
পিকলুর ডানা
পায়েল চট্টোপাধ্যায়
১
খাঁদুকে দেখলেই পিকলুর গা জ্বলে। ভিজে বেড়ালের
মতো মুখ করে থাকে সবসময়। এদিকে
সেয়ানা। কোনো প্রশ্ন করলেই বইয়ে মুখ
গুঁজে দেয়। পিকলুর সাধের চিলেকোঠার ঘরটাও
দখল করেছে। এমনিতে দাদু ওই ঘরে থাকে। পিকলুরও অধিকার ছিল ঘরটায়। এখন ওই
ঘরটায় গেলেই খাঁদুর সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়। দাদুই যত
নষ্টের গোড়া। ঠাম্মার কোনো এক বান্ধবীর নাতি এই
খাঁদু। ঠাম্মা নাকি ছোটোবেলায় ‘সই’ পাতিয়েছিল
খাঁদুর ঠাম্মার সঙ্গে। ওর মা কয়েক বছর ধরে
অসুস্থ। ওর বাবা মাকে চিকিৎসার জন্য
ভেলোর নিয়ে গেছে। “ছেলেটা একা-একা কোথায় থাকবে, কোন আত্মীয়-স্বজন ওর সঙ্গে কেমন ব্যবহার
করবে কে জানে? তুমি ওকে আমাদের বাড়ি নিয়ে এসো। ও পিকলুর সঙ্গে এক স্কুলেই পড়ে। দুজনে
একসঙ্গে স্কুল যাবে।” বাবা-মা
দুজনেই সেদিন খেতে বসে দাদুকে বলল কথাগুলো।
“আমার ঘর আমি কিন্তু কাউকে দেব না!” সবে বলে উঠতে যাচ্ছিল পিকলু, দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে
আর বলা হল না। ঠাম্মার ছবির দিকে ছলছল চোখে
তাকিয়ে রয়েছে দাদু। পিকলুর ঠাম্মাকে মনে নেই। পিকলু যখন খুব ছোট্ট, এই খাঁদুর থেকেও ছোটো, তখন ঠাম্মা মারা যায়। দাদুর মুখেই ঠাম্মার গল্প শুনেছে ও। দাদুর
সঙ্গে পিকলু সবচেয়ে বেশি গল্প করে। দাদুর
কাছে বসলেই মনে হয়, পিকলুর শরীরে যেন দুটো ডানা
জুড়ে গেছে। খুনসুটি, গল্প। দারুণ আনন্দ। সেখানেও খাঁদুটা ভাগ বসাল!
খাঁদু আর ওর মা-বাবা অনেকবার এসেছে পিকলুদের বাড়ি। পিকলুর থেকে তিন বছরের ছোটো। পিকলুর
ক্লাস সিক্স। স্কুলেও খাঁদুর সঙ্গে কোনো কথা
বলে না পিকলু। দাদু সবসময় বলে, “বাড়ির ছোটোরা হচ্ছে সবচেয়ে আদরের। স্পেশাল।” খাঁদু এলেই দাদু কোলে নিয়ে খুব
আদর করত ওকে। চোখ ফেটে জল আসত পিকলুর। কোনোদিন কাঁদেনি।
স্কুল ছুটি থাকলে খাঁদু সারাদিন চিলেকোঠায় কাটায়। মা-বাবা চাইছিল, খাঁদু পিকলুর ঘরে থাকুক। দাদু হঠাৎ বলল, “না, না। ও আমার সঙ্গে
ছাদের ঘরে থাকবে।”
পিকলুর সমস্যা মিটেছিল। ওর তো
আনন্দ হওয়ার কথা। ও কিছুতেই খাঁদুকে নিজের ঘরে
থাকতে দিতে চাইছিল না। তেমনটাই হল। তবুও
পিকলুর এমন কান্না পাচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে, ওর ডানাদুটো কেউ যেন খুলে নিচ্ছে!
“সারাদিন কী এত পড়াশোনা করিস তুই?” চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে প্রশ্ন করল পিকলু।
দাদু আজ সকাল থেকেই বাইরে। বন্ধুদের
সঙ্গে আড্ডায় গেছে। পিকলুদের স্কুল ছুটি আজ। খাঁদু সারাদিন চিলেকোঠার ঘরে বসে বই পড়ছে।
“কী রে! মুখ
নীচু করে আছিস যে! উত্তর দিচ্ছিস না কেন?”
“আমি একটা হিসেব করছি, পিকলুদাদা।”
“কীসের হিসেব? শোন, আমায় একদম ‘দাদা’ বলবি না।”
“আমার মায়ের একটা অপারেশন হয়েছে। ডাক্তার কতদিন পরে ছাড়বে, সেটা
বলেছে। দিনগুলো হিসেব করছিলাম।”
“দেখি তো, হিসেব
করে কী বের করলি? কী লিখেছিস দেখি? অক্টোবরের ২ তারিখ। সে তো এখনও তিন মাস বাকি। তোর মা
কি ওইদিন আসবে?”
“বাবা তো তা-ই বলছিল। আমি তখনই চলে যাব,
পিকলুদাদা।” শেষের শব্দদুটো বলেই মুখে আঙুল
দেয় খাঁদু।
“ভুল হয়ে গেছে আমার।” নিজেই বলে খাঁদু।
২
দাদু আগে প্রত্যেক রবিবার পিকলুকে নিয়ে খেলার মাঠে যেত, ক্রিকেট খেলা শিখতে। দাদু নিজে হাতে করে সব সরঞ্জাম কিনে দিয়েছে। রোববার বিকেলটা দারুণ আনন্দে কাটে পিকলুর। ফুরফুরে সময়। যে স্টেডিয়ামটায় ও
ক্রিকেট খেলা শেখে, সেখান থেকে ওদের বাড়িটা ১৫ মিনিট দূরে। ওইটুকু রাস্তা দাদু সাইকেলে করে নিয়ে যেত পিকলুকে। মাঠের ভেতর দিয়ে। কাঁচা-পাকা রাস্তা, সবুজ মাঠ। এই সময়টায় পিকলুর মনে হত, ওর পিঠে
ডানাদুটো জুড়ে গেছে। দাদুর সঙ্গে ও উড়ে চলেছে
মাঠের ওপর দিয়ে। দাদুর কাছে গেলেই ওর ঠিক এমন মনে
হয়।
এই রবিবার থেকে সেটাও পালটে গেল। এখন থেকে
রিকশায় করে পিকলুকে দিয়ে আসবে দাদু। দাদু
যদিও সাইকেলে করেই ওদের দুজনকেই দিয়ে আসবে বলছিল।
দুজন আবার কে? ওই ব্যাটা খাঁদু। ক্রিকেট কোচিং সেন্টারটায় দাদু ওকে ভরতি করিয়েছে। “ছেলেটার মা ও হওয়ার পর থেকেই অসুস্থ, ওর বাবা একা হাতে আর কতদিক সামলাবে?
যতদিন না সব ঠিক হচ্ছে, এখানে থাকুক, খেলা শিখুক।” দাদু রাতে খেতে বসে ঘোষণা করল। বাবা-মা রীতিমতো খুশি। পিকলু
খাঁদুর দিকে তাকায়। রুটি ছিঁড়ে অনভ্যস্ত হাতে
খাওয়ার চেষ্টা করছে।
“খুব ভালো করেছেন, বাবা। খাঁদুটা তেমন হলে আরও কয়েক মাস
থাকুক না আমাদের সঙ্গে। কী রে
তুই তো ঠিক করে খেতে পারছিস না, আমি তোকে খাইয়ে দিই?” মা
পিকলুর মাছের কাঁটা বেছে দিতে দিতে বলল।
“তুমি পিকলুকে খাওয়াও, আমি বরং খাঁদুকে খাইয়ে দিচ্ছি। এই বয়সে পিকলুকে কতবার খাইয়ে দিয়েছি বলো তো।” খাঁদু একা-একা খাওয়ার চেষ্টা করছিল দেখে
বাবা বলল।
শেষে বাবাকেও খাঁদু দখল করে নিল! ছেলেটা দাদুকে একেবারে কেড়ে নিয়েছে। এখন বাবাও! এবার কি তবে মাকে কেড়ে নেবে? পিকলু মরিয়া হয়ে ওঠে। “মা, তুমি কতদিন আমায় খাইয়ে দাও না! শুধু মাছ বেছে দিয়ে বলো, ‘নিজে হাতে খা।’ আজ তুমি
আমায় খাইয়ে দেবে।”
“তুই না আর ক-বছর পরে
মাধ্যমিক দিবি! খাঁদু কত ছোটো তোর থেকে! ও কিন্তু মনে মনে হাসছে তোকে দেখে!” মা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে পিকলুকে বলে।
আবার সেই কথা। খাঁদু পিকলুর থেকে ছোটো। সেটা তো জানে ও। কিন্তু এ-ই কী পিকলুর অপরাধ! বড়ো হয়ে গেলেই সব আদর এমন কমে যায়
কেন! পিকলু কি ইচ্ছে করে বড়ো হচ্ছে! খাঁদু যে ছোটো, এতে পিকলুর কী করার আছে?
পিকলুর চোখ ফেটে জল আসে। কাঁদলে সকলে হাসাহাসি করবে। সকলে বলবে “পিকলু, তুই না বড়ো
হচ্ছিস, খাঁদুটা কত ছোটো! ওর সামনে
কাঁদছিস?”
ঢক করে খাবার গেলার মতো কান্নাটা আটকে নেয় পিকলু। কোনোমতে রাতের খাবারটা শেষ করে।
“তুমি আমার ওপর খুব রেগে আছ পিকলুদা, তাই না?”
হঠাৎ খাঁদুর গলার আওয়াজে চমকে ওঠে পিকলু। এত সাহস ছেলেটার! একেবারে
পিকলুর ঘরে ঢুকে পড়েছে!
“কিছু বলবি তুই? তাড়াতাড়ি বল। আর বলেছি না তোকে, আমায় ‘দাদা’ বলে
ডাকবি না।”
“আমি একটা উপায় ভেবেছি।”
মাথা নীচু করে বলে খাঁদু।
“কীসের উপায়?” স্কুলের
হোমটাস্ক করতে করতে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে পিকলু।
“আমি ছোটো বলে সকলে তোমার আদর থেকে আমায় ভাগ দিচ্ছে,
তোমার কষ্ট হচ্ছে, আমি বুঝতে পেরেছি।” মাথা নামিয়ে কথাগুলো বলে খাঁদু।
পিকলু খাতা থেকে মুখ তোলে। তাকিয়ে
থাকে খাঁদুর দিকে। ছেলেটা মনের কথা পড়তে পারে নাকি!
তাহলে কী হবে? পিকলু যে ওকে মোটেই পছন্দ করে না, ও সেটা বুঝতে পেরে গেছে! এবার যদি মা-বাবাকে বলে দেয়! দাদুর কাছে নালিশ করে! দাদুর সঙ্গে তো রাতে ঘুমোয় খাঁদু। হঠাৎ পিকলুর মনে হল, ওর পিঠে আর কোনো ডানা নেই। খালি-খালি লাগছে সবটা। সকলে কি খুব বকাবকি করবে পিকলুকে! আদর করবে না আর!
