কাজের
মানুষ
দেবব্রত
দাশ
।। এক।।
ল্যাবরেটরি রুম থেকে যখন ডক্টর
দিব্যেন্দু বসুরায় বেরিয়ে এলেন, তখন অনেক
রাত। দেয়ালঘড়ির কাঁটাদুটো প্রায় এক লাইনে এসে গেছে। মিসেস বসুরায় যথারীতি অপেক্ষা
করছেন স্বামীর জন্যে। গল্পের বইটা বন্ধ করে হাই তুলতে তুলতে ডাইনিং টেবিলের দিকে
পা বাড়ালেন তিনি। আজ ক’বছর তো এরকমই চলছে। প্রথম প্রথম অসহ্য মনে হত, এখন সয়ে গেছে।
ডক্টর বসুরায়কে খুব বেশি উৎফুল্ল
দেখাচ্ছে আজ। কিছু একটা বলবার জন্যে তিনি ছটফট করছেন ভেতর ভেতর। খাবার-টাবারগুলো
গুছিয়ে এনে টেবিলে বসতে না বসতেই স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “এতদিনে সফল হওয়া গেল। গতানুগতিক এই দুনিয়াটার ভোল পালটে দিতে আর বেশি
সময় লাগবে না আমার।”
মিসেস বসুরায় মাংসের কারি ঢালতে ঢালতে
বললেন, “টেলিগ্র্যাফিক ল্যাঙ্গুয়েজ ছেড়ে একটু খোলসা
করেই বল না বাবা! এমন ভাব দেখাচ্ছ, যেন তোমার রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট
আমিই!”
পেল্লায় সাইজের মাংসের একটা টুকরো
মুখে নিয়ে ডক্টর বসুরায় চোখেমুখে কৌতুক ফুটিয়ে তুলে বললেন, “বলছিলুম, এই অলস কুঁড়ের বাদশা মানুষ জাতটার কথা। ভাবলে
দুঃখ লাগে যে, মানুষ তার জীবনকালের অমূল্য এক চতুর্থাংশ সময়ই
কাটিয়ে দ্যায় স্রেফ ঘুমিয়ে! অর্থাৎ, কোনও মানুষ ষাট বছর বাঁচলে
পনেরো বছরই তার কেটে যায় ঘুমের রাজ্যে। সময়ের কী অপচয় বল দেখি!”
মিসেস বসুরায় বললেন,
“তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তোমার
উদ্ভাবিত উপায়টা কী শুনি?”
“সে-কথাই তো বলছি,” ডক্টর বসুরায়
দ্বিগুণ উৎসাহে বলে চলেন, “মানুষের আলসেমি আমি
ঘুচিয়ে দেব জন্মের মতো। এমন ব্যবস্থা করব যে, এখনকার চারগুণ
দ্রুতগতির জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে সে। বিশ্বজুড়ে এই যে দীর্ঘসূত্রতা - অফিসে
লালফিতের বাঁধন, কলকারখানায়,
স্কুল-কলেজে কাজে ফাঁকি সব ঠাণ্ডা করে দেব একেবারে। সোজা কথা, অলসদের পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে এবার।”
স্বামীর কথায় মিসেস বসুরায় বিশেষ ভরসা
পেয়েছেন বলে মনে হল না। আগেও অনেকবার এমন কথা শুনেছেন তিনি। আসলে বিজ্ঞানী-গবেষকরা
বোধহয় একটু বেশিমাত্রায় কল্পনাবিলাসী তাঁদের গবেষণার ব্যাপারে।
দুই দাঁতের মাঝে মস্ত এক হাড় গুঁড়ো
করতে করতে আড়চোখে স্ত্রীর দিকে চেয়ে খোঁচা দিলেন ডক্টর বসুরায়,
“যত নষ্টের মূল হল গিয়ে তোমাদের ওইসব ছাইপাঁশ নভেল-টভেলগুলো। রাবিশ!
দুনিয়াটা গোল্লায় যাচ্ছে ওর জন্যেই। পঙ্গু হয়ে পড়ছে মানুষ জাতটাই। কাজ
করবে কী, মাথায় ঘুরছে তো ওইসব নভেলের ডায়ালগ!”
