঙাচোরা জিপখানা আসছে। ফাদার নোহাকে দেখে হাত
নাড়লেন। বাবা বেরিয়ে এল ঘর থেকে ছোটো বাক্স নিয়ে। বাবা এখানের স্কুলের নন টিচিং
স্টাফ, কিন্তু সেটা ছাড়াও আর-একটা কাজেও খুব
পোক্ত। সেটা হল রোগীদের দেখভাল করা। চার্চের হাসপাতালে গিয়ে গিয়ে বাবা অনেক কিছু
শিখেছে। বিশেষ করে হাড়ভাঙা বা বড়োসড়ো চোট পাওয়া রোগীকে কী করে সাবধানে দেখভাল করতে
হয়, ব্যান্ডেজ করতে হয়, প্লাস্টার বানিয়ে দিতে হয় – এসব বাবা
খুব ভালো পারে। তাই যদি তেমন কোনো বিপদ হয় কারোর, ফাদার অমনি
বাবাকে ডেকে পাঠান। পাহাড়ে মানুষের কতরকম উটকো বিপদ হয়, তখন বাবাকে
অনেক দূর দূর যেতে হয় হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর সঙ্গে।
শীতের ছুটিতে এখন পড়াশোনা তেমন নেই। সপ্তাহে দুদিন ওরা ফাদার মরিস
আর ফাদার ম্যাথুর কাছে হাতের কাজ শিখতে যায়। ফার্স্ট এড শিখছে এখন নোহা। বাবা
বলেছে, সামনের বছর কার্পেন্টরি ক্লাসে দেবে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ওদের
বাড়ি দূর থেকে দেখতে ভারী ভালো লাগে বটে, কিন্তু বাড়িগুলোকে
শক্তপোক্ত রাখতে কাঠের কাজ জানা খুব জরুরি।
মা বলে, “নোহা কি আর এই পাহাড়ে বসে থাকবে? ও মাটির
কাছে গিয়ে চাকরি করবে, অফিসার হবে।”
নোহারও ইচ্ছে করে
মাটির কাছে যেতে। কিন্তু সে কেবল বেড়ানোর জন্য। এই পাহাড়ের বাতাস, পাথর বেয়ে
নেমে আসা জল আর আকাশ-ছোঁয়া গাছপালা ছেড়ে সমতলে গিয়ে অফিসার হতে
নোহার বয়েই গেছে।
বান্টুর লেজ থেকে সেই নীল ফুলটা খসে পড়ে গেছে। এখন কেমন টুকটুক করে
ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে পাথরের ওপর লাফিয়ে। মা বলে, “এটা কুকুর
নয়, মাউন্টেন গোট। ক-দিন পরেই দেখবি ওর শিং আর দাড়ি
গজাবে। যার এত পাহাড়ে চড়ে গাছের পাতা চিবোনো স্বভাব, সে কখনও
কুকুর হয়?”
বছর খানেক আগে বাবা ওপরের অর্কিডের বাগান থেকে নামার সময়ে ওকে
রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখে তুলে এনেছিল। বেচারির তখন একটা পা ভাঙা। বোধহয় অনেক
উঁচু থেকে পড়ে ভেঙেছে। সেই পায়ে কাঠ বেঁধে কাপড়ের ফালি দিয়ে প্লাস্টারের মতো করে
দিয়েছিল বাবা আর দাদু। মা ওকে দুধভাত মেখে দিত। দিব্যি খেয়ে নিত শুয়ে শুয়ে। এখন পা
সেরে গেছে। সারাদিন কেবল পাখি আর প্রজাপতি তাড়া করে বেড়ায় আর রাত হলে রান্নাঘরের
বারান্দায় চটের ওপর শুয়ে ঘুমোয়।
ঠাকুমা বলে, “আহা! বান্টুর
ওপর আমাদেরও মায়া পড়ে গেছে। পথের কুকুর বলে মনেই হয় না।”
নোহা
জানে, ‘মায়া’ নামের একটা ‘পরি’ থাকে
পাহাড়ের মাথার ঝাউবনে। চাঁদরাতে সে পরি নেমে আসে। বাড়ির আশেপাশে ঘোরে। তাই তো বেশি রাত হলে ঘরের বাইরে যাওয়া
এক্কেবারে বারণ।
রোজ সন্ধের পর ওদের বাগানের লাগোয়া উপাসনার ঘরে তিনটে বড়ো মোম
জ্বলে। রাতে ওই ঘরের জানলা খোলাই থাকে। ঠাকুরদা বলে, “পরি এসে ওই
ঘরের জানলা দিয়ে ভেতরে ঢোকে, তারপর দেবতার জন্য থালায় রোজ একটা ফল
কী একটু বাদাম দেওয়া থাকে, তাতে নিজের ডানার পালক বুলিয়ে যায়।”
নোহা বলে, “তুমি কী করে জানলে, পরি আসে ওই
ঘরে?”
