
গলি থেকে রাজপথ
সায়ন্তনী পলমল ঘোষ
‘গলি থেকে রাজপথ’ - এই একটি বাক্যের সাহায্যেই বিজ্ঞানী
মণিলাল ভৌমিকের যাত্রাপথকে আখ্যায়িত করা যায়। অবিভক্ত
মেদিনীপুরের এক অখ্যাত ছোট্ট গ্রাম থেকে খ্যাতি, যশ, অর্থের সুউচ্চ শিখরে পৌঁছোনোর পথটা মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ
ছিল না। কণ্টকময় সেই বন্ধুর পথে হাঁটতে
হাঁটতে মণিলাল ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, জীবনযুদ্ধ
তাঁর অন্তরাত্মাকে রক্তাক্ত করেছে কিন্তু নিজের লক্ষ্যে সর্বদা অবিচল থেকেছেন তিনি।
অবিভক্ত মেদিনীপুরের তমলুকের কাছে ছোট্ট এক গ্রাম সিউরিতে দরিদ্র
স্কুল শিক্ষক গুণধর ভৌমিকের গৃহে ১৯৩১ সালের ৩০ মার্চ জন্ম নিলেন ভবিষ্যতের এই বিস্ময়কর
প্রতিভা। শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে গুণধর
ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশকে স্বাধীন করার মহান ব্রতে। গান্ধীজির
অনুগামী ছিলেন তিনি। ফলস্বরূপ প্রায়শ ইংরেজ শাসকের
পুলিশের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে অজ্ঞাতবাসে থাকতে হত তাঁকে। চরম
দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতায় ঘেরা সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলিতে ছোট্ট মণির কাছে প্রদীপের
শিখা হয়ে জ্বলতেন তার মা ও ঠাকুমা। এই
দুই নারী তাঁদের ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করতেন মণিকে যাবতীয় দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে দূরে রাখতে। মাঝে
মাঝে যখন গুণধর অল্প সময়ের জন্য বাড়ি আসতেন তখন দীর্ঘ অদর্শনের পর বাবাকে দেখে মণির
হৃদয় উদ্বেল হয়ে উঠত। বাবার হাত ধরে তমসাছন্ন রাত্রিতে
আল পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে তারায় ভরা আকাশ দেখে মণির মনে হাজার প্রশ্ন ভিড় করত।
অস্থির হয়ে উঠত তার মন। মাঝে
মাঝেই গুণধরের সন্ধানে বাড়িতে হানা দিত ইংরেজ সরকারের পুলিশ। তছনছ
করে দিত তাদের ক্ষুদ্র গৃহস্থালি। হাত
তুলত বালক মণিলালের গায়েও। অবাক
বিস্ময়ে মণি দেখত তার ক্ষীণতনু ঠাকুমা সারদা গর্জে উঠতেন পুলিশের বিরুদ্ধে।
মা-ঠাকুমা ছাড়াও আরেকজন নারী
মণির চেতনাকে প্রভাবিত করেছিলেন। তিনি
হলেন মেদিনীপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামের আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র মাতঙ্গিনী হাজরা।
মাতঙ্গিনীর কাছ থেকে মণি যেমন পেয়েছিলেন অপার স্নেহ তেমনি পেয়েছিলেন
জীবনে এগিয়ে চলার প্রেরণা। মাতঙ্গিনী
প্রতিনিয়ত মণিকে মন দিয়ে পড়াশোনা করার উৎসাহ দিতেন। তিনি
বুঝতে পেরেছিলেন মণিলাল আর পাঁচটা সাধারণ গ্রাম্য বালকের মতো নয়।
তার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক বিপুল সম্ভাবনা। খালি
পায়ে চার কিলোমিটার হেঁটে মণি পড়তে যেতেন পাঠশালায়।
এইভাবেই দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবন এগিয়ে যাচ্ছিল,
কিন্তু আরও বড়ো ঝঞ্ঝা অপেক্ষা করছিল মণির জন্য।
দেখা দিল কালান্তক মহামারী ও দুর্ভিক্ষ। একেকদিন
পুরো পরিবারের জন্য জুটত হয়তো একটি রুটি। কোনো
দিন আবার সারাটা দিনই অভুক্ত থাকতে হত। এই
দুঃসময়ে মণিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ঠাকুমা সারদা।
নিজের গ্রাসটুকু তুলে দিতেন মণির মুখে,
ফলে সারদা নিজে আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন মৃত্যুর
দিকে। শেষ পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ মণির
কাছ থেকে কেড়ে নিল তার অতি প্রিয় ঠাকুমাকে। একসময়