মিসেস বসুরায় স্বামীর কথা গায়ে না
মেখে হেসে বললেন, “সত্যিই তুমি একজন
বর্ন-সায়েন্টিস্ট! তোমায় ল্যাবরেটরির যন্ত্রগুলোর পাশাপাশি সাজিয়ে রাখলে দিব্যি
মানিয়ে যায়, কী বল?”
খোঁচাটা বেমালুম উপেক্ষা করে ডক্টর
বসুরায় বলতে লাগলেন, “শাস্ত্রেও লিখেছে,
কাজই হল গিয়ে জীবন। কিন্তু মানুষ তা জেনেও জানে না! বিধাতা যে অফুরন্ত সময় আমাদের হাতে দেননি,
তাও মানুষ ভেবে দ্যাখে না! একটা দিনে সেকেন্ডের হিসেবে সময় মোটে
ছিয়াশি হাজার চারশো সেকেন্ড। একান্তভাবেই সুনির্দিষ্ট।”
“তুমি কি সময়টা বাড়িয়ে দেবে নাকি?” মিসেস বসুরায় ব্যঙ্গমিশ্রিত কৌতূহল প্রকাশ করলেন।
ডক্টর বসুরায় বললেন, “না, কমিয়ে দেব। চারভাগের একভাগ করে দেব।”
“মানে!” সবিস্ময়ে স্বামীর মুখের দিকে
চাইলেন মিসেস বসুরায়।
“মানেটা এমন কিছু কঠিন নয়। পার্থিব
একটি দিনরাত্রির সময়দৈর্ঘ্য যখন নির্দিষ্ট, তখন বেশি কাজ আদায় করে নিতে হলে মানুষের অভ্যাসেরই পরিবর্তন দরকার। ভেবে
দ্যাখো, চব্বিশ ঘণ্টার পরিবর্তে যদি বারো ঘণ্টায় দিনরাত শেষ হত তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াত?
মানুষকে প্রয়োজনের তাগিদেই ওই অর্ধেক সময়েই নিত্যনৈমিত্তিক যাবতীয়
কাজকর্মগুলো সেরে ফেলতে হত।”
“মোটেই না, একদিনের জায়গায় দু’দিন
লাগাত সে। বছরটা তো তখন তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের বদলে সাতশো তিরিশ দিনে হত।” মিসেস
বসুরায় বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বাধা দিলেন।
ডক্টর বসুরায় মৃদু হেসে বললেন,
“শুধু তুমিই নও, তোমার মতো আরও দু’জন আছেন। তাঁরা আমার মতটা মেনে নিতে অস্বীকার করছেন। একজন হলেন গিয়ে
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা জীববিজ্ঞানী ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি চৌধুরী। আর একজন
যাদবপুরের কৌস্তুভ দাশ, যিনি গবেষণা করছেন
ইকোসিস্টেমের ওপর। ওই দু’জনের বক্তব্য, পরিবর্তিত
পরিস্থিতিতে মানুষ হয়তো তার অধিগত অভিযোজন ক্ষমতার দরুন কিছুটা দ্রুতগতির
জীবনধারণে অভ্যস্ত হলেও হতে পারে, কিন্তু যে মুহূর্তে পুরনো
পরিবেশে ফিরে আসবে সেই মুহূর্ত থেকেই পরিবেশের প্রভাব তার ওপর কাজ করতে শুরু করবে
এবং কিছুদিনের মধ্যেই পুরনো শ্লথ জীবনে আবার সে প্রবেশ করবে।”
“এটাই তো স্বাভাবিক,” মিসেস বসুরায়
সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে ওঠেন, “বিজ্ঞানের আমি কিছুই
জানিনে বটে, তবে যুক্তিটা মনে ধরেছে আমার।”
“কিন্তু ভিন্ন যুক্তিও তো থাকতে পারে,
আরতি। সেটা শুনে মন্তব্য করাই ভালো।” ডক্টর বসুরায় লেকচার শুরু করেন
আবার, “পুরনো পরিবেশে ফেরানোর পর মানুষকে দ্বিগুণ
পরিমাণ কাজের মধ্যে রাখা হবে। অর্থাৎ, চব্বিশ ঘণ্টার দিনরাত্রির
পরিবেশ হলেও আরোপিত কাজকর্মের দৌলতে আর পুরনো পরিবেশ ভাববার কোনও কারণ থাকবে না।”
“সব জলবৎ তরলং যেন একেবারে! নাও, এবার ওঠো তো দেখি। রাত কত হল, সে খেয়াল আছে?
আবার তো কাকভোরে উঠেই ঢুকবে ল্যাবরেটরিতে!” বলতে বলতে দীর্ঘ হাই
তুললেন মিসেস বসুরায়।
ডক্টর বসুরায় একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন।
।। দুই।।
পরদিন ভোরে ল্যাবরেটরি থেকে
ব্রেকফাস্ট টেবিলে যখন এসে বসলেন বসুরায়, তখন সবে সাতটা বেজেছে। অন্যদিনের তুলনায় বেশ আগেই। ভোরের চা ল্যাবরেটরিতে
পাঠিয়ে দেন মিসেস বসুরায়। আটটা নাগাদ ঘণ্টাখানেকের জন্যে ঘরে
আসেন দিব্যেন্দু বসুরায় এবং তারপর আবার যন্ত্রঠাসা নানান গন্ধের ও শব্দের আধার সেই
বিচ্ছিন্ন চৌহদ্দির মধ্যেই নির্বাসিত করেন নিজেকে।
বসুরায়কে আজ এত তাড়াতাড়ি আসতে দেখে
মিসেস বললেন, “বিজ্ঞানীর যে আজ
সাতসকালেই ছন্দপতন! বলি, ব্যাপার কী?”
স্ত্রীর এ-কথা এড়িয়ে গিয়ে বসুরায়
বললেন, “তোমায় কাল রাতে যা বলছিলাম, সে ব্যাপারে এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পৌঁছনো গেছে। এইমাত্র ফোনে খবর এল,
ব্যাঙ্গালোরের ‘হিন্দুস্থান এরোনটিকস’-এর ওপর বিশেষ ধরনের উড়োজাহাজ
তৈরির যে দায়িত্ব ছিল তা তারা সাফল্যের সঙ্গেই সম্পন্ন করেছে।”
“বিশেষ ধরনের উড়োজাহাজ মানে?” পাঁউরুটিতে মাখন মাখাতে মাখাতে প্রশ্নটা ছুঁড়লেন মিসেস।
স্ত্রীর অপ্রত্যাশিত উৎসাহে দ্বিগুণ
উৎসাহিত হয়ে ব্যাখ্যান শুরু করে দিলেন বিজ্ঞানী। সবকথা স্ত্রীকে একবারটি না শোনালে
পেটের ভাত হজম হয় না ভদ্রলোকের, সে তিনি
শুনুন চাই নাই শুনুন। আর আজ তো মেঘ না চাইতেই জল, জানবার
জন্যে আগ্রহ প্রকাশ! অতএব খুঁটিনাটি কিছুই বাদ নয়, “যেমন ধর, সাধারণ প্লেনের মতো এ প্লেনের ছাদ মেটালের তৈরি নয়। ছাদ প্রায় পুরোটাই
এবং দেয়ালের প্রায় বারো-আনা অংশই অভঙ্গুর কাচের তৈরি। এর ফলে সূর্যের আলো ভেতরে
ঢুকতে পারবে আর তাই দিনরাত্রির সময়-ব্যবধানটুকু নভোচারীদের মনে প্রত্যক্ষ রেখাপাত
করতেও সক্ষম হবে। আকাশযানটির ভেতরে সামনের দিক থেকে একেবারে পেছনের অংশ পর্যন্ত
প্যাসেজের দু’পাশে সারি সারি ছ’টি করে প্রকোষ্ঠ অর্থাৎ মোট বারোটি প্রকোষ্ঠ থাকবে।
ছ’টি নভোচারীদের থাকা-শোওয়া-খাওয়ার জন্যে আর অন্যদিকের ছ’টি কাজ করবার জন্যে।
ভেতরে বায়ু চলাচলের কৃত্রিম ব্যবস্থা রয়েছে। নভোচারীদের শ্বাসকার্যের ফলে উদ্ভূত
কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে পুনরায় অক্সিজেনে রূপান্তরিত করবার জন্যে বায়ুশোধক যন্ত্র
