গল্প:: ফুরায় শুধু চোখে - ঋষভ চট্টোপাধ্যায়


ফুরায় শুধু চোখে
ঋষভ চট্টোপাধ্যায়

“কী রে, মুখটা ওরকম বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছিস কেন? খবরের কাগজটা চোখের সামনে থেকে সরিয়ে রেখে বললেন বাবা বলেই মা রক্ষেকালীর মতো এক হাত লম্বা জিভ কেটে বললেন, “ওহ! এই কথাটা তো আবার আমাদের আমলে চলত তোদের জেন্-জি ল্যাংগো-তে বাংলার পাঁচকে কী বলে রে?
“ওটা ল্যাংগো না বাবা, লিংগো,” মুখচোখ একদম এক রেখে বলে হোমি
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই হল লিঙ্গ তো আমরাও করেছি পরীক্ষায় আসত যে - লিঙ্গ পরিবর্তন
শুনে হোমি বাবার দিকে যে চোখে তাকায়, সেটাকে জেন্ ওয়াই, জেন্ জি সব ভাষাতেই পোকার ফেস বলাই যায় যদিও বেশিরভাগ পোকা-মাকড়ের ফেস মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখাই যায় না; তবে গেলে সেই মুখকে যে হোমির এই মুহূর্তের মুখের থেকে বেশি হাসিখুশি বলে মনে হত, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশই নেই
ব্রেকফাস্ট শেষ করে কাউকে কিছু না বলে মুখ গোঁজ করে সকলের সামনে থেকে সরে পড়ে হোমি সরে পড়ার আগে দেখতে পেয়েছে সকলের চোখ এড়িয়ে একেবারে শয়তানের হাসি হাসছে টুপুর ওর দূরবস্থাটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে
এদিকে হোমি কাউকে কিছু বলতেও পারছে না, কারণ শর্তও সেরকমই ছিল টুপুর ইচ্ছে করেই এই ব্যাপারে হোমি আর বাড়ির অন্য সকলের মাঝে রীতিমতো আয়রন কার্টেন ঝুলিয়ে দিয়েছে কোভিড-পরবর্তী পৃথিবীর প্রথম কোয়ারেন্টাইন হওয়া মানুষ হিসেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিশ্চয়ই হোমিকে মনে রাখবে এখন হোমি যদি অসহায় হয়ে মা-বাবার থেকে কোভ্যাক্সিন মানে হেল্প চেয়ে বসে, তাহলে ওর মান-সম্মানের উপর এক্সপায়ারি ডেটের লেবেল পড়ে যাবে না হয় সবে সেভেনে  উঠেছে, তা বলে কী ওর মান সম্মান নেই নাকি?
ওদিকে কপিল, ঐশী, পাপিয়া, শুভ, আজিজ সবাই সকাল থেকে কল করেই যাচ্ছে কখন আসবে জিজ্ঞেস করছে কী উত্তর দেবে হোমি, নিজেই তো জানে না আদৌ ওর নিজেরই দেখা হবে কিনা ফোনে ওর দোনামোনা দেখে কপিল তো বলেই দিল, “তুই যা দেরি করছিস, একটা ফাইনাল ডিসিশন নেওয়ার আগে তো দেখছি ব্যাঙ্গালোর আইপিএল জিতে যাবে
শুভ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আপাদমস্তক বিরাট কোহলির ফ্যান জন্মদিনে কোহলির ব্র্যান্ডের জুতো চাই, বাবা খাওয়াতে নিয়ে এলে কোহলির রেস্তরাঁতেই যেতে হবে সবে সেভেন, এখন থেকেই আয়নার মধ্যে প্রায় ঢুকে গিয়ে খোঁজার চেষ্টা করে দাড়ি গজাচ্ছে কিনা যতদিন না কোহলি ছাঁটটা দিতে পারছে, মনে শান্তি নেই ওর এই তো সেদিনের কথা ওদের বাড়িতে বসে সবে হোমিদের বলেছে, “একবার কলেজে উঠতে দে কবজির ঠিক উপরটায় একদম কোহলির মতো একটা ট্যাটু...!” এমন পোড়া কপাল, ঠিক সেইসময় কাকিমা ওদের ঘরের পাশ দিয়ে পেরোচ্ছিলেন ব্যস! আর যায় কোথা? ডান কানখানা এমন জোরে মুলেছিলেন, যে ট্যাটুতেও সম্ভবত অত ব্যথা হয় না
সে যাই হোক, কপিলের খোঁচাটা শোনামাত্র অফেন্স নিয়ে নেয় শুভ “ভাই, কোহলিকে নিয়ে কোনো আজেবাজে কথা হবে না কিন্তু, বলে দিলাম
শুনে ঐশী ফিক করে হেসে ফেলে, “রাখ তো! তোরা সতেরো বছরে পারিসনি আমরা মেয়েরা কিন্তু স্রেফ দু-বছরে জিতে দেখিয়ে দিলাম সালা কাপ নাম দে
হোমি অন্তর থেকে কেকেআর-এর ফ্যান সেদিন ফিল্ডিং করতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ছড়ে গেল বিকেলের ম্লান আলোয় ওর একবার যেন মনে হল - ছড়ে যাওয়া জায়গাটা পার্পল লাগছে না?
“সে তোরা যত খুশি নাম দে, জিতব তো আমরাই,” ফোনের এপার থেকে বলে উঠল হোমি
“আঃ! বেশ জোরে বিরক্তি প্রকাশ করল কপিল, “তখন থেকে উলটোপালটা বকে যাচ্ছে সবাই মিলে আগে একটা ডিসিশনে আসতে দে যে আজ খেলাটা আমরা দেখব কোথায়!

