
মরুব্যূহ
সুমন মিশ্র
এক
মাস দুই আগে কাজের সূত্রে পার্থে
আসলেও শহরটাকে অভিমন্যুর সেইভাবে দেখে ওঠাই হয়নি।
তাই একটা লম্বা উইকএন্ড পাওয়ায় সে ঠিক করেছিল, সেই কাজটাই ধীরেসুস্থে
সারবে। কিন্তু সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে দিল
জেমস্। সে রীতিমতো জোরাজুরি শুরু করল, অভিমন্যু যেন তার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে যায়—আদিবাসী জীবনের ওপর বিশদ তথ্য সংগ্রহের জন্যে।
জেমস্ অভিমন্যুর সঙ্গে একই অফিসে
কাজ করলেও তার একটা আলাদা পরিচয় আছে। সে বহু
বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী সম্প্রদায় এবং তাদের সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করে চলেছে। প্রত্যেক
সপ্তাহান্তেই সে বেরিয়ে পড়ে তার ক্যামেরা আর গাড়ি নিয়ে।
অস্ট্রেলিয়া তো বটেই, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের বিভিন্ন পত্রিকাতেও তার তোলা ছবি ও প্রবন্ধ প্রকাশিত
হয়েছে। এই তো কিছুদিন আগে মেলবোর্নের ‘ভল্ট’ ম্যাগাজিন জেমস্কে সেরা প্রতিশ্রুতিমান তরুণ প্রবন্ধকার
হিসাবে সম্মানিত করেছিল।
অভিমন্যুর একদমই ইচ্ছে ছিল না, জেমসের সঙ্গে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার জনবিরল মরুভূমি অঞ্চলে যাওয়ার। কিন্ত জেমস্
ওসবের তোয়াক্কা না করেই সমস্ত পারমিট, গাড়ি এবং রসদের
ব্যবস্থা করে ফেলল। তাদের গন্তব্য গিবসন মরুভূমির দক্ষিণে অবস্থিত ওয়ারবার্টন।
পার্থ থেকে ভোররাতে রওনা হয়ে,
মাঝে ল্যাভার্টনে আধঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে ওয়ারবার্টন পৌঁছোতে রাত ন-টা বেজে গেল। ততক্ষণে
শহরটা নিঝুম হয়ে গিয়েছে।
গ্রেট সেন্ট্রাল হাইওয়ে থেকে একটা
চওড়া পাকা রাস্তা ঢুকে গিয়েছিল ওয়ারবার্টনের মধ্যে।
সেই রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটা চৌমাথা পড়ল। চৌমাথার মোড়ে গাড়ি থামিয়ে জেমস্
যখন ম্যাপ দেখে বোঝার চেষ্টা করছে কোনদিকে যাবে, ঠিক তখনই
পাশের অন্ধকার রাস্তা থেকে প্রায় ভূতের মতোই একটা ছেলে হাত নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে এল।
তাকে দেখে জেমসের মুখে একটা চওড়া হাসি ফুটে উঠল। ছেলেটা
গাড়ির কাছে আসতেই, জেমস্ গাড়ি থেকে একলাফে নেমে তাকে জড়িয়ে
ধরল। তারপর উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “কেমন আছ, ব্রাদার? পাঁচ বছর পর আবার দেখা হল তাহলে।”
ছেলেটার পরিচয় পাওয়া গেল। নাম
‘টাউ’। বয়েস আন্দাজ
পঁচিশ হবে। ওয়ারবার্টনের সবথেকে বড়ো যে-দোকানটা রয়েছে, সেটা তার বাবার। দোকানের লাগোয়া
টাউয়ের বাড়ি। সেখানেই অভিমন্যুদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।
বোঝা গেল, টাউয়ের সঙ্গে জেমসের সখ্যতা অনেকদিনের। টাউ
অভিমন্যুদের গাড়িতে উঠে বসল এবং তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।
অভিমন্যুদের গাড়ি যখন টাউয়ের বাড়ির
সামনে পৌঁছোল, তখনও তাদের দোকানটা খোলা ছিল। একমাথা
ঝাঁকড়া সাদা চুল নিয়ে স্থূল চেহারার যে-মানুষটি দোকানে বসে আছেন,
তিনি টাউয়ের বাবা। টাউ জানাল, জেমস্রা আসবে বলেই এত রাত অবধি দোকান খোলা রাখা হয়েছে। অভিমন্যুরা
দোকানটা ঘুরে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস, যেমন শুকনো খাবার ও পানীয়
নিয়ে নিল পরের দিনের জন্যে।
এমন সময়ে একটা ‘ক্যাঁচ’ করে শব্দ ভেসে এল পেছন দিক থেকে। অভিমন্যু
দেখল, একটা লোক দোকানের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেছে। লোকটা
এখানকার নয়, তবে অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে দীর্ঘদিন
কাটিয়েছে সেটা বোঝা যায় তার চামড়ার ট্যান থেকে। ত্বক রোদে পুড়ে লালচে হয়ে গিয়েছে।
মাথায় ছোটো ছোটো করে কাটা চুল। মুখের কোনো শ্রী নেই, চোয়াল
ভেঙে গিয়েছে, চোখগুলো যেন কোটরে বসে গিয়েছে। তবে দৃষ্টি
তীক্ষ্ণ। ছিপছিপে পরিশ্রমী চেহারা। হাতের পেশিগুলো প্রমাণ করছে, তাকে যথেষ্ট খাটাখাটনি করতে হয়।
লোকটা জেমস্ আর অভিমন্যুকে
যেন খেয়ালই করল না। দোকানে ঘুরে ঘুরে জিনিস দেখতে লাগল। লোকটার মুখচোখে কেমন যেন
একটা রুক্ষ ভাব।
টাউ কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে
লোকটাকে বলল, “এখন আর কিছু বিক্রি হবে না। দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে।”
লোকটা একবার টাউকে
তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখল, তারপর খসখসে গলায় বলল, “টেল দেম ফার্স্ট।” ইঙ্গিতটা
জেমস্দের দিকে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না।
টাউ গম্ভীর গলায় বলল, “ওনারা
আমার আত্মীয়। বাইরের লোকেদের জন্যে দোকান সাড়ে আটটায় বন্ধ হয়ে যায়।”
রাগে লোকটার মুখ বিকৃত হয়ে
গেল একমুহূর্তের জন্যে। তারপর অভিমন্যুদের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের স্বরে হেসে বলল, “আত্মীয়? আজকাল তেলে-জলে মিশে যাচ্ছে দেখছি।”
জেমস্ রেগে গেলেও নিজের
রাগকে সামলে নিয়ে লোকটাকে বলল, “তেলে-জলে মেশার ব্যাপারটা
বুঝতে মনটা একটু প্রশস্ত হতে হয়।”
লোকটা একমুহূর্তের জন্যে থমকে
দাঁড়াল। জেমস্কে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করল।
তারপর টাউকে বলল, “দেখো ভাই, কিছু মনে কোরো না। হঠাৎ রেগে
যাওয়াটা আমার পুরোনো বদ অভ্যাস। আর সারাদিন মরুভূমির গরমে ঘুরে ঘুরে ব্যাপারটা আরও
বেড়ে গিয়েছে। আসলে কাল সকালেই আমায় বেরোতে হবে। কয়েকটা জিনিস না পেলেই নয়।”
লোকটার কথাবার্তা এমন হঠাৎ
পরিবর্তন হওয়ায় তিনজনেই বেশ অবাক হয়ে গেল। টাউয়ের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, লোকটাকে সে পছন্দ করছে না। কিন্তু অভিমন্যু বলল, “টাউ
ভাই, সত্যিই হয়তো ওনার জিনিসগুলো দরকার। দিয়েই দাও না।”
টাউ নিমরাজি হয়ে বলল, “ঠিক
আছে। তবে মনে রাখবেন, আমার বন্ধুরা অনুরোধ করল বলেই জিনিস দিচ্ছি,
না হলে টাউকে কেউ জোর করতে পারে না।”
লোকটা একঝলক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে
টাউকে দেখল। তারপর জিনিসগুলো কিনে চটপট গুছিয়ে নিয়ে ঝড়ের গতিতে বেড়িয়ে গেল।
দুই
পরের দিন ভোরবেলা জেমসের ডাকে
অভিমন্যুর ঘুম ভাঙল। বাইরে তখন সূর্যোদয়ের আগুন রং ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। চারপাশে
লাল বালি ও মাটিতে সেই রং ছড়িয়ে পড়ে এক অবর্ণনীয় দৃশ্যপট তৈরি করেছে। ভোরের সেই
কাঁচা সোনা রং মেখে ওয়ারবার্টন যেন ‘এল ডোরাডো’ হয়ে উঠেছে। চারপাশে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। পাশেই একটা গাছের
ডালে সুন্দর একটা পাখি বসে মাঝে মাঝে ডাকছে। মাথায়
ঝুঁটির দিকটা সাদা, ডানা এবং পিঠটা ধূসর বর্ণের, বাকি শরীর মিষ্টি গোলাপি রঙের। জেমস্
জানাল, এটা একধরনের কাকাতুয়ার প্রজাতি, নাম ‘গালহা’।
ব্রেকফাস্ট শেষ করে ওয়ারবার্টন
শহরটা ঘুরে দেখা হল। পুরো শহরটা পায়ে
হেঁটে ঘুরতে মিনিট চল্লিশ সময় লাগে।
এখানে স্কুল, দোকান, খেলার মাঠ, চার্চ যেমন
আছে, তেমনই একটা ছোটো এয়ারপোর্টও আছে। অভিমন্যুর
সবথেকে সুন্দর লাগল এখানকার আর্ট গ্যালারি। সেটা
অবশ্য মূল ওয়ারবার্টন থেকে সামান্য দূরে গ্রেট সেন্ট্রাল হাইওয়ের ওপর। অসাধারণ
সব চিত্র সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার
আদিবাসী চিত্রকলায় এক অদ্ভুত স্বতন্ত্রতা আছে। জাঁকজমকহীন, কিন্তু অভিনব। দেখে
মনে হয়, যেন আনন্দযজ্ঞ চলছে। বেশিরভাগই
আদিবাসী সংস্কৃতি, পশুপাখি, দৈনন্দিন জীবন
বিষয়ক। তাঁরা কতরকম উজ্জ্বল রঙে ক্যানভাস রঙিন
করে তোলে, তার ওপর হালকা উজ্জ্বল রঙের অসংখ্য বিন্দু দিয়ে আসল ছবি ফুটে ওঠে। প্রাচীন
পদ্ধতি, কিন্তু কন্টেম্পোরারি চিত্রকলার থেকেও যেন আধুনিক।
অভিমন্যু মুগ্ধ হয়ে ছবিগুলো দেখছিল, এমন সময়ে পেছন থেকে একটা খসখসে কণ্ঠস্বর ভেসে এল। কালকের
সেই লোকটা।
লোকটা নিজেই এগিয়ে এল অভিমন্যুদের
দিকে, তারপর ঠোঁটের কোনায় একটা আন্তরিক হাসি ফুটিয়ে তুলে করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে
দিল জেমসের দিকে, “কাল রাতের ঘটনার জন্যে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কী জানেন
তো, মরুভূমির রুক্ষ পরিবেশে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়ানোর প্রভাব ইতিমধ্যেই
শরীরের ওপর পড়তে শুরু করেছে। সারাদিন
ঘুরে যদি কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা খুঁজে না পাওয়া যায়, তখনই মেজাজ বিগড়ে
যায়। এই দেখুন, আমার পরিচয়ই দেওয়া হয়নি। আমি
হাডসন, আদতে মেলবোর্নের লোক হলেও বলতে পারেন গত কুড়ি বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার
আউটব্যাকই আমার ঘরবাড়ি।”
জেমস্ও ভদ্রতার খাতিরে হেসে নিজের
পরিচয় দিল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, “আপনি এই মরুভূমিতে
ঠিক কী খুঁজে বেড়ান?”
