
ধূমকেতুর আগমন
বুম বোস
(১)
ধূমকেতু
বসু অর্থাৎ আমার ধূমমামার কথা আপনাদের আগেও বলেছিলাম। চরম
বাউন্ডুলে, সংসারধর্মে
মন নেই, কোনো
স্থায়ী আস্তানাও নেই। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস
তার কোনো টিকির পাত্তাই পাওয়া যায় না। তারপর
আচমকাই কোনো একদিন আমাদের বাড়ির বারান্দার সামনে উদয় হয় সে। একগাল
হেসে বলে, “এক
কাপ চা খাওয়া তো, দীপু।
রোদে ঘুরে ঘুরে গলাটা শুকিয়ে গেল।”
মায়ের
মুখে শুনেছি, আগে
নাকি ধূমমামা এরকম ছিল না। ভালো
চাকরি করত, বন্ধুবান্ধব, পরিবার নিয়ে
হাসিখুশি জীবন ছিল। তারপর মাথায় কী ব্যামো হল
কে জানে, চাকরি-বাকরি ছেড়ে দিয়ে কলেজ স্ট্রিটে
বইয়ের দোকান দেবে বলে উঠেপড়ে লাগল। কিন্তু
শেষে বইয়ের দোকান তো হলই না, মামাটা আমার কেমন যেন হয়ে গেল।
তবে
মামা যে একেবারে বে-গুণ, কোনো গুণই যে
তার মধ্যে নেই, তেমনটা
কিন্তু নয়। লেখার হাত তার বেশ ভালো।
গোয়েন্দা এবং ভৌতিক উপন্যাস লেখায় সে দারুণ হাত পাকিয়েছে।
কয়েকটি বইও আছে বাজারে। সেইসব
বইয়ের রয়্যালটির টাকায় কোনোরকমে চলে যায় মামার।
কিন্তু
আমার সেই ভবঘুরে ধূমমামা যে আচমকাই ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলে বসবে, এমন কথা আমি
স্বপ্নেও ভাবিনি। মামার কোন এক দূর-সম্পর্কের কাকা ছিলেন, থাকতেন চেতলায়।
মামা নাকি তার সেই কাকার খুব ন্যাওটা ছিল।
তো এবার হয়েছে কী, ধূমমামার সেই বিপত্নীক,
নিঃসন্তান কাকা মারা যাওয়ার আগে তাঁর দু-কামরার ঘুপচি ফ্ল্যাটটা মামার
নামে লিখে দিয়ে গেছেন।
যাই
হোক, এই
অপ্রত্যাশিত সম্পত্তি লাভের পর মামার মাথায় নতুন ব্যামো চাগাড় দিল, সে নাকি প্রোফেশনাল
গোয়েন্দা হবে। অতঃপর দু-কামরার ফ্ল্যাটের একটি ঘর
রইল তার শোয়ার জন্য, অন্যটি
হয়ে গেল তার চেম্বার। ক্লায়েন্ট ধরার জন্য সম্বল
হল একটি পুয়োরলি ডিজাইনড্ ওয়েবসাইট আর একটা সোশ্যাল মিডিয়া পেজ।
ব্যাপারটি
প্রথম শোনার পর যতটা বোকা-বোকা লেগেছিল, ততটাই আবার এক্সাইটিংও লেগেছিল। বড়ো
বড়ো সব গোয়েন্দাদেরই তো একটা করে অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকে। ধূমমামা
যদি আমাকে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নেয়, তাহলে কী মজাটাই না হবে! এই ভাবনা নিয়েই আমি মাঝেমধ্যেই মামার আস্তানা ওরফে চেম্বারে
গিয়ে হাজির হই। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ, এখন কয়েকমাস
নির্ভেজাল ছুটি। তাই মায়ের শাসনের বাঁধনটাও
কিঞ্চিৎ আলগাই রয়েছে।
আজও
বিকেল-বিকেল
আমি চলে এসেছি ধূমমামার ডেরায়। ধূমমামার
ফ্ল্যাটটা গ্রাউন্ড ফ্লোরে, তাই সিঁড়ি-টিড়ি ভাঙতে হয় না। যদিও
এই কচি বয়সে সিঁড়ি ভাঙতে অনীহা দেখলে কোনো গোয়েন্দাই আমায় তার সহকারী হিসেবে নিত না।
যাই
হোক, আজ
মামার ডেরায় ঢুকেই দেখি সে চেয়ার-টেবিলে বসে, একটা আদ্যিকালের ল্যাপটপ নিয়ে কীসব খুটুর-খাটুর করছে।
আমি
ঘরের মধ্যে ঢুকেই চটি ছেড়ে একটি চেয়ার টেনে বসলাম। মামার
এই সামনের ঘরটা চেম্বার। একটা ছোট্ট আলমারি, চেয়ার-টেবিল ছাড়া তেমন কোনো আসবাব
এই ঘরে নেই। ভেতরের ঘরে অবশ্য একটি খাট, টিভি এবং আরও
একটি আলমারি আছে। বলা বাহুল্য, এইসব আসবাবপত্রও তার সেই দূর-সম্পর্কের কাকারই দান।
“এই প্রাগৈতিহাসিক ল্যাপটপটা
কোত্থেকে বাগালে?” আমি ধূমমামার মুখোমুখি চেয়ারে বসে কথাটা পাড়লাম।
ধূমমামা
ল্যাপটপ থেকে মুখ না তুলেই বলল, “এ আমার এক বন্ধুর পুরোনো অস্ত্র। আমায়
ফ্রিতেই দিয়ে দিয়েছে। ওর এখন দামি অস্ত্র আছে।”
“সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু তুমি
এখন ওটা নিয়ে কী খুটুর-খাটুর করছ?”
“সকালে একটা মেইল এসেছে।
সেটারই রিপ্লাই লিখছি।”
“মেইল! কীসের মেইল?”
“একটা কেস।”
কেস
শব্দটা শুনেই আমার চোখদুটো চকচক করে উঠল। বললাম, “কী কেস? দেখাও একবার
মেইলটা।”
ধূমমামা
মেইলটা
খুলে আমায় দেখাল। মেইলে ইংরেজিতে লেখা ছিল—
হ্যালো
মিস্টার ধূমকেতু,
আপনার
এই সংস্থার খোঁজ আমি একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট থেকে পেয়েছি। একটি
অদ্ভুত বিষয়ে আমি আপনাকে হায়ার করতে চাই। আগামী
বুধবার অর্থাৎ ৫ মার্চ আমাকে সারাদিন ফলো করতে হবে আপনাকে। একমুহূর্তও
চোখের আড়াল করা চলবে না। চোখের আড়াল হলেই বিপদ।
বেলা এগারোটা নাগাদ আমি নিজের বাড়ি থেকে বেরোব।
ঠিক বিকেল চারটের সময়ে আমি হাওড়া স্টেশনের কাছাকাছি একটি রুফটপ
রেস্তোরাঁর নীচে দাঁড়াব। আপনি তখন আমার সঙ্গে এসে
দেখা করবেন। আমি আপনাকে পরিচয় জিজ্ঞেস
করতেই আপনি নিজের নাম বলবেন ‘অবিনাশ সেন’।
তারপর আমাকে আপনি ওই রুফটপ রেস্তোরাঁয় ডিনারের জন্য নিমন্ত্রণ
করবেন। আমি রাজি হলেই আমায় নিয়ে
সোজা ওই রুফটপ রেস্তোরাঁয় উঠে বসবেন। আমার
হাতে একটা ব্রিফকেস থাকবে, ওটা আমি আপনাকে দেব। যদি
কোনোভাবে ওটা আপনাকে দেওয়ার আগেই আমার কিছু হয়ে যায়,
তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্রিফকেসটা নিয়ে রুফটপ রেস্তোরাঁর ঠিক
সামনেই আর-একটি
বিল্ডিং আছে (লোকেশন
আপনাকে পাঠানো থাকবে)—ওটার
ছাদে উঠে আসবেন। তারপর ব্রিফকেসটি ছাদের কোণে
রেখে আপনি ফিরে যাবেন। আপনার কাজ ওখানেই শেষ হবে।
কাজ শেষ হলে আপনার উপযুক্ত পারিশ্রমিক আমি আপনাকে দেব।
রাজি থাকলে আমায় আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ডিটেইলস্ পাঠিয়ে দিন, আমি কিছু টাকা
আপনাকে অ্যাডভান্স পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনার
উত্তরের আশায় থাকব।
ধন্যবাদ,
পীযূষ বড়াল
ইমেইলটা আগাগোড়া পড়ে বললাম, “ইন্টারেস্টিং! কী করবে? নেবে কেসটা?”
ধূমমামা
বলল, “তেমনটাই
তো ইচ্ছে।” বলেই সে ইমেইলে নিজের ব্যাংক
অ্যাকাউন্ট ডিটেইলস্ পাঠিয়ে
দিল।
প্রায়
সঙ্গে সঙ্গেই ইমেইলের রিপ্লাইতে একটি ভদ্রলোকের ছবি এল। লোকটির
বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন, মাথায় কাঁচাপাকা চুল,
মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর চোখে গোল ফ্রেমের চশমা।
ছবিটির তলায় লেখা ছিল,
“এটি আমার ছবি। সঙ্গে
ঠিকানাও পাঠলাম। অ্যাডভান্সের টাকাও ইতিমধ্যেই
আপনার অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। আশা
করছি, আপনি
আমায় সাহায্য করতে পারবেন।”
ইমেইলটি পড়া শেষ হতে না হতেই
ধূমমামার মোবাইলে ব্যাংকে টাকা ঢোকার নোটিফিকেশন এল। আমি
একগাল হেসে বললাম, “তোমার প্রথম কেস। কনগ্র্যাচুলেশনস!”
“হুম।
একটু খটকা লাগছে রে,
দীপু। প্রথম
কেসটাই যে এমন অসভ্য হবে ভাবিনি।”
“ধ্যাৎ।
কেস আবার অসভ্য হয় নাকি!”
“অসভ্য কেস না তো কী! নইলে গোয়েন্দা
নিযুক্ত করে এসব ভুলভাল কাজ করায়? তাও আবার আমার মতো একজন আনকোরা নতুন, অনভিজ্ঞ গোয়েন্দাকে!”
“আহা! সব পুরোনো এবং
অভিজ্ঞ গোয়েন্দাই তো এককালে আনকোরা নতুনই ছিল।”
“হুম্। একটা পক্ষীরাজ লাগবে কাজের
জন্য।”
বুঝলাম, ধূমমামা বাইকের
কথা বলছে। মামা এরকমই, নিত্যব্যবহার্য
জিনিসগুলোর উদ্ভট সব নাম দেয়।
“এখন কী করবে?” আমি আবার জিজ্ঞেস
করলাম।
“আপাতত একজন পুরোনো কমরেডকেও
ফোন করতে হবে। অনেক কাজ আছে এখন।
তুই বাড়ি যা। মঙ্গলবার
বিকেলে এখানে চলে আসিস। ওইদিন রাতে এখানেই খাবি আর
থাকবি। দরকার হলে তোর মায়ের সঙ্গে
কথা বলিয়ে দিবি আমার।”
আমি
সব শুনে, বাধ্য
ছেলের মতো ঘাড় নাড়লাম। বুধবারের অভিযানের কথা ভেবে
আমার চোখদুটো উত্তেজনায় চকচক করে উঠল।
(২)
কথামতোই
মঙ্গলবার বিকেল-বিকেল
চলে এলাম ধূমমামার ডেরায়। পৌঁছেই দেখি, সে ফোনে কার
সঙ্গে গুরুগম্ভীর স্বরে কথা বলছে।
“আপনাকে যে-কথাগুলো বললাম, ভুলেও পাঁচকান
করবেন না। আপনার যত বিশ্বস্ত লোকই হোক
না কেন, কাউকেই
এইসব বলা যাবে না। বুঝলেন?”
ওপার
থেকে ধূমমামার প্রশ্নের কী উত্তর এল জানি না। দেখলাম
তার ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলছে। ফোনটা
রেখে সে হাসিমুখেই তাকাল আমার দিকে। বলল, “আজ কী খাবি, দীপু? পকেট তো বেশ
গরমই আছে। বিরিয়ানি খাবি?”
“কোথায় খাবে, আমিনিয়া?”
“উঁহুঁ।
সিরাজ।”
“সে তো অনেক দূর।”
“ধুর বোকা।
বিরিয়ানি খেতে যত দূরে যাবি,
ততই মজা।”
“তোমার যত গুল।”
“দেরি করিস নে।
ঝটপট বেরিয়ে পড়ি, চল।”
অতঃপর
বেরিয়ে পড়লাম মামার সঙ্গে। একটা
বাস ধরে পার্কসার্কাস পৌঁছোতে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা লেগে গেল। সাউথ
পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রির সামনে নামতে নামতে সন্ধে নেমে গেল শহরে।
রাস্তার ওপারে সিরাজ রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ডটি জ্বলজ্বল করছে।
আমি সেদিকে পা বাড়াতে যাব,
তক্ষুনি ধূমমামা আমার জামা টেনে ধরল। বলল, “এত তাড়াতাড়ি
কেউ ডিনার করে! চল, আগে একটু হেঁটে
আসি আশপাশটা। খিদেটা চাগাড় দিলে তবেই না
খেয়ে মজা।” বলেই সে আমার
হাত ধরে সিরাজের উলটোদিকে হাঁটতে লাগল।
ধূমমামার
ভাবগতিক কিছুই বুঝতে পারছি না। কী
যে করতে চাইছে, সে-ই জানে।
আরও
কিছুটা এগোনোর পর ডানদিকে বেঁকে আর-একটি তুলনামূলক সরু রাস্তায় প্রবেশ করলাম আমরা।
এই রাস্তাটি বড়ো রাস্তার তুলনায় বেশ অনেকটাই নিরিবিলি।
গাড়িঘোড়াও কম, যদিও মাঝেমধ্যেই একটি-দুটি বাইক কিংবা প্রাইভেট কার দেখা যাচ্ছে।
রাস্তার দু-পাশে বড়ো বড়ো, দোতলা-তিনতলা বাড়ি সব সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছে৷ পাড়াটি যে বড়োলোকেদের, তাতে কোনো সন্দেহ
নেই।
খানিকটা
এগোতেই ধূমমামা আমার কানে ফিশফিশিয়ে বলল, “আমরা এই রাস্তা ধরে সোজা কিছুদূর হাঁটব, তারপর ফিরে আসব।
চারিদিকে ভালো করে নজর রাখবি,
তবে এমনভাবে রাখবি যেন কেউ বুঝতে না পারে।”
বলেই সে আবার চুপ করে গেল।
খানিকটা
এগোতেই একটি বাড়ির গেটে লেখা ঠিকানায় চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম।
ধূমমামা
বলল, “চেপে
যা। আর আর-একটু এগোলেই দেখবি, একটা কালো গাড়ি
দাঁড়িয়ে আছে। ওটার দিকে ড্যাবড্যাব করে
তাকাবি না।”
দূর
থেকে একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম বটে,
তবে ওটা নিয়ে এত ঘাবড়ানোর কী আছে বুঝলাম না।
তবে এটা যে ওই ‘পীযূষ বড়াল’ ভদ্রলোকের পাড়া, সেটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। একটা
বাড়ির গেটের ওপর লেখা ঠিকানায় রাস্তার নামটা দেখেই ইমেলের সেই ঠিকানাটা মনে পড়ে গেছিল।
কিন্তু
কাল যেখান থেকে কাজ শুরু করতে হবে, সেখানে একদিন আগে এসে ঘুরঘুর করার কী মানে, সেটা বোধগম্য
হল না।
গাড়িটার
কাছাকাছি পৌঁছোতেই ধূমমামা আমায় বেশ জোরেই বলল,
“ভুল রাস্তায় ঢুকেছি,
বুঝলি। তপনদার
বাড়ি এদিকে নয়। চল, মোড়ে গিয়ে একবার
ফোন করে নিই।” বলেই আবার পেছন
ফিরে হাঁটতে শুরু করল সে। আমিও তার পিছু নিলাম।
গাড়ির থেকে কিছুটা তফাতে এসে বললাম,
“এবার?”
ধূমমামা
গম্ভীরমুখেই বলল, “সিরাজ... মাটন বিরিয়ানি।”
(৩)
পীযূষবাবুর
গাড়িটা একটা লাল স্যান্ট্রো। বাড়ি
থেকে বেরোনোর পর ওটিতে চড়ে আপাতত মোট তিনটি জায়গায় গিয়েছেন তিনি।
বলা বাহুল্য, আমরাও তাঁর পিছু পিছু ওই তিনটি জায়গায় ঢুঁ মেরেছি।
প্রথমেই গেলেন মিন্টো পার্কের কাছে একটি অফিস বিল্ডিং-এ, নাম ‘এক্সপ্রেস টাওয়ার’। সেখানে সম্ভবত নিজের কোম্পানির
অফিসে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। কারণ ওঁকে নিয়ে আমিও কিঞ্চিৎ
রিসার্চ করেছি এই ক-দিনে।
ওঁর একটি ওয়েবসাইট ডেভলপমেন্ট ফার্ম আছে, সে খবর সোশ্যাল
মিডিয়াতেই পেয়েছি।
অফিসে
তিনি প্রায় ঘণ্টাখানেক ছিলেন। তারপর
সেখান থেকে বেরিয়ে, গাড়ি
নিয়ে সোজা গেলেন ডালহৌসি। ডালহৌসিতে, রাইটার্স বিল্ডিংয়ের
সামনে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি
ওঁকে কিছু কাগজপত্র দিলেন। কাগজগুলো
ব্রিফকেসে রেখে তিনি আবার গাড়িতে এসে বসলেন। আবার
আমরা তাঁর পিছু নিলাম। এবার তিনি পৌঁছোলেন ধর্মতলায়
একটি জুতোর শোরুমে। সেখানে মিনিট দশেক থেকেই
বেরিয়ে এলেন। হাতে কোনো প্যাকেট দেখলাম
না, সুতরাং
ধরে নেওয়া যায় তাঁর কোনো জুতোই পছন্দ হয়নি। গাড়ি
নিয়ে তিনি আবার এগিয়ে চললেন।
কলকাতার
রাস্তায় কাউকে কন্টিনিউয়াস ফলো করার যে থ্রিল,
তা যে করেছে সে-ই জানে! আগে ভাবতুম, এসব বোধহয় শুধু গোয়েন্দা কিংবা থ্রিলার উপন্যাসেই হয়।
কিন্তু আজ নিজেই এমন একটা অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়ে গা-টা বেশ শিরশির করছে।
লোকটার
পিছু সেই কখন থেকে ঘুরছি, অথচ ধূমমামা এই এতটা সময় ধরে আমার সঙ্গে গুনে গুনে মোটে সাত-আটটা কথা বলেছে, তাও ওয়ান-টু ওয়ার্ড।
আমিও তাই আর ঘাঁটাইনি ওকে। তবে
সে যে এত ভালো বাইক চালায়, আগে জানতাম না। আজ
প্রায় ওঁর বাইকের পেছনে বসে সারা কলকাতা ঘুরে ফেললাম,
অথচ একবারের জন্যেও বাইক বেকায়দায় হেলেওনি অবধি।
যাই
হোক, বিকেল
চারটের কিছু আগেই আমরা হাওড়া স্টেশনের কাছাকাছি সেই বিশাল বিল্ডিঙের সামনে উপস্থিত
হলাম, যার
রুফটপ রেস্তোরাঁয় আমাদের বসার কথা পীযূষবাবুর সঙ্গে। উনি
গাড়ি থেকে নামতেই আমরা সটান ওঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি
ধূমমামার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনিই অবিনাশ সেন?”
ধূমমামা
বলল, “হ্যাঁ।
এই বিল্ডিঙের ওপরে একটি দারুণ রুফটপ রেস্তোরাঁ আছে, চলুন সেখানে
গিয়েই বসি। জিনিস এনেছেন তো?”
পীযূষবাবু
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতেই আমরা বিল্ডিংয়ের ভেতর ঢুকে পড়লুম। লিফ্টে প্রবেশ করে চোদ্দো নম্বর
বোতাম টিপতেই লিফ্ট
শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে ঊর্ধ্বমুখে ধাবিত হল।
(৪)
রেস্তোরাঁটি
ভীষণ সুন্দর করে সাজানো। বিকেলের মরে-যাওয়া আলোয় ছাদখোলা এই রেস্তোরাঁটি
বড্ড মায়াময় লাগছে। লিফ্ট থেকে বেরিয়ে আমরা রুফটপ
রেস্তোরাঁর একটি কোনার দিকের টেবিলে বসে পড়লাম। আমরা
বসামাত্রই একটা ওয়েটার ঠিক যেন ঝড়ের বেগে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল।
বলল, “স্যার, ইয়োর অর্ডার প্লিজ?”
অথচ সে এখনও আমাদের মেনুকার্ড অবধি দেয়নি।
অবাক
হওয়া আরও বাকি ছিল। ওয়েটার এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে
সঙ্গেই আমাদের ঠিক পাশের টেবিলে বসে-থাকা তিন ভদ্রলোক গাল এঁটো করে হেসে আমাদের সামনে লাইন দিয়ে
দাঁড়ালেন।
“ধূমকেতুবাবু, আমরা আপনার গোয়েন্দা
উপন্যাসের দারুণ ভক্ত!” তিন ভদ্রলোকের মধ্যে একজন বললেন।
কিন্তু
অদ্ভুতভাবেই ধূমমামা ওঁর কথায় কোনো ভ্রূক্ষেপই করল না। সে
একদৃষ্টিতে চেয়েছিল তার হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইল ফোনটির স্ক্রিনের দিকে।
প্রায় মিনিট পাঁচেক লোক তিনটি আবোল-তাবোল বকে গেলেন, মামাকে শরৎচন্দ্রের সঙ্গেও তুলনা করলেন একজন।
তারপর
আচমকাই ধূমমামার ফোনটি টুংটাং শব্দে বেজে উঠল। ফোনটা
রিসিভ করে কানে ধরতেই তার ঠোঁটে একটা স্বস্তির হাসি খেলে গেল। এবার
সে হাসিমুখেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি এখন সেফ, পীযূষবাবু। লোকটা
ধরা পড়েছে।”
আমি
হতভম্বের মতো একবার তাকাচ্ছি ধূমমামার দিকে,
একবার পীযূষবাবুর দিকে। ধূমমামার
লেখালেখির ভক্তেরা তাকে আচমকাই “থ্যাংক ইউ” বলে রেস্তোরাঁ থেকে ছুট্টে বেরিয়ে গেলেন।
ধূমমামাও দেখি ছুটল ওদের পিছু-পিছু। ওর
ঠিক পেছনেই ছুটলাম আমি আর পীযূষবাবু।
লিফ্টের বদান্যতায় আমরা চোদ্দোতলা
বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে নিমেষে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে এলাম। এবং
এসেই দেখলাম এক অদ্ভুত দৃশ্য। জনাকয়েক
পুলিশ, তাদের
প্রত্যেকের হাতে রিভলবার, একটি তালগাছের মতো ঢ্যাঙা লোককে পাকড়াও করেছে।
লোকটির ছোটো ছোটো করে কাটা চুল,
চোখদুটো কটা, দাড়িগোঁফ কামানো, গায়ে লেদারের কালো জ্যাকেট। হাতে
হাতকড়া পরিয়ে তাকে হাঁটু মুড়ে নীচে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
একজন
পুলিশ অফিসার একটি লম্বা রাইফেল তুলে দেখালেন। রাইফেলের
নলটি কালো রঙের, হাতলটি
বাদামি। রাইফেলটির ওপরে একটা সরু
নলের মতো টেলিস্কোপ বসানো। অফিসার
বললেন, “দেখুন, স্যার। টপ
কোয়ালিটি স্নাইপার রাইফেল। লোকটির
নাম ‘ভিকি’। টাকা নিয়ে কাজ করে।”
“ওকে কে হায়ার করেছিল বলেছে?” ধূমমামার ভক্তদের
মধ্যেই একজন জিজ্ঞেস করলেন। বুঝলাম, ওরাও পুলিশের
লোক।
“বলেছে।
টিম পাঠিয়ে দিয়েছি। ঠিক
ধরা পড়বে।”
আমি
তখনও বোকার মতো দাঁড়িয়ে ড্যাবড্যাব করে ধূমমামার দিকে তাকাচ্ছিলাম।
মামা আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা দেখে হাসল মৃদু, তারপর বলল, “আজ আমাদের পীযূষবাবুর
বাড়িতে নেমন্তন্ন। এলাহি খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন।
সেখানে গিয়েই তোকে সব বলছি। চল।”
(৫)
পীযূষবাবুর
বাড়ির প্রকাণ্ড ডাইনিং রুমে, অসামান্য সব খাবারে সুসজ্জিত ডাইনিং টেবিলে বসে কথাবার্তা হচ্ছিল
আমাদের। পীযূষবাবুর চোখেমুখে কৃতজ্ঞতার
ছাপ স্পষ্ট। মামা একহাত সাইজের একটি গলদা
চিংড়িকে কাবু করার চেষ্টা করছিল। আমি
বললাম, “কী
গো, ব্যাপারটা
কী ঘটল, আমায়
একটু বলো খুলে?”
ধূমমামা
আমার প্রশ্ন শুনে চিংড়ি খেতে খেতেই আমার দিকে তাকাল। বলল, “সেদিন যখন পীযূষবাবুর
তরফ থেকে ইমেইল
আসে, এবং
তিনি নিজেই আমাকে তাঁকে ফলো করার কেস দেন,
তখনই আমার খটকা লেগেছিল। বিশেষত, ওই রুফটপ রেস্তোরাঁয়
নিয়ে গিয়ে বসানোর ব্যাপারটায়। তখনই
আমি পীযূষবাবুর সম্পর্কে খোঁজখবর শুরু করলাম। এবং
তা করতে গিয়েই জানলাম যে, তিনি শহরের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। আমি
তখনই ওঁর নম্বর জোগাড় করে ওকে ফোন করি। আর
তা করতেই পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি
যে মোটেই আমায় ইমেইল
করে তাঁকে ফলো করতে বলেননি, সেকথা স্পষ্ট জানান তিনি। তিনি
আমায় এও জানান যে, তাঁর
বিজনেসের একটি অত্যন্ত গোপন বিষয় (রাজ্য সরকারের প্রোজেক্ট রিলেটেড টেন্ডারের বিষয়) নিয়ে কেউ একজন
তাঁকে ব্ল্যাকমেল করছে। যদিও এত গোপন খবর কোম্পানির
উচ্চপদস্থ গুটিকয়েক কর্মচারী এবং মালিক ছাড়া বাইরের কারোর জানার কথা নয়।
অথচ, সেই তথ্য বাইরে পাচার হয়েছে। পীযূষবাবু
আমায় জানান যে, এই
বিষয়ে তিনি সন্দেহ করেন তাঁরই বিজনেস পার্টনার শ্যামসুন্দর আগরওয়ালকে।
তার মতিগতি বিগত কয়েক বছর ধরেই পীযূষবাবুর ভালো ঠেকছে না।
কিন্তু কোনোরকম প্রমাণ ছাড়া তিনি তাকে চার্জও করতে পারবেন না।
অতঃপর
ব্ল্যাকমেলারের কথামতোই অনেকগুলো টাকা নিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন এই রুফটপ ক্যাফের নীচে।
তাঁকে ব্ল্যাকমেলার তেমনটাই করতে বলেছিল।
বলেছিল ‘অবিনাশ সেন’ নামে একজন এসে তাঁর থেকে টাকা সমেত ব্রিফকেস সংগ্রহ করবে।
অন্যদিকে
আমার সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট দেখে, আমাকে একজন দুর্দান্ত বোকা লোক ভেবে, সে পীযূষবাবুকে
ফলো করার ফল্স
কেস দেয় আমায়।
আসলে
এই ব্ল্যাকমেলিং-এর ব্যাপারটা মোটেই টাকার জন্য ছিল না। এই
পুরো নাটকের মূল মোটিভ ছিল—পীযূষবাবুকে খুন করে পথের কাঁটা সরানো এবং একজন বোকাহাঁদা ডিটেকটিভকে
তার খুনের দায়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া। কারণ, পীযূষবাবু স্নাইপারের
গুলি খেয়ে খুন হওয়ার পর তাঁরই ব্রিফকেস সমেত আমাকে পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে পাওয়া গেলে
সন্দেহটা আমার ওপরেই যেত। কিন্তু ওই খুনি আমায় যতটা
বোকা ভেবেছিল, ততটা
আমি নই। তাছাড়া আমার বাল্যবন্ধু শুভাশিস
লালবাজারে পোস্টেড থাকায় ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে অনেকটা সুবিধে হয়েছে।
মোদ্দা কথা, আমার জীবনের প্রথম কেস সাকসেসফুলি সলভ্ড।” একটানা বলেই ধূমমামা চোখ টিপল।
আমি
বললাম, “কালপ্রিটটা
কে বললে না তো?”
ধূমমামা
বলল, “হাওড়ার
হিটম্যান ভিকি তার স্বীকারোক্তিতে শ্যামসুন্দর আগরওয়ালের নাম বলে দিয়েছে।
পুলিশ তাকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করেছে এয়ারপোর্ট থেকে।
বিদেশে পালানোর তালে ছিল সে।”
ধূমমামার
এই পোড়খাওয়া গোয়েন্দাদের মতো অ্যানালিসিস শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি।
পীযূষবাবু
বললেন, “ব্রাভো, মিস্টার ধূমকেতু!
কে বলবে, এটাই আপনার জীবনের প্রথম কেস। আপনার
উপযুক্ত পারিশ্রমিক আমি দেব। আপনি
আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।”
পীযূষবাবুর
মুখে নিজের ভূয়সী প্রশংসা শুনে ধূমমামা আপ্লুত হয়ে হাসল একবার, তারপর আবার মন
দিল চিংড়ির মালাইকারিতে।
‘যাক, শেষমেশ তবে এই
অসভ্য কেসটার সমাধান হল।’ মনে মনে ভাবলাম
আমি। তারপর সামনে রাখা বাটি থেকে
একটি বড়ো সাইজের ইলিশের পিস পাতে তুলে নিলাম।
----------
ছবি - নচিকেতা মাহাত
No comments:
Post a Comment