ফিরে পাওয়া
অভিজ্ঞান
রায়চৌধুরী
“দীপু না?”
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। সৌম্য, আমার
স্কুলের বন্ধু। বারো বছর এক সঙ্গে পড়াশোনা করেছি। তিরিশ বছর বাদে দেখা। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে ওর? গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হাড়
জিরজিরে চেহারা। চোখের তলা বসা। মাথাজোড়া টাক। বয়স যেন সময়ের অনেক আগেই চোখে-মুখে
থাবা বসিয়েছে। একটা রংচটা সবুজ শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে অজানা বিষণ্ণতা।
জড়িয়ে ধরে বলে উঠলাম, “কী খবর?
এরকম চেহারা হয়েছে কেন? কী করিস এখন?”
“বলছি,
একটু ফাঁকায় চল। এখানে কথা বলতে অসুবিধা হবে।”
ঠিকই, এই ভিড়ের মধ্যে কথা বলা অসম্ভব। ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে। এ ওর গায়ের ওপর এসে পড়ছে। যতদূর দেখা যায় শুধুই লোকের মাথা।
নানান বয়সের মহিলা-পুরুষ-বাচ্চা সবাই
উৎসবে মেতেছে। খানিক দূরে দূরে স্টল। তাতে নানান ধরনের পানীয়
রাখা। অনেকরকম ফাস্টফুডের স্টল।
প্রায় এক মাইল দূরে স্টেজ। খালি চোখে প্রায় দেখাই
যাচ্ছে না। তবে জায়গায় জায়গায় বড়ো বড়ো ইলেকট্রনিক স্ক্রিন রাখা, তাতে স্টেজের ছবি
দেখানো হচ্ছে। বেশ কয়েকজন কলাকুশলী একটা মাতাল করা গানের তালে তালে স্টেজের
ওপর নাচছে। সেই একই ছন্দে নেচে চলেছে এই মাইল খানেক এলাকায় ছড়িয়ে থাকা দর্শকরা। কারও যেন কোনও পরিচয় নেই, লজ্জা নেই, দ্বিধা নেই। বাঁধন ছেঁড়া
আনন্দে পরিচিত-অপরিচিতের দাগ মুছে গেছে। আমি নিজেও খানিক আগে নাচছিলাম।
অবশ্য এখনকার দিনে এমনিতেও চেনা-অচেনা কথাটার তাৎপর্য হারিয়ে গেছে। চেনা মুখ খুব
দ্রুত অচেনা হয়ে যায়, অচেনারা চেনার জায়গা নেয়।
সে যাক গে, পরিবর্তন তো আসবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। ভিড়
এড়িয়ে ফাঁকা জায়গার খোঁজে সৌম্যর পিছু নিই। খানিক বাদে একটা ক্যাফের দিকে নির্দেশ
করে সৌম্য। বলে ওঠে, “চল, ওখানেই বসা যাক। দুটো কফির অর্ডার দে। আমার পকেট
ফাঁকা।”
ওর চেহারা দেখে আগেই বুঝেছিলাম, কথাতেও বুঝলাম ওর অবস্থা
খুবই খারাপ।
দু’কাপ এসপ্রেসো নিয়ে মুখোমুখি বসলাম। বাইরের উন্মাদনা,
চিৎকার, শরতের নীল আকাশ, হালকা সাদা নানান নক্সার মেঘের জিগস পাজল ভাঙাগড়া দেখার
মধ্যে যে আনন্দ ছিল, সবটুকু হারিয়ে গেল সৌম্যর মুখের দিকে একঝলক
তাকাতেই। দুঃখ-বিষণ্ণতা যে মুখে এত গভীর দাগ কাটতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করতে
পারতাম না। কপালে দুই ভুরুর মধ্যে গভীর খাঁজ। আমার দিকে খানিকক্ষণ
একদৃষ্টে তাকিয়ে বলে উঠল, “কেমন আছিস?”
“ভালো,
একরকম চলে যাচ্ছে।”
“কী
করছিস?”
“আই
রোবটসের নাম শুনেছিস? আড্ডা মারার রোবট তৈরি করে। ওরই মার্কেটিংয়ে আছি।
‘দুঃখের সময়-সুখের সময়-সবসময়-আপনার সঙ্গী–আই রোবট’ অ্যাডটা দেখেছিস? আমার
তৈরি।” বেশ একটা নাটকীয় কায়দায় বলে উঠলাম।
কিন্তু উৎসাহটা নিভিয়ে দিয়ে একটা বড়ো
দীর্ঘশ্বাস ফেললে সৌম্য। কফির কাপটা মুখের কাছে এনে আওয়াজ করে একটা চুমুক দিয়ে ফের
বলে উঠল, “বাড়ি থেকে বেরোস না একদম, তাই না?”
“না, তেমন
দরকারই হয় না। বাড়িতে থেকেই কাজ করি। ওই মাঝে মধ্যে রেয়ারলি বেরোই।”
“তার মানে
খোঁজখবর কিছুই রাখিস না, তাই তো?”
“তা কেন
রাখব না? ইন্টারনেট আছে, খবরের কাগজ আছে, টিভি আছে, ফোন আছে, ভার্চুয়াল নলেজ
সেন্টার আছে, নিউজ ফিড আছে - চাইলেই ঘরে বসে সারা বিশ্ব।
সব খবর রাখি। তা হঠাৎ করে এমন প্রশ্ন?”
মুচকি হাসল সৌম্য। হাসিতে শ্লেষ মাখানো।
“বল তো আজ
এখানে এত লোকের ভিড় কেন?”
“কেন আবার, ফুটবলে ‘সোনার বাংলা’ জিতেছে বলে! এত বড়ো একটা টুর্নামেন্ট।
তাই সরকার থেকেই সব আয়োজন করেছে। উফ, চারদিকে যা হুল্লোড়। বিশাল অ্যাচিভমেন্ট।”
একটু ব্যঙ্গের হাসি হাসল সৌম্য। তারপর কফির কাপটা নামিয়ে আমার
দিকে তাকাল।
“তুই না
বিজ্ঞানের খুব ভালো ছাত্র ছিলি! সব লজিক হারিয়ে ফেললি নাকি?”
চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ভৎর্সনার সুরে ফের বলে
উঠল, “সব ব্যাটা গাধা। চোখে ঠুলি বেঁধে বসে আছে। তুইও ওদের দলে
ভিড়েছিস! আচ্ছা, তোর অবাক লাগে না? সামান্য একটা খেলা দুটো টিমের মধ্যে, তাও
আবার একই দেশের। তা নিয়ে এত হইচই! ওদিকে রোজ লক্ষ লক্ষ লোক না খেয়ে মরছে। জলের
অভাবে চাষবাস বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা তাদের খবরও রাখি না। সব
লজিক আমরা হারিয়ে ফেলেছি। কাঠের পুতুলের মতো ওদের কথায় উঠছি-বসছি-নাচছি। ওরা যা বলছে
বিশ্বাস করছি।”
শেষের দিকের কথাগুলো সৌম্য ফিস ফিস করে বলল।
কিন্তু ও যে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে তা ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারছিলাম। ওর
রগের শিরাগুলো দপদপ করছিল।
“ওরা মানে, কারা?”
“গর্ভনমেন্ট, মিডিয়া সব একদল
হয়ে আমাদের যা বোঝাচ্ছে, আমরা তাই বুঝছি। যা দেখাচ্ছে, তাই
দেখছি। ওরা যদি সূর্যকে দেখিয়ে বলে চাঁদ, আমরা ভাবি তাই তো, চাঁদই
হবে।”
বাকি কফিটা একচুমুকে শেষ করে সৌম্য বলে উঠল, “কাল
আসছিস? ময়দানে? মঙ্গলের উদ্দেশে যারা রওনা হচ্ছে তাদের জন্য হাততালি দিতে?”
কথাটা যেভাবে শেষ করল সৌম্য, তাতে
স্পষ্ট একটা ব্যঙ্গ ছিল। বললাম, “ভালো মনে করেছিস। ঠিকই তো। কালই তো রকেট লঞ্চ করা হবে
শ্রীহরিকোটা থেকে। অবশ্যই থাকব।”
“তাহলে
কাল দেখা হবে, আজ চলি,” বলে হঠাৎ করে উঠে দাঁড়াল সৌম্য। ফের বলল, “তোকে
ট্যাগ করে রেখেছি যাতে লোকের ভিড়ে তোকে খুঁজে পেতে অসুবিধে না হয়।” বলে ওর
ফোনে আমার আইডিটা সেভ করে নিল।
এরপর যেরকম হঠাৎ করে এসেছিল, সেরকম
হঠাৎ করে বেরিয়ে গেল। কফির দাম মিটিয়ে আবার আমি ভিড়ে গিয়ে মিশলাম।
সৌম্যর সঙ্গে কথা বলে মনে যেটুকু দ্বিধাদ্বন্দ্ব হয়েছিল তা ভুলতে মিনিটখানেক লাগল।
ড্রিঙ্কস হাতে মঞ্চের গানের তালে তালে পা ফেললাম। ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলাম।
পরদিন সন্ধ্যা সাতটা। ময়দানের বেশ খানিকটা দূরে
ম্যাগলেভ ট্রেনটা থামল। সেখান থেকে আধঘণ্টার হাঁটা। স্টেশন থেকেই সারি দিয়ে লোক
এগিয়ে চলছে। কাউকে জিজ্ঞাসা করার দরকার নেই। জনস্রোত একমুখী। ময়দানে ঢোকার আগেই
আমার ফোনটা বেজে উঠল। সৌম্য। বলল, “দাঁড়া, তুই যেখানে আছিস সেখানেই থাক। খুঁজে
পেয়েছি। পাঁচ মিনিটে আসছি।”
আজকাল টেকনোলজি এত এগিয়ে গেছে যে একজন আরেকজনকে
খুঁজে বের করতে জিপিএস বেসড ট্রাকিংয়ের সাহায্য নেয়। আইডিটা জানা থাকলেই হল। খুঁজে বের
করা জলের মতো সোজা।
চার মিনিটের মাথায় বাঁ-কাঁধের
ওপর হাতটা এসে পড়তেই ঘাড় না ঘুরিয়েই বুঝলাম
সৌম্য এসে গেছে।
“চল, আর
তো পাঁচ মিনিটের মধ্যেই লঞ্চ।”
ওর সঙ্গে এগোলাম। এটা একটা আলাদা মজা। হাজার হাজার, ভুল
বললাম, লক্ষ লক্ষ লোক বড়ো স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তাতে শ্রীহরিকোটা থেকে লাইভ
ভিডিও দেখানো হচ্ছে। সবার হাতে চিপস, পপকর্ন, কোল্ড ড্রিঙ্কস। চোখে মুখে উত্তেজনা। রকেট লঞ্চের
আর কয়েক মিনিট বাকি। যারা এসেছে
তাদের মধ্যে ক’জন স্যাটেলাইটের অর্থ বোঝে, তাও জানি না। তবে এরকম
একটা সেলিব্রেশন দেখার বিনা পয়সার মজা কে মিস করে! আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সৌম্য
বলে উঠল, “কী, টেনশন
হচ্ছে নাকি?”
“হ্যাঁ, তা তো
একটু হবেই। ভারত থেকে মঙ্গলে ফার্স্ট টাইম একশোজন
সাধারণ লোককে নিয়ে মহাকাশ ভ্রমণ। স্পেস ট্রাভেল। একটু ভুল হলেই কী হবে বল তো? আর
কত খরচ!”
“ভুল হবে
না। সব দেখবি সময়মতো হয়ে যাবে। ঠিক যেমন অন্য সব মিশনেও হয়। আসলে অভিযান হলে তবে
তো ব্যর্থতার প্রশ্ন! সব ধাপ্পা!”
আমি সৌম্যর কথার উত্তর দিলাম না। ওর মাথার যে একটু
গণ্ডগোল হয়েছে তা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। রুদ্ধশ্বাসে
দাঁড়িয়ে রইলাম। পুরো ময়দান জুড়ে কয়েক মিনিটের নীরবতা। দু-একটা বাচ্চার কান্না আর বায়নার শব্দ। এর মধ্যেই হঠাৎ
হাততালির ঢেউ তুলে জায়ান্ট স্ক্রিনে লঞ্চ ভেহিকল ASLV-50 মাটি ছেড়ে উঠল। কয়েক সেকেন্ড। স্পেস-ক্র্যাফটটা
ফোকাসের বাইরে হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে ফুটে উঠল ‘মিশন
সাকসেসফুল’।
হাত তুলে পাগলের মতো লাফাতে শুরু করলাম। ঠিক যেমন
আমার আশেপাশের হাজার খানেক লোকও আনন্দে আত্মহারা হয়ে লাফাচ্ছে। কেউ জামা
খুলে আকাশে ছুঁড়ে দিচ্ছে, তো কেউ
আনন্দে মাটিতে বসে পড়েছে। কেউ বা মদের নেশায় কী যে বলছে
তার কোনও ঠিক নেই। একটা দেশাত্মবোধক গান শোনা যাচ্ছে।
হঠাৎ সৌম্যর দিকে চোখ পড়ল। ঠোঁটের কোণে হাসি।
জিনসের দু’পকেটে হাত দিয়ে একইভাবে চারদিকের পরিবেশের মধ্যে
নিতান্তই বেমানানভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অবাক চোখে ওর দিকে তাকাতেই ও বলল, “আচ্ছা, তোর
একবারও মনে হয় না যে এসব সাজানো?”
“মানে?”
“পুরোটাই
সাজানো। কোনওরকম লঞ্চই হয়নি। পুরো ভিডিওটাই আগে থেকে তৈরি। লোক
ঠকানো!”
“কী
বলছিস! তোর মাথার ঠিক আছে? এ নিয়ে একমাস ধরে এত লেখালেখি হচ্ছে। কত মিডিয়া ছিল
দেখলি না লঞ্চ সাইটে? স্যাটেলাইট লঞ্চ স্টেশনের কন্ট্রোল রুমটাও দেখাচ্ছিল। কত
সায়েন্টিস্ট! সব মিথ্যে?”
“হ্যাঁ,
মিথ্যে। সব ধাপ্পাবাজি। আসল ইস্যু থেকে লোকের মন সরিয়ে রাখার জন্য। আচ্ছা দীপু, আজকের
দিনটা তোর খেয়াল আছে? ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। আজকে পৃথিবী মঙ্গল থেকে অনেক দূরে থাকে।
কখনও আজকের দিনে এই অভিযান হওয়া উচিত? আজ পাঠালে সেই স্পেস-ক্রাফট
মঙ্গলে পৌঁছবে ২০২৫-এ, যেখানে এ-বছরের
নভেম্বরে পাঠালে ওটা মঙ্গলে পৌঁছবে ২০২৪-এ। এই সময়ে পৃথিবী মঙ্গল থেকে সব থেকে
দূরে থাকে। এসময়ে কখনও মহাকাশযাত্রা হতে পারে? অবাস্তব! যারা এটা জানে তাদের কথা
বলতেও দেওয়া হয় না।”
আমি অবাক চোখে তাকালাম সৌম্যর দিকে। এ তো
পাগলের প্রলাপ নয়। তবুও বললাম, “অন্য কোনও কারণও তো থাকতে পারে। আমরা তো আর এ-ব্যাপারে
এক্সপার্ট নই।”
“জানি তুই
এত সহজে আমার কথা মেনে নিবি না। আচ্ছা, তোকে আরেকটা জিনিস দেখাই। শ্রীহরিকোটার কারেন্ট
ওয়েদার। বলে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে শ্রীহরিকোটার ওয়েদার দেখানোর চেষ্টা করল সৌম্য।
আমার কাছে খবর আছে যে ওখানে বৃষ্টি হচ্ছে। আর ওই স্ক্রিনে দেখলি কীরকম
ঝকমকে আকাশ দেখাল?” বলে সৌম্য ফোনের স্ক্রিনে ফুটে ওঠা ওয়েদার রিপোর্টটা
আমায় দেখায়।
তাতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে সানি স্কাই।
টেম্পারেচার ৩২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। ঠিক যেরকম
দেখাচ্ছিল।
এবার চেঁচিয়ে ওঠে সৌম্য, “ওরা
ওয়েদার রিপোর্টও চেঞ্জ করে দিয়েছে! কী সাংঘাতিক! মাই গড! এসব কী হচ্ছে! তুই
বিশ্বাস কর দীপু, ওখানে বৃষ্টি হচ্ছে।”
আমি ওর পাগলামি দেখে মুচকি মুচকি হাসছিলাম। বলে
উঠলাম, “সৌম্য, তুই বাড়ি যা। এসব নিয়ে মাথা খারাপ করিস না। এসব
সাজিয়ে ওদের লাভ কী! তুই মনের মধ্যে থেকে এসব নেগেটিভিটি দূর কর।
সব কিছুতেই প্রশ্ন তোলা যায়। কিন্তু লজিক্যালি ভেবে দেখ। খুব সহজ ঘটনাকে শুধু শুধু
জটিল করিস না।”
এবার সৌম্যর চোখে রাগ ফুটে উঠল। “তোদের
কাছে লজিক শিখতে হবে, তাই না? ওই, ওই যে লোকটা, যে
সায়েন্টিস্টের অভিনয় করছিল কিছুদিন আগে সাবানের বিজ্ঞাপনে অভিনয় করত। চাপদাড়ি
লাগিয়ে আর চোখের মণির কালার বদলে আমার চোখ এড়িয়ে যাবে, তাই না! এই
কন্ট্রোল রুমের প্রত্যেকটা সায়েন্টিস্ট সাজানো! মাঝারি মানের অভিনেতা! বিজ্ঞানের
কিছুই বোঝে না।”
আমি হেসে উঠলাম। “কেন, তোর
ওদের উপরে এত রাগ কেন? চল, আমার বাড়ি চল।” বলে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
ভিড় এড়িয়ে বেরোতে যাব, হঠাৎ
থমকে দাঁড়ালাম! ঠিক রোহণের মতো দেখতে একটা ছেলে।
আকাশটা যেন একটু ধূসর হয়ে গেল। রোহণ যখন চলে যায়, তখন ওর চার বছর বয়স হয়েছিল। কোনও কথা না বলে সৌম্যর পিছু পিছু হাঁটতে থাকলাম। মিনিট কুড়ি হেঁটে চললাম। কথা নেই। চিৎকার চেঁচামেচি পিছনে
ফেলে এসেছি। খানিকক্ষণ চাওয়া পাওয়ার হিসেব কষে মনটা যেন হাল ছেড়ে অচেনা কোন দেশে
হারিয়ে গেল। গঙ্গার ধার দিয়ে হেঁটে চলেছি। ফুরফুরে হাওয়া গায়ে এসে লাগছে। দু’দিকে
সাজানো বাগান। গাছের ফাঁক দিয়ে আধফালি চাঁদ। পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। সব মিলিয়ে মাথা বেশ
ফুরফুরে লাগছিল। সৌম্য গুনগুন করে গাইতে গাইতে চলেছে। কথাগুলো কানে এল।
রবীন্দ্রসঙ্গীত।
দিনেকের দেখা, তিলেকের সুখ
ক্ষণিকের তরে শুধু হাসিমুখ
পলকের পরে থাকে বুক ভরে
চিরজন্মের বেদনা
ওর গানের গলা বেশ ভালো। হঠাৎ গান থামিয়ে সৌম্য জিজ্ঞেস করল, “তুই সত্যিই ভালো আছিস তো, দীপু?”
“হ্যাঁ, দিব্যি আছি। যেদিকে হাওয়া থাকে সেইদিকে কাটা ঘুড়ির মতো উড়ে যাই। সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে থাকি। কোনও পিছুটান নেই।”
শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল সৌম্য। তারপর বলে উঠল, “শুধু তুই
কেন, প্রায়
সবাই ভালো আছে। কোনও দায়িত্ব নেই, কোনও ভাবনা
নেই, খারাপ-ভালো বোধ নেই। সব খুইয়েই এখন আমরা শুধু সেই মুহূর্তের আনন্দে মেতে আছি।
শেষ কবে দুঃখ পেয়েছিস, তা মনে পড়ে দীপু?”
মাথা নাড়লাম। সত্যিই মনে পড়ে না। সব সময়
দিব্যি আনন্দে আছি।
“কেন
জানিস? ভেবে দেখেছিস কারণটা? ওরা আমাদের কাঁদতে দেয় না। আমাদের মনও ওরা
নিয়ন্ত্রণ করে। আয়নোস্ফিয়ারে বিশেষ কম্পাঙ্কের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য
পাঠানো হয়। যা ফিরে এসে ছড়িয়ে পড়ে সারা রাজ্যে। আমাদের ব্রেনে আনন্দের
সঞ্চার করে। দুঃখের দিনেও তাই আমরা দুঃখ পাই না। কাঁদতে আমরা তাই ভুলে গেছি। খুব
কষ্টেও মুখের হাসি মোছে না। ওরা জানে যে আমরা চারপাশের কঠিন সত্যকে ভুলে থাকলে ওরা যা ইচ্ছে তাই করে
যেতে পারবে। কোনও বিদ্রোহ হবে না। কেউ প্রশ্ন তুলবে না। ওরাও নিশ্চিন্তে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে আরও অপকর্ম করে
যেতে পারবে। আমিও যদি তোদের মতো হতে পারতাম!”
খানিক থেমে আবার বলল, “কিন্তু পারলাম
না। এই এটার জন্য।”
পকেট থেকে ছোটো বলের মতো কিছু একটা বার করল সৌম্য। তারপর বলল, “আমার
আবিষ্কার। এটা চালু থাকলে সরকারি রেডিও ওয়েভের কোনও
প্রভাব পড়ে না। তুই স্বাভাবিকভাবে
ভাবতে পারবি। আর তখনই সত্যি ঘটনাগুলো তোর চোখে পড়বে। অসহায় মানুষগুলোর চিৎকার কানে আসবে।
নিজের ফেলে আসা স্মৃতি ফিরে এসে মনের সঙ্গে কথা বলবে।”
বলে ছোটো বলটার উপর একটা জায়গা আলতোভাবে টিপল সৌম্য। একটা
সবুজ আলোর আভা বলটা থেকে বেরোতে শুরু করল। হাতে নিলাম। হাল্কা গরম। ভিতরে কিছু
একটা জিনিস খুব জোরে কাঁপছে।
“চল, ওই
বেঞ্চটায় বসা যাক।”
খানিকদূরে একটা বেঞ্চ ছিল। দু’জনে
সেখানে গিয়ে বসলাম। আমার হাতের বলটা থেকে অদ্ভুত সবুজ আভাটা এখনও বেরুচ্ছে।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকলাম ওটার দিকে। গঙ্গার ধারের এই বাগানটায় একসময় রোহণকে নিয়ে নিয়মিত আসতাম।
কণাও থাকত সঙ্গে। এখানকার স্লিপগুলোতে বার বার চড়ত রোহণ। গাছগুলোর
মধ্যে লুকোচুরি খেলতাম ওর সঙ্গে। খানিকক্ষণ
লুকোচুরি খেলার পর আমাকে খুঁজে পেলেই ছুটে এসে অভিমানী চোখে আমায় জড়িয়ে ধরত। বল নিয়ে ক্যাচ ক্যাচ খেলতাম।
রোহণ বলটাকে ধরতে পারলেই পরক্ষণেই ফেলে দিয়ে হাততালি দিয়ে উঠত
আনন্দে। কী সুন্দর যে ছিল সেই দিনগুলো!
তারপর এল সেই দিন! স্কুলের গাড়ির মাতাল
ড্রাইভারটার কাছে আসলে কোনও লাইসেন্সও ছিল না। ঘুষ দিয়ে নকল লাইসেন্স জোগাড় করেছিল।
একটা গাছের সঙ্গে ধাক্কা মেরেছিল গাড়িটা। তিরিশটা
বাচ্চার মধ্যে শুধু পাঁচজন বেঁচেছিল। রোহণ সে পাঁচজনের মধ্যে ছিল না। সে
ড্রাইভারের কোনও শাস্তি হয়নি। শুনেছিলাম তার নাকি চেনাজানার মধ্যে কোন এক প্রভাবশালী
মন্ত্রী ছিল। ব্যস, সব দোষ মাফ।
সবকিছুর সুর কেটে গেল। যেন একটা চিল এসে হঠাৎ করে ছোঁ মেরে
সব-সবকিছু কেড়ে নিয়ে গেল! একটা মুহূর্ত, একটা খবর, ব্যস, তারপর
সব শেষ। সময় যেন ব্ল্যাকহোলে হারিয়ে গেল।
আমি মাথা নিচু করে মুখ ঢেকে বসেছিলাম বেশ
খানিকক্ষণ। হাতে চোখের জলের
স্পর্শ বুঝিয়ে দিল কাঁদছি। আমি এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলাম। নিজের এ কান্না
আমি বহুদিন শুনিনি। মনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া কথার যেন আমি হদিশ পাইনি। মনে হল একটা মরুভূমির মধ্যে হারিয়ে গেছি। সামনে শুধু একটাই গাছ।
তাতে একটাও পাতা নেই। মনে হল সে গাছ যেন আমারই মতো। বেঁচে থেকেও
অস্তিত্বহীন।
চাঁদ হারানো এ সন্ধেয় যেন
নিজেকে নিজের কাছে হঠাৎ করে খুঁজে পেলাম। বেদনাও যে এত আপনার হতে পারে টের
পেলাম। এ স্মৃতিতেই মিশে আছে আমার পরিচয়।
সৌম্য আমার পিঠে হাত দিয়ে বলে উঠল, “মন খারাপ করিস না, দীপু।
বলটা দিয়ে দে, ফেরা যাক। সূর্যাস্তের
শেষ রঙ ফের দেখতে পাবি। দেখ, ওদিকে তাকিয়ে দেখ। মনে হচ্ছে যেন কোনও এক শিল্পী তুলির
টানে তোর মন ভালো করার চেষ্টা করছে। বারবার রঙ বদলে বদলে আরও ভালো করে আঁকার
চেষ্টা করছে। এতে কিন্তু কোনও কারসাজি নেই।”
(এখনও পর্যন্ত
অসংকলিত গল্প। পূর্বে প্রকাশিত হলেও ম্যাজিক ল্যাম্পের জন্য সামান্য পরিবর্তিত)
অলঙ্করণঃ
স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়