গল্প:: ভুলের মাশুল - অনন্যা দাশ


ভুলের মাশুল
অনন্যা দাশ

হেমকান্তবাবু আরামকেদারায় বসে জানলার বাইরের আকাশ দেখছিলেন এই সময়টা তিনি আয়াকে বলেন জানলার পর্দা খুলে দিতে আয়াই বিছানা থেকে ওঁকে আস্তে আস্তে এনে এই আরামকেদারাটায় বসিয়ে দেয় জানলার বাইরে সূর্যাস্ত হচ্ছে সূর্যাস্তের আকাশ তাঁর খুব প্রিয় অপরূপ রং আর রঙের বাহার কয়েক টুকরো মেঘ রয়েছে আকাশে সেগুলোও সূর্যাস্তের রঙের ছটায় সোনালি হয়ে গেছে বসে বসে সব দেখেন তিনি আগে নিজেও ছবি আঁকতেন তিনি মানে বিশাল কিছু নয়, আঁকতে ভালো লাগত তাই আঁকতেন, তবে এখন আর সেসব কিছুই করতে পারেন না হাত কাঁপে, তাছাড়া কিছুদিন হল বিছানায় প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন তিনি সকাল-বিকেল দু-বেলা দু-জন আয়া আসে দেখাশোনা, খাওয়া-দাওয়া, ওষুধ ইত্যাদির জন্যে তারাই মাঝে মাঝে উঠে বসিয়ে দেয় আজ অবশ্য অনেকেরই আসার কথা হেমকান্তবাবুর পাঁচ ছেলেমেয়ে আজ তারা সবাই আসবে একটা ব্যাপারে মীমাংসা করতে চান তিনি সেই ব্যাপারটা বহুদিন ধরে কাঁটার মতন তাঁর বুকে বিঁধছিল সেটার একটা হিল্লে না হলে শান্তিতে মরতেও পারবেন না তিনি
আয়া এসে বলল, “ওরা এসে গেছে, এখানে আসতে বলব?”
হ্যাঁ, বলো আসতে
ওরা একে একে ঘরে এসে ঢুকল বড়ো ছেলে সুকান্ত, মেজো ছেলে নবীন, দুই মেয়ে শ্রীলা আর মাধুরী আর কনিষ্ঠ পুত্র নক্ষত্র
সুকান্তই প্রথম কথা বলল, “কী হয়েছে, বাবা? হঠাৎ আমাদের সবাইকে এইরকমভাবে ডেকে পাঠালে কেন? আমাদের সবাইকে কাজকর্ম ছেড়ে আসতে হল এটার কী দরকার ছিল? তাও আবার পরিবারের সবাইকে ছাড়া শুধু আমরা! এদিকে আয়াকে জিজ্ঞেস করতে সে তো বলল, তুমি ভালোই আছ
দরকার ছিল বলেই ডেকেছি অনেকদিন ধরে একটা ব্যাপার নিয়ে আমার মনের মধ্যে খচখচ হচ্ছে সেটা একটা দগদগে ঘা বা ফোঁড়ার মতন আমাকে কষ্ট দিচ্ছে প্রতিটা মুহূর্ত! আমার শরীর এখন ভঙ্গুর, তাই আমার পক্ষে চিলেকোঠায় যাওয়া সম্ভব নয়; আর তাই তোমাদের ডেকেছি চিলেকোঠার ঘরটার কথা তোমরা সবাই জানো সেই ঘরটায় বেশ কিছু হাবিজাবি জিনিসের মধ্যে একটা সিন্দুক দেখতে পাবে তোমরা সেই সিন্দুকে তোমাদের মাকে লেখা একটা চিঠি আছে কোন চিঠির কথা বলছি, তোমরা বুঝতে পারবে সেই চিঠিটা নিয়ে এসো, তারপর কথা হবে পাশের ঘরে আমার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে একটা গণেশের চাবির রিংয়ে চিলেকোঠার চাবিটা আছে একটাই চাবি, শুধু ঘরের দরজাটা খোলার জন্যে সিন্দুকে কোনো চাবি দেওয়া নেই
চাবি নিয়ে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নক্ষত্র বিড়বিড় করে বলল, “বাবার মনে হয় শরীরের সঙ্গে মাথাটাও গেছে কোন এক সিন্দুকে রাখা পুরোনো চিঠি নিয়ে এখন মাথাখারাপ করছে মিছিমিছি আজকের বিকেলটা নষ্ট হল মিতা ভারী রাগ করছিল আজকে আমাদের সবার বাইরে খেতে যাওয়ার কথা ছিল বাচ্চারাও এই দিনটার জন্যে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করে
মাধুরী বলল, “হ্যাঁ, আমাদেরও সেইরকমই প্ল্যান ছিল শুক্রবার বলে তা কী আর করা যাবে! আগামীকাল যেতে হবে
নক্ষত্র গোমড়া মুখ করে বলল, “হুঁ!”
চিলেকোঠার ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ওরা সবাই ভেতরটা অন্ধকার, ধুলোয় ভরা অনেকদিন কেউ ঢোকেনি মনে হয় কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ সুকান্ত আলোর সুইচটাকে অন করতে একটা কম পাওয়ারের আলো জ্বলে উঠল ঘরে প্রচুর জিনিস তাকে পুরোনো দিনের ভারী ভারী পুজোর বাসন, লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতীপুজোর সময়ে সাজাবার জিনিস আরও অনেক কিছু, তবে সিন্দুক একটাই ওরা সবাই ওই সিন্দুকটাকে চেনে মা- দাদুর সিন্দুক ছিল মা সেটা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন সিন্দুকের ওপর বেশ কিছু জিনিসপত্র রাখা ছিল সেগুলোকে ধরে ধরে সরানো হল
শ্রীলা হাঁচতে শুরু করল বিরক্ত হয়ে বলল, “আমার আবার ধুলোয় অ্যালার্জি চিলেকোঠায় আসতে হবে জানলে মাস্ক পরে আসতাম
কিন্তু তাও কৌতূহলের চোটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল না
সিন্দুকের ডালা খুলে দেখা গেল, তার মধ্যে জামাকাপড় ইত্যাদি রয়েছে ওগুলো ওদের মা- জিনিস বোঝা যাচ্ছিল একটা মলাট দেওয়া পুরোনো গীতা একটা কার্ডের বান্ডিল, সেগুলো ওদেরই সব ছোটোবেলাকার আঁকা, বা ওদের ছেলেমেয়েদের মা সবকিছু সামলে রেখেছেন একটা ঝুটো গয়নার বাক্সও পাওয়া গেল তার মধ্যেই ছিল ভাঁজ করা একটা চিঠি
সুকান্ত চিঠিটা একঝলক দেখেই বলল, “বাবার শরীরে যা- হয়ে থাকুক, মাথা এখনও খারাপ হয়নি রে, নক্ষত্র!”
নক্ষত্র বলল, “কী আছে চিঠিতে? পড়
সুকান্ত চিঠিটা পড়তে লাগল -

শ্রীচরণেষু দিদি,
জানি না তুই বুঝেছিস কিনা গতকালের ঘটনার জন্যে তোর ছেলেমেয়েদের একজন দায়ী তোর একজন সন্তান খুবই বেপরোয়া সে খুনও করতে পারে আমি জানি, সেটা কে আমি দেখেছি তাকে ঘৃণ্য কাজটা করতে তুতাই আর সুরমা মরেও যেতে পারত তবে ভয় নেই, আমি যা দেখেছি তা আমি অনায়াসেই ভুলে যেতে পারি দশ লক্ষ টাকার বিনিময়ে নাহলে পুলিশ, আদালত, জেল অনেক কিছুই থাকতে পারে তোদের কপালে ভেবে দেখিস তোর সন্তানের ভাগ্য তোর হাতে
ইতি,
প্রদীপ
মাধুরী বলে উঠল, “প্রদীপ মানে তো মেজোমামা!”
চল, চিঠিটা বাবার কাছে নিয়ে যাই, তারপর কথা হবে
সিন্দুক আর চিলেকোঠার ঘর বন্ধ করে ওরা সবাই নীচে নেমে এল বাইরে তখন অন্ধকার হয়ে আসছে বাবার ঘরে আলো জ্বালানো হয়েছে বলে আয়া পর্দা টেনে দিয়েছে
হেমকান্তবাবু আরামকেদারায় বসে ঝিমোচ্ছিলেন ওদের পায়ের শব্দ পেয়ে চোখ খুললেন
চিঠিটা পেয়েছ?”
পেয়েছি, বাবা
বেশ, একবার পড়ে শোনাও আমি আসলে জানতাম না, এই চিঠির কথা তোমাদের মা এই চিঠিটা পেয়ে আমার কাছে লুকিয়েছিল তার মৃত্যুশয্যায় সে আমাকে বলে চিঠিটার কথা সে চলে যাওয়ার পর আমি চিলেকোঠায় গিয়ে ওটা দেখি ভেবেছিলাম, ওইভাবেই রেখে দেব, ভুলে যাব ওটার কথা কিন্তু ভুলতে চেষ্টা করেও ভুলতে পারিনি সারাদিন মাথায় ওই চিঠির কথাগুলো ঘুরপাক খেয়েছে শুয়ে-বসে প্রতিক্ষণ ভাববার চেষ্টা করেছি প্রদীপ আর ওর স্ত্রী সুরমা তো অনেকদিন আগেই গত হয়েছে, তাই ওদের জিজ্ঞেস করা যাবে না তুতাইকে আমি জিজ্ঞেস করতেও চাই না কিছুতেই মাথা থেকে বার করতে পারছি না ব্যপারটাকে তারপর মনে হল, তোমরা ভাইবোন; তোমাদের পরস্পরের সম্পর্কে জানা উচিত তাই আজ তোমাদের ডেকে পাঠিয়েছি তোমাদের পরিবারের লোকেদের এটা জানানো সুখের হবে না জেনেই তাদের আজকে ডাকিনি তোমরা চাইলে বাড়ি গিয়ে তাদের সবকিছু জানাতেও পারো, আবার নাও জানাতে পারো
সুকান্ত আবার চিঠিটা পড়ল
হেমকান্তবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “যে-ঘটনাটার কথা প্রদীপ বলছে, সেই ঘটনাটার ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারছি তুতাইয়ের জন্মদিনে ওদের বাড়িতে যে-অনুষ্ঠান হয়েছিল, তারপর তুতাই আর ওর মা-, মানে তোমাদের মামিমার ভয়ানক শরীর খারাপ হয় মানে খাবারে বিষক্রিয়া, অর্থাৎ ফুড পয়জনিং মতন সেই ঘটনাটার কথাই মনে হয় বলা হয়েছে চিঠিতে তোমাদের মধ্যে কেউ একজন খাবারে কিছু মিশিয়েছিলে সেদিন
মামা যদি দেখেই ফেলে থাকেন, তাহলে আটকাননি কেন?” শ্রীলা জিজ্ঞেস করল
উনি হয়তো তখন বুঝতে পারেননি, কী ঘটছে পরে দুয়ে-দুয়ে চার করেছেন
সুকান্ত একটু ভেবে বলল, “সেটা তো প্রায় তিরিশ বছর আগেকার ঘটনা আমাদের সবার বয়স এখন চল্লিশ-ঊর্ধ্ব আমার ঘটনাটা পরিষ্কার মনে আছে তুতাই আর মামিমার খুব পেটখারাপ হয়েছিল তুতাইয়ের জন্মদিনের পার্টির পর ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত ছিল কারণ অন্য কেউ অসুস্থ হয়নি পরে জানা গিয়েছিল যে, মিষ্টি দই থেকে ওটা হয়েছিল কারণ একমাত্র ওরা দুজনেই ওই দই খেয়েছিল মামা যেটা মাকে লিখেছেন, সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমাদের মধ্যে থেকে কোনো একজন মিষ্টি দইতে কিছু মিশিয়েছিল মামার ইঙ্গিত বিষের দিকে কিন্তু পার্টির অত লোকের মধ্যে সবার অলক্ষ্যে সেটা করা তো সম্ভব নয়
নক্ষত্র ফোড়ন কাটল, “সবার অলক্ষ্যে তো হয়নি, মামা তো দেখে ফেলেছিলেন
নবীন বলল, “মামিমা আর তুতাই দুজনের কেউই কিন্তু ভালো মানুষ ছিল না মামিমা সবসময়ে আমাদের ওপর খ্যাঁচাতেন আর তুতাই তো মারাত্মক রকমের বুলি করত নিজেকে খুব চালাক মনে করত সব সময় আমাদের হেনস্তা করত, আমাদের নামে মিথ্যে মিথ্যে নালিশ করত
ওরা সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল
মাধুরী বলল, “, তার মানে আমাদের মধ্যে থেকেই কেউ সেটার বদলা নেওয়ার চেষ্টা করছিল?”
সুকান্ত বলল, “হতেই পারে, এবং সেটাই হয়তো হয়েছিল
শ্রীলা বলল, “ওটা যদি সত্যি না হত, তাহলে মা এই চিঠিটা সামলে রাখতেন না; আর মামারও মাকে ব্ল্যাকমেল করার সাহস হত না
হেমকান্তবাবু এবার বললেন, “সত্যিটা না জানা পর্যন্ত আমি শান্তি পাচ্ছি না ওই যে বললামদিন-রাত ব্যপারটা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, তাই আমি সত্যিটা জানতে চাই
সুকান্ত সবচেয়ে বড়ো ওদের মধ্যে, তাই সে- বলল, “ওই দিনটার কথা আমার মনে আছে মামার বাড়ি তো আমাদের বাড়ি থেকে হাঁটাপথে ছিল পার্টিটা ওদের ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে হচ্ছিল আমি সবার আগে পৌঁছে গিয়েছিলাম একা-একাই, কারণ আমার বন্ধু জয়রাও নিমন্ত্রিত ছিল জয়রা মামাদের পাশের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সেই থাকত পার্টির থেকে আমার জয়ের সঙ্গে খেলার আগ্রহ ছিল বেশি জয়ের কাছে নতুন ভিডিয়ো গেম ছিল একটা আমি আর জয় জন্মদিনের পার্টি ছেড়ে ওর বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম ভিডিয়ো গেম খেলতে জয়ের মা-বাবাও জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ছিলেন, তাই ওদের বাড়িতে ওর ঠাকুমা ছাড়া কেউ ছিল না ওর মা-বাবা বাড়িতে থাকলে আমাদের খেলতে দিতেন না অতক্ষণ ধরে পরে অবশ্য জয় পার্টি থেকে পালিয়ে গিয়ে ভিডিয়ো গেম খেলার জন্যে প্রচুর বকুনি খেয়েছিল জয়ের সঙ্গে আমার এখনও যোগাযোগ আছে হোয়াটস্যাপ, ফেসবুক ইত্যাদিতে ওকে বলতে হবে, সেদিনের কথা মনে করছিলাম জয় আমার অ্যালিবাই! যাই হোক, সেদিন তুতাইয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কী হয়েছিল না হয়েছিল, আমি কিছুই জানি না তুতাই আর মামিমার শরীর খারাপের ব্যাপারটা পরে জেনেছিলাম আমরা তো পার্টির খাবারও খাইনি; খেলতে এতটাই মশগুল ছিলাম জয়দের কাজের মাসি ম্যাগি করে দিয়েছিল আমাদের খাবার জন্যে
শ্রীলা বলল, “আমি তো জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যেতেই পারিনি, কারণ তার আগেই আমার পা ভেঙেছিল তিন সপ্তাহের জন্যে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছিল সেদিন খুব কেঁদেছিলাম, যেতে পারিনি বলে আশা করেছিলাম, কেউ হয়তো একটুকরো কেক অন্তত নিয়ে আসবে আমার জন্যে, কিন্তু কিছুই আনা হয়নি মা বলেছিলেন, কেকটা বেশি বড়ো ছিল না, তাই সব শেষ হয়ে গিয়েছিল পরদিন মা আমার জন্যে কেক বানিয়ে দিয়েছিলেন বাড়িতেশ্রীলা চোখের জল মুছে বলল
নবীন বলতে শুরু করল, “আমি দাদার একটু পরেই মামার বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিলাম সেখানে গিয়ে দাদাকে খুঁজছিলাম, কিন্তু পাইনি এখন বুঝতে পারছি, কেন সে তো জয়দাদের বাড়ি গিয়ে বসে ছিল আমি ছাদ থেকে নীচে নেমে মামা-মামিমাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলাম, দাদা কোথায় তাঁরা বিরক্ত হয়ে বললেন, তাঁরা জানেন না মামার অবশ্য খাবারের ট্রে ইত্যাদি নিয়ে ক্যাটারারের সঙ্গে ফোনে বিস্তর ঝগড়া চলছিল দইয়ের হাঁড়িটা টেবিলে রাখা ছিল, মামিমা ওটাকে নিয়ে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিলেন ওটা তো খোলাই হয়নি
