জাগরণ
পার্থপ্রতিম মাইতি
(আর্থার সি. ক্লার্কের দি এয়োকেনিং গল্পের সুদূর ভাবানুবাদ)
প্রভু স্বপ্ন দেখার ভয়
পাচ্ছিলেন। তবে প্রভু স্বপ্ন দেখতে ভালোই বাসতেন। বলতেন, স্বপ্ন না থাকলে বেঁচে থাকার আনন্দ আর কোথায়। জীবনযাপনের নামে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলা
অস্তিত্বের নিদারুণ অবসাদে স্বপ্নটাই অনেকের অন্যতম বিনোদন তো বটেই। কিন্তু
সমস্যাটা হল, প্রভু মোটেই একরাত্রির সুইট ড্রিমসের ভয় পাচ্ছেন না। এইমুহূর্তে তিনি
একশো বছর ঘুমোতে চলেছেন, আর ভয়টা
হল, একশো বছরের ম্যারাথন স্বপ্নে তার মাথাটাই শেষপর্যন্ত
নষ্ট হয়ে যেতে
পারে। পুরো পরিকল্পনাটাই বানচাল হয়ে যাবে তাহলে।
প্রভুর সেইদিনটা স্পষ্ট
মনে আছে। কয়েকমাস
আগেই, যখন মুখ্য চিকিৎসক সোজা
বিজ্ঞানসভা থেকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ছুটে এসে জানিয়েছিল, “প্রভু, আপনার হার্ট ফেলিওর করছে, আর বড়জোর একটা বছর আমরা
সামলে রাখতে পারব। তারপর... মানে...”
ডাক্তারের ইতিউতি ভাব
থেকেই সবকিছু প্রভুর জানা হয়ে গিয়েছিল। না, মৃত্যুর ভয় তিনি পাননি। কিন্তু তার কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। জেনেশুনে কাজ ফেলে রেখে
চলে যাবেন এতটা অলস তিনি নন। সেটা
নতমুখ ডাক্তারকে জানিয়ে দিতে প্রভু দেরি করলেন না।
“তারপর আর কোনও কিছুই
তোমাদের হাতে নেই।” প্রশ্ন নয়, নৈর্ব্যক্তিকভাবে কথাটা ছুঁড়লেন প্রভু।
“আজ্ঞে না, প্রভু। একশো বছর ধরেই কৃত্রিম হৃদয় বানানোর চেষ্টা
চলছে। আমাদের বিজ্ঞানীরা চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না। কিন্তু...
আশা করা যায় আর একশো বছরের ভেতর...”
“ঠিক আছে,” শান্ত ঠান্ডা গলায় প্রভু শব্দদুটো উচ্চারণ করলেন।
ডাক্তার আরও সঙ্কুচিত হয়ে যেন নিজের পোষাকের ভেতরে গুটিয়ে গিয়েছিল। প্রভু
বক্তব্যটা শেষ করলেন, “আমি আরও একশো বছর অপেক্ষা করব। তোমরা আমার জন্য একটা কিছু বানিয়ে দাও। আমার শরীর
যাতে নিরাপদে থাকে, একশো বছরে অনেক ধকল সহ্য করতে হতে পারে। তারপর ঘুম পাড়িয়ে দাও। তোমাদের সাম্প্রতিক
প্রজন্মের হাইবারনেশন টেকনোলোজি খুব সহজেই এটা করতে পারবে তা আমি জেনেছি।”
মুখ্য চিকিৎসক কী ভেবে
বলল, “যথা আজ্ঞা, প্রভু। তবে সফল হলেও কারোর ওপরে এখনও পরীক্ষা করা হয়নি সেভাবে।”
হাত নেড়ে বিষয়টার
অপ্রাসঙ্গিকতা বুঝিয়ে দিলেন প্রভু। ডাক্তার বিজ্ঞান সভায় গেল প্রভুর আদেশ নিয়ে। প্রভুর
ইচ্ছাই সকলের ইচ্ছা। তিনি সাক্ষাৎ ঈশ্বরের পুত্র। মানবজাতির ত্রাণকর্তা।
তারপরের একশো বছরে
পৃথিবীতে প্রলয় নেমে এল। সমুদ্রের সব জল উঠে এল ডাঙায়। তীব্র জলোচ্ছ্বাসে মারা গেল
একশো কোটি মানুষ। তারপর হল এমন ভূমিকম্প যা হাজার বছরে কেউ দেখেনি। হিমালয়
ভেঙেচুরে মাটির তলায় চলে গেল। সেই জায়গায় হল বিশাল একটা হ্রদ। ভারতের দক্ষিণ
সীমান্ত দ্রুত উঁচু হয়ে হয়ে গেল পর্বতময়। তারপর থেকে শ্রীলঙ্কা এখন ভূপৃষ্ঠস্থ
উচ্চতম স্থান। যদিও তার উচ্চতা মাপার জন্য কেউ ব্যস্ত ছিল না। এই
চরম বিপর্যয়ের কোনও আগাম বার্তা বিজ্ঞানসভার বিজ্ঞ পন্ডিতদের ছিল না। কিন্তু
সৌভাগ্যক্রমে প্রভুর জন্য প্রস্তুত হাইবারনেশন বক্স সবধরনের বিপদ প্রতিরোধকারী করে
তৈরি করা হয়েছিল। ফলে পৃথিবী ওলটপালট হয়ে যাওয়া ভুবনবিদারী এই প্রকৃতিজ পালাবদলেও
বাক্সবন্দী প্রভুর কোনও ক্ষতি হল না। তবে নির্ধারিত স্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে তিনি
মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলেন। তিনিও যেমন পৃথিবীর অবস্থা জানলেন না, যে ক’জন মানুষ এই বিপর্যয় সামলে বেঁচে রইল তারাও
তাকে ভুলে গেল। হাইবারনেটেড অবস্থায় তিনি অনন্তকাল বেঁচে থাকতে পারতেন। কিন্তু তাঁর অনন্ত ঘুম ভাঙানোর জন্য যে নির্দেশ তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন তা
পালন করার লোক পৃথিবী হতে ততদিনে অবলুপ্ত। একশোর পর কয় শো বছর কাটল তার আর কোনও
হিসেব মানব সভ্যতার ইতিহাসে নেই।
একদিন মহাসাগরের জলে
ভাসতে ভাসতে বাক্সবন্দী প্রভু কোনও এক অজানা দ্বীপের উপকূলে ঠেকলেন। অদ্ভুত জিনিস
নজরে পড়তে ধীরে ধীরে ভিড় জমাল সেখানকার অধিবাসীরা। কিছুক্ষণের মধ্যে বাক্স খোলা হল। কয়েকশো বছরের ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন
প্রভু। অনেক কাজ বাকি রেখে গেছিলেন তিনি। তাঁর জন্য অপেক্ষায় আছে অনন্ত ক্ষমতার
শাসনদন্ড, প্রজার ভক্তিভান্ড। অসীম দুর্বলতাবোধ সারা শরীরে। কিন্তু উজ্জ্বল চোখে সামনে তাকালেন তিনি। যা দেখলেন, অন্য কেউ নিশ্চয়ই আতঙ্কে আত্মহারা হত। প্রভু হাসলেন। বিষণ্ণ সেই হাসি। আর
তারপরেই তাঁর চোখদুটো
চিরকালের মতো বুজে গেল। প্রাণের সাড়া পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়ার আগেই মস্তিষ্ক অন্ধকার
হয়ে গেল। ছোট্ট একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বহু শতবর্ষ আগলে রাখা প্রাণটা ত্যাগ করলেন প্রভু।
প্রভু
নির্বোধ নন। একপলকেই তিনি সবকিছু বুঝে নেন। তিনি ভূয়োদর্শী। নতুন পৃথিবীর অধিকার
নিয়ে মানুষ আর পতঙ্গপ্রজাতির সংগ্রাম ভবিতব্য ছিলই, তা তিনি জানতেন। কিন্তু যা আশা করেননি
তিনি, মুখের ওপর ঝুঁকে পড়া অজানা দ্বীপের জীবগুলোকে দেখে তা
বিশ্বাস করতেই হল তাঁকে। তিনি একশো বছর নয়, ঘুমিয়েছেন কয়েকশো
বছর।
আর
ইতিমধ্যেই মানুষ আর পতঙ্গপ্রজাতির সংগ্রাম
শেষ হয়ে গেছে। পরাজিত মানুষ।
_____
অলঙ্করণঃ ঋতম মুখার্জী
খুব সুন্দর সাবলীল অনুবাদ।
ReplyDelete