“প্রাণের অস্তিত্ব। বলতে
পারেন, আমি ডিগ্রিহীন একজন বায়োলজিস্ট। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে নতুন
প্রজাতির পাখি, প্রাণী ও পোকামাকড়ের সন্ধান চালাই। এটাই আমার
নেশা।”
“এ তো খুবই সময়সাপেক্ষ এবং
পরিশ্রমের কাজ!” জেমসের গলায় বিস্ময়।
“তা বলতে পারেন, তবে নতুন প্রজাতি আবিষ্কারের যে আনন্দ, সেটাই আমার
চালিকা শক্তি। এখনও অবধি চার প্রজাতির নতুন সরীসৃপ
এবং প্রায় আশিরকম নতুন পোকামাকড় আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমার নামের পাশে আছে।”
অভিমন্যু দেখল, জেমসের মুখেচোখে একটা সম্ভ্রমের ভাব ফুটে উঠছে, যেটা
লোকটার প্রতি তার কালকের বিরক্তিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে।
এরপর হাডসন জেমসের সঙ্গে তার
দেখা আদিবাসী সম্প্রদায় এবং তাদের সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করল। জেমস্ও
নিজের পছন্দের বিষয় পেয়ে উৎসাহের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিল। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দেখা
গেল দুইজনে আর্ট গ্যলারির অন্যপ্রান্তে বসে হাত নেড়ে, অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে
বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করছে।
অভিমন্যু টাউয়ের দিকে তাকাল।
টাউ দৃশ্যতই অসন্তুষ্ট। সে বিরক্তি-মেশানো গলায় বলল,
“তোমরা শহুরে লোক। মানুষ
চেনো না। আমরা চিনি। আমি
বলে দিচ্ছি, এই লোকটা ভালো নয়। এখন
সে জেমসের সঙ্গে মিষ্টি করে কথা বলছে কেন জানি না, কিন্তু
আমার মন বলছে কোনো একটা মতলব আছে।”
অভিমন্যুরও তাই মনে হচ্ছিল। কিছুক্ষণ
পরে জেমস্ একগাল হাসি নিয়ে ফিরে এল।
“বুঝলে অভিমন্যু, ভেবেছিলাম আজ সকালটা এখানে কাটিয়ে গাড়ি নিয়ে আশেপাশে একটু ঘুরে দেখব। দূরে
ওই টিলাগুলোর ওপর থেকে দারুণ ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যাবে এলাকাটার। কিন্তু হাডসন একটা
দারুণ পরিকল্পনা করেছে।”
“হাডসন!” অভিমন্যুর গলায় বিস্ময় ঝরে পড়ল।
“আর বলছি কী। এখান
থেকে ঘণ্টা দেড়েক গ্রেট সেন্ট্রাল রোড ধরে এগিয়ে গিয়ে একটা কাঁচা রাস্তা পাওয়া যায়,
যেটা দিয়ে দক্ষিণ পূর্বে ঘণ্টা দুয়েক গেলে একটা মাঝারি শুকনো সরোবর পড়বে। জল নেই, শুধু নুন জমে আছে। তার
চারপাশে খানিকটা মরুদ্যানের মতো অংশ। বেশ
বিরল প্রজাতির পাখি এবং পোকামাকড় সেখানে দেখতে পাওয়া যায়। হাডসন
এও বলেছে যে, পাশেই একটা বহু প্রাচীন টিলার মধ্যে হাজার হাজার
বছরের পুরোনো আদিবাসী চিত্রকলার কিছু নমুনা সে দেখেছে। সেখানে
এমন কিছু প্রাণীর ছবি আছে, যাদের কথা অন্তত আধুনিক মানুষদের অজ্ঞাত।”
এইটুকু বলে জেমস্ কয়েক মুহূর্ত
থামল। তারপর আবার উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, “ভাবতে পারো অভিমন্যু, আদিবাসী সংস্কৃতির গবেষণায় এটা কত বড়ো একটা
আবিষ্কার। যা কেউ এতদিন জানত না, তা আজ সবাই জানবে। থ্যাংকস্ টু হাডসন।”
অভিমন্যুর ভুরু কুঁচকে গেল।
টাউ বিরক্তি-মেশানো গলায় বলল, “মিথ্যে কথা। এমন
কিছু থাকলে আমরা আগেই জানতাম। কেউ জানল না, এই হাডসন হঠাৎ খুঁজে বের করল।”
হাডসন হেসে বলল, “নাই জানতে
পারো, এটা তো তোমাদের এলাকার প্রায় প্রান্তভাগে। হয়তো গত একশো-দেড়শো বছর সেখানে
কেউ যায়নি। সবাই ভুলে গিয়েছে। আমি খুঁজে বের করলেই বা অসুবিধা কী? শেষ অবধি তো
তোমাদের সংস্কৃতিকেই তুলে ধরা হচ্ছে।”
টাউ গুমরে গেল।
অভিমন্যু জেমসের কাছে গিয়ে ফিশফিশ
করে বলল, “অচেনা জায়গায় ঝুঁকি নেওয়ার কি কোনো প্রয়োজন আছে? কোনো বিপদ হলে তো
সাহায্যের জন্যও কাউকে পাব না।”
জেমস্ অভিমন্যুর কাঁধে হাত
রেখে হেসে বলল, “এত ভয় পেলে কি অভিযাত্রী হওয়া যায়?” এইটুকু বলেই সে গটগট করে
হেঁটে বেরিয়ে গেল।
টাউ সেইদিকে তাকিয়ে হতাশায়
কাঁধ ঝাঁকাল। ঠিক সেই সময়ে টাউ-এর ফোনটা বেজে উঠল, ফোনের অপর প্রান্তে
কী কথা হল বোঝা না গেলেও দেখা গেল, টাউয়ের চোখেমুখে চিন্তার
ছাপ।
অভিমন্যু জিজ্ঞাসা করল, “কোনো
সমস্যা হয়েছে?”
টাউ চিন্তিত গলায় বলল, “কয়েক
মাস ধরে এক অদ্ভুত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের ওয়ারবার্টনের ডাম্পিং ইয়ার্ড পরিত্যক্ত
গাড়িতে ভরে যাচ্ছে। হয়তো গাড়ির মালিক আমাদের এখান থেকেই রসদ
নিয়ে রওনা হয়েছিল মরুভূমির বুকে, কিন্তু দুইদিন পরে এখানকার রেঞ্জার সেই গাড়ি খারাপ
অবস্থায় রাস্তার ধারে কুড়িয়ে পেয়েছে। গত ছয়
মাসে এই নিয়ে সপ্তম ঘটনা ঘটল। কোনো
ক্ষেত্রেই গাড়ির মালিককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অদ্ভুত
রহস্য।”
তারপর একমুহূর্ত থেমে অভিমন্যুকে
বলল, “জেমস্কে আটকাতে পারব না, কিন্তু তোমরা
সাবধানে থেকো।”
লাঞ্চ শেষ করে ওয়ারবার্টন থেকে
বেরোতে দুপুর সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। লাল ধুলোর ঝড়
তুলে হাইওয়ে ধরে অভিমন্যুদের গাড়ি এগিয়ে যেতে লাগল। আর হাডসনের
গাড়ি তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।
অভিমন্যুর চিন্তিত মুখ দেখে জেমস্
বলল, “চারপাশের পরিবেশকে উপভোগ করো, বন্ধু। আর তোমার
চিন্তার উপশম তো আমার কাছে আছেই। তুমি কী
ভাবছ, এত বছর এই জেমস্ অস্ট্রেলিয়ার আউটব্যাকে কোনো নিরাপত্তা
ছাড়াই ঘুরে বেড়িয়েছে?”
জেমস্ স্টিয়ারিঙের ঠিক নীচের
একটা কম্পার্টমেন্ট থেকে একটা বন্দুক বের করে অভিমন্যুকে দেখাল।
“তোমার বন্দুক আছে?” অভিমন্যু
উত্তেজিত কণ্ঠে বলল।
“শুধু আছে নয়, বেশি বেগড়বাঁই করলে ওই হাডসনের খুলিও উড়িয়ে দিতে পারি,” জেমস্ শীতল কণ্ঠে বলল।
“তার মানে তুমিও ওকে বিশ্বাস
করো না?” অভিমন্যু বিস্মিত গলায় জিজ্ঞাসা করল।
“কোনো প্রশ্নই ওঠে না।”
“তাহলে ওর সঙ্গে আমরা যাচ্ছিই
বা কেন?”
জেমস্ সামনের রাস্তার দিকে
দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলল, “লোকটা যা বলছে সেটা যদি একটুও সত্যি হয়, তাহলে তা বেশ সাড়া-জাগানো আবিষ্কার হতে পারে। তাই
ভাবলাম, একটা রিস্ক নিয়ে দেখি।”
অভিমন্যুর মনে হল, এটা জেমসের পাগলামো ছাড়া আর কিছু নয়।
সে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে সামনে হাডসনের গাড়িটা জোরে ব্রেক চেপে দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়ি
থেকে হাডসন লাফিয়ে নামল। তারপর আঙুলের ইশারায় পাশের একটা কাঁচা রাস্তা দেখিয়ে বলল,
“আমাদের এই রাস্তাটা ধরতে হবে। ঠিকঠাক যেতে পারলে তিনটের মধ্যে জায়গাটায় পৌঁছে
যাব। আশপাশটা ঘুরে, গুহাটা দেখে একঘণ্টার মধ্যে রওনা দিতে পারলে দিনের আলো থাকতে
আবার হাইওয়েতে ফিরে আসতে পারব।”
জেমস্ মাথা নেড়ে সম্মতি
জানাল। তারপর দুটো গাড়িই কাঁচা রাস্তায় নেমে এল। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর অভিমন্যুরা
লক্ষ করল হাডসন গাড়ির গতিবেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। জেমস্ও তাল মিলিয়ে গাড়ি জোরে চালাতে
লাগল। কাঁচা রাস্তাও বলা চলে না। গাড়িদুটো
একটা বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে। চারপাশে
সূচালো ঘাসের ঝোপ। হাডসনের গাড়িটা অদ্ভুত কায়দায় সেই ঝোপ
কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা জেমস্দের
নেই। তাই তাদের গাড়ি বেশিরভাগ সময়ই ঝোপগুলোর উপর দিয়েই চলেছে।
অভিমন্যু দেখল, জেমসের কপালে ভাঁজ পড়েছে।
“কী হয়েছে?” অভিমন্যু চিন্তিত
গলায় জিজ্ঞাসা করল।
“হাডসন এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছে
কেন? বিশেষত চারপাশে যেখানে এত স্পিনিফিক্সের ঝোপ।”
“কীসের ঝোপ?”
জেমস্ কিছু বলার আগেই খুব জোরে
একটা আওয়াজ হল; সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ির ইঞ্জিনের দিক থেকে ধোঁয়া
বেরোতে শুরু করল। জেমস্ খুব জোরে
ব্রেক চেপে গাড়ি দাঁড় করাল। দুইজনে
তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে দেখল, গাড়ির নীচে আগুন ধরেছে। জেমস্
প্রায় ঝাঁপিয়ে গিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে জলের পাত্র নিয়ে এল। অভিমন্যুও তার দেখাদেখি
আর একটা জলের পাত্র এনে আগুন নেভানোর কাজে লেগে পড়ল। গাড়ির নীচ থেকে গলগল করে
ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। কিন্তু কপালগুণে আগুনটা ছড়িয়ে পড়ার আগেই সেটাকে আয়ত্তে আনা গেল।
আগুন নিভিয়ে জেমস্ আর
অভিমন্যু যখন হাঁফাচ্ছে, তখন দেখা গেল হাডসন কিছুদূরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে
ধীরেসুস্থে হেঁটে আসছে।
তাকে দেখেই জেমসের রোদে-পোড়া মুখটা রাগে টকটকে লাল হয়ে উঠল। ছুটে গিয়ে সে হাডসনের জামার কলার চেপে
ধরল।
“ঠিক করে বলো, কী মতলবে তুমি আমাদের এখানে নিয়ে এসেছ?” জেমস্ রাগে গরগর করতে করতে বলল।
হাডসন জেমসের দিকে শান্ত
দৃষ্টিতে একমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “আরে, আমার আবার কী মতলব! আমি কি জানতাম, তোমাদের গাড়িতে আগুন ধরে যাবে?”
“আলবাত জানতে। পুরোটাই
তোমার পূর্ব পরিকল্পনা। তুমি জানতে না
যে, এখানে গাড়ি চালিয়ে আসলে স্পিনিফিক্স ঘাসের ওপর দিয়ে গাড়ি চালাতে
হবে?”
অভিমন্যু জেমসের হাত থেকে হাডসনের
কলারটা ছাড়াল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, “স্পিনিফিক্স জিনিসটা কী?”
জেমস্ উত্তেজিত গলায় বলল, “চারপাশে যে তীক্ষ্ণ ঝোপজাতীয় ঘাস দেখছ, এইগুলো স্পিনিফিক্স। সারা
গিবসন মরুভূমিই এই ঘাসে ভর্তি। এই ঘাস
এবং এর বীজ অত্যন্ত দাহ্য। গাড়ির
নীচের বা সামনের গরম হয়ে যাওয়া অংশে আটকে গিয়ে সহজেই জ্বলে ওঠে। আমাদের
গাড়িতেও সেটাই হয়েছে।”
তারপর হাডসনের দিকে ফিরে বলল, “তুমি তো জানতে যে, এমনই হবে। স্পিনিফিক্সের
ওপর দিয়ে যেতে গেলে ইঞ্জিনের সামনের দিকটা ঢেকে দিতে হয়, যাতে ঘাস ইঞ্জিনে না ঢোকে। আমাদের
সেই ব্যবস্থা ছিল না, কারণ তুমি বলোনি।”
হাডসন শীতল কণ্ঠে বলল, “এটা আবার বলার কী আছে। সবাই
জানে। তোমাদেরও বলা উচিত ছিল যে তোমরা অ্যামেচার, তাহলে হাতে ধরে শিখিয়ে দিতাম। একটা
দুর্ঘটনার দায় যদি আমার ওপর চাপিয়ে শান্তি পাও, তাহলে তা-ই হোক। কিন্তু এখন এই
নাটক বন্ধ করে গাড়িটা নিয়ে আমার পেছন পেছন এসো, নইলে অনেক দেরি হয়ে যাবে
পৌঁছোতে।”
জেমস্ আর কিছুই বলল না। একবার
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হাডসনকে দেখল, তারপর গাড়ি স্টার্ট করতে গেল। কিন্তু
অনেক চেষ্টা করেও গাড়ি স্টার্ট হল না। জেমস্ গাড়ি মেরামতির জিনিস বের করে ভালো
করে ব্যাপারটা পরীক্ষা করতে যাবে, এমন সময়ে হাডসন বাধা দিল।
“এখন বসে বসে গাড়ি ঠিক করবে? তারপর
জায়গাটায় কখন পৌঁছোবে? সন্ধের পরে?”
জেমস্ উত্তর দিল না।
হাডসন খসখসে গলায় বলল, “যা যা
প্রয়োজনীয় জিনিস আছে, আমার গাড়িতে তুলে তোমরাও ওতে চেপে বোসো। আমরা
ঘুরে আসি জায়গাটা থেকে, ফেরার পথে গাড়িটা সারাইয়ের চেষ্টা করব। বেশি দেরি হয়ে গেলে
আজকের মতো ফিরে যাব ওয়ারবার্টনে। কাল গাড়ি সারাইয়ের লোক নিয়ে আসব।”
জেমস্ এইবারও উত্তর দিল না।
অভিমন্যু জেমস্কে বলল, “আর
ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। চলো, আমরা ওয়ারবার্টনে ফিরে যাই।”
এই কথাটা শুনে হাডসন একটা
অদ্ভুত হাসি হেসে রহস্যময় কণ্ঠে বলল, “কীভাবে ফিরবে? হেঁটে?
কারণ আমি তো লেকটায় না গিয়ে আজ ফিরব না। হ্যাঁ, ফেরার পথে যদি দেখি রাস্তার ধারে তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ে আছ, তখন গাড়িতে তুলে নিতে পারি।”
অভিমুন্যর মনে হল, এক ঘুসিতে লোকটার মুখ ভেঙে দেবে।
জেমস্ এতক্ষণে কথা বলল, “অভিমন্যু, আপাতত আমাদের আর কিছু করার নেই, জিনিসপত্রগুলো
হাডসনের গাড়িতে তোলো।”
এক এক করে সব জিনিস গাড়িতে
তোলা হয়ে গেলে জেমস্ স্যাটেলাইট ফোনটা বের করে ওয়ারবার্টনে টাউকে সমস্ত পরিস্থিতি
জানাল।
তারপর হাডসনকে দেখিয়েই
বন্দুকটা কোমরে গুঁজে রাখল, আর বলল, “বুঝলে অভিমন্যু,
এইটা সঙ্গে থাক। যদি
দেখি হাডসনের কথা মিথ্যে তাহলে…”
হাডসন একটা অদ্ভুত হাসি হেসে বলে
উঠল, “উফ্, ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম!”
তিন
যদিও এর পরে আর কোনো সমস্যা হয়নি। হাডসন
দক্ষ হাতে গাড়ি চালিয়ে সমস্ত স্পিনিফিক্সের ঝোপ বাঁচিয়ে অভিমন্যুদের যখন শুকনো লেকের
ধারে পৌঁছে দিল, তখন বেলা সাড়ে তিনটে। রাস্তায়
অভিমন্যু বা জেমস্ একটাও কথা বলেনি। কিন্তু
রওনা দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই হাডসনের ব্যবহারে আবার আমূল পরিবর্তন হয়েছিল। তখন
তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, সেই সকালে আর্ট গ্যালারির হাডসন। হাসছে, গুনগুন করে গান করছে। এমনকি
জেমস্ চুপ করে আছে দেখে একবার কৌতুক করে বলল, “চিয়ার আপ, মাই ফ্রেন্ড। এই শুকনো
পরিবেশে শুকনো মুখে বসে থাকতে নেই। ছবিগুলো
নিজের চোখে দেখলে বুঝবে, হাডসন লোকটা ভুয়ো নয়।”
জায়গাটায় পৌঁছে দেখা গেল, শুকনো লেকটা নেহাত ছোটো নয়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার
বিশাল আয়তনের সামনে সেটা এতই ছোটো যে, ম্যাপে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। চারপাশে
ঝোপজাতীয় উদ্ভিদ বেশি। এছাড়া মুলগা, ব্লাডউড জাতীয় গাছও বেশ কিছু আছে। বেশ
কিছু পাখির ডাক ভেসে আসছে গাছগুলো থেকে। সবমিলিয়ে
অপেক্ষাকৃত মনোরম পরিবেশ।
পাশেই একটা পাথুরে টিলা। হাডসন
জানাল, টিলার ওপরে একটা গুহার মধ্যেই সেই ছবিগুলো রয়েছে।
জেমস্ অভিমন্যুকে বলল, “তুমি আশপাশটা ঘুরে দেখো, আমি চটপট গুহায় গিয়ে দেখে
আসি।”
অভিমন্যু কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু জেমস্ কোমরে গোঁজা বন্দুকে চাপড় মেরে বলল, “চিন্তা নেই। যাব, আর
আসব। আমাদের অবস্থানটা ওয়ারবার্টনে জানিয়ে রেখো।” অভিমন্যু
স্যাটেলাইট ফোনটা হাতে নিয়ে টাউয়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করল।
জেমস্ হাডসনের সঙ্গে এবড়ো-খেবড়ো পাথুরে পথ বেয়ে টিলার ওপরে উঠল। গুহাটা মাঝারি আকৃতির। গুহার সামনে
দাঁড়ালে নীচে গাছপালা, সামনে শুকনো হ্রদের একটা বিস্তীর্ণ
দৃশ্য দেখা যায়। জেমস্ দেখল, অভিমন্যু নীচে গাড়ির পাশেই
দাঁড়িয়ে আছে। সে হাত নেড়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল, অভিমন্যুও প্রত্যুত্তরে হাত নাড়ল।
গুহায় ঢুকে জেমস্ বেশ অবাক
হল। সে ভেবেছিল, পুরোটাই হাডসনের সাজানো গল্প। কিন্তু সে
দেখল, এখানে সত্যিই আদিবাসী প্রস্তরচিত্র রয়েছে। গুহাটা দুটো
অংশে বিভক্ত। ঢুকেই একটা বড়ো কক্ষ, আর ডানপাশে আর একটা
রাস্তা চলে গিয়েছে আরও ভেতরে। সামনের
অংশেই দেয়াল জুড়ে সব ছবি। কত রকম জন্তু-জানোয়ার, বেশিরভাগই লালচে রঙে আঁকা। কিছু জন্তু-জানোয়ারের ছবি
একদম অচেনা। অস্ট্রেলিয়ায় এমন প্রাণী জেমস্ আগে দেখেনি। সে ছবিগুলোর আরও কাছে
এগিয়ে গিয়ে মনোযোগ দিয়ে সেইগুলোকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল।
অভিমন্যুর হাতে-ধরা স্যাটেলাইট ফোনে সিগন্যাল আসতে শুরু করল। ওপার
থেকে টাউয়ের উত্তেজিত কণ্ঠ ভেসে এল, “তোমরা এখন কোথায়?”
অভিমন্যু টাউকে সব বুঝিয়ে
বলল। টাউ আরও চিন্তিত গলায় বলল, “আর একমুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ওখান থেকে বেরিয়ে
পড়ো। কিছু একটা বড়ো ষড়যন্ত্র হয়েছে।”
“কী বলতে চাইছ?” অভিমন্যুর
গলা কেঁপে গেল।
“এইরকম কোনো প্রস্তরচিত্র বা
গুহার কথা আমার বাবা কোনোদিনও শোনেননি। আমাদের এখানে সবথেকে বয়স্ক মানুষটিও এই
ব্যাপারে কিছুই জানেন না। তুমি তো জানো, আমাদের সংস্কৃতিতে
প্রজন্মের পর প্রজন্ম নানান তথ্য গল্পের আকারে বলা হয়। ওইরকম কিছু সত্যিই থাকলে
কেউ না কেউ ঠিক জানত, তা সে যত পুরোনো কথাই হোক না কেন। আমি
এখনই লোক নিয়ে বেরোচ্ছি তোমাদের উদ্ধার করার জন্যে। বি সেফ।”
অভিমন্যু কাঁপা হাতে ফোনটা পকেটে
রেখে ছুটে গেল গুহার দিকে।
জেমস্ মুগ্ধ দৃষ্টিতে
প্রস্তরচিত্রগুলো দেখছিল। একটা খটকা তার মনে রয়েছে। মনে
হচ্ছে, ছবিগুলো অতটাও পুরোনো নয়। কিন্তু
সে এই বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছে না।
পেছন থেকে হাডসনের কণ্ঠস্বর
ভেসে এল, “কী, এবার বিশ্বাস হল?”
জেমসের চোখ হঠাৎ আটকে গেল
ছবিগুলোর একদম নীচে। খুব ছোটো করে কারও নামের ইনিশিয়াল আঁকা আছে।
জেমস্ চোখ কুঁচকে সেটা দেখতে
দেখতে বলল, “এটা আবার কী?”
পেছন থেকে হাডসন একটা ঠান্ডা হাসি
হেসে বলল, “আরে, ওটা আমার সই। দেখোনি, বড়ো বড়ো শিল্পীরা নিজেদের সৃষ্টির নীচে সই করে রাখে। ভালো
আঁকিনি বলো? জাস্ট লাইক অরিজিনাল?”
জেমস্ চমকে উঠল। তার
মানে এটা একটা ফাঁদ ছিল। সে দ্রুত তার
কোমরে রাখা বন্দুকের দিকে হাত বাড়াতে গেল, কিন্তু সেই সুযোগ পেল
না। প্রথমে পিঠে সপাটে কোনো একটা বস্তুর আঘাত
অনুভব করল। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে সে মাটিতে শুয়ে
পড়ল। সে দেখল, হাডসন কখন যেন চুপিসারে পাশের কক্ষ থেকে একটা বেসবল ব্যাট নিয়ে এসেছে জেমস্কে
মারবে বলে। পরমুহূর্তেই জেমস্ নিজেকে সামলে নিয়ে
ওঠার চেষ্টা করতেই হাডসন আবার বেসবল ব্যাটটা দিয়ে জেমসের মাথার পাশে সজোরে আঘাত করল।
জেমসের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল, মনে হল এখুনি চোখের
সামনে অন্ধকার নেমে আসবে। সে কাঁপা
হাতে কোমর থেকে বন্দুক বের করার চেষ্টা করতেই, হাডসন তার হাতে ব্যাট
দিয়ে সজোরে আঘাত করল। জেমসের
শরীরটা রক্তাক্ত অবস্থায় একদিকে নেতিয়ে পরল।
হাডসন তাড়াতাড়ি জেমসের থেকে বন্দুকটা
নিয়ে গুহার একদিকে ফেলে দিল। জেমস্কে
রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে হাডসনের চোখ চকচক করে উঠল। একটা
তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পড়ল তার চোখেমুখে। সে বলে
চলল, যদিও জেমসের মনে হল—শব্দগুলো যেন কতদূর থেকে
ভেসে আসছে।
“ব্যাপারটা অনেকটা মাছ
ধরার মতো। শিকারকে খেলিয়ে খেলিয়ে নিজের পরিধির মধ্যে
নিয়ে আসতে হয়। তারপর সুযোগ বুঝে…। তবে
বুঝলে জেমস্, এটা মাছ ধরার থেকেও বেশি ইন্টারেস্টিং। কারণ
এখানে শিকারটা মানুষ। তাঁরা যেমন বুদ্ধিমান, তেমনই বোকা। নাহলে
একই ফাঁদ পেতে গত ছয় মাসে এতগুলো শিকার জোগাড় হয়।”
জেমস্ বিড়বিড় করল, “সাইকোপ্যাথ। সিরিয়াল কিলার!”
হাডসন অভিমানী সুরে বলল, “না বন্ধু, এটা কিন্তু ভারী অন্যায়। তুমি
আমাকে সিরিয়াল কিলার বলতে পারো না। আমি
তো তোমাদের প্রাণে মারব না। বাকিদেরও
মারিনি। শুধু লেকের লবণের স্তরের মধ্যে জ্যান্ত
পুঁতে দেব। পুরোটা নয়, মাথাটা বাইরেই থাকবে। তারপর
ভাগ্যে থাকলে বাঁচবে, না হলে মরবে। ইটস
আ ফেয়ার গেম, ফান গেম।” বলেই সে একটা শয়তানি হাসি হেসে উঠল।
ঠিক সেই সময়ে অভিমন্যু গুহার
মুখে এসে পৌঁছোল। বর্তমান পরিস্থিতিটা বুঝতে তার কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল। হাডসন
জেমসের দিকে মুখ করে কথা বলছিল। গুহার প্রবেশপথের দিকে তার পিঠ ছিল, সে শিকারকে বাগে পাওয়ার আনন্দে এতটাই বিহ্বল ছিল যে,
অভিমন্যুকে খেয়াল করল না। অভিমন্যু পা টিপে হাডসনের দিকে এগিয়ে গেল।
হাডসন তখনও বলে চলেছে, “ভয় নেই, তোমায় একা ছাড়ব না। তোমার বন্ধুটা কিছুক্ষণ পরে যখন তোমায় খুঁজতে আসবে,
তখন তারও একই হাল করব। তারপর দুটোকে...”
হাডসন কথা শেষ করতে পারল না, তার আগেই অভিমন্যু তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আচমকা আক্রমণে হাডসনের হাত থেকে বেসবল
ব্যাটটা পড়ে গেল, কিন্তু সে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে অভিমন্যুকে
সজোরে মেঝেতে আছড়ে ফেলল। অভিমন্যু
যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল। হাডসন অভিমন্যুকে
সজোরে আঘাত করতে শুরু করল। অভিমন্যু
নিজেকে বাঁচাতে হাডসনের চোয়ালে সজোরে ঘুসি চালাল। হাডসন
একটু দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ল। তার ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরোতে লাগল।
অভিমন্যু কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে
হাডসনকে আবার আক্রমণ করতে গেল। ঠিক সেই সময়ে হাডসন কোমর থেকে একটা ছুরি বের করে
অভিমন্যুর বাঁ কাঁধে বসিয়ে দিল। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে অভিমন্যু কিছু দূরে
মাটিতে বসে পড়ল। হঠাৎ তার চোখ পড়ল, একটু দূরে পড়ে-থাকা জেমসের বন্দুকের ওপর। সে তার
যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীরটাকে কোনোমতে টেনে নিয়ে চলল সেই দিকে। জেমস্ তখনও নিঃসাড়ভাবে
পড়ে আছে মাটিতে, হয়তো জ্ঞান হারিয়েছে।
কিন্তু অভিমন্যু সেই বন্দুক
অবধি পৌঁছোনোর আগেই হাডসন ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে মাটি থেকে বেসবল ব্যাটটা তুলে
নিল; তার মুখে ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে পাশবিক হাসি, তার দাঁতগুলো রক্ত মেখে লাল হয়ে গিয়েছে। সে বিড়বিড় করে বলছে, “উফ্, এই শিকারদুটোর কথা সারাজীবন মনে থাকবে। শুধু আর কিছুক্ষণ!”
হাডসন ধীরে ধীরে এগিয়ে এল
অভিমন্যুর দিকে। সে বেসবল ব্যাটটা তার শিকারের মাথা লক্ষ্য করে চালাতে যাবে, ঠিক সেই সময়ে অভিমন্যু কোনোমতে কাঁপা হাতে বন্দুকটা তুলে নিয়ে গুলি
চালাল। পরপর দুইবার। একটা হাডসনের কাঁধে, আর একটা পায়ে। হাডসন টলতে টলতে গুহার
মুখের সামনে এসে পড়ে গেল। অভিমন্যুর চোখের সামনেটা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল।
রক্তক্ষরণে জ্ঞান হারানোর আগে সে দেখল, হাডসন কোনোমতে ছেঁচড়ে
ছেঁচড়ে গুহা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
টাউ যখন লোকজন নিয়ে ঘটনাস্থলে
পৌঁছোল, ততক্ষণে জেমস্ ও অভিমন্যু দুজনেই রক্তক্ষরণের ফলে সংজ্ঞাহীন। দুইজনের
শারীরিক অবস্থার আরও অবনতির আগেই টাউ তাদের ওয়ারবার্টনে পাঠানোর ব্যবস্থা করে, হাডসনের খোঁজে বের হল। কিন্তু
লোকটার কোনো হদিস পাওয়া গেল না। টাউ
দেখল, জায়গায় জায়গায় জমাট বাঁধা রক্তের ছোপ। গুহামুখ ছাড়িয়ে রক্তের দাগ
বাইরে চলে গিয়েছে। জেমস্ ও অভিমন্যুর জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত কী ঘটেছে, তা জানা সম্ভব নয়। কিন্তু সে অনুমান করতে পারল যে,
হাডসন যথেষ্ট আহত হয়েছে, না হলে দুইজনকে ফেলে সে পালাত না। রক্তের দাগ অনুসরণ করে
বোঝা গেল যে, হাডসন টিলা থেকে নীচে নেমে এসেছিল। জায়গায়
জায়গায় পাথর ও ঝোপের পাতার ওপর রক্তের ছোপ থেকে স্পষ্ট যে,
টিলা থেকে নামার সময়ে হাডসনকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। বারবার বিভিন্ন জায়গায়
দাঁড়িয়ে তাকে বিশ্রাম নিতে হয়েছে।
টাউ সেই রক্তের রেখা অনুসরণ
করে এগিয়ে চলেছিল। টিলা থেকে নেমে আসার পরেও মাটিতে সেই রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছিল,
কিন্তু কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আর সেটা দেখা গেল না। নীচে
রাখা গাড়িটাও আর পাওয়া গেল না। অদ্ভুতভাবে
গাড়ির চাকার দাগ টিলার পেছনে আরও রুক্ষ এবং কাঁকুরে প্রান্তরের ওপর গিয়ে হারিয়ে গিয়েছে। সামনে
শুকনো লেক ও বিস্তীর্ণ মরুভূমি।
হাডসন কোথায় চলে গেল? সে কি
বেঁচে যাবে? সে যদি সুস্থ হয়ে যায় কোনোভাবে, তাহলে কি আবার ফিরে
আসবে প্রতিশোধ নিতে? নাকি অন্য কোথাও, অন্য কোনো পরিচয়ে আবার সে তার জাল বিস্তার
করবে? টাউয়ের কাছে এইসব প্রশ্নের উত্তর নেই। সে শুধুই দুশ্চিন্তার দৃষ্টিতে সামনের
সীমাহীন নিষ্ঠুর মরুপ্রান্তরের দিকে তাকিয়ে রইল।
----------
ছবি - সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি
No comments:
Post a Comment