“এসব কী বলছিস তুই, খাঁদু!” ভয়ে ভয়ে বলে পিকলু।
“তুমি চিন্তা কোরো না, আমি কাউকে কিছু বলব না।” ছেলেটা যেন আবার পিকলুর মনের কথা পড়ে ফেলে।
“আমি একটা উপায় ভেবেছি। তোমায় আমি বুঝিয়ে বলব।” খাঁদু ধীরে ধীরে বলে।
“কীসের উপায়? তুই কি সব উলটোপালটা
বলছিস বল তো! রাত হয়েছে, শুতে যা।” গলাটা ইচ্ছে করেই গম্ভীর করে রাখে পিকলু।
“দাদু কাল তোমায় আর আমায় নিয়ে মেলায় যাবে বলেছে। রথের মেলা। আমি ওখানেই তোমায় বলব উপায়টার
কথা।”
খাঁদু মুখ নীচু করে বেরিয়ে গেল। কেমন
দুঃখী-দুঃখী মুখ। ছেলেটা এমনিতে পিকলুর ঘরে আসে না। এই কয়েক
মাসে প্রথমবার এল। ওর মতলবটা কী! কাল রথের মেলায়
দাদু নিয়ে যাবে ওদের দুজনকে। দাদুর
সামনেই পিকলুকে কিছু বলবে না তো! নাকি দাদুকে নালিশ করবে সব! নাহ্, আজ আর ঘুম আসবে না।
৩
মেলায় যাবে না বলে রীতিমতো কান্না জুড়েছিল পিকলু। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। বাবা-মা
বকাবকি শুরু করে দিয়েছিল। দাদু আর
এই খাঁদুর সঙ্গে আসতেই হল। মেলায়
খুব ভিড়। পিকলুদের গ্রাম বর্ধমানে। এখানে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো একটা রথ টানা হয়। রথের মোটামুটি পাঁচদিন আগে থেকেই এই মেলা বসে। চলে একেবারে উলটোরথ পর্যন্ত। পরশু রথ। পুরোনো রথটা সুন্দর করে সাজানো হচ্ছে। দাদু পিকলুকে বারবার করে বলে দিয়েছে, ও যেন খাঁদুর হাত না ছাড়ে। সকাল
থেকে দাদুর শরীরটা খারাপ ছিল। তবুও ওদের
নিয়ে এসেছে।
এই প্রথম খাঁদুর হাত ধরল পিকলু।
যেই পিকলু হাত ধরেছে, খাঁদু অমনি
মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। দাদু
একটু ধীরে ধীরে হাঁটছে। খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে।
“তুই দাদুকে কিছু বলবি নাকি আজ?” নিজের ভয়টা যথাসম্ভব চেপে রেখে বেশ জোরের সঙ্গেই কথাটা বলে পিকলু। খাঁদুও মাথা নেড়ে ‘না’ বলল। মুখ না
তুলে। ছেলেটা কি সত্যিই এতটাই দুঃখী?
দাদু, মা, বাবা পিকলুকে বলে, ভালো
জিনিস ভাগ করে নিতে হয়। সকলকে ভালোবাসতে হয়। পিকলু ওদের কথা শোনে। কিন্তু
দাদু, মা, বাবা—এদেরকে ভাগ করে নেওয়া যায়?
এতদিন পর্যন্ত ওই বাড়িতে পিকলু সবচেয়ে ছোটো ছিল। যাবতীয় আদরের একমাত্র ভাগীদার। সেখানে
আর-একজন এলে কষ্ট হয় না! তবুও আজ খাঁদুর জন্য একটু মনখারাপ হচ্ছে পিকলুর। ওকে ততটাও খারাপ লাগছে না আর।
দাদু আস্তে আস্তে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। পিকলু আর খাঁদু এগিয়ে এসেছে। একটা
সাদা বিন্দুর মতো দেখা যাচ্ছে দাদুকে।
“আমার খিদে পেয়েছে। ফুচকা খাব। তুই খাবি? আমার কাছে টাকা আছে।”
পিকলু জিজ্ঞেস করে।
ভ্যাপসা গরমে খাঁদুর মুখ থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। নাকি চোখের জল? ধুর! কী সব
ভাবছে পিকলু।
“আমার খিদে পায়নি। কিছু খাব
না।” খাঁদু
মাথা নামিয়ে বলে।
“দাদু আমায় বলেছে দুজনকে খেতে। আমার সঙ্গে আয়।”
ভিড়ের মধ্যে খাঁদুকে হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে পিকলু। ফুচকার দোকানে রীতিমতো লাইন। পিকলু
এগিয়ে যায়। দুটো শালপাতার ঠোঙা চেয়ে নেয়। আশেপাশে মানুষের ভিড়। ছোট্ট
খাঁদুর চিহ্ন নেই। ফুচকার দোকানে দুজনের টাকা
মিটিয়ে দু-হাতে শালপাতার ঠোঙা নিয়ে ভিড়
কাটিয়ে এগিয়ে আসে পিকলু।
ছেলেটা কোত্থাও নেই।
খাঁদু নেই।
হারিয়ে গেছে ও!
দাদুর কথাও মনে পড়ে। সেই সাদা
বিন্দুটা কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। মানুষের
ভিড়ে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ওরা কি
হারিয়ে গেল? নাকি পিকলু হারিয়ে গেল? মায়ের ফোনটা আনলেই হত। মা-বাবা এখনও পিকলুকে ফোন ব্যবহার
করতে দেয় না। খুব প্রয়োজনে মায়ের ফোনটা
ব্যবহার করে। আজ যে কেন নিয়ে এল না! খাঁদুকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়াতে বলেই ফুচকা
কিনতে এসেছিল পিকলু। বারবার ওকে বলে দিয়েছিল
পিকলুর জন্য অপেক্ষা করতে।
তাহলে কোথায় গেল ছেলেটা!
ও কি তবে ইচ্ছে করেই হারিয়ে গেল!
সেদিন এটার কথাই বলতে চাইছিল ও!
হারিয়ে যেতে চাইছিল খাঁদু!
এটাই ওর উপায়!
পিকলুর ব্যবহারে এতটা দুঃখ পেয়েছে ছেলেটা! কিন্তু দাদু? দাদু কোথায়! দাদুকেও যে দেখা যাচ্ছে না! খাঁদু দাদুকে
সব আগে থেকে বলে দেয়নি তো! তারপর দুজনে মিলে পিকলুকে মেলায় ফেলে রেখে চলে গেছে! ইশ্, কী যে অন্যায় করে ফেলেছে পিকলু! চিৎকার করে কাঁদতে
ইচ্ছে করছিল পিকলুর। ওর সেই দুটো ডানা যেন
হারিয়ে গেছে! মেলায় ভিড়ের মধ্যে দৌড়ে
বেড়াতে শুরু করল সে।
৪
একটা কালো রঙের ত্রিপল-ঘেরা
জায়গা। দাদুর মাথায় বোধহয় চোট লেগেছে। চোখ খুলতে পারেনি নিশ্চয়ই এখনও। একজন
বরফের টুকরো নিয়ে বসে আছে। বাচ্চা
ছেলে। দাদুর আশেপাশে খুব ভিড়। মাইকে ঘোষণা শোনা যাচ্ছে, “একজন বয়স্ক মানুষ হঠাৎ মাথা ঘুরে রাস্তায় পড়ে গেছেন। নাম বলার মতো অবস্থায় নেই। তাঁকে
আপাতত মেলার শেষ প্রান্তে তাঁবুতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তাঁর নাতি জানিয়েছে, তাঁর
নাম ‘রথীন্দ্রনাথ’। পদবি বলতে পারছে না ছেলেটি। তাঁর পরিবারের অন্য কেউ থাকলে একটু যোগাযোগ করবেন। ওঁর পরনে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি।”
ভাগ্যিস ঘোষণাটা কানে গিয়েছিল পিকলুর! খুঁজে খুঁজে তাঁবুটার কাছে এসেছে। ভেতরে
খুব ভিড়। ছোট্ট তাঁবু। কেউ একজন দাদুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অন্য একজন জলের ছিটে দিচ্ছে। তবে একটা
ছোট্ট হাত বরফের টুকরো ঘষে দিচ্ছে দাদুর মাথায়। দূর থেকে ঝাপসা চোখে দেখছে পিকলু। দাদুর
হাই প্রেশার। নিশ্চয়ই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। পিকলু আজ আসতে কতবার বারণ করল! দাদু শুনল না।
“তুমি কাকে খুঁজছ?”
একটা লোক তাঁবুর ভেতর ঢুকতে গিয়ে পিকলুকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল।
“আমার দাদু মেলায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওখানে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ভিড়ের
মধ্যে ঢুকতে পারছি না।”
“তুমি রথীন্দ্রনাথবাবুর নাতি? তাহলে ওই ছেলেটা যে বলল, ও
রথীন্দ্রনাথবাবুর নাতি। ‘সুমন’ না কী যেন নাম। ও-ই তো তোমার দাদুকে পড়ে থাকতে দেখে সকলকে
ডেকে এনেছিল। তারপর আমরা এই তাঁবুতে নিয়ে এলাম। ও কে তাহলে?”
পিকলু হনহন করে দাদুর কাছে এগিয়ে এসেছে। দাদুর সামনে এখন আর কেউ বসে নেই। দাদু চোখ
খুলেছে। পিকলুকে কাছে ডাকল।
“দাদুভাই, আমার শরীরটা হঠাৎ করে খারাপ হয়ে গেল। তোমাদের আনন্দটা একেবারে মাটি করে দিলাম। কিন্তু তুমি কোথায় ছিলে? খাঁদু
কোথায়? ও বোধহয় আমায় এখানে নিয়ে এসেছে। তুমি ওর
সঙ্গে ছিলে না?”
দাদু ছলছল চোখে পিকলুর দিকে তাকিয়ে। দাদুর
চোখে রাগ নেই। পিকলুর হঠাৎ মনে হল, ওর পিঠে আর কোনোদিন কোনো ডানা জুড়ে যাবে না। দাদুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল পিকলু।
“যে-ছেলেটা
এখনই বসেছিল, ও কোথায় গেল! ও নাকি রথীন্দ্রনাথবাবুর নাতি নয়। এই ছেলেটাই নাতি। কোনো চোর-জোচ্চর নিশ্চয়ই! পালিয়ে গেল নাকি ছেলেটা! আপনি আপনার পকেটে মানিব্যাগটা আছে কিনা দেখেছেন!
আপনাকে নিয়ে আসার নাম করে হয়তো কিছু চুরি করেছে!”
তাঁবুর দায়িত্বে থাকা সেই লোকটা বলল।
“না না। ও আমার
ভাই। আমি অয়ন, মানে পিকলু। ও আমার ভাই সুমন। ডাকনাম ‘খাঁদু’। ও কোথায় গেল?” পিকলু কাঁদতে কাঁদতে বলে।
“খাঁদু দাদুভাই আশেপাশে কোথাও নিশ্চয়ই আছে। তুমি ঠিক খুঁজে পাবে, পিকলু। আমি জানতাম, একদিন তুমি ঠিক বুঝবে। যাও, তোমরা দুজনে একসঙ্গে এসো। আমরা বাড়ি যাব।”
দাদুর চোখদুটোও যেন হাসছে। পিকলু
দৌড়ে বেরিয়ে এসেছে তাঁবু থেকে। খাঁদুকে
খুঁজছে। সেই ফুচকার দোকানটার পাশ দিয়ে
যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। একটা
চেনা গলা বলছে, “আমার দাদা দাম দিয়ে গেছে। ফুচকা কিনতে এসেছিলাম আমরা। আমার খুব
খিদে পেয়েছে। আমায় ফুচকা দেবেন?” পিকলু দৌড়ে যায়। “আমাকেও ফুচকা দিন তো। খিদে
পেয়েছে। তখন খাওয়া হয়নি। ভাই আর আমি একসঙ্গে খাব।” পেছন থেকে খাঁদুকে জড়িয়ে ধরে পিকলু। পিকলুর হঠাৎ মনে হয়, ও যেন
মাঠের ভেতর দিয়ে সাইকেলে যাচ্ছে। নিজের
ডানায় ভর করে উড়ে যাচ্ছে ও।
----------
ছবি – শুভশ্রী দাস
No comments:
Post a Comment