মাধুরী বলল, “আমি আর নক্ষত্র মা-বাবার সঙ্গেই পৌঁছেছিলাম আমার তখন কেকের প্রতি প্রচণ্ড লোভ ছিল আমি সোজা ছাদে গিয়ে কেকের কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম কখন কেক কাটা হয়ে যাবে আর আমি কেক পাব না, সে- ভয়ে আমার মনে আছে, ক্যাটারারদের খাবার আনতে দেরি হচ্ছিল তাই নিয়ে লোকে একটু রেগে গিয়েছিল সবার খিদে পেয়ে গিয়েছিল শুধু কেক দিয়ে তো আর পেট ভরে না ওরা খাবার নিয়ে এসে পৌঁছোতে মামা-মামিমা তুমুল চেঁচামেচি শুরু করলেন
এবার নক্ষত্রর পালা, সে বলল, “হ্যাঁ, আমিও মাধুদির সঙ্গে কেকের আশপাশেই ঘুরঘুর করছিলাম ছাদে তবে একটা ব্যাপার আমার মনে আছে কেকের মোমবাতি জ্বালাবার জন্যে কারও কাছে দেশলাই বা লাইটার ছিল না মামা বললেন, ‘আমি আমাদের রান্নাঘর থেকে নিয়ে আসছিবলে দেশলাই আনতে চলে গেলেন তখনই মনে হয় কিছু একটা দেখেছিলেন আমি আর মাধুদি অবশ্য পুরো সময়টা ছাদেই ছিলাম আমরা সেদিন নীচে মামার বাড়িতে গিয়েছিলাম বলে তো মনে পড়ছে না আর গেলেও মা-বাবার সঙ্গে একটুখানির জন্যে বাড়ি ফেরার আগে
হেমকান্তবাবু এবার একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কাজটা কেন করলে, সেটা আমাদের সবাইকে বলবে এবার?” যাকে বললেন সে একটুকুও না ঘাবড়ে বলল, “চিঠিতে আমার কথাই বলা হয়েছে, সেটা কী করে বুঝলে?”
হেমকান্তবাবু শান্ত স্বরে বললেন, “সেটা বোঝা তো কঠিন কিছু নয় সুকান্ত আর শ্রীলা তো এমনিতেই বাদ তারা তো সেখানে ছিলই না, তাই ওদের কাজ হতে পারে না সুকান্ত বন্ধুর বাড়িতে পালিয়েছিল আর শ্রীলার পা ভাঙা বলে সে বাড়িতেই ছিল একা-একা মাধুরী আর নক্ষত্র তখন বেশ কিছুটা ছোটো, তাই ওরা ছাদেই ছিল তারা প্রদীপের ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকলেও আমাদের সঙ্গে অল্পক্ষণের জন্যে সেটা আমার মনে আছে আমি আর তোমাদের মা ওদের ধরে রেখেছিলাম বেরিয়ে যেতে হবে বলে তাই নবীন এটা তোমার কাজ না হয়ে যায় না সবাই যখন কেক কাটা নিয়ে ব্যস্ত ছিল, তখন তুমি রান্নাঘরে ঢুকে কাজটা করেছিলে বলে আমার মনে হয় প্রদীপ দেশলাই নিতে গিয়ে তোমাকে দেখে ফেলেছিল তখনও হয়তো সে বুঝতে পারেনি তুমি কী করছ পরে ওদের দুজনের শরীর খারাপ হতে ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারে এবং তোমাদের মাকে চিঠিটা লেখে
নবীন বিরক্তি প্রকাশ করে বলে উঠল, “খুব বোকা-বোকা কথা কোন প্রমাণ নেই কারও কাছে মামার কাছেও ছিল না শুধু শুধু মাকে বোকা বানান উনি আর মাও বোকার মতন অতগুলো টাকা দিয়ে দিল!
হেমকান্তবাবু এবার বললেন, “তা- যদি হয়, তাহলে তুমি জানলে কী করে যে দইয়ের ভাঁড়টা ফ্রিজে ছিল আর সেটা খোলাই হয়নি?”
