
আলমারি ও একটি কম্পাস
সৃঞ্জয় মৌলিক
পঞ্চম শ্রেণি, দোলনা ডে স্কুল
রূপমের মামা একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।
কাজের জন্য তিনি দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ান এবং প্রায় ছ’মাস পর পর বাড়ি ফিরে
আসেন। প্রত্যেকবার তিনি রূপমের জন্য নিয়ে আসেন বিদেশি জিনিসপত্র—কখনও আধুনিক যুগের খেলনা, কখনও প্রাচীনকালের কিছু অদ্ভুত বস্তু। রূপমের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হল মামার
সেই সব গল্প, যেগুলোতে মিশে থাকে ভিনদেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস আর রহস্য। এইবার মামা ফ্রান্স থেকে রূপমের জন্য এনেছেন একটি
প্রাচীন কম্পাস। কম্পাসটি হাতে পেয়ে রূপম আনন্দে আত্মহারা। সারাদিন সে এটি নিয়েই
ব্যস্ত থাকে, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। এটি অন্য কম্পাসের মতো
নয়—তামার তৈরি বাইরের খোলস, আর ভেতরের
কাঁটাটি সারাক্ষণ নড়াচড়া করে, যেন কোনো অদ্ভুত শক্তির টানে
চলছে। একদিন, সেটি একটি পুরনো আলমারির ভিতর রেখে রূপম
ঘুমিয়ে পড়ে।
রাত গভীর হতে থাকে। হঠাৎ ঘোড়ার ছুটে
চলার শব্দে রূপমের ঘুম ভেঙে যায়। সে আতঙ্কিত হয়ে শোনে, শব্দটা যেন আলমারির ভিতর
থেকে আসছে। ভয়ে ভয়ে সে আলমারির কাছে গেল, হাত বাড়িয়ে
হাতলটা ধরল, তারপর জোরে টেনে দরজা খুলল। সামনের দৃশ্য দেখে
সে হতবাক হয়ে গেল। সামনে এক বিশাল প্রান্তর। রূপম এক মুহূর্তের জন্য অবাক হয়ে
তাকিয়ে রইল। চারপাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভাসছে, আকাশজুড়ে
চক্কর মারছে কিছু বাজপাখি। দূরে দাঁড়িয়ে আছে এক ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন নগরী,
আর নগরীর মাঝে দেখা যাচ্ছে এক পুরোনো মন্দির।
চোখের পলক পড়তেই রূপম দেখতে পেল একটি খয়েরি রঙের ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে, যার পায়ের কাছে পড়ে আছে তার ফরাসি কম্পাসটি।
রূপম কাছে গিয়ে কম্পাসটা তুলে নিল এবং
ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল। ঘোড়াটিকে রূপম কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ঘোড়াটি যেন
কম্পাসের নির্দেশে ছুটে চলেছে। দ্রুতগতিতে ছুটতে ছুটতে তারা এসে থামল মন্দিরের
সামনে। মন্দিরটি অত্যন্ত পুরোনো, যেন বহু শতাব্দী ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার গায়ে খোদাই করা রয়েছে বিভিন্ন অদ্ভুত সব চিহ্ন।
রূপম ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে কম্পাস হাতে
মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করল। ভিতরে ঢুকেই তার নজরে এল বিশাল এক গোলাকার পাথর, যার উপর খোদাই করা
রয়েছে অনেক পুরোনো প্রতীক। পাথরের উপর সেই প্রতীকের আকৃতিগুলো তার কাছে ভীষণ
পরিচিত মনে হচ্ছে। রূপম এগিয়ে গিয়ে কম্পাসটা পাথরের সঙ্গে
ছুঁইয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে প্রকাণ্ড ঝড় উঠল, আর পাথরের গায়ে ভেসে উঠল একটি রহস্যময় দরজা। সেই দরজা থেকে উজ্জ্বল আলোর
