বইঃ ঝম ঝম
লেখকঃ শাশ্বত কর
প্রকাশকঃ পত্র ভারতী; প্রচ্ছদঃ
মৃণাল শীল
আলোচনাঃ তন্ময় বিশ্বাস
এ গল্পের শুরু সে অনেককাল আগে। অনেক অনেক আগে যখন সব বড়োরাই ছোটো
ছিল, আকাশ এসে মিশত নদীর জলে আর
বকরা সুযোগ বুঝে কড়ি দিয়ে যেত গোলাপি নখে? এ গল্প সেই তখনকার।
সেই চুপকথার সময় বালিশের ওপর বুক ঠেকিয়ে আজকেরই কেউ
এক পা দোলাতে দোলাতে হয়তো পড়েছিল অদ্ভুত এক রূপকথা। যে রূপকথায় একেকটা পরতে পরত ঢেকে থাকে
পেঁয়াজ খোসার মতো। সে
গল্পের শুরু থেকেই থাকে চরিত্রদের আনাগোনা। নতুন নতুন ক্যারেকটার আসছে তো আসছেই। একটা চ্যাপ্টারের সাথে আরেকটার কোনও
মিলই নেই। মনে
হবে লেখক বুঝি আলাদা আলাদা গল্প মিশিয়ে দিয়েছেন উপন্যাসের নাম করে। তাই বলে ছেড়ে দিতে কিন্তু পারবেন না। আরে বাবা, প্রশ্নের উত্তর তো খোঁজা
চাই, নাকি?
গল্প বলতে বলতেই
কোথাও টুক করে বসিয়ে দিচ্ছেন রহস্য, কিংবা ছাড়ছেন দেদার হাসির ফোয়ারা। তখন একটু পড়া থামিয়ে পেট চেপে দুমদাম
হাত-পা ছোঁড়া ছাড়া তেমন একটা উপায় থাকে না। যদি একটু দীক্ষিত টাইপ পাঠক হন, তবে পড়তে পড়তেই বুঝবেন কথা
বলাটাও ঠিক কতটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়। তা নাও যদি বোঝেন, শেষের দিকে এটা তো বুঝবেনই
ছড়িয়ে থাকা পুতির মতো আলাদা আলাদা গল্পগুলো, চরিত্রগুলো কেমন সুন্দর লাল-নীল সুতোতে গেঁথে যাচ্ছে!
সেই সময়ই হয়তো কোনও এক সদ্য কিশোর নিজের গ্রামখানাকে
বুনে নিয়েছিল অদ্ভুতুড়ে এক রূপকথায়। গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপ, সেলুন, ভীতু নাপিত কিংবা বিলের ওপারের
সেই ঘরগুলো,
যেখানে কোনও
কারণ ছাড়াই যাওয়া বারণ এইসব একে একে সেঁধিয়ে যায় তার গল্পে। তারপর তো বেড়ে ওঠে ডালপালা, টকাস করে ডানা মেলে
পক্ষীরাজ। কে
জানে, হয়তো কোনও গোপন ডায়েরিতে লেখাও
হয়েছিল সে গল্প।
কিন্তু তা হলেই বা। Antoine-র ছোট্ট রাজপুত্রটি তো সেই
কবেই বলে গেছে,
যে বড়োরা বড্ড
বেশি সংখ্যার ওপর জোর দেয়। এই ধর না তুমি গিয়ে বললে, “আমি একটা গল্প লিখেছি।”
অমনি তোমাকে জিজ্ঞেস করা হবে, “বয়স কত?”
তোমার ভাঁড়ারে তো তখন সবে মাত্র সাত! কী আর করা তাই বললে? ব্যস
হয়ে গেল।
“খাল্লি ডেঁপোমি, যাও পড়তে বস গে।”
খাতা ঢুকল সিন্দুকে। গোমড়া মুখে বছর গেল। তাই বলে গল্প কি আর হারিয়ে যায়? যায় না তো? সময়ের সাথে সাথে
চারাগাছ হয় মহীরুহ। সাত
বেড়ে গিয়ে হয় সাতাশ। লায়েক সংখ্যা বটে একটা। আবার নামে ডায়েরি। তারপর কাটাকুটি, কি-বোর্ড, দৌড়াদৌড়ি - তবে না গিয়ে হল
গল্পের মতো গল্প?
সেই গল্পতে আবার আছে তোমার মতো কি তোমার ছোটোবেলার মতো
একজন। আরে,
বাবিন গো! চেন?
ও কিন্তু ঠিক
তোমার মতোই। তোমার
মতোই মন দিয়ে ডরেমন দেখে, কাগজ মুড়িয়ে ঘুড়ি জোড়ে, গুটিসুটি মেরে বড়োদের আদর খায়, আবার ঢিসুম ঢিসুম করে রোল
প্লেও খেলে। এই
মহারাজা,
তো এই ফ্যান্টম। মানে সব মিলিয়ে আরেকটা তুমিই আর কি!
তবে সাবধান! শুরু থেকেই কিন্তু গল্প ছুটবে! এই বাবিন, তো এই গগন, তো পরক্ষণেই জটাজুট সমেত কোনও
এক সাধুবাবা। হুঁ
হুঁ এ হল অদ্ভুতুড়ে সিরিজ। এ গল্প সবার। সবাই নায়ক। তারা সবাই রাজা!
আবার অদ্ভুতুড়ে সিরিজ নয়ও। আলাদাও আছে। এই যেমন ধর কোথাও হুড়মুড়িয়ে কিন্তু
স্নিগ্ধভাবে ঢুকে পড়েছে প্রকৃতি। তার যেমনি ঠাটবাট, তেমনি মোহময়ী আঁকাজোখা। আর প্রকৃতির সাথে কি কবিরা না এসে
পারেন? তাও আবার হয়! তাই তো লিখতে লিখতে তারই অজান্তে
এসে পড়ে,
“লাল, যেন সদ্য পোড়া ইটের হৃদয়। সবুজ এমন, যেন সতেরো দিনের স্নিগ্ধ
আপেল।”
আর এই হুট করে ধরা পড়ে গিয়েই যেন কবি, থুড়ি আমাদের বন্ধু লেখক নিজেই
যেন নিজেকে ধমকে ওঠেন, “অর্বাচীন,
দৃষ্টিহীন!”
এগুলো কি লেখকের বুকের ভেতর থেকেই বুড়বুড়ি কাটে? কে জানে! আমরা থোড়াই লেখক! ওসব বোঝাবুঝি চশমাওয়ালা জ্যাঠাদের
কাজ। আমরা
বরং গল্প পড়ি। তবে
খবরদার, ওই জ্যাঠামি করে আবার লজিক
খুঁজতে যেও না যেন। অদ্ভুতুড়ে
ঘরানায় লজিস্টিক চর্চা মারাত্মক অপরাধ।
তবে কখনও কখনও তাল যে কাটে না তা নয়। ওই যে একটু আগে বললাম না, সদ্য পোড়া
ইটের হৃদয়?
এরকমই নরম-সরম মানুষগুলোর ভাবনা মাঝে
মাঝে একটু বেশি বেশি করেই ভেসে পড়েছে গল্পে। আর কে না জানে কোনও কিছুই বেশি বেশি
ভালো নয়। সব
রান্নারই তো এটা ওটার পরিমাপ থাকে। তাই না? এই নুনটা, চিনিটা, ঝালটা, তেমনিই আর কী!
এমনই এক মায়াময় তেল, নুন, মশলার গল্প শুনিয়েছেন শাশ্বত কর। গল্পদাদুর ঢঙে বলে যাওয়া চিরপুরাতন, আবার চিরনতুন সেই শিষ্টের
পালন দুষ্টের দমনের গল্প। সেই দেবতা অসুরেরই এক অন্যরকমের লোকগাথা।
লেখকের নিজের কথায়, ‘এ গল্পে মজা আছে, অদ্ভুত আছে, আর সরল মনের নিরালা গ্রাম
আছে, গ্রামের সহজ সরল মানুষেরা
আছেন, শ্রদ্ধা আছে আর ভালোবাসা আছে
অনেকটা।’
ও, ভালো কথা, টাইম মেশিন আছে কিন্তু। আবার ফোর্থ ডাইমেনশনও আছে। আরও কত কীই না আছে। দুষ্টু লোক আছে, তাদের অদ্ভুত সব যন্ত্র আছে, বিজ্ঞান আছে সুযোগ বুঝে।
তার গল্পই বাবু হয়ে বসে কেমন অনায়াস প্রত্যয়ে বলে গেছেন
লেখক। চোরা
টান টানে সেই গল্প। অদ্ভুতুড়ে
থ্রিলারে যা হয় আর কী! কোথাও
আস্ত মানুষই অদৃশ্য করে ফেলছেন চোখের সামনে, তো কোথাও পারমিশন নিয়েই যেন রহস্যটুকু
গুছিয়ে রাখছেন পরের চমকের জন্য। আবার কোথাও ঘাড় ঘুরিয়ে হালকা চালে
এটা ওটা বলে নিতেও ছাড়েননি। যাকে আমরা গম্ভীর ভাষায় বলি দর্শন। ডেঁপো ছেলেপিলেরা বলে জ্ঞান দেওয়া!
“ইচ্ছের মতো ইচ্ছে করলেই হয়।”
সত্যি এখন গালে হাত দিয়ে ভাবি, এমন গল্প বলতে তো ইচ্ছেটা
থাকা চাই!
ইচ্ছের মতো চাই। সবাই তো পারে না অমন অলৌকিকপনা ইচ্ছে
করতে। কতজন
পারে হুড়হুড়িয়ে বেড়ে যেতে যেতে বয়সের সংখ্যা বাড়াতে বাড়াতে মনটাকে সেই ছোট্টটি রেখে
দিতে? আমি তো ভাই পারিনি।
কোথাও মন খুঁজে ফেরে মাস্টার অংশুমানের সাথে
একটু আধটু মিল। বা
কোথাও সেই নবীন গঞ্জের দৈত্যর, রোগা হলে কী হবে ইয়া মোটা, ফরসা তবে কালোটাও বেশ কুচকুচেই, লম্বা কিন্তু বেঁটের দিকেই
গড়ন ধরনের প্রায় হুবহু ভাষা।
আবার শীর্ষেন্দুর সেই অদ্ভুতুড়ের অদ্ভুত ভাষার টরেটক্কা
কোথাও কোথাও। অবশ্য
গল্প বলা কবেই বা অমন গ্রাফশিট মেনে হয়েছে? তার চলন তো চিরকালই হাটে, মাঠে, আকাশে, নদী ছুঁয়ে ছুটে চলা। বরং আপনি বইখানা নামিয়ে দিন বাড়ির
ছোটোটির সামনে। দেখবেন
ডরেমন, কিতরেসুর থেকে অনেক অনেক বেশি
রসদ পেয়ে যাবে সে। আর
পেয়ে গিয়েই চুকুস করে ঠোঁট ছোঁয়াবে আপনার গালে। তবে ওই যে বললাম, দিতে হবে। না দিয়েই পড়ে না, পড়ে না করে ঘ্যান ঘ্যান করবেন
না প্লিজ।
তবে আঁকা আর লেখার বিস্তর ফারাক যে! এই জনতা-জনার্দনরা খুদে হলে
কী হবে, এরা কিন্তু বেজায় সিরিয়াস। যাক গে, যা বই দেখছি, তাতে দ্বিতীয় সংস্করণ বেরলো
বলে।
_____
Khub sundar alochona. Baita parar agraha thaklo.
ReplyDelete