গল্প:: উপকথা: ইরুক পুঙ্গার অনন্ত হৈ - পিয়ালী ব্যানার্জি


ইরুক পুঙ্গার অনন্ত হৈ
(Gondi উপকথা অবলম্বনে)
পিয়ালী ব্যানার্জি

সে এক নিবিড় জঙ্গলের দেশ। কতরকম সবুজ। লতায় পাতায় জড়িয়ে এমন আচ্ছাদন যে মেঘ ডেকে আনে। মাঝে মাঝেই  ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি হয়ে যায় টিলার ওপর। ছায়া ঘনিয়ে এলেই ময়ূরের নাচ শুরু হয়। বনের ছোটো বড়ো পশুপাখি অবাধে খেলে বেড়ায়। সেই ময়ূরের নাচের ছবি এঁকে রাখে ঘরের দেয়ালে পাঁচিলে ছোট্ট মেয়ে ইরুকি-র বুড়া নানীটা। চমৎকার রঙের বাহার সে ছবিতে, আর হবে নাই বা কেন, রং-গুলা যে পাতার রসে, গাছের বাকলের রসে, মাটি পাথরের রসে বানায় ওরা নিজেরাই। গ্রামজুড়ে মেয়ে পুরুষের এই এক ক্ষমতা, ছবি আঁকার। ইরুকি বুড়া নানীর পাশে বসে ছবি আঁকা দেখে আর গল্প শোনে। সেও পারে তুলি চালাতে অল্পস্বল্প। কাঠকয়লার এক খণ্ড তার হাতে, মাটিতে বসে মকশো করে ইরুকি, তার নানীর মতো ত্রিভুজ বর্গক্ষেত্র আর নিখুঁত বৃত্ত সে এখনো আঁকতে পারে না, তবু চেষ্টা করে।
নানীর গল্প আর হাত একসঙ্গে চলে, যে ছবি সে আঁকছে তার গল্প বলে যায়। ইরুকি শোনে মন দিয়ে।
তারপর?...

সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পায়ে চলা রাস্তাটা প্রায় হারিয়েই গেছে। তার মাঝখান দিয়ে আপন মনে হেঁটে চলেছে শক্তপোক্ত গড়নের শক্তিশালী এক লোক। সে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে চলেছে, মনে আজ তার খুব ফুর্তি। ঘরের উঠানে আজ হই হই আনন্দের আসর বসবে, গাঁয়ের কত মানুষ জড়ো হবে, নাচ গান হবে, খাবার দাবার হবে। সেই মজলিশের জোগাড়ের জন্য সে চলেছে জঙ্গল থেকে এমন কিছু খুঁজে আনতে যা দিয়ে সে অতিথিদের চমক লাগিয়ে দেবে। গাঁয়ের মাতব্বর বলে কথা! একটা কিছু না করলে চলবে! সবাই তাকে মাথা বানিয়েছে, তাদের জন্যে নতুন কিছু খুঁজতেই হয়। কিন্তু খুঁজে খুঁজে সারা হল মাতব্বর, দিন গড়িয়ে দুপুর এল, ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়ল সে। এমন সময় অল্প দূরে এক ছাতার মতো ফলফলে সবুজ পাতাওয়ালা গাছ সে দেখতে পেল, ডালপালা দু-হাতে আকাশের দিকে ছড়িয়ে কী অপূর্ব বিস্তার নিয়েছে। আহ্ কী আরাম! একটু বসে নিই, এই ভেবে সে গুঁড়িতে  ঠেস দিয়ে বসে পড়ে, গাছটা যেন মায়ের মতো তাকে আশ্রয় দেয়। মোটা গুড়িতে ঠেস দিয়ে আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার, জঙ্গলের মৃদু হাওয়ায়, আর পাখির কিচিমিচি গানে জায়গাটা ভরপুর।
তারপরই সে ভাবল, এই ভরদুপুরে বন তো শান্ত থাকে, এখানে এত পাখি কীসের!
তাকিয়ে দেখে গাছের সামনে গোড়ালি ডোবা বেশ এক বড়ো গর্ত জুড়ে যে জল জমেছে সেই জলে কী এক নাম না জানা সাদা ফুল ভাসছে প্রচুর। ফুলগুলো বেশ অদ্ভুত দেখতেও, মাখন রং আর মাথায় যেন নোলক ঝিরিঝিরি বসন্তের হাওয়ায় ঝরছে তো ঝরছেই পাখিরা এসে বসছে সেই জলের ধরে, জলে নামছে উঠছে, জল খাচ্ছে, ঝটাপটি করছে, খুনসুটি করছে, আবার উঠছে নামছে, জল ঘিরে নাচছে কিন্তু জল ছেড়ে যেন উঠতেই চাইছে না। পরিষ্কার স্বচ্ছ জলে নীল আকাশের ছায়া পড়ছে আর তাতে নৌকোর মতো ভাসছে সাদা ফুল। কী বাহার!
একটু ঝুঁকে এক আঁজলা জল এনে মুখে দেয় মাতব্বর, আহা কী যেন এক মিষ্টি সুবাস সেই জলে! আর এক আঁজলা খায়। শরীর জুড়িয়ে মনে চাঙ্গা ভাব আসে। ক্লান্তি কেটে যায়, এ জলের কী এমন জাদু, সে ভাবতে থাকে। কিছুটা জল খেয়ে তার মন এমন ফুরফুরে হয়ে গেল কী করে! এই জলে ওই ফুল পড়ে কি এই স্বাদ? পাখিগুলোর মতোই গাছটিকে ঘিরে ছন্দে ছন্দে নাচতে ইচ্ছে করে তার। সে নাচতে থাকে, নাচতেই থাকে, নাচতেই থাকে, পাখিদের মতো হালকা, মুক্ত বিহঙ্গ যেন সে, পৃথিবীর মাটি ঘাস গাছ লতা যেন তাকে আরও ঘিরে নেয়, মায়াময় হয়ে ওঠে সন্ধ্যা।
একসময় মগজে তার ঝিলিক খেলে যায়, এই জলই সে নিয়ে যাবে অতিথিদের জন্য আসর মেতে যাবে।
ভাবতে ভাবতে সে খেই হারায়, মনের আনন্দে উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু কীসে করে সে জল নিয়ে যাবে!
বেলা পড়ে আসে। বনে অন্ধকার নেমে যাবে।
ঠিক সেই সময় দূর থেকে কোলাহল ভেসে আসে।
তাদের মাতব্বর, তাদের প্রিয় সর্দার, সেই ভোরবেলা জঙ্গলের দিকে বেরিয়েছে, এখনও ফেরেনি, তাই গ্রামের সবাই দল বেঁধে খুঁজতে বেরিয়েছে। এ বন সে বন করে তারা শেষে এখানে উপস্থিত। ওমা! এ কী দেখে তারা! তাদের মাতব্বর যে মৃদু মৃদু হাসছে আর দুলছে। না, কোনো বিপদে পড়েনি সে। সবাই মিলে তাকে ঘিরে ধরে, সারাদিনের গল্প শুনতে চায়।
মাতব্বর তখন তাদের সব কিছু বলে।
লোকজন সকলে মিলে তখন ঠিক করে যার কাছে যা পাত্র আছে তাতে করেই জল ভরে নেবে তারা
কিন্ত এই যে নতুন একটা পানীয় আবিষ্কার হল, সেটা দেবতাকে না দিয়ে তারা তো খেতে পারে না। সবাই মিলে তখন আবার বুদ্ধি বের করল, তাহলে চলো পশুপতি দেবতার থানে আগে যাওয়া হোক।
বাঁশি ঢেটরা পিটিয়ে তারা যাবে সেই সাঁঝের বেলায় গভীর বনে দেবতার থানের দিকে।

বুড়া নানীর গল্প একটু থামে। সেই গল্প থেকে যেন নতুন রং ধরে ছবিতে। ইরুকি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে নানীর ছবিতে ওই তো সেই বন, বনের পথ, সার দিয়ে বিন্দুগুলো আলপনার মতো লতিয়ে উঠেছে সবুজ বনলতা, তাকে ঘিরে কেমন টিয়া সবুজ, নীল ময়ূর, আর ওটা কি চিতা! বাঘ তো বটে! নানী বাঘ ছিল নাকি! অস্থির হয়ে সে বলে, থামলে কেন নানী, বলো বলো।
নানী পিঠ ছাড়ায় খানিক। তারপর গল্প চলে ছবির তালে। ইতিমধ্যে দেয়ালে লতিয়ে উঠেছে বাসর লতা, মধ্যমণি এক গাছ, তার তলে হরিণ শিশু, পাতায় পাতায় পাখি দুলছে। ইরুকি বলে এ মায়াবী গাছখানা ভারী সুন্দর, এর নামটা বলো। নানী মিটিমিটি হাসে আর বলে, ইরুকি ইরুকি, তুই গল্প তো শোন আগে।
তারপর