নবীন চুপসে গেল একমুহূর্তের মধ্যেই তাকে অনেকটা বয়স্ক দেখাচ্ছিল যেন এবার সে বলল, “তুতাইটা ভীষণ পাজি ছিল আমি ওর বয়সের সবচেয়ে কাছাকাছি ছিলাম বলে আমি মাঝে মাঝে ওদের বাড়িতে যেতাম সেইরকমই একবার যখন ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখন মামিমার ব্যাগ থেকে টাকা সরাল আর মামিমা টের পেয়ে যেতে আমার ঘাড়ে দোষটা চাপাল মা-ছেলে মিলে আমাকে বেদম পিটিয়েছিল সেদিন তারপর বলেছিল, বাড়ির কেউ কালশিটের কথা জিজ্ঞেস করলে যেন বলি, স্কুলে মারপিট করেছি; নাহলে ওরা পুলিশে রিপোর্ট করে আমাকে জেলে পাঠিয়ে দেবে চুরির দায়ে তখন অনেক ছোটো ছিলাম, তাই ওদের কথা বিশ্বাস করেছিলাম জন্মদিনের অনুষ্ঠানের দিন আমি যখন ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখন ওরা তিনজনেই রান্নাঘরে ছিল মামা ক্যাটারারের সঙ্গে ফোনে ঝগড়া করছিলেন দইয়ের হাঁড়িটা টেবিলে রাখা ছিল আমি তখন প্রচণ্ড মিষ্টি দই ভালোবাসতাম আর খিদেও পেয়েছিল আমি মামিমাকে বলেছিলাম, ‘আমাকে একটু দই দেবেন?’ তুতাই তাই শুনে বলেছিল, ‘এই হ্যাংলা! ওটা তোর জন্যে নয়, ওটা আমার জন্যে শুধু আমি খাব! মা ওটাকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দাও তো, নাহলে এই হ্যাংলা ওটাকে শেষ করবেভীষণ খারাপ লেগেছিল আমার ভীষণ অপমানিত বোধ করেছিলাম আমি আর ছাদে যাইনি ওদেরই একটা ঘরে লুকিয়েছিলাম জোলাপের বড়িগুলো কোথায় থাকত, আমি জানতাম তুতাই- দেখিয়েছিল একবার সেটার থেকেই কয়েকটা নিয়ে গুঁড়ো করে আমি ওই দইয়ের হাঁড়ির ঢাকাটা তুলে ওর মধ্যে ছড়িয়ে দিই আমি জানতাম, মামার মিষ্টি দই সহ্য হয় না তাই মামা খাবেন না শুধু তুতাই খাবে, আর বড়োজোর মামিমা হয়েছিলও তাই মামা যখন দেশলাই নিতে ঢোকেন, তখন আমি ফ্রিজের দরজাটা বন্ধ করছি উনি ভেবেছিলেন, আমি বোধহয় খিদে পেয়েছে বলে খাবার চুরি করছি পরে ওদের পেটখারাপ হতে বুঝতে পারেন মাকে উনি বলেন যে, আমি দইয়ে বিষ মিশিয়েছি আর ওরা দুজন মরতে বসেছিল ইত্যাদিকিন্তু ওটা আসলে জোলাপ ছিল মা মিছিমিছি এক লোভী পরিবারকে অতগুলো টাকা দিলেন! তবে হ্যাঁ, স্বীকার করছি, কাজটা বাজে হয়েছিল সেই জন্যেই নিজেকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে আমি আমার প্রিয় মিষ্টি দই খাওয়া জন্মের মতো ছেড়ে দিয়েছি
মাধুরী এবার বলল, “ সেই জন্যেই! আমি তখন ভাবতাম, কী করে এটা হল? একদিন প্রচণ্ড ভালোবাসে আর পরদিন থেকে দই ছোঁয়ও না!”
হেমকান্তবাবু একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে শ্রীলা আর মাধুরীকে বললেন, “রান্নাঘরে মিষ্টি ইত্যাদি যা জলখাবার আছে, সবার জন্যে নিয়ে এসো তো প্লেটে করে
----------
ছবি - সুজাতা চ্যাটার্জী

No comments:

Post a Comment