ইংরেজ সরকারের পুলিশের হাতে মণির বাবাও বন্দি হলেন। যাবতীয়
সমস্যার মধ্যেও মণি মন দিয়ে পড়াশোনাটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
মণিলাল ভৌমিকের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল গান্ধীজির
সহচর্য পাওয়া। বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী হওয়ার
সুবাদে গান্ধীজির মহিষাদল ক্যাম্পে বেশ কিছুদিন কাটানোর সুযোগ ঘটে মণিলালের।
গান্ধীজির জীবনচর্চা প্রভাবিত করে মণিলালকে।
একসময় মণি বাবাকে আর্জি জানান তাকে ভালো কোনো স্কুলে ভরতি করার
জন্য, কারণ তাঁর জ্ঞান পিপাসা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল,
কিন্তু ভালো স্কুলের খরচ তার বাবার পক্ষে চালানো সম্ভব নয়।
এখানেও মণির সহায় হল তার প্রতিভা। দুর্ভিক্ষ
ও মহামারী নিয়ে লেখা তার একটি প্রবন্ধ পড়ে একটি বড়ো স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাকে সেই
স্কুলে পড়ার সুযোগ করে দেন। কোলা
ইউনিয়ন হাই স্কুল থেকে স্কুলের শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন মণিলাল।
কৃতিত্বের সঙ্গে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় পাশ করেন মণিলাল।
এরপর শুরু হয় জীবনের নতুন এক অধ্যায়। স্কলারশিপ
নিয়ে ভর্তি হন স্কটিশ চার্চ কলেজে। খ্রিস্টান
মিশনারী পরিচালিত এই কলেজে এসে প্রথম খ্রিস্ট ধর্মের সঙ্গে পরিচিতি ঘটে মণিলালের।
এসময়ই তাঁর মধ্যে প্রথম আধ্যাত্মিক সংকট দেখা দেয়,
কিন্তু কেউই তাঁর অনুসন্ধিৎসা মেটাতে পারেনি।
কলেজ শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ
করেন মণিলাল। এইখানে তিনি বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী
সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সান্নিধ্য লাভ করেন।
পড়ার শেষে তাঁর বাবা আদেশ দেন গ্রামে ফিরে আসতে।
বাবার আদেশ শিরোধার্য করে গ্রামে গিয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন মণিলাল,
কিন্তু বিধাতা যাঁর ললাট লিখনে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হওয়া লিখেছেন
তাঁকে তো এই ক্ষুদ্র পরিসরে আটকে রাখা যায় না। স্বাধীন
ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে ১৯৫৪ সালে মণিলাল পি এইচ ডি করার সুযোগ পান খড়গপুর আই আই
টি-তে। ১৯৫৮
সালে খড়গপুর আই আই টি-র প্রথম ছাত্র হিসেবে
পি এইচ ডি সম্পূর্ণ করেন তিনি। সেই
বছরই তাঁর লেখা বেরোয় আমেরিকান জার্নাল অফ কেমিক্যাল ফিজিক্সে। সত্যেন্দ্রনাথ
বসুর সুপারিশে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম ম্যাকমিলান মণিলালকে
স্লোন ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ দেন, কিন্তু সাগর
পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্লেনের টিকিটের পয়সা ছিল না মণিলালের কাছে।
বহু অবস্থাপন্ন বন্ধুরা তাঁকে ফিরিয়ে দেন,
কিন্তু নিরাশ করেনি তাঁর জন্মভূমি। গ্রামের
মানুষদের আর্থিক সহায়তায় পকেটে মাত্র তিন ডলার নিয়ে মণি পদার্পণ করলেন লস এঞ্জেলেসে।
স্বাগত জানালেন স্বয়ং অধ্যাপক ম্যাকমিলান।
শুরু হল মণিলালের স্বপ্নের উড়ান। তাঁর
গবেষণার বিষয় ছিল ইলেকট্রনিক এনার্জি ট্রান্সফার। ফলে
লেজার (light amplification by stimulated emission of radiation) প্রযুক্তিবিদ্যার সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন মণিলাল। স্টাফ
সায়েন্টিস্ট হিসেবে যোগ দেন প্যাসাডোনার ইলেকট্রো অপটিক্যাল সিস্টেমসে।
প্যারিসের থার্ড ইন্টারন্যাশনাল কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিক্স কনফারেন্স-এ মণিলাল ও তাঁর সহকারী তুলে ধরেন তাঁদের নতুন আবিষ্কারের কথা।