তারপর সবাই মিলে সেই সাদা সাদা ফুল কুড়িয়ে নেয়, ফুল জলে দিয়েই তৈরি করে নেবে তারা পানীয়। আর তারপর সেই গর্তের জল হাঁড়িতে ভরে নিয়ে সবাই চলল গহন বনে পশুপতির থানে।
জঙ্গল যেখানে ঘন হয়ে কালচে নীল হয়ে আসে সেখানে পশুপতির বাস। মাতব্বর তার দলবল নিয়ে হাজির হল সেখানে। ভক্তিভরে দেবতাকে উৎসর্গ করল সেই পানীয়। তারপর সকলে অপেক্ষায় পল পল গুনতে লাগল
পশুপতি প্রসন্ন মুখে সেই পানীয় গলায় ঢেলে দেন কিছুটা। তারপর স্থির। তারপর সবাই অবাক হয়ে শোনে দেবতার গলা দিয়ে এ কেমনতরো স্বর!
যেন বন টিয়ার ডাক!
অনর্গল টিয়ার ভাষায় কথা বলে যাচ্ছেন পশুপতি।
একসময় চুপ। আবার হাত বাড়িয়ে পাত্র মুখে ঢালেন। এবার নিশ্চুপ। সারা বন অন্ধকারে থম থম করছে। সবাই ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করে। হঠাৎ পশুপতির গলা দিয়ে এমন বাঘের মতো গর্জন বের হয় যে জঙ্গল কেঁপে ওঠে।
কিন্তু কই, দেব আবার জলের পাত্র মুখে তুলেছেন আর বাকি জলটুকু গলায় ঢেলে দিচ্ছেন যে!
এবার সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে দেব আর নিজের পায়ে চলতেই পারছেন না, গড়িয়ে চলেছেন বুনো বরা যেমন যায়। মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে দেব খুশিতে ভরপুর।
সবাই হই হই করে ওঠে, দেবতা প্রসন্ন হয়েছেন। পাত্র থেকে বাকি প্রসাদটুকু সবাই ভাগাভাগি করে নেয়, নেচে নেচে এবার ঘরে ফেরে সকলে।

লাফিয়ে ওঠে ইরুকি! বুঝেছি বুঝেছি, মহুয়া মহুয়া! ইরুক পুঙ্গার অনন্ত হৈ
এই আমাদের মহুয়া ফুল নানী, এরকম করে আবিষ্কার হয়েছিল! কী ভালো গল্পটা!
বুড়া নানীর হাতের তুলি তখনও চলছে। আর ইরুকি ছুটেছে তার বন্ধুদের কাছে, এই গল্প তাদেরও শোনাতে হবে যে।

ওই জঙ্গল ছিল ভারতের মধ্যপ্রদেশের ছত্তিশগড়ের জঙ্গল আর ওই গাছ ছিল মহুয়া। সারা ভারতের জঙ্গলে কত রকম স্থানীয় নাম এর - কোয়া, কচড়া মহুল, মউল ইল্লিপে। এরকম অনেক আদরের নাম দিয়েছে জঙ্গলের মানুষ। এ যে তাদের কাছে কল্পবৃক্ষ, কারণ এর ফুল মরে না। শুকিয়ে গেলেও পচে না, আবার জলের মধ্যে ফেললেই তাজা, প্রাণবন্ত। তাই তো অনন্ত। আদিবাসী গোন্ড মানুষের বিশ্বাস এই গাছের তলাতেই জন্ম নিয়েছিল তাদের আদি পুরুষ কোয়া পেন। মহুয়া এক মহৌষধি। এ গাছের কিচ্ছুটি ফেলার নয়। সাহেবরা এর নাম দিয়েছে বাটার ট্রি। বীজ থেকে তেল পাওয়া যায়। ফুল ফল সব খাওয়া যায়, পাতা ফুল থেকে ওষুধ হয় যা পেটের জন্যে, দেহের বাত বেদনায়, সর্দি কাশি শ্বাসকষ্ট, সবকিছুর জন্যে উপকারী।
----------
ছবি - গোন্দ চিত্র: দুর্গাবাঈ ভ্যাম (আন্তর্জাল)

No comments:

Post a Comment