আর ডিসিশন! ডিসিশন বিশ বাঁও জলে! গোড়া থেকেই বলি আজ সন্ধেবেলা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকা টানটান উত্তেজনা হোমিদের বাড়িতে ইয়াব্বড়ো একটা ড্রইংরুম আজিজ প্রথম দিন এসে বলেছিল, “আরিব্বাস! নিউ মার্কেট থেকে ক’টা ফেক অ্যান্টিক কিনে এই ঘরে সাজিয়ে রিল বানিয়ে ইনস্টাগ্রামে ছাড় তারপর খ্যাক খ্যাক করে হেসে যোগ করেছিল, “লোকে ‘হিডেন জেমস অফ কলকাতা’ ভেবে দেখতে চলে আসবে রে তো এ হেন ড্রইংরুমে মাস ছয়েক হল শোভা পাচ্ছে একটা ৪৫ ইঞ্চির স্মার্ট টিভি, দেয়ালের কোনায় লাগানো, আর দুইখানা হোম থিয়েটার বলাই বাহুল্য, এরকম হাই ভোল্টেজ ম্যাচ থাকলে ওদের বাড়িতেই কপিলরা সবাই এসে জড়ো হয়
এবারও প্ল্যান সেরকমই ছিল বাদ সাধল হোমির খুড়তোতো দিদি টুপুর কাল সন্ধেবেলা এসে বলে আজ খেলার সময়ই নাকি ওর কোন ড্যান্স শোয়ের সিজিন ফিনালে আছে দুজনে মিলে খুব একচোট ঝগড়া হওয়ার পর টুপুর ওকে চ্যালেঞ্জ করে বসল, “শোন, টিভির রিমোট আমি এমন জায়গায় লুকিয়ে রেখে দেব, যে তুই খুঁজেই পাবি না যদি খুঁজে বের করতে পারিস, তাহলে টিভি তোর
ব্যস! কেলেঙ্কারি! টিভি ছাড়া আজকাল ফোন বা ল্যাপটপেও খেলা দেখা যায়, কিন্তু হোমির তো নিজের ফোন নেই বাবার ফোন বা ল্যাপটপ চার ঘণ্টার জন্য বাবা দেবেন না কাল সন্ধ্যা থেকে পাগলের মতো গোটা বাড়ি খুঁজে চলেছে হোমি রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর লুকিয়ে লুকিয়ে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির এক একটা কোনা খুঁজতে শুরু করে মাঝরাত্তিরে এত নিমগ্ন হয়ে খুঁজছিল, যে বেখেয়ালে কখন টুপুরেরই সামনে এসে পড়েছে, খেয়াল করেনি টুপুর টয়লেটের জন্য উঠেছিল হোমির হাতের পেনসিল টর্চের আলোয় ওর এলোমেলো হয়ে থাকা চুল আর ঘেমে চান হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে প্রথমে একটু চমকে গিয়েছিলকিন্তু সে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তারপরেই স্বমূর্তি ধরে সে উচ্চকণ্ঠে খোনা গলায় হাসতে শুরু করে হোমির অবস্থা দেখে হোমি বলতে বাধ্য হয়, “একটু আসতে হাস, দিদি পাশের গলিতে দুটো পেতনি ঘুমোচ্ছে, তোর হাসি শুনে ভয়ে পালাবে
খোঁচাটা একটুও গায়ে মাখে না টুপুর বলে, “আহা রে! কত্ত কষ্ট করে, ঘুমের বারোটা বাজিয়ে খুঁজছিস! আমি বরং ঘুমোতে যাই তুই খুঁজতে থাক এতদূর অবধি তাও ঠিক ছিল, হোমি টুপুরকে কাটিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যেত কিন্তু এরপর টুপুর যা করল, সেটা হিন্দি সিনেমার চরম নিষ্ঠুর ভিলেনরাও করে না কাঁধ ঝাঁকিয়ে, আদুরে গলায় টুপুর বলল, “এত মনপ্রাণ দিয়ে খুঁজতে থাকলে হয়তো ফিফটি ওভার ওয়ার্ল্ড কাপ ট্রফিটাও খুঁজে পেয়ে যেতে পারিস
“না! দিদি, না! প্রায় কেঁদে ফেলেছিল হোমি আরেকটু হলে নিঃসন্দেহে ওর গভীরতম ব্যথার জায়গায় পিন ফুটিয়েছে টুপুর “দিদি, প্লিজ, আর যা খুশি বল, কিন্তু এটা...
একটা ভুবনমোহিনী হাসি হেসে ‘গুড নাইট’ বলে ঘুমোতে চলে গেল টুপুর আর বিন্দুমাত্র খোঁজার ইচ্ছে অবশিষ্ট ছিল না হোমির মনে মনটাই ভেঙে গেল ওর ধীর পায়ে ঘরে এসে শুয়ে পড়ল ঘুম আসা অবধি ভাবতে থাকল, কাল রিমোট পাওয়া যাক বা না যাক, ইন্ডিয়া যেন অন্তত কাল জিতে যায় তাহলে সামান্য হলেও মেরামতি হবে উনিশে নভেম্বরের ক্ষতে!

