গল্প:: রিমি - তাপস মৌলিক


রিমি
তাপস মৌলিক

সেদিন আমাদের পাড়ার একটা ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল। মেয়েটার নাম রিমি। ক্লাস টুয়ে পড়ে। প্রথম যেদিন দেখা হয় তখন অবশ্য তার নাম জানতে পারিনি। সেটা জেনেছি দু-দিন সাক্ষাতের পর তিন দিনের দিন। রিমি খুব গম্ভীর। কথা কম বলে। আলাপ বলতে তার মাত্র দু-চারটে কথা, আমার বকবকই বেশি। তিন-চারবার নাম জিজ্ঞেস করার পর লজেন্স চুষতে চুষতে অন্যদিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বলেছিল, “রিমি।” বললাম, “রিমি তো ডাকনাম, ভালো নাম কী?” সে আবার গম্ভীরভাবে জবাব দিল, “রিমি।” পদবি জানার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, “রিমি কী? পুরো নাম?” সে বিরক্ত হয়ে জোরের সঙ্গে বলল, “রিমি।” “কোন ক্লাস?” জিজ্ঞেস করি এবার। রিমি কথা বলল না, ডানহাতের দু-আঙুল তুলে বুঝিয়ে দিল ক্লাস টু। যাই হোক, তার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার কথাটা বলি এবার।
সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়েছিল। প্রাত্যহিক কাজকর্ম, বাজারহাট ইত্যাদি সেরে জলখাবার খেয়ে দশটা নাগাদ কানাইদার চায়ের দোকানে এসে বসেছি। পাড়ার মধ্যেই ছোট্ট চায়ের দোকান, সামনে একফালি ইট পাতা বারান্দা, ওপরে টালির চাল, বারান্দার দু-পাশে মুখোমুখি দুটো কাঠের বেঞ্চ পাতা। অন্যদিন আরও সকাল সকাল আসি, লোকজন থাকে, খানিক গল্পগুজব হয়। সেদিন আমি একা, আর কেউ নেইস্বাভাবিক, অফিসকাছারির সময়। কানাইদা নতুন করে চায়ের জল চাপিয়েছে, একটা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে একদিকের বেঞ্চে বসলাম আমি।
মার্চ মাসের প্রথমদিক। ক’দিন পরে দোল। শীত চলে গেছে, গরমও পড়েনি তেমন। সুন্দর আবহাওয়া। আমাদের পাড়ার এই রাস্তাটা একটু নিরিবিলি, সরু বলে গাড়িঘোড়া চলে না। দু-পাশে বেশ কয়েকটা কৃষ্ণচূড়া গাছ রয়েছে এখনও। কৃষ্ণচূড়া ফুলের ঝরে পড়া পাপড়িতে রাস্তাটা লাল হয়ে থাকে এইসময়। পাড়ার মধ্যে কাছেই ‘পদক্ষেপ’ নামে একটা প্রাইমারি স্কুল আছে। সকালের স্কুল। তখন সবে স্কুল ছুটি হয়েছে। ছোটো ছোটো বাচ্চারা কলকল করতে করতে দল বেঁধে বাড়ির দিকে চলেছে। এক্কেবারে ছোটো যারা, নার্সারি বা কেজিতে পড়ে, তাদের মায়েরা এসে তাদের নিয়ে যায়। একটু বড়োদেরও কারও কারও বাড়ির লোক আসে। বাকিরা নিজেরাই ফেরে দলবেঁধে, তুমুল হইহল্লা আর দুষ্টুমি করতে করতে।
রিমি কিন্তু একা একাই ফিরছিল। দেখি একটা ফরসা গোলগাল ছোট্টখাট্ট মেয়ে, পরনে স্কুলের সাদা জামা আর গাঢ় লাল স্কার্ট, টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে এল, তারপর কানাইদার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পিঠের স্কুলব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে গম্ভীরভাবে ব্যাগের এ পকেট সে পকেটের চেন খুলে কিছু খুঁজতে শুরু করল। সামনের আর পাশের পকেটগুলোয় যা খুঁজছিল তা পেল না মেয়েটা। তখন সে বইখাতা রাখার বড়ো জায়গাটা খুলে ভেতরে হাতড়াতে শুরু করল। তাতেও নিশ্চয়ই লাভ হল না, কারণ এরপর সে ব্যাগ থেকে এক এক করে তার সমস্ত বইখাতা বার করে সেই ধুলোভরা রাস্তার ওপরেই রাখতে শুরু করল। আমি একদৃষ্টে দেখছিলাম ব্যাপারটা। আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, “কী রে, কী খুঁজছিস? কিছু হারিয়ে ফেলেছিস?” মেয়েটা কোনো উত্তর দিল না। ব্যাগ খালি করার পর মনে হয় জিনিসটা পাওয়া গেছে, দেখলাম মেয়েটার বাঁ হাতের মুঠোয় কিছু একটা রয়েছে, অন্য হাতে বইখাতাগুলো রাস্তা থেকে তুলে সে ফের ব্যাগে পুরল, তারপর চেন বন্ধ করে ব্যাগটা সেখানেই রেখে উঠে এল দোকানের বারান্দায়। কানাইদার দিকে চেয়ে দেখলাম সে মিটিমিটি হাসছে, মনে হল চেনে মেয়েটাকে। মেয়েটা কোনো কথা না বলে দোকানঘরটার সামনে এসে দাঁড়াল। সেখানে একটা উঁচু ধাপের ওপর কয়েকরকম বিস্কুট আর লজেন্সের বয়াম রাখামেয়েটার নাগালের বাইরে। তাই সে চটপট আমি যে বেঞ্চটার একধারে বসে আছি তার ওপর উঠে পড়ল, তারপর বাঁহাতের মুঠো খুলে একটা এক টাকার কয়েন ধাপের ওপর রাখল, লজেন্সের একটা বয়াম খুলে একটা লজেন্স বার করে বয়ামটা ফের বন্ধ করল, তারপর বেঞ্চ থেকে নেমে মোড়কটা খুলে লজেন্সটা মুখে পুরল, মোড়কটা ভালো করে ভাঁজ করে চায়ের ভাঁড় ফেলার জায়গায় ফেলল, শেষে বারান্দা থেকে রাস্তায় নেমে স্কুলব্যাগটা পিঠে তুলে নিল।
এই পুরো সময়টায় সে আমার বা কানাইদার দিকে একবার তাকালোও না। পাত্তাই দিল না। কী গম্ভীর রে বাবা! মজা করার জন্য বলে উঠলাম, “বাহ্, একা একা লজেন্স খেয়ে চলে যাচ্ছিস! আমাকে দিলি না?”
এই প্রথম মেয়েটার মুখে একচিলতে হাসির রেখা দেখলাম। চলে যেতে গিয়ে কয়েক পা এগিয়েও সে দাঁড়িয়ে পড়ল, আর কী আশ্চর্য, ফের ফিরে এল দোকানের সামনে। ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে ফের চেন খুলে সমস্ত বইখাতা রাস্তার ওপর নামাল, তারপর ভেতর হাতড়ে আরেকটা এক টাকার কয়েন বার করে দোকানে উঠে এল, একইভাবে বেঞ্চের ওপর উঠে টাকাটা রেখে বয়াম থেকে আরেকটা লজেন্স বার করল, তারপর নেমে হাত দিয়ে বেঞ্চটার ওপরে জুতোর দাগ মুছে দিল আর আমার দিকে তার লজেন্স-ধরা হাতটা বাড়িয়ে ধরল। মুখে কোনো কথা নেই। আমি হতবাক হয়ে তার হাত থেকে লজেন্সটা নিয়ে বললাম, “থ্যাংক ইউ!” ততক্ষণে কানাইদার চা তৈরি হয়ে গেছে। একটা থালায় করে এক ভাঁড় চা নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এসে সে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল। মেয়েটা তখন ফের রাস্তায় নেমে গেছে। চায়ের ভাঁড়টা তুলে নিতে নিতে আমি তাকে বললাম, “তুই লজেন্স খেলি, আমাকেও দিলি। এখন এই যে আমি চা খাচ্ছি, তুই খাবি?”
মেয়েটা কথা না বলে দু-পাশে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল, খাবে না। স্কুলব্যাগটা পিঠে তুলে নিল ফের আমি বললাম, “কেন রে? চা খেলে বুঝি গায়ের রং কালো হয়ে যাবে? তাহলে বিস্কুট খাবি?”
ফিক করে হেসে ফেলল মেয়েটা। আমার দিকে পেছন ফিরে চলে যেতে যেতে বলল, “তাহলে তো দুধ খেলে গায়ের রং সাদা হয়ে যাবে!” বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল।
“বেগুন খেলে বেগুনি হয়ে যাব!”
“পটল খেলে সবুজ হয়ে যাব!”
“আপেল খেলে লাল হয়ে যাব!”
এমনিভাবে এক লাইন বলে আর খিলখিল করে হাসে। যত দূরে যায় তত আরও জোরে জোরে বলে যাতে আমি পেছন থেকে শুনতে পাই। ব্যাপারটায় খুব মজা পেয়েছে বোঝা গেল।
“কমলালেবু খেলে কমলা হয়ে যাব!”
“চিপস খেলে হলুদ হয়ে যাব!”
দূর থেকে তখনও চিৎকার করছে সে, সঙ্গে খিলখিল হাসি।
আমি তাজ্জব হয়ে দোকানের বেঞ্চে বসে রইলাম। কানাইদা বলল, “চা-টা খেলে না? ঠান্ডা হয়ে গেল যে!”
----------
ছবি - মেটা এআই

No comments:

Post a Comment