ঠাকুরদা বলে, “বা রে, বুঝব না! যেদিন
পরি আসে, সেদিন বাতাসে কেমন ফুলের গন্ধ ছন্ছন্ করে দেখিস না? ওই পরির
পালকের ছোঁয়া দেওয়া আপেল খেয়েই তো আমার মা এখনও দেখ, কেমন
বেঁচেবর্তে আছে, মায়া কাটাতে পারছে না সংসারের।”
একথা সত্যি। দাদিম্মা এখনও দিব্যি ওদের বাগানে ঘুরে ঘুরে আপেল পেড়ে
আনে, বাদাম জড়ো করে, সন্ধে হলে বড়ো উনুনে আগুন দেবে বলে শুকনো
গাছের ডালপালা জড়ো করে রাখে।
“কই রে, আজ লিয়াম আসবে বলে বুঝি ইস্কুলে যেতে ইচ্ছা
করছে না?” মা রান্নাঘর থেকে হাঁক দেয়। তারপর বলে, “যা, একবার।
যদি ফাদারের কাছে বন্ রুটি থাকে তো নিয়ে আয় একটা। লিয়াম এলে ওকে চা দিয়ে দেব। শোন, ছাতা নিয়ে
যা। পথে জোরে বৃষ্টি এলে দাঁড়িয়ে যাবি।”
এসব কাজে নোহার ভারী উৎসাহ। লিয়ামকাকাকে ও ভীষণ ভালোবাসে। ওর নাম
তো কাকাই রেখেছে। যেদিন নোহা জন্মেছে, সেদিন নাকি পাহাড়ে
ধস নেমেছিল বিরাট। নদীও ফুলেফেঁপে গাঁও কে গাঁও ভাসিয়ে নিয়েছিল। দাদিম্মার বোনেদের
বাড়িঘরের খুব ক্ষতি হয়েছিল। এক ননদের বাড়ির সামনের ফলন্ত পিচ গাছখানা উপড়ে উড়ে
গেছিল। কিন্তু কোনো আশ্চর্য উপায়ে নোহাদের বাড়ির তেমন বিশেষ কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। লিয়ামকাকা
তখন এখানেই। সেদিনের সেই বিপর্যয়ের পর যখন পাহাড়ের চুড়োর মেঘ কেটে সূর্য দেখা গেল, তখন কাকা ওকে
কোলে নিয়ে বলেছিল, “এই ছেলে নোহার মতো রক্ষা করেছে পরিবারটাকে।” সেই থেকেই
নাম হয়েছে ‘নোহা’।
মা বলে, “লিয়ামটা বড্ড ভালোবাসে ওই রুটি। দেখ, যদি পাস।
ফাদারকে বলিস, লিয়াম আসছে।”
নোহা মাথা নাড়ে। দৌড়ে বেরিয়ে যায়। কিছুদূর গিয়ে রাস্তার ধার ঘেঁষে
দাঁড়ায় একটু। পায়ের নীচেটা একটু কাঁপছে যেন।
হাতিঝোরার দিকে অনেকে বড়ো জিপ নিয়ে বেড়াতে আসে। অমনি কোনো জিপ উঠে
আসছে নীচের দিক থেকে। দাদু এইসব লোকজন একদম পছন্দ করে না। বলে, “এরা নীচের
নোংরা ওপরে নিয়ে আসে।” অনেক সময়ে ঠাকুরদা, নোহা ও আরও
দু-চারজন মিলে এদের ফেলে যাওয়া খাবারের প্যাকেট, জলের বোতল
রাস্তা থেকে তুলে বড়ো ঝুড়িতে ফেলে দেয়। ঠাকুরদা গজগজ করে। বলে, “আধ মাইল
অন্তর কুড়াদান রাখা আছে, তাও শহুরে বাঁদরগুলো রাস্তা আর
পাহাড় নোংরা করে যাবে।”
হুঁ, ঠিকই বুঝেছে। নীচে থেকে জিপটা উঠে এল। জোরে
গান বাজছে। হিন্দি গান। নোহা হিন্দি বুঝতে পারে, কিন্তু
বলতে পারে না সেভাবে। জিপটা ওর কাছাকাছি আসতে একটা ছেলে জানলা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “এ বাচ্চা, এলিফ্যান্ট
ফলস কত দূর হবে?”
নোহা ওপর দিকে আঙুল তুলে ইশারা করে। আসলে এলিফ্যান্ট ফলস, মানে হাতিঝোরা
এখান থেকে অনেকটাই দূর। কত দূর, অত আন্দাজ জানে না সে। শুধু জানে, চাঁদনি
রাতে ঝোরায় মা-হাতিরা বাচ্চাদের জল খাওয়াতে এনে পাহাড়ের সীমানা চেনায়। পরিষ্কার
আকাশের রাতগুলোয় ওদের ডাক শোনা যায় গোটা পাহাড় জুড়ে।
জিপটা কড়কড় করে পাথর মাড়িয়ে ওপরে উঠে যায়। টুপটাপ করে বৃষ্টি এসে
পড়ে গাছের পাতা আর পাথরের গায়ে ফুটে থাকা বেগুনি ফুলের ওপর। নীচে থেকে দুটো ছেলে হাতে ভুট্টা নিয়ে উঠে আসছে। খুব মজার কোনো কথা
হচ্ছে বোধহয়। হাসতে হাসতে উঠছে ওরা। নোহার দিকে যখন তাকায়, তখনও ওদের
চোখে অনেকটা হাসি লেগে আছে। দেখেই বোঝা যায়, ওরা নোহার
মতো মিশনারি স্কুলে পড়ে না। পাতা কুড়িয়ে আর মাল বওয়ার কাজ করে এখন থেকেই সংসারে
দুটো পয়সা দেয়। নোহার ইচ্ছে করে, ওদের সঙ্গে কথা বলতে। মাথা ঝুঁকিয়ে জিজ্ঞেস
করে, “নীচে থাকো? না কি ওপরে?”
একটু বড়ো ছেলেটা বলে, “নীচে। চামিয়ার বস্তিতে।” অন্য ছেলেটা বলে, “আমরা
চামিয়ার নাতি।”
নোহা চামিয়ার গল্প শুনেছে। সে নাকি ভারী সাহসী মানুষ। বলে, “বাবা রে!
চামিয়া? যে এক হাতে চিতার ল্যাজ ধরে ঘুরিয়ে ঝরনার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল?”
দুজনেই হাসে। বলে, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই-ই। তুমি
কোথায় থাকো?”
নোহা হাত দিয়ে একটু দূরে ওদের সুন্দর রঙিন ছোটো ছোটো পতাকা দিয়ে
সাজানো বাড়িখানা দেখায়। দূর থেকে ভারী ভালো দেখতে লাগছে বাড়িটা। ওই পতাকাগুলোর
মানে নোহা জানে। নীল কাপড় মানে আকাশ, সাদা মানে মেঘ, সবুজ মানে
জল, হলুদ মানে মাটি আর লাল মানে আগুন। ছোটো ছোটো পতাকা সুতোয় মালার মতো
বেঁধে বাড়ির দরজায় সাজানো। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, দাদিম্মা
এখনও একইভাবে বসে আছে দাওয়ায়। মুহূর্তের মধ্যে বেচারার মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়।
দাদিম্মাকে কিছুতেই এখনই প্রস্তুত হতে দেবে না সে। লিয়ামকাকাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে, কী করলে
দাদিম্মা আরও অনেক অনেক বছর ওদের এই ছোট্ট বাড়িটা ছেড়ে আর কোত্থাও না যেতে পারে। কাকা নিশ্চয়ই জানবে কোনো একটা উপায়।
ভাবতে ভাবতে চার্চের রাস্তাটা ধরে দৌড়ে চলে নোহা। সঙ্গে বান্টুও ভুকভুক
করে ওকে পাহারা দিতে দৌড়োয়। নোহা ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। ভাবে, এমনি করেই
ও-ও দাদিম্মাকে পাহারা দেবে আরও অনেক অনেক দিন।
----------
ছবি
– শুভশ্রী দাস
No comments:
Post a Comment