পরদিন ঘুম থেকে উঠে দুপুর বারোটা অবধি খোঁজার পরও যখন কোনো উপায় হল না, কাঁদো কাঁদো গলায় ফোন করল কপিলকে কপিল পুরো টিম নিয়ে বাড়ি আসার পর ওকে সবটা ডিটেলে বলল হোমি
“বাবাঃ! এ কী রিমোট না ইনফিনিটি স্টোন? যেখানে সেখানে লুকিয়ে ফেললেই হল? তুই কিচ্ছু চাপ নিস না, আমি আছি তো
কপিলের নেতৃত্বে সকলে মিলে আরও ভালো করে সব ক’টা ঘর খোঁজা হল পুলিশি কায়দায় লেপ তোষক এদিক ওদিক করে দেখা হল খাটের নীচে, বারান্দায় ফুলের টবের মধ্যে, ওয়াশিং মেশিনের ভেতর, বাথরুমে - কোনো জায়গাই বাদ দেওয়া হল না কিন্তু নিট ফল শূন্য
ঘড়ির কাঁটা বলছে দুপুর তিনটে শোকে মুহ্যমান অবস্থায় যখন ওরা সবাই লাঞ্চ করে উঠেছে, তখন সেজেগুজে ফিটফাট হয়ে বেরিয়ে গেল টুপুর বেরোনোর আগে ওদের ঘরে একবার ঢুঁ মারল
“হ্যালো! বাব্বাহ! তোমরা সবাই মিলে আজ আমার সঙ্গে ডান্স ফিনালে দেখবে বুঝি? চওড়া হাসি হেসে বলে টুপুর
সবাই মুখ গোমড়া করে বসে আছে এইভাবে হেরে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না ওরা কিন্তু উপায়ই বা কী? ঐশী বলে ওঠে, “কেন এরকম করছ টুপুর দিদি? তুমি তো চাইলে ফোনেও দেখে নিতে পারবে তোমার অনুষ্ঠান টুপুর বলে, “রাইট রাইট, ভালো মনে করিয়েছিস তো ফোন, ইয়েস পকেট থেকে ওর ফোনটা বের করে বলে, “দাঁড়া, ইনস্টাগ্রামে একটা ছোট্ট রিল বানাই বলেই রিলটা ওপেন করে খুব ন্যাকা ন্যাকা গলায় বলতে শুরু করে, “হ্যালো ফ্রেন্ডস! ইয়ে হাম হ্যায়, ইয়ে মেরা ভাই হ্যায়, অউর ইঁয়াহা ইন সবকা ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল বরবাদ হো গয়ি হ্যায়!
রাগে গা রি-রি করলেই মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে কপিল টুপুর বেরোতেই ওর ঘরে হানা দেয় কপিলের দলবল কম্পিউটার টেবিল, কসমেটিক্স বক্স, বালিশ তোষক কিচ্ছু বাদ দিল না কিন্তু সবই বৃথা পণ্ডশ্রম
হঠাৎ কী মনে হতে দাঁড়িয়ে পড়ল কপিল “আমাদের কোথাও একটা ভুল হচ্ছে জানিস তো? এই বাড়িতে লুকোনো যায় এমন সব জায়গা আমরা খুঁজে নিয়েছি কিচ্ছু পাওয়া যায়নি তার মানে জিনিসটা না-লুকিয়ে রাখা আছে