ঝলকানি বের হতে লাগল। রূপম দরজার দিকে তাকিয়ে রইল, তার
সামনে এক অনন্ত রহস্য। সাহস করে সে দরজার সামনে গিয়ে সেটি খুলল এবং নিজেকে এক নতুন
জগতে আবিষ্কার করল। এই জগতে প্রবেশ করেই রূপম বুঝতে পারল, তার
সামনে দুটি পথ, একদিকে অন্ধকারে ঢাকা, অন্যদিকে
আলোতে ভরা। কিন্তু রূপম কীভাবে জানবে কোন পথ তার জন্য সঠিক? রূপম
কম্পাসের কাঁটার দিকে তাকিয়ে দুটি পথের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছিল।
কম্পাসের কাঁটাটি আস্তে আস্তে ঘুরে অন্ধকারের দিকেই স্থির হল। রূপমের মনে একটু ভয়
জমতে থাকলেও কৌতূহল তাকে পিছু হটতে দিল না।
আত্মবিশ্বাস জোগাড় করে রূপম অন্ধকারের
দিকে পা বাড়াল। যত এগিয়ে গেল, চারপাশের পরিবেশ আরও ভয়ঙ্কর হতে থাকল—অন্ধকার আরও ঘন হল। হঠাৎ সে একটি চাপা গর্জন শুনতে পেল। সে থেমে গেল,
তার চারপাশে কোনো প্রাণীর উপস্থিতি অনুভব করল। এক বিশাল ছায়ামূর্তি
তার সামনে ভেসে উঠল। এটি যেন কোনো প্রাচীন মন্দিরের রক্ষাকারী দেবতা। রূপম সাহস করে এগিয়ে গেল, এবং সেই ছায়ামূর্তি তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“তুমি এখানে কেন এসেছ, বালক? তুমি কি জানো এই পথে যা খুঁজতে এসেছ, তার মূল্য কী?”
রূপম কিছুক্ষণের জন্য ভেবে নিল। সে জানত
না তার সত্যিকারের উদ্দেশ্য কী, তবে তার মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল যে এই যাত্রায় তার
নিজের ভিতরের কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। সে দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল, “আমি সত্য খুঁজতে এসেছি। আমি সেই রহস্য উন্মোচন করতে চাই, যা এই কম্পাসের মধ্যে লুকিয়ে আছে।”
রক্ষকটি কিছুক্ষণ চুপ করে রূপমের দিকে
তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, “তাহলে তোমার সাহসিকতার
পরীক্ষা হবে। তোমাকে প্রমাণ করতে হবে যে তুমি সত্যের যোগ্য।”
হঠাৎ করেই অন্ধকার সরে গেল এবং রূপম
দেখতে পেল সেখানে গোলকধাঁধার মতো দেখতে কিছু স্থাপত্য দেখা যাচ্ছে। মাটিতে বিভিন্ন প্রতীক
আঁকা, যেগুলো একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে
গেছে। রূপম বুঝতে পারল, এটাই সেই পরীক্ষা যেখানে তাকে নিজের
সাহস ও বুদ্ধি দিয়ে পেরিয়ে যেতে হবে।
কম্পাসটি তার হাতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
কাঁটাটি এবার গোলকধাঁধার মধ্যে দিয়ে একটি বিশেষ পথ নির্দেশ করল। রূপম ধীরে ধীরে
সেই পথে চলতে লাগল। একের পর এক ধাঁধা, প্রতীক আর সংকেতের সমাধান করে সে
এগিয়ে চলল। অবশেষে, রূপম পৌঁছোল একটি
প্রাচীন দেবী মূর্তির সামনে। আর তাঁকে প্রণাম করামাত্র সে
নিজেকে আবার আলমারির বাইরে খুঁজে পেল। চারপাশের পরিবেশ ঠিক আগের মতো। শুধু মিলিয়ে
গেছে ঘোড়ার শব্দ আর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। তার হাতের ফরাসি
কম্পাসটিও বদলে গেছে। সেটিতে কোনো আওয়াজ নেই, চঞ্চলতা নেই, একদম চুপচাপ।
----------
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment