নাটক:: জন্মদিনের উপহার - সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি


জন্মদিনের উপহার
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি

চরিত্রলিপিঃ রৌনক, দীপু, জিকো, আরও দুটি ছেলে [সবার বয়স ১২-১৩ বছর], রৌনকের মা বাবা [যথাক্রমে ৩৫ ৪০ বছর], রোবিরোবটের কস্টিউম পরা

প্রথম দৃশ্য

মা: রৌনক, এই দেখ জন্মদিনে তোর ছোটোমামা কী গিফট পাঠিয়েছে!
রৌনক: কই দেখি, দেখি! মা, এত বড়ো বাক্স!
মা: হ্যাঁ, বাবলুটা যে কী সব করে! কে জানে কী আছে ভিতরে
রৌনক: খুলে দাও না মা! দেখি
মা: হ্যাঁ দিচ্ছি, নে তুইও হাত লাগা
[মোড়ক খুলতে একটা ছোটো রোবট বেরিয়ে আসে সঙ্গে কিছু কাগজপত্র আর দু-একটা ছোটো প্যাকেট]
মা: কী রে, এটা আবার কী?
রৌনক: মা, মনে হচ্ছে একটা রোবট দেখো, কাগজে কীসব লেখা আছে
মা: তাই তো দেখি কী লিখেছে [কাগজ হাতে নিয়ে রৌনকের মা পড়তে থাকেন] প্যাকেটে রাখা ব্যাটারি দুটো নির্দিষ্ট জায়গায় সেট করে সুইচ অন করতে হবে আগে
রৌনক: তারপর?
মা: তারপর তোমার রোবট বন্ধু রেডি তোমার পড়াশোনায় সাহায্য করবে, তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেবে, তোমার সঙ্গে খেলবে! যখন যেটা দরকার, সেই মোডে চালু করতে হবে শুধু
রৌনক: বাহ বাহ, তো দারুণ ব্যাপার! এক্ষুনি ওকে চালু করে দাও
মা: হ্যাঁ, আরেকটা জিনিস লিখেছে রোবটের একটা নাম দিতে হবে শুরুতে, ওই নামটা পাসওয়ার্ড দিয়ে টাইপ করে নিতে হবে ওকে চালু করার আগে
রৌনক: কী নাম দেব, মা?
মা: সে তোর ইচ্ছে, তুই- বল
রৌনক: রোবি বলে ডাকি?
মা: রবি? রবীন্দ্রনাথ নাকি?
রৌনক: না, না, রোবট থেকে রোবি বানালাম ভালো না?
মা: হ্যাঁ, বেশ তো নে, তোর রোবিকে এবার চালু করে দিচ্ছি

দ্বিতীয় দৃশ্য

মা: কী রে, এই ভরসন্ধেবেলা মোবাইল নিয়ে বসে আছিস কেন?
রৌনক: উফ মা, তুমি বুঝতে পারছ না, আমি হোমটাস্কের জন্য অনলাইন স্টাডি করছি তো!
মা: তাই বুঝি? দাঁড়া, রোবিকে পাঠাচ্ছি এখুনি - এসে দেখুক কত কী পড়ছিস তুই
[মা বেরিয়ে যায় রোবির প্রবেশ চাকা লাগানো পায়ে গড়িয়ে গড়িয়ে আসে]
রোবি: রৌনক, তুমি এখন মোবাইলে গেম খেলছ কেন?
রৌনক: রোবি, তুমি এখন এখানে এলে কেন?
রোবি: কারণ তুমি তোমার মা-কে মিথ্যে কথা বলেছ ভালো ছেলেরা মিথ্যে বলে না রৌনক
রৌনক: আচ্ছা, আচ্ছা তাহলে তুমি আমাকে হোমটাস্কে হেল্প করে দেবে তো?
রোবি: নিশ্চয়ই দেব তবে, তার আগে তোমাকে পড়া ধরব
রৌনক: মানে?
রোবি: মানে, এখন আমি তোমার মাস্টারমশাই বন্ধু না তোমার মা আমাকে টিউটর মোডে অন করে দিয়েছেন
রৌনক: কেলেঙ্কারি! আচ্ছা বলো রোবি স্যার, কী জিজ্ঞেস করবে?
রোবি: বলো এখন বাংলা কবিতা পড়া ধরব রবি ঠাকুরের প্রশ্ন কবিতাটা মুখস্থ বলো
রৌনক: আচ্ছা রোবি স্যার, আমি আগে একটু জল খাব?
রোবি: ‘বীপ, বীপ’! প্রশ্ন নয়, উত্তর দাও
রৌনক: এই যাহ, একটু আগেই তোপ্রশ্নবলতে বললে
রোবি: ‘বীপ, বীপ!’ আবার ভুল উত্তর জলদি কবিতাটা বলো
রৌনক: বাবা রে! তো পুরো কড়া মাস্টারমশাই দেখছি
রোবি: ‘বীপ, বীপ!’ আমি এখুনি তোমার মা-কে ডেকে আনছি তিনবার ভুল উত্তর দিয়েছ তোমার রাতের খাবার বন্ধ করার শাস্তি হবে
রৌনক: [কাঁদো কাঁদো মুখে] বলছি, বলছি মা গো আমায় ছুটি দিতে বল, সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা…’
রোবি: গুড বলে যাও

তৃতীয় দৃশ্য

দীপু: কী রে, তোর রোবট স্যার নাকি তোকে খুব পড়াচ্ছে বাড়িতে?
রৌনক: আর বলিস না দীপু, জীবন অতিষ্ঠ করে দিল এই রোবি কেন যে ছোটোমামা
জিকো: তা আমাদেরও একটু দেখা না, শুনেছি নাকি সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারে?
দীপু: হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিয়ে আয়, একবার পরখ করে দেখি
রৌনক: বলছিস? আচ্ছা নিয়ে আসছি ওকে প্রশ্নের উত্তরদাতা মোডে অন করে দিচ্ছি আগে
দীপু: সেটাতে কী হয়?
রৌনক: কিছুই না শুধু সব কথার শেষে একটা করে প্রশ্ন রাখতে হয় যার উত্তর দেবে
জিকো: সব প্রশ্নের উত্তর দেবে?
রৌনক: তাই তো লিখেছে ম্যানুয়ালে
জিকো: আচ্ছা! একবার পরীক্ষা করেই দেখা যাক
দীপু: হ্যাঁ, হ্যাঁ, জিকো, ঠিক বলেছিস দেখা যাক
[উইংসের পাশে রাখা রোবিকে চাকা গড়িয়ে নিয়ে আসে রৌনক]
দীপু: হাই রোবি আমি দীপু তুমি কি নাইরোবি থেকে এসেছ?
রোবি: আমি রোবি, কিন্তু নাইরোবি কেনিয়াতে আমাকেকে নিয়াএসেছে আমি জানি না আমাকে এখানেই অন করা হয়েছে
দীপু: বাহ বাহ, বেশ বুদ্ধি তো তোমার! আচ্ছা তুমি কি সব প্রশ্নের উত্তর জানো?
রোবি: আমার মেমরিতে যেসব প্রশ্নের উত্তর লোড করা আছে, তার জবাব দিতে পারব তুমি প্রশ্ন করো, আমি উত্তর দেব
দীপু: বটে? দেখি তোমার মেমরির জোর কত বলো দেখি একটা ভূতের ওজন কত হয়?
রোবি: বিজ-বিজ-বিজজ
জিকো: আরে কী হিজিবিজবিজ বকছ? উত্তর দাও?
রোবি: এরর! এরর! সরি, অন্য প্রশ্ন প্লিজ!
জিকো: মা, পারে না, পারে না!
দীপু: ছি ছি, তো প্রথমেই ফেল আচ্ছা দেখি, পরেরটা কেমন জবাব দাও এবার অঙ্কের প্রশ্ন ধরি বলো দেখি, ‘পাই’-সংখ্যার একদম শেষ অঙ্কটা কত?
রোবি: পাই ইজিকুয়ালটু থ্রি পয়েন্ট ওয়ান ফোর ওয়ান ফাইভ নাইন টুবিজ বিজ বিজ্জজ
দীপু: ওই যে আবার শুরু হল, দেখ রে রৌনক!
রৌনক: তাই তো দেখছি রে তাজ্জব ব্যাপার এই প্রথম রোবিকে এমন হোঁচট খেতে দেখছি
দীপু: কী বাপু? এটাও পারলে না?
রোবি: এরর এরর সরি, অন্য প্রশ্ন প্লিজ!
রৌনক: আরিব্বাস! শোন দীপু আর জিকো, কিন্তু তিনটের বেশি ভুল সহ্য করতে পারে না সে প্রশ্নই হোক বা উত্তর তারপরেই একটু যেন বিগড়ে যায় দেখেছি
জিকো: বাহ, দুটো ভুল তো হয়েই গেল, আর একটা যদি করানো যায়
দীপু: তাহলেই কেল্লা ফতে গুড আইডিয়া দাঁড়া এবার একটা সোজা কিন্তু জম্পেশ প্রশ্ন করব ব্যাটাকে [রোবটের দিকে ফিরে] বলো তো দেখি রোবি, ডিম আগে না মুরগি আগে?
রোবি: ডিম-মুরগি-ডিম-মুরগিবিজ-বিজ-বিজ্জজ্জ
দীপু: হা হা হা!
রোবি: এরর এরর এরর এরর
জিকো: আরে, তো দেখছি ফাটা রেকর্ড বাজাতে শুরু করল!
রৌনক: ম্যালফাংশন হয়েছে মনে হয় শিগগির একটা সহজ প্রশ্ন করে দেখ
জিকো: ওকে, করছি বলো তো রোবি, দুই আর দুই-য়ে যোগ করলে কত হয়?
রোবি: তো খুব সোজা দুই যোগ দুই ইজিকুয়ালটু বাইশ
দীপু: হা হা হা! ভুলভাল বকছে রে! ব্যাটার মাথা গেছে
রৌনক: তাই তো মনে হচ্ছে রে দাঁড়া, আমি আরেকটু পরখ করি আচ্ছা রোবি, বল তো, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নাম কী?
রোবি: ডোনাল্ড ডাক! কোয়াক কোয়াক!
রৌনক: সাড়ে সব্বোনাশ, এই দীপু, এবার তো মনে হচ্ছে সত্যিই ব্যাটা বিগড়ে গেছে!
জিকো: কিন্তু রোবটটা খারাপ হয়ে গেলে তোর মা-বাবা বকবে না? এটাকে কোনোভাবে আর ঠিক করা যাবে না?
রৌনক: হ্যাঁ, সেটা একটু চাপের ব্যাপার বটে, তবে বোতাম টিপে রিসেট করে দিলে হয়তো গোলমালটা ঠিক হতে পারে
দীপু: আরেকটা ব্যাপার, ওর ওই মাস্টারির মোডটা একেবারে বন্ধ করে দেওয়া যায় না? বাকি দুটো অপশন থাক বরং
রৌনক: চেষ্টা করে দেখতেই পারি হলে তো বাঁচোয়া
জিকো: তবে তাই কর! [সবাই একসঙ্গে রোবির উপর ঝুঁকে পড়ে খুটখাট করতে থাকে মঞ্চের আলো নেভে]

চতুর্থ দৃশ্য

মা: [নেপথ্যে] রৌনক, হোমটাস্কগুলো হয়েছে?
রৌনক: [গেম খেলতে খেলতে গলা তুলে] এই তো করছি, মা! [চাপা গলায়] অ্যাই রোবি, ঝটপট সলভ কর বলছি অঙ্কগুলো!
রোবি: এই তো করছি তুমি নিশ্চিন্তে গেম খেলো! খুট খাট খুট খাট!
রৌনক: (গেমে ডুবে) হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর ডিস্টার্ব করিস না! ফুটবল ম্যাচটা এবার জিততেই হবেআরে জিও! গো---!
রোবি: সব অঙ্ক করা শেষ হয়ে গেছে এবার কী করব?
রৌনক: উফ, জ্বালাস না তো! একটা ইংরেজিএসেলিখতে দিয়েছিল মনে হয় বাবা দেখ ওটা যদি করে ফেলতে পারিস আমি তাহলে আরেক রাউন্ড খেলে নিই
রোবি: আচ্ছা ক্লিক-ক্লিক-ক্লিক- এই যে তোমার ইংরেজি রচনা লিখে দিলাম আর কিছু করব?
রৌনক: গুড, গুড রোবি, আমার সায়েন্স প্রোজেক্ট জমা দেওয়ার ডেটটা কবে ছিল রে?
রোবি: মেমরি চেক করছিবিপ-বিপ- আগামীকাল ওটা জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট
রৌনক: সব্বোনাশ! সেটা আগে মনে করাবি না হতভাগা? শিগগির ওটা শেষ কর!
রোবি: [কাগজপত্র আর টুকিটাকি জিনিস নিয়ে তাড়াহুড়ো করে] বিজ্ঞানের প্রোজেক্ট বানিয়ে দিলাম এখন?
রৌনক: বেশ করেছিস এখন চুপচাপ বোস তো [কিছুটা বিরক্ত]
[বাবা ঘরে ঢোকে]
বাবা: কী রে, এসেটা লিখেছিস?
রৌনক: [গেম খেলা ছেড়ে খাতা এগিয়ে দেয়] এই তো দেখো
বাবা: বাহ, বাহ! দারুণ হয়েছে ভেরি গুড বেটা!
[রৌনক চুপচাপ অল্প হাসে তার যেন খুব একটা আনন্দ হচ্ছে না, এমনভাবে বাবা খাতাটা নিয়ে বেরিয়ে যায়]
রৌনক: [আপনমনে] দূর, সবই ঠিকঠাক হচ্ছে স্কুলের ইন্টারনাল এক্সামেও ফুল মার্কস পেলাম সেদিন, তাও যেন মনটা কেমন কেমন করছে দীপু আর জিকো কতদিন খেলতে আসে না, দেখি ওদের একটা ফোন করি
[মোবাইল হাতে নিয়ে ডায়াল করে] হেলো, দীপু? কেমন আছিস রে? একদিন আয় না বাড়িতে!
দীপু: [নেপথ্যে] রৌনক, এখন ফোন করিস না তো সায়েন্স প্রোজেক্ট করছি তোর মতো তো আর রোবট নেই যে দু-মিনিটে সব করা হয়ে যাবে আবার স্কুলে ফুল মার্কসও পাব! [খুট]
রৌনক: আরে শোন তো, হেলো, হেলো! যাব্বাবা! কেটে দিল? দেখি জিকোকে করি [ফের ডায়াল করে ফোন] হেলো, জিকো? আমি রৌনক বলছি রে! কেমন আছিস?
জিকো: হেলো, হ্যাঁ বল কী ব্যাপার, হঠাৎ ফোন করলি যে?
রৌনক: একদিন বাড়িতে আয় না কতদিন আড্ডা হয় না, খেলা হয় না
জিকো: কী করে হবে? তুই তো তোর রোবিকে নিয়েই মশগুল থাকিস ওর সঙ্গেই পড়া, ওর সঙ্গেই খেলা আমাদের আর পাত্তা দিস নাকি?
রৌনক: না রে, তেমন ব্যাপার নয় তুই আয় না একদিন আগামীকাল?
জিকো: না রে, আমার হবে না কাল আমি আর দীপু আইপিএল ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে যাব রাখছি রে এখন [খুট]
রৌনক: ধুত! এই রোবিটাই হয়েছে যত নষ্টের গোড়া! ওর জন্যই আমার সব বন্ধুগুলো... আচ্ছা, একটা কাজ করলে হয় না? আইডিয়া!

পঞ্চম দৃশ্য

[রৌনকের বাড়িতে সব বন্ধুরা একজোট দীপু আর জিকো ছাড়াও আরও দুজন আছে সামনে রোবিও আছে সবাই বই খাতা নিয়ে পড়ছে]
রোবি: সবাই এসে গেছ বেশ, এবার আজকের পড়া শুরু হবে আজকে তোমরা নিউটনের গতিসূত্র শিখবে প্রথম সূত্র...
দীপু: [রৌনককে ফিসফিস করে] এটা খুব ভালো করেছিস রে তোর রোবি স্যারের কাছে আমরা সবাই পড়লে মজাও হবে, আর স্কুলেও ভালো রেজাল্ট হবে সবার
রৌনক: হ্যাঁ রে, ওই টিউশনি মোডটাই শুধু অন করে দিয়েছি বাকিগুলো অফ করে নইলে নিজেরই কিচ্ছু পড়া হচ্ছিল না
রোবি: দীপু আর রৌনক, পড়ার সময় গল্প করছ কেন? সূত্র তিনটে পড়া দাও এখুনি
দীপু আর রৌনক [একসঙ্গে]: হবে না স্যার, সরি
রোবি: স্ট্যান্ড আপ! বোথ অফ ইউ! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়াটা রেডি করে আমাকে বলবে [বাকিদের দিকে ফিরে] হ্যাঁ, যা বলছিলাম, তৃতীয় সূত্রে আমরা যে ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়ার কথা জানতে পারি, সেই বলদুটো কিন্তু একসঙ্গেই কাজ করে!
রৌনক: [দাঁড়িয়েও মুচকি হাসে] এটাই ভালো, বল? একটু বকুনি না খেলে আমাদের পড়া হয় না
দীপু: যা বলেছিস! রোবট স্যার জিন্দাবাদ!
রোবি: ফের কথা বলছ তোমরা?
দীপু আর রৌনক [একসঙ্গে]: সরি রোবি, উপস, রোবি স্যার!
[বাকিরা সবাই হেসে ওঠে]
সমাপ্ত
ছবি - লেখক

No comments:

Post a Comment