“তার মানে? না-লুকিয়ে রাখা আছে? আবার কেমন কথা? ভুরু কুঁচকে গিয়েছে বাকিদের
“দ্যাখ, আমরা এই ভেবে খুঁজছি যে জিনিসটা কোথায় লুকোনো হতে পারে হয়তো সেইজন্যই খুঁজে পাচ্ছি না কারণ হয়তো জিনিসটা এমন কোথাও রাখা আছে যেখানে সেটাকে লুকোনো সম্ভবই না
“তুই যে কী বলছিস কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না
কপিল উত্তর না দিয়ে ধীর পায়ে গোটা বাড়িতে একবার চক্কর কাটে ওর পিছু পিছু ঘোরে বাকিরাওসবশেষে ড্রইংরুমের টিভি স্ট্যান্ডটার সামনে এসে দাঁড়ায় কপিল
“তোদের রিমোটের রংটা কী ছিল রে?
“কালো কিন্তু তাতে হবেটা কী?
টিভি স্ট্যান্ডটার পিছনে কয়েকদিন আগেই একটা ধূসর রঙের গেম থিমড ওয়াল পেপার লাগানো হয়েছেদেয়ালটার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় কপিল ওয়ালপেপারে বিচিত্র সব আঁকিবুকি কোথাও জয়স্টিকের ছবি আঁকা, তো কোথাও মাউস, কোথাও মাদারবোর্ডের নকশা, তো কোথাও গ্রাফিক্স কার্ডের ডিজিটাল ফটোমজার ব্যাপার হল এই সব ক’টি নকশাই কালো রঙের
একদৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হাত বাড়িয়ে একটা চেয়ার টেনে নেয় কপিল উঠে পড়ে তার উপরে দেয়ালের যেখানে হাত রাখে সেখানে একটা কোনাকুনিভাবে আঁকা রিমোটের নকশা ধীরে ধীরে সেলোটেপটা তুলে ফেলে দ্বিমাত্রিক নকশার উপর থেকে হাতের মধ্যে খসে পড়ে একটা ত্রিমাত্রিক রিমোট
হতবাক চোখে একে অপরের দিকে মুখ হাঁ করে তাকিয়ে আছে হোমিরা কপিলের মুখে বিশ্বজয়ের হাসিঠিক সেই সময় দরজা খুলে ঘরে ঢোকে টুপুর সামনে তাকানো মাত্র হাতের ব্যাগটা খসে পড়ে যায় মাটিতে

হোমি আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, “ইয়ে হাম হ্যায়, ইয়ে হামারা দোস্ত হ্যায়, অওর ইঁয়াহা পে ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল হো রহা হ্যায়।”
----------
ছবি - শুভশ্রী দাস

No comments:

Post a Comment