এইসময় থেকে মণিলাল আর্থিক মুক্তির স্বাদ পেতে আরম্ভ করেন।
মার্কিন মুলুকে গবেষণার প্রবল সম্ভাবনার মধ্যেও দেশের প্রতি শিকড়ের
টানে তৎকালীন কর্মস্থল ‘জেরক্স’ থেকে পাঁচ বছরের ছুটি নিয়ে ভারতবর্ষে ফেরেন মণি, কিন্তু
সদ্য স্বাধীন ভারতে তখন লেজার গবেষণা অনেক পিছিয়ে। কিছুকাল
মাতৃভূমির বুকে কাটিয়ে আবার আমেরিকায় ফিরলেন মণিলাল এবং জয় করলেন লেজার গবেষণা ক্ষেত্র।
১৯৬৮ সালে নরথ্রপ করপোরেশন-এর রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজি সেন্টারে যোগদানের আমন্ত্রণ পান।
নতুন উদ্যমে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন গবেষণায়। তাঁর
কার্বন মনোক্সাইড লেজার গবেষণার উপর ভিত্তি করে আবিষ্কৃত হল কন্টিনিউস লেজার।
১৯৭৩ সালের ১৪ মার্চ ডেনভারের অপটিক্যাল সোসাইটি অফ আমেরিকার আলোচনা
সভায় মণিলাল সর্বপ্রথম এক্সিমার লেজারের সন্দেহাতীত প্রমাণ দাখিল করেন।
শল্য চিকিৎসায় বিপ্লব আনল এই লেজার,
বিশেষ করে চোখের দৃষ্টি ঠিক করার চিকিৎসায় যা Lasik সার্জারি নামে খ্যাত। আবিষ্কারের
স্বীকৃতি হিসেবে আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি এবং ইনস্টিটিউট অফ ইলেকট্রনিক অ্যান্ড
ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স-এর ফেলো নির্বাচিত হন,
খড়গপুর আই আই টি থেকে পেলেন ডি এস সি ডিগ্রি।
সম্মানের সঙ্গে সঙ্গে এল গগনচুম্বী আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য।
বেভারলি হিলস, বেল এয়ার, প্যালস ভারডিস প্রভৃতি অভিজাত এলাকায় ছটি অট্টালিকার
মালিক হন মণিলাল। হাত রাখলেন দামী দামী গাড়ির
স্টিয়ারিংয়ে, কিন্তু এত সবের মধ্যেও
মনের মধ্যে ঠাকুমা সারদা ও প্রেরনাদাত্রী মাতঙ্গিনীর জন্য দুঃখ রয়ে গেল।
এরপরই মণি তাঁর হৃদয়েশ্বরী বিজ্ঞান থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে
জীবনটা উপভোগের খাতে বইয়ে দিলেন। পার্টি,
বন্ধু-বান্ধব নিয়ে মেতে উঠলেন, কিন্তু অচিরেই মণি বুঝতে পারলেন এ পথ তাঁর জন্য নয়।
তীব্র আত্মিক ও মানসিক সংকট দেখা দিল মণিলালের মধ্যে।
এইসময় অভিনেতা এডি আলবার্ট, শিক্ষাবিদ আশলে মন্তেগু এবং সাংবাদিক নরম্যান কাজিন্স এই তিন বন্ধু মণিলালকে
এই মানসিক অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেন, সেই সঙ্গে মননের
গহনে ছিল গান্ধীজি ও মাতঙ্গিনীর প্রভাব। মণিলাল
আবার নিজেকে সমর্পণ করেন বিজ্ঞানের পদতলে।
সারাজীবনে বহু সম্মান অর্জন করেছেন মণিলাল।
২০১১ সালে ভারত সরকার ভূষিত করেছে পদ্মশ্রী উপাধিতে।
২০১০ সালে পেয়েছেন প্রবাসী ভারতীয় সম্মান পুরস্কার।
সুযোগ পেয়েছেন ‘দ্য লাইফস্টাইল অফ দ্য রিচ এন্ড ফেমাস’ শোতে।
২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘দ্য মণিলাল ভৌমিক ইনস্টিটিউট অফ থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স’।
এত সাফল্যের মধ্যেও মণিলাল ভুলে যাননি তাঁর অতীতের জীবন সংগ্রাম,
তাই বাংলার দরিদ্র-মেধাবী ছাত্রদের জন্য তৈরি করেছেন
‘মণিলাল ভৌমিক ফাউন্ডেশন’ যাতে অর্থের অভাবে
কোনো প্রতিভার অকালমৃত্যু না ঘটে। চুরানব্বই
বছরের এই বিজ্ঞানী লিখেছেন বেশ কয়েকটি বিখ্যাত বই - ‘Code
Name God: The Spiritual Odyssey of a Man of Science’, ‘Hello Einstein’, ‘The Cosmic
Detective’ তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখ্য। বিজ্ঞানী
মণি ভৌমিকের জীবন হল এক বিস্ময়কর জয়যাত্রা যা মানুষকে অন্ধকার সরিয়ে আলোর পথে অগ্রসর
হতে প্রেরণা জোগাবে।
----------
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment