গল্প:: গ্রহান্তরের আগন্তুক - অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়


গ্রহান্তরের আগন্তুক
অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

গোড়ার কথা

     তুফানের বিষয়ে কখনও লিখব বলে ভাবিনি লিখলেও সেকথা মানুষ বিশ্বাস করবে বলে তো মনে হয় না অথচ তুফানের বিষয়ে সত্যিটা জানি কেবল আমরা দুজন; এবং আমরা দুজনেই বিশ্বাস করি তুফানের ঘটনা সত্যি তুফানকে যদি আর কখনও খুঁজে পাওয়া না যায়, যদি আর কোনোদিন তুফান তার পরিচিত চেহারায় আমাদের সামনে এসে না দাঁড়ায়, তবু আমরা তুফানের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারব না কারণ আমরা জানি, তুফান বাস্তব তুফান এখনও আমাদের আশেপাশেই রয়েছে তুফানের মৃত্যু নেই তুফান কি তাহলে অন্য গ্রহের আগন্তুক? তুফানের সঙ্গে কি তাহলে আমাদের আবারও দেখা হবে কোথাও?
নাহ্, বড্ড খাপছাড়া শোনাচ্ছে বোধহয় প্রথমে আমার পরিচয়টাই আপনাদের খুলে বলি বরং আমার নাম এক্স-১৩২ ক্ষমা করবেন, আমার আসল পরিচয় আমি সত্যিই এভাবে আপনাদের কাছে প্রকাশ করতে অপারগ তাই ওই কোড-নম্বরেই আমাকে আপাতত মনে রাখতে হবে আপনাদের ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গোপন এক মিশনে আমি সহকারী মিশন ডাইরেক্টর হিসেবে অভিযান পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছি গত ২৭ সেপ্টেম্বর, কাজাখস্তান মরুভূমি অঞ্চলের বৈকানুর রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে বিশেষ যে রকেটটি উৎক্ষেপিত হয়, আমাদের মিশনে সেইটিই ছিল প্রথম পদক্ষেপ গোপনীয়তার কারণে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো সংবাদমাধ্যমেও এই বিষয়ে আমরা কোনো খবর পাঠাইনি তাই উৎক্ষেপণের পরেপরেই রকেটটি যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে শেষ অবধি আমরা যে কোনোমতে মিশন স্থগিত রাখতে বাধ্য হই, সেই নিয়েও কোনো খবর এখনও অবধি কোথাও প্রকাশ্যে আসেনি আশার কথা, রকেটে নভশ্চর যাঁরা ছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই সুস্থ সবল রয়েছেন তাঁদের মধ্যে গ্রুপ কমান্ডার এম-৩৯, তাঁর সঙ্গে কথা বলার পর, আমরা দুজন আবারও নিশ্চিত হইতুফানের সাহায্য ভিন্ন এই রকেটকে বাঁচানো অসম্ভব ছিল নিশ্চিত করে বলা যায়, এম-৩৯ এবং আমি এক্স-১৩২, এখনও অবধি কেবল আমরা দুইজনেই এই সময়ে দাঁড়িয়ে তুফানের অস্তিত্বের বিষয়ে জানি তুফানের সঙ্গে এখনও অবধি কেবল আমাদেরই দু-একবার যোগাযোগ হয়েছে আমরা সেই খবর প্রকাশ্যে আনিনি কারণ তুফানের বিষয়ে আমাদের আরও তথ্যের প্রয়োজন এরই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তুফান-সম্পর্কিত পুরো ঘটনাটাই আমরা এখানে লিখে রাখতে চলেছি ভবিষ্যতে এই লিখিত রেকর্ডই হয়তো আমাদের সত্যের কাছাকাছি পৌঁছোতে সহায়তা করবে

[]

আগস্ট, ২০ নৈনিতাল, উত্তরাখণ্ড
আন্তর্জাতিক রাডার কনফারেন্স সেরে নৈনিতাল থেকে ফিরছিলাম জায়গাটাকে অবশ্য ঠিক নৈনিতাল বলা চলে না বরং নৈনিতালের কাছেই সেখানে পাহাড়ের ওপর ভারী সুন্দর এক কনভেনশন সেন্টার ফিরতেই ইচ্ছে করছিল না প্রায় তার ওপর দেশ-বিদেশ থেকে আসা নামজাদা এক-একজন গবেষক-বৈজ্ঞানিক তাঁদের সঙ্গে আলোচনা, মত-বিনিময়এই সবকিছুর মধ্যে কোথা দিয়ে যে সময় কেটে গেল, জানি না কিন্তু না ফিরেও আর উপায় নেই আর মাত্র মাসখানেকেরই অপেক্ষা কেবল আমাদের গোপন মিশনের লঞ্চ ডেট শেষ অবধি পাকাপাকিভাবে ঠিক হয়েছে ২৭ সেপ্টেম্বর ইতিমধ্যেই বৈকানুর উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের সঙ্গে প্রাথমিক সমস্ত বিষয়ে আলোচনা শেষ করে ফেলা হয়েছে আমাদের যন্ত্রপাতিগুলোও একে-একে সব রওনা হতে শুরু করেছে এই মিশনের বিষয়ে চূড়ান্ত গোপনীয়তা বজায় রাখা হচ্ছে সব পর্যায়েই এমনকি বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রকের সচিবও এই বিষয়ে অবগত নন কেবল প্রধানমন্ত্রীর দফতরের বিশেষ সচিব, এবং প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই প্রকল্পের বিষয়ে জানেন আর জানি মিশনের সঙ্গে যুক্ত আমরা কয়েকজন, এবং অবশ্যই আমাদের ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার চেয়ারম্যান

[এই লেখার বেশ কিছু অংশ আমার এতদিনের ব্যক্তিগত ডায়ারি থেকে তুলে আনা তাই কখনো-সখনো সেই লেখার পাশেপাশেই, মার্জিন-নোট হিসেবে আমি নতুন বিষয়গুলো লিখে রাখব হয়তো সেভাবেই এই মিশন তার সঙ্গে তুফানেরই বা কী যোগাযোগসেই বিষয়গুলো বুঝতে সুবিধে হবে আপনাদের যেমন এই মুহূর্তে এই মিশনের বিষয়ে আপনাদের কিঞ্চিৎ জানানো উচিত বলে মনে করছি
বিগত বেশ কিছু বছর ধরেই আমরা এই মিশনের বিষয়ে কাজ করতে শুরু করেছি শুরুটা হয়েছিল কোভিড অতিমারির কিছু পরেপরেই ভারত মহাসাগরের গভীরে অবস্থিত এক নির্জন দ্বীপ, সেই দ্বীপেই চালু করা হয়েছিল আমাদেরই বিজ্ঞানীদের হাতে বানানো অতীব সূক্ষ্ম নিখুঁত এক রেডিয়ো টেলিস্কোপ মহাজাগতিক তরঙ্গ সংকেত খুঁজে বের করতে তার জুড়ি মেলা ভার সেই টেলিস্কোপেই হঠাৎ লাগাতার ধরা পড়তে শুরু করেছিল একের পর এক অদ্ভুত তরঙ্গ সংকেত আশ্চর্যের কথা হল, সেগুলি সবই যেন আসছিল বিরাট মহাকাশের বিশেষ এক অঞ্চল থেকেই! কেউ কি তাহলে যোগাযোগ করতে চাইছিল আমাদের সঙ্গে? কোন বিশেষ উদ্দেশেই বা তারা এই বার্তা পাঠাতে শুরু করেছিল? বার্তাগুলি আমরা সম্পূর্ণ ডি-কোড করতে পারিনি সংখ্যার পাশাপাশি বেশ কিছু অদ্ভুত চিহ্ন মেশানো থাকত সেই বার্তাগুলোয়, যা আমরা অনেক চেষ্টা করেও সম্পূর্ণ বুঝতে পারিনি কেবল এটুকু বুঝেছিলাম, চাঁদ আর মঙ্গলের মাঝামাঝিই কোথাও কোনো এক মাঝারি মাপের গ্রহাণু বা ধূমকেতুর ভাঙা অংশ থেকে সেই বার্তা পৃথিবীতে এসে পৌঁছোচ্ছে এও বুঝেছিলাম, সেই বার্তার প্রেরক যেন আমাদের নতুন কিছু জানাতে চায় বিজ্ঞানের বিষয়ে, আধুনিক মহাকাশযাত্রার বিষয়ে আমরা স্তম্ভিত, অবাক হয়ে গিয়েছিলাম
না, পৃথিবীর অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলির সঙ্গে আমরা কোনোরকম যোগাযোগ করিনি আমাদের মনে হয়েছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম যদি ব্রহ্মাণ্ডের ওপারের কোনো গোষ্ঠী বা প্রাণের সঙ্গে সত্যিই আমাদের তরফে যোগাযোগ করা গিয়ে থাকে, তাহলে সেই সাফল্য নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের বিষয়টা গোপন রাখা উচিত আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা যদি অন্য সংস্থাগুলিকে সময় থাকতে এই বিষয়ে অবহিত করতাম তাহলে হয়তো অন্তত আরও তিনটি রকেট আজ নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচতে পারত অথবা সেগুলিতে থাকা নভশ্চরেরা হয়তো আজও বেঁচে থাকতেন অথবা হয়তো তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আজও বেঁচে আছেন কিন্তু কোথায়, কীভাবেসেসব জানারও আর কোনো উপায় নেই
আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, মহাকাশের যে অংশ থেকে সংকেত এসে পৌঁছোচ্ছে, সেই অংশেরই নির্দিষ্ট এক গ্রহাণুর অভিমুখে আমরা একটি রকেট পাঠাব তিন অথবা চারজন নভশ্চর সেই রকেটে থাকবেন গ্রহাণুর ওপরে কোথাও আমাদের রকেট অবতরণ করবে আমরা আশা করেছিলাম, সেই গ্রহাণুপৃষ্ঠেই হয়তো আমরা কোনোভাবে সেই অজানা, অচেনা গ্রহান্তরেরমানুষদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ স্থাপন করতে পারব আমরা অনেকটাই তাড়াহুড়ো করেছিলাম আমরা কেবল দূর থেকে পাঠানো রেডিয়ো সংকেতের সাহায্যে খানিক আন্দাজ করতে পেরেছিলাম, সেই গ্রহাণুর অপর পিঠে, অর্থাৎ যে-অংশকে আমরা সাধারণ অপটিক্যাল টেলিস্কোপের মাধ্যমে দেখতে পাই না, সেই অংশে কিছু সুনির্দিষ্ট জ্যামিতিক কাঠামো রয়েছে সেগুলিকেই আমরা এবড়ো-খেবড়ো ভূমিরূপের পরিবর্তে নির্দিষ্ট বাসস্থান অথবা গবেষণাগার ধাঁচের কোনো বস্তু বলে মনে করেছিলাম আমাদের মনে হয়েছিল, সেই সব গবেষণাগার থেকেই আমাদের উদ্দেশে সেই তরঙ্গ সংকেতগুলি এতদিন যাবৎ পাঠানো হয়েছে আমরা বিরাট ভুল করেছিলাম]

১৭ আগস্ট, ২০ নৈনিতাল, উত্তরাখণ্ড বিকেল ৪টে ৪৯
হাইওয়ের ওপর ছোটো একটি রেস্তোরাঁয় চা খেতে ঢুকেছিলাম সেই সময়েই ফোন বেজে উঠল এম কলিং এম-৩৯ আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিলাম, তেমন ভিড় নেই এখন কানে ইয়ারবাড লাগাতেই এম-এর সুরেলা কণ্ঠস্বর, “তুমি কী রাস্তায়? কথা বলা প্রয়োজন!” শুনে বুঝলাম, ব্যাপারটা সিরিয়াস আমি বললাম, “রাস্তায় ঠিকই একটু চা খেতে নেমেছি কিন্তু কথা বলা যাবে এখানে ভিড় নেই” “গুড,” ওপাশ থেকে জবাব এল, “আমি ভিডিয়ো কলে নিচ্ছি তোমায় কিছু জিনিস দেখানো প্রয়োজনআমি ততটাও অবাক হইনি এই মিশনের গ্রুপ ক্যাপটেন হিসেবে এম-কে বেছে নেওয়া আমার সবদিক থেকেই যথার্থ মনে হয়েছে কারণ একদিকে সে যেমন যন্ত্রপাতির বিষয়ে ওয়াকিবহাল, অন্যদিকে তেমনই তার টনটনে অঙ্কের জ্ঞান তাই মাঝে-মাঝেই জটিল সমস্ত ইকোয়েশনের ধাঁধা নিয়ে সে আমার কাছে এসে হাজির হয় যে-কোনো জিনিসের সবটা স্পষ্ট করে না বোঝা অবধি তার স্বস্তি নেই
এই জায়গাটা ভালো করে দেখছ? বিশ্বাস হচ্ছে তোমার?” এম-এর গলায় স্পষ্ট আশঙ্কার ছাপ আমিও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না একেবারেই ভুল হচ্ছে কোথাওওয়ার্মহোল!” আমার মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে যায়ঠিক তা-, আমার অঙ্কে ভুল নেই কোথাও,” এম-এর আত্মবিশ্বাস টলে না আমি হাত থেকে চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখি সব কেমন যেন গণ্ডগোল বোধ হয়
আমার অঙ্কে ভুল নেই, এক্স,” ওপাশ থেকে আবারও এম-এর কণ্ঠস্বর, “এখন এই মিশনের বাস্তবতা নিয়ে আমাদের আরও ভাবা প্রয়োজন বোধহয়আর তার সময় নেই আমি কপালে হাত দিয়ে ভাবতে চেষ্টা করি ঠিক সে-সময়েই লোকটা আমার পাশে এসে দাঁড়ায়

[]

