গল্প:: ভুতভুতে - অঙ্কন মুখোপাধ্যায়


ভুতভুতে
অঙ্কন মুখোপাধ্যায়

ভুতভুতে গ্ৰামের কথা প্রথম শুনি বাসের এক সহযাত্রীর মুখে। আমি আর আমার বন্ধু বাসে করে চলেছি ঝাড়গ্ৰামে একটা নিউজ সংগ্ৰহের কাজে। বাসেই পরিচয় হয় লোকটার সঙ্গেসবার অনুরোধে উনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে শেষে তার কাঁধের ঝোলা থেকে একমুঠো মুড়ি মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বলতে লাগলেন গল্পটা ---

ভুতভুতে গ্ৰামের সঙ্গে আমার পরিচয় অনেকদিনের। দুটো-একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে লাইব্রেরিয়ানের চাকরিটাই প্রথম হয়ে গেল ওই ভুতভুতে গ্ৰামে। গ্ৰামের নামটা শুনে একটু অদ্ভুত লাগলেও প্রথম চাকরির টানে চলে গেলাম ভুতভুতে।
যাওয়ার আগেই খোঁজ করে জানা গেল, ভুতভুতে একটা গণ্ডগ্ৰাম। সেই গ্ৰামের কোনো এক সুহৃদয়বানের দানের জমি আর কিছু টাকাপয়সায় তাঁর ইচ্ছায় একটি ছোটোখাটো পাঠাগার তৈরি হয়েছিল এককালে। ভাগ্যক্রমে সেখানেই আমার চাকরি। তবে আর-একটা গোপন খবর পেয়ে গেলাম ভুতভুতে রওনা দেওয়ার পর। বাসের এক সহযাত্রীর কাছে জানতে পারলাম অদ্ভুত কথাখানা। ভুতভুতের মাত্র কুড়ি-ত্রিশ ঘর মানুষ, আর বাকি সবটাই নাকি তেনাদের অধীনে। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তেনাদের! মানে?’
! আপনি বোধহয় প্রথম ভুতভুতে যাচ্ছেন? চাকরি করতে নিশ্চয়ই?’
হ্যাঁ, আপনি কী করে জানলেন মশাই?আমি জিজ্ঞাসিলুম।
ওখানে যারা যায়, শুধু ওই চাকরি করতেই যায়। বললাম না, ভুতভুতে হল তেনাদের গ্ৰাম, ওখানে মানুষ সংখ্যালঘু। ওখানে মানুষ থাকে ক-ঘর? তেনাদেরই রমরমা। তবে মানুষ যারা আছে, তারা ওই ইস্কুলের, হসপিটালের স্টাফেরা; সরকারি কোয়ার্টারে থাকে। আর বুড়ো বয়সে রিটায়ারের পর যাদের কোনো যাওয়ার জায়গা নেই, তারা থাকে বাড়ি করে। আর কয়েকজন মাত্র পুরোনো গ্ৰামবাসী। যাচ্ছেন তো, সব বুঝতে পারবেন পরে পরে।’
না, এসব কথার অর্থ আমি কিছুই বুঝলাম না। সহযাত্রী লোকটা নেমে গেল কয়েকটা স্টপেজ পর। তারও কয়েক স্টপেজ পরে নামতে হল আমায় বাসের কন্ডাক্টরের ডাকে। বাসটা চলে যেতেই বুঝলাম, রাস্তার দু-ধারটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল ঝপ্ করে। মাটিতে প্রায় মিশে যাওয়া একটা পাথরের ফলক কোনোরকমে মুখ তুলে জানান দিচ্ছে ভুতভুতে নামটার অস্তিত্ব। চারিধার দেখতে দেখতে যখন ভাবছি, ‘যাব কোথায়’; ঠিক তখনই কোথা থেকে এক অদ্ভুত দেখতে মানুষ আমার সামনে উদয় হল ভোজবাজির মতো। আমি কোনো কথা বলার আগেই, আমার ব্যাগ তুলে নিয়ে বলল, ‘ভুতভুতে যাবেন তো? আসুন আমার পিছু পিছু।
আমি কিছু বলার আগেই ও চলতে লাগল। অগত্যা আমাকেও ওর পিছু নিতে হল। কোথায় চলেছি, জানি না! লোকটাকে জিজ্ঞেস করেও কোনো ফল হয়নি।
ভায়া, এটা কি ভুতভুতে গ্ৰাম? আপনি বুঝি খবর পেয়ে আমায় নিতে এসেছেন?’
উঁহুঁ, সামনে থেকে কোনো উত্তর আসে না। লোকটা আমার থেকে ঠিক দু-হাত দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। একটা সময় পর লোকালয়ে এসে পৌঁছোলাম। তবে সেখানেও কেউ কোনো কথা বলে না। শুধু আমায় দেখে আর হুশ হুশ করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়।
শেষে একটা বাড়ির সামনে এসে আমার পথপ্রদর্শক মালপত্র নামিয়ে দিল। একটা অফিস কোয়ার্টার, সঙ্গে লাগোয়া গ্ৰাম্য পাঠাগার। সাইনবোর্ডটা ধুলো পড়ে পড়ে কালো হয়ে গেছে। এই ভগ্নকুটির যে আমার থাকবার ঠিকানা, তা বুঝতে পারলাম। তবে অদ্ভুত লাগলযে-লোকটা আমায় এতটা পথ নিয়ে এল, তাকে আর দেখতে পেলাম না।
তাকে দেখা গেল আবার দুপুরে আমার স্নানের আগে। জিনিসপত্র গুছোতে গুছোতে যখন ভাবছি, ‘এবার স্নানের ব্যবস্থা করা যাক’—তখন লোকটা এসে বলে গেল বাথরুমে জল তোলা আছে, ঠান্ডা-গরম সবের ব্যবস্থা আছে। আবার স্নান সেরে এসে দেখি, আমার জন্য মেঝেতে আসন পেতে ভাত বেড়ে রাখা হয়েছে। কাঁসার থালায় ভাত, আলুভাজা, বেগুনভাজা, পটলভাজা। পাশে একটা বাটিতে কলাইয়ের ডাল। আর একটা বাটিতে আলুপোস্ত। একটা ডিশে মাছভাজাও রয়েছে দেখলাম। দিব্যি খেয়ে নিলাম পেটপুরে। খাওয়া হলে পর, লোকটা চলে গেল এঁটো বাসন নিয়ে। সত্যি বলতে, লোকটা ঠিক আমার দরকারের সময়ে এসে উপস্থিত হত, আবার কাজ মিটিয়ে কোথায় উধাও হয়ে যেত!
লাইব্রেরির কাজ বুঝে নিতে গিয়ে দেখলাম, এখানকার সদস্যসংখ্যা খুবই কম হাতে গোনা বারোজন বইপ্রেমীর কার্ড রয়েছে। লাইব্রেরিটা দুটো ছোটো ঘরে বিভক্ত। সামনেরটায় আমি বসি। পাশেরটা রিডিং রুমের মতো। তবে রিডিং দেবার লোক নেই। সেখানেও অদ্ভুত কাণ্ড! প্রথম দিন এ-আলমারি,-আলমারি থেকে ক্যাটালগ খুঁজতে গিয়ে যখন হয়রান, তখন একজন লোক পাশের ঘর থেকে এসে ক্যাটালগ আমার সামনের টেবিলে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল পাশের ঘরের ভেতর। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই লোকটা উধাও। পাশের ঘরে গিয়েও কাউকে পেলাম না। তখনই পরিচয় হল বিনোদবিহারী ঘোষের সঙ্গে। এইসব অদ্ভুত বিষয় নিয়ে যখন ভাবছি, তখন ঘরে এসে ঢুকলেন তিনি, ‘নতুন লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে আলাপ করতে এলাম, মশাই।
তাই? না হয় আলাপ করবেন, কিন্তু আবার হুশ করে উধাও হয়ে যাবেন না তো শ্রীযুক্ত...?’
বিনোদবিহারী ঘোষ। উধাও হয়ে যাওয়ার কথা কী বলছেন?’
লোকটাকে ভুতভুতে আসার পর থেকে সব ঘটনা খুলে বলতে উনি বললেন, ‘ভয় নেই, কোনো ক্ষতি করে না ওরা। শুধু দরকারে এসে উপস্থিত হয়। যেচে পড়ে উপকার করে। এই ভুতভুতে গ্ৰামের এটাই বিশেষত্ব।
আমি বললাম, ‘কাদের কথা বলছেন বলুন তো?’
কিছুদিন থাকো ঠিক বুঝতে পারবে।
ভুতভুতে গ্ৰামের বিশেষত্ব দিনদিন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। ওদের সঙ্গে থাকতে অসুবিধার বদলে সুবিধাই বেশি হল। সকালে ঘুম ভাঙলে চা নিয়ে হাজির হত, তেমনি তাদের তুলে দেওয়া জলে স্নান করে এসে দেখতাম, আসনের সামনে বাড়া ভাত আমার জন্য অপেক্ষারত। এই সকল কায়াহীনের সঙ্গে থাকতে থাকতে বাইরের পৃথিবীর কথা যখন ভুলতে বসেছি, তখন একদিন আমাকে নিমন্ত্রণ করলেন বিনোদবিহারীবাবু। লাইব্রেরিতে বেশিরভাগ সময়ে কেউ আসত না। যে দু-একজন আসতেন, তাঁরা আবার বইপ্রেমী ছিলেন না। আমার সঙ্গে চারটি গল্পগুজব করে চলে যেতেন। আমারও সময় কাটত। এমনই একদিনে কেউ আর আসবে না জেনে লাইব্রেরিতে তালা দিয়ে চলে গেলাম বিনোবিহারীবাবুর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। আমার লাইব্রেরি থেকে একটা ছোটো বাঁশবাগান পেরিয়ে একটা ডোবার পাশে তাঁর বসত বাড়ি। খুবই সাধারণ গৃহ। নীচ দিয়ে ঢুকেই বাঁদিকে একটা গোয়াল। সেখানে একটা গাইগোরু বসে বসে জাবর কাটছে যেন অনন্তকাল ধরে। তারপরেই আমাকে মহা-সমারোহে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন বিনোদবাবু। এখানেও সেই অদ্ভুত কাণ্ডবিনোদবাবু শুধু একবার করে হাঁক পাড়েন, আর কোথা থেকে লোকজন এসে তাঁর কথামতো কাজ করে দেয়। আমাকে বসতে দিয়ে বিনোদবাবু হাঁকলেন, ‘ওহে, কে কোথায় আছিস? আমাদের ভুতভুতের নতুন লাইব্রেরিবাবুর জন্য খাবারের ব্যবস্থা কর।
অমনি গলা অবধি ঘোমটা ঢাকা বউমানুষ এসে হাজির হল ভাতের থালা হাতে। আমার এইসব ব্যাপার-স্যাপার এই ক-দিনে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল।
আসুন, খাবেন আসুন।
রাজকীয় খাবার খেয়ে পান চিবোতে চিবোতে যখন আমার লাইব্রেরির দিকে ফিরে আসছি, তখন বাঁশবাগানের মধ্যে কোথা থেকে একজন উদয় হল আমার সামনে। ধুতি-ফতুয়া পরা, নাকে চশমা আঁটা এক বৃদ্ধ লোক। মাথার টাকটায় হাত বোলাতে বোলাতে এক গাল হেসে বলল, ‘বিনোদের বাড়ি গিয়েছিলেন বুঝি?’
হ্যাঁ।’
আমি নগেন সামন্ত। ক-দিন গাঁয়ে ছিলুম না। তাই আপনার সঙ্গে আলাপ হয়নি।
নমস্কার।
নমস্কার নমস্কার! তা ভয় পাবেন না যেন, আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। ওরা উপকারী
কাদের কথা বলছেন বলুন তো?’
বুঝতে পারবেন, আর কিছুদিন থাকুন। ওই বিনোদ বুঝি এই ফাঁকে আপনাকে ওর বাড়িতে খেতে ডেকেছিল? তা আমার বাড়িতে কিন্তু একদিন আপনার পায়ের ধুলো দিয়ে আসতে হবে। এই বাঁশবাগানের পর যে বড়ো নিমগাছটা আছে, তারপরেই আমার বাড়ি।
আচ্ছা, সে হবে খন।
আগামীকাল শনিবার, খুব ভালো দিন, আসুন না।
ঠিক আছে এই বলে ফিরে এলাম কোনোরকমে।
পরদিন নগেন সামন্ত একেবারে ধরে-বেঁধে আমায় নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়িতে। সেখানেও সেই এক ব্যাপার। ওঁর বাড়ি থেকে মধ্যাহ্নভোজন করে ফেরার পথে আবার এক বিপত্তি। কোথা থেকে পঞ্চানন কর্মকার নামে একজন এসে আমায় নিয়ে যেতে চাইলেন তাঁর বাড়ি। যথারীতি তাঁর নিমন্ত্রণও রক্ষা হল। কিন্তু সেখান থেকে ফেরার সময়ে আবার একজন ধরল। বললে বিশ্বাস করবেন নারোজ এই ঘটনা চলতে লাগল আমার সঙ্গেআজ বিষ্টু মজুমদার আসে, তো কাল হরি নন্দী। একের পর এক নতুন নতুন লোক এসে নিমন্ত্রণ করে যায়। আর পরদিন আমাকে ধরে নিয়ে যায় তাদের বাড়ি। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ করলাম, একবার যার বাড়িতে খাওয়া হয়ে যেত, তার আর কোনো খোঁজখবর মিলত না তারপর থেকে। না বিনোদ বিহারী ঘোষ, না নগেন সামন্ত, না অন্য কেউ। কারও কোনো খোঁজ আর পাওয়া যেত না। কোথা থেকে নতুন নতুন লোক আসত, আমাকে নিমন্ত্রণ করে খাইয়ে, কোথায় আবার হারিয়ে যেত! নতুনদের পুরোনো লোকগুলোর কথা জিজ্ঞেস করলে শুধু হেসে হেসে বলত, ‘ওতে ভয় পাবেন না যেন। ভুতভুতেবাসী বড়ো উপকারী, কারও কোনো ক্ষতি করে না। হে হে হে...’
এই করে এক বছর কেটে গেল। ছুটিতে ফিরে গেলাম বাড়ি। সবাই বলতে লাগল, ‘এ কী চেহারা করেছিস? একেবারে শুকিয়ে গেছিস তো! ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করিস না ওখানে?’”

আমরা সবাই শুনছি অবাক হয়ে। আমার বন্ধুটি বলল, “তা আপনার ওই মুচমুচে না ভুতভুতে,  সেটা কি এই জগতের মধ্যে অবস্থিত?” বাসের অনেকে হো হো করে হেসে উঠলেন। বাস ছুটে চলেছে। একটু পর বাস থামল একটা জঙ্গলঘেরা জায়গায়। গল্প-বলা লোকটা জিনিসপত্র নিয়ে নেমে গেল। যাওয়ার আগে শুধু বলল, “সবাই বিশ্বাস করে না আমার কথা। সেটা তাদের ব্যাপার। তবে ভুতভুতেবাসী খুব উপকারী। একবার ভুতভুতেতে গেলে আর ফেরাই যায় না।এই বলে লোকটা বাস থেকে নেমে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বাসটা স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে চলল আবার। জানলার ধারে বসে আমার চোখে পড়ল মাটিতে পোঁতা একটা পশ্চাৎগামী পাথরের ফলকের ওপর। আবছা অন্ধকারে তাতে খোদাই করা নামটা দেখে চমকে উঠলাম। ঝটিকা আলোকে ভুতভুতে নামটা একবারের জন্য উদ্ভাসিত হয়ে আবার চিরতরে হারিয়ে গেল অন্ধকারের রাজ্যের মধ্যে।
----------
ছবি - নচিকেতা মাহাত

No comments:

Post a Comment