১৮ আগস্ট, ২০ রাত ১টা
আমার গাড়ি দিল্লি ঢুকছে প্রায় লোকটা আমার পাশে বসে রয়েছে ওর নাম তুফান আমি এখনও ওর বলা কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছি না লোকটা আমাদের এই মিশনের বিষয়ে এত কিছু জানলই বা কীভাবে? আমার মাথা কাজ করছে না কিন্তু লোকটাকে এখনই কারোর সামনে আনা যাবে না আমি আর কিছুক্ষণেই এম-এর বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছোব আমাদের মুখোমুখি বসে কথা বলা প্রয়োজন আমি এম-কে ফোন করছি লোকটার নাম তুফান বাড়ি নৈনিতাল, উত্তরাখণ্ড অন্তত সেটুকুই সে বলেছে কিন্তু আমার সন্দেহ হয়
আপনি বলছেন যে, আপনি অ্যাপ্লায়েড ম্যাথেমেটিক্সের ছাত্র? আপনার কোনো অ্যাকাডেমিক কাগজপত্র, সার্টিফিকেট, এসব আপনি কিছু দেখাতে পারেন?” এম তুফানকে জিজ্ঞেস করে লোকটা দু-পাশে ঘাড় নাড়ে অর্থাৎ, না আমারও লোকটাকে অদ্ভুত মনে হয় অথচ কী অসম্ভব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই না সে আমার পাশে দাঁড়িয়ে তখন বলে উঠেছিল, “আপনাদের ক্যালকুলেশনে কোনো ভুল নেই! এই মিশনকে নিয়ে আপনাদের সত্যিই আরও ভাবা উচিত!”
আপনি প্লিজ আমাদের সঙ্গে একটু সহযোগিতা করুন,” আমি পাশ থেকে বলি, “আপনি কে, কোথা থেকে এই মিশনের বিষয়ে জেনেছেন, এসব খুলে না বললে আমরা কিছুতেই আপনার কথাকে সরকারিভাবে গুরুত্ব দিতে পারব নালোকটা শোনে কিন্তু বলে না কিছুই
কোথাও একটা ভুল হচ্ছে আমাদের,” এম ঘাড় নাড়ছে ওর মোবাইলে মেইলের নোটিফিকেশন আসেএই তো, প্রফেসার শ্রীধর ক্যালকুলেশনটা দেখে পাঠিয়েছেন, আরথেমে যায় এম, “উনি বলছেন, আমরা কোথাও ভুল করছি এমনটা হওয়া ফিজিক্যালি অসম্ভবআমি ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে প্রফেসার শ্রীধরের জবাবটা দেখতে শুরু করি লোকটার কথা আমরা যেন ভুলে যাচ্ছিলাম লোকটা উঠে দাঁড়ায়আমাকে যেতে হবে এবার,” তুফান বলে আশ্চর্যের বিষয়, আমাদের দুজনের কারোরই মনে হয় না ওকে আমাদের আটকানো উচিত

[পরে আমরা বসে ভেবেছিলাম তুফান কেবল আমাদের সাবধান করে দিতেই এসেছিল কিন্তু ওর কথায় আমরাও বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি নিজেদের গণনার ওপর আমরা নিজেরাই সন্দিহান ছিলাম]

[]

[ওয়ার্মহোল বিষয়টা এখানে একটু পরিষ্কার করে নেওয়া প্রয়োজন অন্যভাবে দেখলে তাকে মহাজাগতিক সময়ের কুঞ্চন হিসেবে ভেবে নেওয়া যেতে পারে সহজভাবে যদি বলতে হয়, এই মহাকাশ বা মহাবিশ্বে আমরা যে-স্পেস বা পরিসরের মধ্যে দিয়ে চলেছিসময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অবস্থান পরিবর্তিত হচ্ছে এমনটা তো হতেই পারেমহাবিশ্বে আরও একটি সমান্তরাল সময় আরও একাধিক ভিন্ন পরিসর বা স্পেসের অস্তিত্ব রয়েছে যদি কোনো বিরল, অজ্ঞাত মহাজাগতিক ঘটনার ফলে দুইটি সমান্তরাল স্পেস বা ব্রহ্মাণ্ড-পরিসর, একই সময়ে একই বিন্দুতে এসে হাজির হয়তাহলে তখন সেই দুইটি সমান্তরাল ব্রহ্মাণ্ড-পরিসরের মধ্যে একটি সরাসরি যোগাযোগের পথ সে-সময়ে তৈরি করা সম্ভবঠিক যেন এক সুড়ঙ্গের মতো সময়ের সেই বিরল সমাপতনকে কাজে লাগিয়ে, সেই সুড়ঙ্গ বাওয়ার্মহোলদিয়েই কেউ বোধহয় তখন ঠিকই পাড়ি দিতে পারে এক ব্রহ্মাণ্ড থেকে সমান্তরাল আর-এক ব্রহ্মাণ্ডে; যদিও বিজ্ঞানীরা এই তত্ত্বের বাস্তবতা নিয়ে উৎসাহী নন
সমান্তরাল আরও ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্বকে মানতে তাঁরা বরাবরই অস্বীকার করেন কাজেইওয়ার্মহোল’-এর বদলেব্ল্যাক-হোলতত্ত্বকে নিয়েই তাঁরা অনেক বেশি মাতামাতি করেন যদিও সেই ব্ল্যাক-হোলের ওপারেও যে আদতে কী রয়েছে, আজ অবধি সেই নিয়েও তাঁদের কাছে কোনো স্পষ্ট সদুত্তর নেই]

২৯ আগস্ট, ২০ উগ্রসেন কি বাউলি, নয়াদিল্লি
এম আর আমি বসেছিলাম এর মধ্যে প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত অন্তত আরও সাতজন প্রফেসারকে আমরা আমাদের আশঙ্কার কথা জানিয়েছি কোনো ফল হয়নি অঙ্কের গলদ বের করতে না পারলেও, কেউই আমাদের আশঙ্কাকে গুরুত্ব দিতে চাননি তুফানের কথা স্বভাবতই আমরা কাউকে জানাতে পারিনি কিন্তু তুফান আমাদের চিন্তার বিষয় ছিল না আমরা কেবল ভাবছিলাম, এই জটিল রহস্যের সমাধান কোথায়
আমাদের অঙ্ক বলছেঠিক যে-সময়ে আমাদের রকেট সেই গ্রহাণুর কাছাকাছি পৌঁছোবে, সেই একই সময়েএকই জায়গায় বিরাট একটি ওয়ার্মহোল তৈরির সুস্পষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে অবশ্যই আমরা জানি না সেই ওয়ার্মহোলের গন্তব্য কোথায়, বা আদৌ তার কোনো সুনির্দিষ্ট গন্তব্য নির্ণয় করা সম্ভব কিনা তাত্ত্বিক বিজ্ঞান আমাদের কেবল এইটুকুই বলতে পারে এম আর আমি নতুন করে আমাদের গণনাকে নেড়েঘেঁটে দেখি কোথাও কোনো ভুল বের করতে পারি না ওয়ার্মহোলের কাছাকাছি এলে, আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার আস্ত একটি রকেটের ওপরেও যে সেই অদ্ভুত ওয়ার্মহোলের কী প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে, তাও আমাদের অজানা তাই শেষ অবধি কোনোভাবেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো যাচ্ছে না শেষ আগস্টের নয়াদিল্লি আজকাল বেশ ভ্যাপসা বোধ হয় উগ্রসেন কি বাউলির এই নির্জনতা আমাদের শান্ত মনে ভাবতে সাহায্য করে কিন্তু সেই ভাবনায় ফল হচ্ছে কই?

কিছু ভুল বের করতে পারলেন?” তুফান আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে
আপনি!” আমরা দুজনেই অবাক হয়ে যাই, “আপনি নৈনিতাল ফিরে যাননি?” এম জিজ্ঞেস করে দু-পাশে ঘাড় নাড়ে তুফান, “নাহ্, কিছু কাজ রয়েছে দিল্লিতে সেইজন্যই এখানে রয়ে গিয়েছি -দিনআমরা ওকে পাশে বসতে জায়গা করে দিই তুফান বসেআপনাদের অঙ্কে কোনো ভুল নেই,” আবারও বলে তুফান, “এটুকু বলতে পারি, সঠিক সময়ে ওই ওয়ার্মহোল আপনাদের রকেটের কাছাকাছিই সে-সময়ে ফুটে উঠবে, আর তারপর…” সে চুপ করে যায় হঠাৎ
তারপর?” আমি অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করি তুফান তবুও চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ
আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে এখনও সে উত্তর অজানা কিন্তু…” কেমন এক দার্শনিক ভঙ্গিতে সে বলে, “এর ফল খুবই বিপজ্জনক হতে পারে
কী সেই বিপদ?” আমি জিজ্ঞেস করি আবার

২৯ আগস্ট, ২০ নয়াদিল্লি রাত ১১টা ২১
নিজের বাড়িতে বসে আছি যা দেখলাম, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না কোনোভাবেই খটকাটা যেন কিছুতেই কাটছে না এম-কে ফোন করব? যা দেখলাম সেইটিই আগে লিখে রাখি বরং
উগ্রসেন কি বাউলি থেকে আমরা একসঙ্গেই বেরোলাম অনেক প্রশ্নের পরেও কিছুতেই যখন তুফান কিছু বলতে রাজি হল না, তখন আমরাও নিজের মনে ভেবে নিয়েছিলামএই নতুন, অদ্ভুত লোকটি যতই অনেক কিছু জেনে ফেলার ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াক, আধুনিক বিজ্ঞান যে-প্রশ্নের উত্তর দিতে এখনও অপারগ, সে-বিষয়ে বোধহয় সত্যিই তার কিছু বলা সাজে না

[তুফানকে আমরা সন্দেহ করেছিলাম, নাকি অবজ্ঞা করেছিলাম, আমাদের জানা নেই ওকে নিয়ে আমাদের সমস্ত ভাবনাচিন্তাগুলোই, যেন সবসময়ে কেমন এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে থাকত অবশ্য এর কারণ আমরা পরে জেনেছিলাম]

তুফানকে আমিই প্রস্তাব দিয়েছিলাম, এম-কে নামিয়ে যদি কাছাকাছি কোথাও নামতে চায়আমার গাড়িতে ওকে ছেড়ে দিতে পারি আমার কোনো অসুবিধে হবে না তুফান এককথায় রাজি হয়ে গেল গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আমরা কস্তুরবা গান্ধি মার্গ আর তলস্তয় রোডের মোড়টায় এসে দাঁড়িয়েছি ঠিক সে-সময়েই ঘটনাটা ঘটে গেল হঠাৎ
আমাদের গাড়িটা সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ছিল চারমাথার মোড়ে রাস্তার ওপাশ থেকে ঠিক তখনই, সিগন্যাল খোলা থাকার শেষ কয়েক সেকেন্ডের সুযোগ নিতে গিয়ে, শোঁ করে একটা দামি বিএমডব্লিউ হঠাৎই প্রচণ্ড বেগে বেরিয়ে, ডানদিকে ঘুরে এগোল একইসময়ে অল্পবয়সি একটি ছেলে, ময়লা কাপড় পরনে, হাতে রাংতা মোড়ানো এক-একটি করে গোলাপফুলে সাজানো একখানি ডালা নিয়ে অসাবধানে রাস্তা পার হতে গেল বিকেলের রাজধানীতে এমন এক-একটি ছেলেকে প্রায়শই এমন সব হেরিটেজ পার্ক চত্বরে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় আমি চোখ বুজে ফেলেছি সেই প্রবল বিএমডব্লিউয়ের চাকার তলায় চাপা-পড়া থেকে ছেলেটিকে বাঁচানো তখন স্বয়ং ভগবানেরও অসাধ্য বলা যায় আমি কান পেতে ভাবছি কখন সেই এক-একটা বিকৃত চিৎকার শুরু হবে চারপাশ থেকে, আর তখনইএম আমার কাঁধে চাপড় মারছে, “গাড়ি স্টার্ট দাও, ঘোরোদ্যাখো, কী হয়েছে!” অসম্ভব! আমি চোখ মেলে দেখি সেই সেকেন্ডের ভগ্নাংশের ভেতরেই তুফান কেমন করে জানি আমার পাশের সিট থেকে সিটবেল্ট খুলে নেমে একছুটে গিয়ে পৌঁছেছে সেই ছেলেটির কাছেএক ধাক্কায় তাকে কোনোমতে সরিয়ে ফুটপাথের ওপাশে ফেলতে না ফেলতেই ওদের কান ঘেঁষে সেই বিএমডব্লিউ গাড়িটাও সটান বেরিয়ে গেছে তার গন্তব্যের অভিমুখে ঘটনার আকস্মিকতায় লোকজন হইহই করে উঠেছে সবাইতুফান, সার্থক নাম তোমার!” বাকি রাস্তাটুকুতে আমি কেবল এটুকুই বলতে পেরেছিলাম

এম ফোন করছেহ্যাঁ বলো, এত রাত্তিরে হঠাৎ?”
ঘুম আসছে না যা দেখলাম, এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি নাআমার বুকের ভেতর থেকে একটা শ্বাস পড়ে, “যাক, অবিশ্বাসটুকু তাহলে কেবল আমার একার নয়” “একদমই নয়,” ওপাশ থেকে জবাব দেয় এম, “এক সেকেন্ডও নয়ন্যানোসেকেন্ডের ব্যবধানে ওভাবে অতদূর ছুটে যাওয়া কোনো মানুষের পক্ষে অসম্ভব উসেইন বোল্টও এই কাজ করতে পারবে না আমরা…” এম চুপ করে যায় তুফানের বিষয়টা সবদিক থেকেই কেমন রহস্যময় হয়ে উঠছে কিন্তু আবারও যেন আমরা আমাদের অন্য চিন্তাতে তলিয়ে যাই

[]

২০ সেপ্টেম্বর, ২০ নয়াদিল্লি
গতকাল খোদ প্রধানমন্ত্রীর দফতরে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সচিবের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন গোয়েন্দাপ্রধান ভি শিবরামকৃষ্ণন গুপ্তচর সংস্থা ’-এর অধিকর্তা স্বয়ং আমাদের জানানো হয়েছে, ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার পাশাপাশি অন্তত আরও দুই থেকে তিনটি দেশ একই সময়ে, একই উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের রকেট উৎক্ষেপণ করতে চলেছে গোয়েন্দাদের কাছে সেই মর্মেই খবর এসে পৌঁছেছে অর্থাৎ অজানা গ্রহের আগন্তুকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে আমরাই এই পৃথিবীতে আর একমাত্র আগ্রহী পক্ষ নই

২২ সেপ্টেম্বর, ২০ নয়াদিল্লি
এম বা আমার সঙ্গে তুফানের আর দেখা হয়নি আজ রাতেই বিশেষ বিমানে আমরা কাজাখস্তানের উদ্দেশে রওনা দেব কড়া নিরাপত্তায় আমাদের বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হবে মিশনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আর প্রায় সকলেই ইতিমধ্যে কাজাখস্তানে গিয়ে পৌঁছেছেন সব যন্ত্রপাতিও ইতিমধ্যেই বৈকানুর কসমোড্রোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সাধারণভাবে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশ তাদের যে-কোনো মহাকাশ অভিযানের সম্পর্কে অন্যান্য দেশকে জানিয়ে রাখে এমনটাই আন্তর্জাতিক নিয়ম কিন্তু এবারেই অদ্ভুত এক নীরবতা গোয়েন্দাদের তরফে আমরা সবটুকুই জানতে পেরে গিয়েছি মোট তিনটি রকেট, কমবেশি একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহাকাশের একই অঞ্চলের দিকে, একইসঙ্গে রওনা হতে চলেছে তবে আশা করা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট গ্রহাণুর ওপর অবতরণের সময় তারা ভিন্ন ভিন্ন ল্যান্ডিং সাইট বেছে নিয়েছে এই বিষয়ে পাকা খবর না থাকলেও, অন্য তিনটি রকেটের উৎক্ষেপণ-স্থল এবং আনুমানিক উৎক্ষেপণের সময় থেকেই এই বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে

২২ সেপ্টেম্বর, ২০ হিন্দান এয়ারবেস, নয়াদিল্লি রাত ১১টা ০৫
আমরা বায়ুসেনার বিশেষ বিমানে উঠে বসেছি প্রতিরক্ষামন্ত্রক থেকে শেষ একটি কমান্ড-শিট আর কিছুক্ষণে আমাদের পাইলটের কাছে এসে পৌঁছোলেই আমরা রওনা হতে পারব আমি জানলার পাশে বসে বাইরের দিকে তাকাই এম আমার পেছনের আসনে বসেছে দূরে বিমানঘাঁটির আলো ঝলমল করে আমরা রানওয়ের ওপর বিমানে আমাদের সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন সেনা অফিসার রয়েছেন আমার কেমন অদ্ভুত মনে হচ্ছিল কমান্ড-শিট এসে গিয়েছে বোধহয় বিমানের ইঞ্জিন গর্জন করে ওঠে বায়ুসেনার বিশেষ বিমান রানওয়ে ধরে ছুটতে শুরু করেছে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের আসনে বসা এম-এর দিকে তাকাই সে চোখ বুজে রয়েছে বিমান মাটি ছাড়ল মিনিট পাঁচেক পরেই আমি কাচের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, ডানদিক দিয়ে খানিক দূরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান আমাদের ঠিক পাশেপাশেই উড়ে চলেছে এক সেনা অফিসারের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়ে গেল তিনি হাত তুলে আমায় আশ্বস্ত করেন

[পরে জেনেছিলাম, নয়াদিল্লি থেকে কিজিলোর্দা এয়ারবেস (বৈকানুর কসমোড্রোম থেকে যার দূরত্ব কমবেশি ২৫০ কিলোমিটার), এই সমস্ত পথটুকুই ভারতীয় বায়ুসেনার তরফে তিনটি তেজস্ যুদ্ধবিমান আমাদের এসকর্ট করে চলেছিল নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় আমরা আকাশপথে পাড়ি দিয়েছিলাম]

২৩ সেপ্টেম্বর, ২০ কিজিলোর্দা এয়ারবেস বৈকানুর কসমোড্রোম, কাজাখস্তান
কিজিলোর্দা এয়ারবেস থেকে বৈকানুর কসমোড্রোম, কমবেশি ২৫০ কিলোমিটার শহর ছেড়ে বেরোতেই, পুরো রাস্তা জুড়ে দু-পাশে শুধুই ধু-ধু স্তেপ অঞ্চল কেবল বেলেমাটি আর বেঁটে বেঁটে ঝোপ-জাতীয় গাছ তবে কালো ফিতের মতো ছিপছিপে সেই রাস্তা ভারী চমৎকার পরপর কয়েকটা শক্তপোক্ত হামভি গাড়ির কনভয় পথে জনমানব নেই আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি এম- বসেছে আমার ঠিক পাশেই আর মাত্র কয়েকদিন এরই মধ্যে শেষ মুহূর্তের সবকিছু দেখেশুনে নিতে হবে ইতিমধ্যে আমরা আমাদের আগের আশঙ্কার বিষয়টা নিয়েও আর কোনো আলোচনা করিনি হয়তো বা মনে মনে আমরা ভেবেই নিয়েছি, আমাদের গণনায় ভুল ছিল কোথাও মহাকাশবিজ্ঞানের ইতিহাসে আমরা এক অবাক সন্ধিক্ষণের মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়েছি এখন, এখান থেকে পিছু হটে আসারও আর কোনো সুযোগ নেই সামনে একটি উটের ক্যারাভ্যান দেখতে পাই সামনে বসে-থাকা সেনা অফিসার আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, “উজবেক যাযাবরের দল এখনও বৃহত্তর এশিয়া মহাদেশের এই অংশে যাযাবর প্রজাতিদের একটা বিরাট প্রভাব দেখা যায় যদিও পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে চারণভূমি কমে আসায় অতীতের যাযাবরী পেশা ধরে রাখতে এখন তাদেরও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে
আমরা যাযাবর দলের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাই সম্পূর্ণ দল এখানে নেই বোধহয় তাও পরপর সার বেঁধে চলেছে অন্তত পঞ্চাশটি উটের সেই ক্যারাভ্যান আমি হামভি গাড়ির জানলার কাচটুকু একটু নামাই ওরা গান গাইছে ভারী মিষ্টি সুর যেন তাতে সেই ধু-ধু স্তেপের ঢেউ-খেলানো ভূমিরূপ আর শনি-মনসা গাছের গন্ধ লেগে থাকে আরামে চোখ বুজে আসতে চায় আমাদের গাড়ির ড্রাইভার স্থানীয় লোক ক্যারাভ্যান পেরিয়ে যাওয়ার পর সে আমাদের দিকে তাকায়, “কী গান গাইছিল ওরা, জানেন স্যার?” সে জিজ্ঞেস করেনা তো, কী গান?” আমি পালটা জিজ্ঞেস করি সেও গুনগুন করে গানটা দু-কলি গেয়ে শোনায় সে বলে, “এর মানে হচ্ছে, স্যারখোলা আকাশের নীচে আমাদের তাঁবু পড়ুক, হু-হু হাওয়ায় উদাসী হোক সব, খোলা আকাশের নীচে অনেক রাত্তির যখন, পাশাপাশি চিত হয়ে শুয়ে তুমি আর আমি আকাশের তারা গুনতে চাই!এম হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করে, “ক্যারাভানের একদম শুরুতে, ঠিক দলপতির পেছনেই যে লোকটা ছিল, তাকে কি ভালো করে লক্ষ করেছিলে?” আমি ঘাড় নাড়িতাহলে থাক…,” এম চুপ করে যায় আমি চোখ বুজে গানের কথাগুলো ভাবতে থাকি এম-এর প্রশ্ন আমার মনে কোনো দাগ কাটে না

[]

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০ স্থানীয় সময় রাত ১টা বেজে ৫১ মিনিট বৈকানুর, কাজাখস্তান
টি মাইনাস নাইন মিনিটস নাউ!গমগমে স্পিকারে ঘোষণা ভেসে আসে রকেট ছাড়তে আর নয় মিনিট রকেটে ওঠার আগে আজ সকালেই আমি এম-কে এই মিশনের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে এসেছি কনট্রোল রুম থেকে আমরা সকলে এখন বিরাট পর্দায় চোখ রেখে দেখছি, আমাদের রকেট প্রস্তুত ফাইনাল কাউন্টডাউন শুরু হচ্ছে দশ, নয়, আট, সাতথ্রাস্টারে আগুনের ফুলকি দেখা যাচ্ছে লঞ্চিং প্যাডের ভাইব্রেশন স্পষ্ট রকেট মাটি ছাড়বে তিন, দুই, একপ্রচণ্ড গর্জনে মাটি ছেড়ে মহাশূন্যের অভিমুখে আমাদের আকাশযান স্পষ্ট তার চলন দেখা যাচ্ছে গতিপথের কোথাও এতটুকু বিচ্যুতি নেই টি প্লাস ওয়ান, টি প্লাস টু, টি প্লাস থ্রিনতুন গণনা শুরু হয়ে গেছে এবার আধঘণ্টার ভেতরেই রকেটের কনট্রোল রুমের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয়ে যাবে ততক্ষণ সব ঠিকমতো চলুক

২৮ সেপ্টেম্বর, ২০ স্থানীয় সময় দুপুর ৩টে বেজে ১৭ মিনিট বৈকানুর, কাজাখস্তান
আমাদের রকেট মহাকাশে এখন এম-এর সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেই আমাদের কথা হয়েছে রকেটের বিভিন্ন অংশে লাগানো ক্যামেরাগুলিও তাদের কাজ করতে শুরু করেছে গ্রাউন্ড কনট্রোল রুমে সেগুলির লাইভ ফিড আসছে আমরা দেখতে পাচ্ছি মহাশূন্যের অন্ধকার ভেদ করে আমাদের আকাশযান অবিরাম এগিয়ে চলেছে যদিও নির্দিষ্ট লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছোতে আমাদের সময় লাগবে এখনও প্রায় বত্রিশ ঘণ্টা উনচল্লিশ মিনিট আমি চোখ বুজে নিজের মনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করি নতুন ইতিহাস লিখতে আর সত্যিই সময় বাকি কিছুক্ষণ

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০ স্থানীয় সময় রাত ২টো বৈকানুর, কাজাখস্তান
আমরা হয় সেই গ্রহাণুকে পেরিয়ে এসেছি, নয়তো আমাদের গণনায় বড়ো কোনো ভুল থেকে গিয়েছে কোথাও আমার শেষ ডায়ারি-এন্ট্রির পরেও বত্রিশ ঘণ্টা পেরিয়ে, রকেট এখন প্রায় পঁয়ত্রিশ ঘণ্টা ধরে উড়ে চলেছেঅথচ এখনও মহাকাশে কোনো গ্রহাণু বা ধূমকেতুর ভাঙা অংশ, এমন কোনো কিছুরই দেখা পাওয়া যাচ্ছে না রকেটের কনট্রোল রুম থেকে আমরা যা জানতে পারছিচাঁদের পাশ ঘেঁষে আমাদের রকেট এখন মঙ্গল আর শুক্রের অভিমুখে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছেঅ্যালার্ট, অ্যালার্ট!” রকেটের কনট্রোল রুম থেকে এম-এর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, “নতুন রকেট দেখা যাচ্ছে নতুন একাধিক অবজেক্ট হ্যাঁ - এক, দুইমোট তিনটি স্পেসক্র্যাফ্ দেখা যাচ্ছে তিনদিক থেকে এগিয়ে আসছে!” গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্যে এতটুকু ভুল ছিল না আমেরিকা, চিন জার্মানিএই তিনটি দেশের পতাকাও এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মহাকাশের বিরাট পরিসরে, চারখানি রকেটচারটি নির্দিষ্ট গতিপথ, কিন্তু সেই গ্রহাণুর অস্তিত্ব কোথায়! ঠিক সেই সময়ে, আমাদের রকেটের একেবারে সামনে লাগানো বিশেষ রেডিয়ো-অপটিক্যাল ক্যামেরার লাইভ ফিড আমাদের সকলকে বাকরুদ্ধ করে দিল আমরা শুনতে পাচ্ছি, এম-সহ রকেটে থাকা আরও তিন নভশ্চরের চূড়ান্ত আতঙ্কগ্রস্ত চিৎকার আমাদের আর কিচ্ছুটি করার নেই অন্ধকার মহাকাশে এক বিরাট হাঁ-মুখ খুলে গেছে হঠাৎ!
মহাকাশের সে এক অনন্য রূপ! এক মহাকাশের নয়এক আকাশ পেরিয়ে সেই অন্য মহাকাশের! সেই ওপারের যতটুকু রকেট-ক্যামেরার মাধ্যমে আমাদের চোখে পড়ছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি সেই মহাকাশের রং নীল আকাশি নয়, সমুদ্রের জলের মতো রং তার আর সেই নীল সমুদ্রের মাঝেই যেন ভেসে বেড়াচ্ছে, একটি নয়, দুটি নয়মোট চারটি বিরাট আগুনের গোলক নতুন ব্রহ্মাণ্ডে কি তাহলে চার সূর্যের রাজত্ব? কিন্তু আমাদের রকেটের কী হবে এখন? আমার চিৎকার করে এম-কে বলতে ইচ্ছে করছে, “এম, তুমি ঠিক! আমরা ঠিক! আমাদের গণনায় ভুল ছিল না কোথাও!” কিন্তু তার আগেই গ্রাউন্ড কনট্রোল রুমের রেডিয়োয় ওপার থেকে পরিত্রাহি চিৎকার ভেসে আসে
হেল্প! হেল্প! বাঁচাও!” চারটি রকেটই প্রচণ্ড বেগে সেই নতুন মহাকাশের দিকে, নতুন ফুটে-ওঠা সেই অতল সমুদ্রনীল গহ্বরের দিকে বাধাহীন ছুটে চলেছে রকেটগুলির ওপর রকেট-যাত্রীদের আর এতটুকুও নিয়ন্ত্রণ নেই চিন আর জার্মানির দুটি রকেট প্রচণ্ড কাছাকাছি চলে এসেছে বিস্ফোরণ! আমাদের ক্যামেরাগুলি এখনও কাজ করে চলেছে আমরা দেখছি, আগুনের গোলার মতো ধাতব টুকরো চারপাশ থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে এদিকে আমেরিকার রকেটটি আকারে বড়ো ভারী হওয়ার কারণে আমাদের রকেটকে ছাড়িয়ে দুর্বার গতিতে সেই মহাজাগতিক ওয়ার্মহোলের দিকে এগিয়ে চলেছে আর কিছু করার নেই হঠাৎই এক তীব্র আলোকবিন্দুর বিস্ফোরণ তার পরেপরেই সেই রকেটটিকে আর দেখা গেল না কোথাওএম! এম!” আমি গ্রাউন্ড কনট্রোল রুমের মাউথপিসে মুখ রেখে চিৎকার করে চলেছি বিইপ  বিইপআর ছবি আসছে নাকমিউনিকেশন ফেলিয়োর! সিভিয়র কমিউনিকেশন ফেলিয়োর!গ্রাউন্ড কনট্রোল রুমের স্পিকারে কেউ একটানা চিৎকার করে চলেছেএম!” বিইপবিইপসব আওয়াজ থেমে গেল হঠাৎ বিরাট পর্দা জুড়ে এখন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার

[]

টাইবার নদীতীর, রোম ১১ নভেম্বর, ২০ স্থানীয় সময় সকাল ১০টা
এম আর আমি পাশাপাশি বসেছিলাম সেই ভয়াবহ ঘটনার পর দেড়মাস কেটেছে কনট্রোল রুমের পর্দায় অন্ধকার নেমে আসার পর আরও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট আমরা আমাদের রকেটের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারিনি এক-একটা মিনিট, সেকেন্ড কীভাবে কেটেছিল, এখনও ভাবলে পরেই আমার গা শিউরে ওঠে শেষ অবধি প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর হঠাৎই পর্দায় আবারও ছবি ফুটে ওঠে স্পিকারে আবারও এম-এর কণ্ঠস্বর শোনা যায়ফিরে আসছি, মিশন অ্যাবর্টআমরা ফিরে আসছি!” স্রেফ এইটুকু বক্তব্য আমরা আলাদা করে আর কোনো নির্দেশ পাঠাইনি তিনদিন পর দক্ষিণ অতলান্তিক মহাসাগরে আমাদের রকেট নিরাপদে অবতরণ করে
অন্যান্য দেশগুলি কীভাবে তাদের রকেট অথবা নভশ্চরেদের দুর্ঘটনার খবর প্রকাশ্যে এনেছিল, বা আদৌ তারা কোনো সংবাদমাধ্যমে সেই বিষয়ে কিছু জানিয়েছিল কিনা, আমরা জানতে পারিনি অন্তত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এই বিষয়ে কোনো খবর প্রকাশিত হয়নি আমাদের নভশ্চরেরা সকলেই অক্ষত ছিলেন মূলত মানসিক আতঙ্ক ছাড়া তাঁরা আর কোনো শারীরিক আঘাত পাননি ওয়ার্মহোলের মুখে পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা সকলে জ্ঞান হারিয়েছিলেন বেশ কিছু সময় পর তাঁদের জ্ঞান ফেরে যখন, তাঁরা দেখেন অদ্ভুত কোনো মিরাক্লে তাঁদের রকেট আবারও পৃথিবীর অভিমুখে ফিরে চলেছে পেছনে তাকিয়ে, নানা যন্ত্রপাতির সাহায্যে নানা পর্যবেক্ষণ চালিয়েও তাঁরা সেই ওয়ার্মহোলের আর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাননি সবকিছুই যেন কেমন ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল কেবল, এম-এর সঙ্গে পরে আমার আলাদা করে কথা হয় সরকারি স্তরে উচ্চ-পর্যায়ের ডি-ব্রিফিংয়ের সময়ও এম সেই কথাগুলো কাউকে বলেনি কারণ বললেও সেকথা কেউ বিশ্বাস করত না উলটে এম-কে সকলের হাসির খোরাক হতে হত
টাইবারের তীরে আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম তিনদিনের আন্তর্জাতিক মহাকাশ কংগ্রেস সম্মেলন ভারত থেকে আমরা দুজনেই এই সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছি এই নিয়ে বেশ কয়েকবারই আমি রোমে এলাম এম- এর আগে এই শহরে এসেছে শহরের এই জায়গাটা ঘুরে বেড়ানোর পক্ষে ভারী মনোরম আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম
এতদিন পর এম-এর সেই কথাগুলোই আমার মনে পড়ছে
তারপর কনট্রোল প্যানেলের ওপর খুব জোরে আমার মাথা ঠুকে গিয়েছিল বাকিরা সবাই ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে আমি সামনের দিকে তাকিয়ে দেখছি, আমাদের রকেট সেই ওয়ার্মহোলের প্রায় কিনারা অবধি গিয়ে পড়েছে ফিরে আসার আর কোনো উপায় নেই সেই নতুন ব্রহ্মাণ্ড আমাদের টানছে কী প্রচণ্ড সেই টান! আমি বাঁচবার সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম কেবল মনে হয়েছিল, অন্তত নতুন এক পৃথিবী দেখে মরতে পারব কেমন সেই পৃথিবী, কেমনই বা সেখানকার মানুষএই নিয়ে কোনো ভয় বা আশঙ্কা করার মতো পরিস্থিতিও তখন ছিল না ঠিক সেসময়েই আমি জানলার বাইরের দিকে তাকাই

জানলার বাইরে তাকিয়ে এম তুফানকে দেখেছিল!
তুফান!
সুপারম্যান?
এম আমাকে আগে বলেনি, সেই উজবেক যাযাবরদের দলেও সে তুফানকে লক্ষ করেছিল যদিও মহাশূন্যে তুফানকে দেখে চেনাই যাচ্ছিল না প্রায় তার পরনে ছিল এক অদ্ভুত উজ্জ্বল রঙের পোশাক তার মাথায় কোনো হেলমেট ছিল না মহাশূন্যে তুফান কেমনভাবে শ্বাস নিচ্ছিল, এম বুঝতে পারেনি কেবল সে দেখেছিল, অভাবনীয় কোনো শক্তির সাহায্যে সে তাদের রকেটের একদিক আঁকড়ে ধরে ওয়ার্মহোলের অভিমুখে তার গতিরোধ করার চেষ্টা করছে এম বিশ্বাস করতে পারেনি অতিমানব সুপারম্যানের গল্প সে কমিক্সের পাতায় পড়েছে অনেকবার কিন্তু বাস্তবে এমন! তুফান কিছু বলছে! অদ্ভুত বিস্ময়ে এম বুঝতে পারে, তার চিন্তার মধ্যে দিয়ে সে তুফানের কথা শুনতে পাচ্ছে রকেট পরিচালনার বিষয়ে তুফান কিছু নির্দেশ দিচ্ছে এম-এর আর কিছু ভাবার অবকাশ ছিল না তুফান লড়ে যাচ্ছে তারই মধ্যে মস্তিষ্কের তরঙ্গের মাধ্যমে ভেসে-আসা তুফানের সেই নির্দেশগুলোই সে একে একে অনুসরণ করতে শুরু করে এরপর আর তার কিছু মনে নেই তুফানকেও আর দেখা যায়নি কোথাও

শান্ত টাইবারের জল আমার মাথার ভেতর কথা বলছে কেউ! এম আমার দিকে তাকায় আমরা দুজনেই তুফানের কথা শুনতে পাচ্ছি
মিস্টার অ্যান্ড মিস ______, আপনারা আমার অভিবাদন জানবেন!” তুফান আমাদের আসল নাম জানে! আমরা এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না আমরা দুজনেই কান পেতে শুনে যাচ্ছি কেবল নাকি বলব, আমাদের মস্তিষ্কে তুফানের কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে? আমরা সেই ধ্বনিকে আমাদের বোধ-ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করে চলেছি
আমি বা আমরা, বহুকাল ধরেই আপনাদের গ্রহে অবস্থান করছি আমাদের কোনো নিজস্ব গ্রহ নেই বাসস্থান নেই এককালে ছিল বোধহয় কিন্তু সেই উজবেক বন্ধুদের মতোই, মহাকাশে আপনারা আমাদের যাযাবর গোষ্ঠী হিসেবে ধরে নিতে পারেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা ঠিক এমনিভাবেই গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে তাঁদের ঠিকানা খুঁজে নিতেন আমাদের লক্ষ্য ছিল ব্রহ্মাণ্ডের শান্তি বজায় রাখা নক্ষত্রযুদ্ধের সমস্ত সম্ভাবনা তাড়ানো
নিজের মস্তিষ্ককেও আর আমার বিশ্বাস হচ্ছে না কোনোমতে আমি চিন্তা করতে চেষ্টা করি, “আপনারা এই পৃথিবীতে কতদিন আছেন? কতজন আপনার মতো মানুষ এই গ্রহের বাসিন্দা?”
উত্তর আসে, “কয়েক হাজার বছর কিন্তু আমরা -জন এই মুহূর্তে আপনাদের গ্রহে রয়েছি, সেই তথ্য সঠিক করে আমি নিজেও বলতে পারি না কারও কারও সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ থাকলেও, আমরা সকলে একে-অপরের সঙ্গে সবসময়ে যোগাযোগ রেখে চলতে পারি না জানবেন, আমাদের মতো এমন অজস্র প্রতিনিধি মহাবিশ্বে, ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন অংশে ঘুরে বেড়ায় কোনো-কোনো সময়ে এক গ্রহ থেকে আর-এক গ্রহে তারা পাড়ি দিয়ে যায় আমি নিজে প্রায় সত্তর বছর আগে আপনাদের এই গ্রহে এসে নেমেছিলাম আপনাদের গ্রহে আমার মতো অন্তত আরও তিনজনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে কিন্তু তারাও এখন ঠিক কোথায়, জানা নেই আমার
একইভাবে এম প্রশ্ন করে এবার অবাক বিস্ময়ে আমি নিজেও মস্তিষ্কের মাধ্যমে সেই প্রশ্ন শুনতে পাইএই ওয়ার্মহোলের বিষয়ে আপনি জানলেন কীভাবে?” উত্তর দেয় তুফান, “আপনারা ওয়ার্মহোলের ওপারে যে ব্রহ্মাণ্ড দেখেছেন, আমাদের ভাষায় ওর নাম ভিকে-ইয়ারকুং মহাজাগতিক অতীতে অনেকবার এই ভিকে-ইয়ারকুংয়ের বাসিন্দারা অনেক গ্রহ, নক্ষত্র এমনকি ক্ষুদ্রতর ব্রহ্মাণ্ডেরও ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ওদের লক্ষ্য থাকে এক-একটি গ্রহ বা ব্রহ্মাণ্ডকে বেছে নিয়ে, সেই গ্রহের বাসিন্দা অথবা তাদের দ্বারা নির্মিত বিজ্ঞানের ছোটোখাটো কোনো নিদর্শন মহাকাশ থেকে কোনোভাবে হাতিয়ে নেওয়া এরপর সেই সংগৃহীত নমুনাগুলিকে কাজে লাগিয়েই ভিকে-ইয়ারকুংয়ের বাসিন্দারা সেই গ্রহ বা অন্যান্য যা কিছু ধ্বংসের পরিকল্পনা সাজায় ওদের লক্ষ্য কেবলই সেই সমস্ত গ্রহ, নক্ষত্র, ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সম্পদকে আত্মসাৎ করা সেই সবকিছুকেই তারা এক বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, বিশেষ এক শক্তি-উৎসে পরিণত করতে সক্ষমযে উৎসের মাধ্যমেই লক্ষ-কোটি বছর পেরিয়েও এক অজর-অমর প্রক্রিয়ায়, তারা তাদের ব্রহ্মাণ্ড অথবা ভিকে-ইয়ারকুংয়ের অস্তিত্ব বজায় রাখে এইবারে ওদের নজর পড়েছিল আপনাদের পৃথিবীর ওপর আমরা সেই খবর জানতে পেরে যাই পৃথিবীতে আমার মতো বাকি তিনজনের কাছেও সেই খবর পৌঁছোয় কিন্তু খুব সম্ভবত, অতি সম্প্রতিই তারা নতুন গ্রহে পাড়ি দিয়েছে বলে এই বিষয়ে তারা আপনাদের কোনো সহায়তা করতে পারেনি একলা আমিই তখন আপনাদের দেশের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করি কিন্তু…” মনে মনে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুফান, “একমাত্র আপনারাই দেখলাম, আমার কথা মন দিয়ে শোনার অন্তত সামান্য চেষ্টা করেছিলেন
তাহলে…” হঠাৎ আমার মাথায় বিদ্যুচ্চমকের মতো একটা ভাবনা খেলে যায় কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই মস্তিষ্ক-তরঙ্গের মাধ্যমে তুফানের জবাব ভেসে আসে, “ঠিক তা-, আমি চিন্তাশক্তির মাধ্যমে বরাবর আপনাদের ভাবনাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করেছি আপনি বলতে পারেন, অন্যান্য দেশের বৈজ্ঞানিকদের ক্ষেত্রেও আমি এই শক্তি ব্যবহার করতে পারতাম ব্যবহার করিনি কারণ, সবকিছুর সমাধান অতিমানবীয় শক্তিতে চলে না সমাধান যার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, তার নিজের মনেও সেই সমাধানের সদিচ্ছাটুকু থাকতে হয় অবাক বিস্ময়ে এতদিনের অভিজ্ঞতায় আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম, আপনাদের গ্রহের বাকি অধিকাংশ মানুষ, ক্ষমতায় বসে থাকা এক-একজনতারা কেবল নিজস্ব পরিসরটুকু, ব্যক্তিগত পরিসরটুকুর বাইরে আর কোনো কিছু নিয়েই কখনও চিন্তা করতে অপারগ বলা বাহুল্য, এতে আমি অত্যন্ত হতাশ হয়েছিলাম
কিন্তু অন্তত একটি রকেট যে আজ ইয়ারকুংয়ের বাসিন্দারা হাতিয়ে নিতে পারল? তার কী হবে এখন?” এম-এর প্রশ্ন তুফান জবাব দেয়, “ইয়ারকুংয়ের বিনাশ নেই আজ না হলে কাল সে আবারও হানা দিত হানা দেবেও কাজেই একটি রকেট তারা হাতিয়ে নিতে পেরেছে বলেই, একেবারে ভেঙে পড়ারও কোনো কারণ নেই পৃথিবীর মানুষও জ্ঞানবিজ্ঞানে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে এই প্রসঙ্গে আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস, একদিন তারাও নিজস্ব ক্ষমতাতেই ভিকে-ইয়ারকুংয়ের মতো শক্তির মোকাবিলা করতে প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা-প্রযুক্তির অধিকারী হবে ততদিন আমরা পাশাপাশি, কাছাকাছি থেকে আমাদের দায়িত্ব পালন করে চলবতুফানের গলা মিলিয়ে যায় আমরা অবাক বিস্ময়ে নিস্তব্ধ বসে থাকি সামনে টাইবারের জল শান্ত প্রবহমান

উপসংহার

     গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত কিন্তু ভারতে ফেরার পরেপরেই মহাকাশ গবেষণা সংস্থার চেয়ারম্যান আমাকে তাঁর চেম্বারে ডেকে পাঠান একটি গোপন রিপোর্ট আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, “পড়ুন
রিপোর্টে লেখা ছিল, গত বছর জাতীয় আর্কাইভের ধুলো ঘেঁটে পরিষ্কার করার সময়ে বিজ্ঞান প্রযুক্তিমন্ত্রকের বেশ কিছু পুরনো নথি হঠাৎই আবারও সকলের সামনে এসেছে সেই নথি অনুযায়ী জানা যাচ্ছে, উত্তরাখণ্ড (সে সময়ের উত্তরপ্রদেশ) রাজ্যের নৈনিতাল হ্রদের ওপর, সত্তরের দশকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের তরফে রাডার সোনার প্রযুক্তি-নির্ভর বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয় সেই গবেষণায় নাকি হ্রদের গভীরে বিরাট এক মসৃণ, ধাতব বস্তুর অস্তিত্ব টের পাওয়া গিয়েছিল অথচ কোনো অজ্ঞাত কারণে সেই নিয়ে তার পরবর্তীতে আর নতুন করে সেই অঞ্চলে কোনো সমীক্ষা হয়নি সেই জিনিসটার গড়ন ছিল নাকি অনেকটা আজকের, আধুনিক সময়ের মহাকাশযানের মতোই! আমি রিপোর্টটা চেয়ারম্যানের হাতে ফিরিয়ে দিইকী ভাবছ, একটু কি তলিয়ে দেখা দরকার আমাদের?” চেয়ারম্যান আমাকে জিজ্ঞেস করেন
আমি কোনো জবাব দিই না কারণ আমি জানি, ওই একই সমীক্ষা এখন যদি আবারও নতুন করে করা হয়, সেখানে আর কোনো কিছুরই অস্তিত্ব মিলবে না আমি এও জানি, প্রথম আলাপের সময়ে তুফান আমাদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলওর বাড়ি নৈনিতাল, উত্তরাখণ্ড আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে শেষমেশ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াই
----------
ছবি - সুকান্ত মণ্ডল

No comments:

Post a Comment