রয়েছে প্রত্যেকটি ঘরে। তাছাড়া উড়োজাহাজটি পরমাণুশক্তি-চালিত,
পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রিত এবং একনাগাড়ে একবছর উড়ে বেড়াতে পারে
আকাশে।”
“তা একবছর ধরে তোমার নভোচারীরা বুঝি
উড়েই বেড়াবে আকাশে আর ওই যে, বারো
ঘণ্টার দিনরাত্রি না কী যে বলছিলে ছাই হিসেবটা, তার দরুনই
বুঝি ওরা কাজের মানুষ হয়ে উঠবে দেখতে দেখতে?” স্বামীর মুখের
দিকে আন্তরিকভাবে দুটো চোখ মেলে ধরলেন আরতি বসুরায়।
“না না, মোটেই তা নয়!” ডক্টর বসুরায় যেন কিঞ্চিৎ আশাহত, “কাজ
না করে খালি খালি উড়ে বেড়াবে, মামাবাড়ির আবদার পেয়েছে নাকি!
ঠাসা কাজের প্রোগ্রাম থাকছে।”
“প্লেনের মধ্যে কাজ!”
“ইয়েস। যেমন ধর, বড়ো বড়ো কোম্পানি ও ফার্মের অডিট রিপোর্ট তৈরি,
দুরূহ জটিল পরিসংখ্যান তথ্যের সাহায্যে পরিসংখ্যান লেখচিত্র প্রস্তুতি, কম্পিউটারের সাহায্যে নানান রকমের গাণিতিক সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে
প্রসেসিং ইত্যাদি এবং হাতেকলমে কাজের মধ্যে থাকবে স্পেয়ার পার্টসের সাহায্যে
ট্রানজিস্টার সেট, ঘড়ি, রেডিও আর নানান
ধরনের ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম প্রস্তুতি। সকাল থেকে শুরু করে শুতে যাবার আগে পর্যন্ত
ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা জীবন। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ ও অন্যান্য
নিত্যকর্মের সময়ও সুনির্দিষ্ট। ঘুম থেকে যথাসময়ে ডেকে তুলবার জন্যে থাকছে অটোম্যাটিক ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা। কোনও ব্যাপারেই একটুও এদিক
ওদিক হবার জোটি নেই।”
“তা না হয় নেই। কিন্তু প্লেন
উড়িয়ে বারোঘণ্টায় দিনরাত্তির শেষ করে দিচ্ছ কীভাবে?”
স্ত্রীর মুখ থেকে এমন প্রশ্ন শোনা
বসুরায়ের কাছে স্বপ্নেরও অতীত। জোর করে যাঁর মগজে কথা ঢুকিয়ে দিতে হয়, তাঁর এ পরিবর্তন! যাই হোক, খুশি চেপে যথাসম্ভব
সহজভাবে বোঝাতে শুরু করলেন ডক্টর বসুরায়, “উড়োজাহাজটি পৃথিবী
পরিক্রমা করবে পশ্চিম থেকে পুবে বিষুবরেখা বরাবর মাইল সাতেক উঁচু দিয়ে। গতিবেগ ঘণ্টায় এক হাজার মাইলের কিছু বেশি (১০৪২ মাইল)। ধর,
যাত্রা শুরুর মুহূর্তে সূর্যোদয় ঘটছে দিগন্তে। দিকচক্রবাল থেকে
মাথার ঠিক ওপরে উঠে আসতে সূর্যের সময় লাগে ছ’ঘণ্টা, অর্থাৎ ঠিক বারোটায় এটা হয়। পৃথিবীর আহ্নিকগতির দরুন পশ্চিম থেকে পুবে ওই
স্থানটি পৃথিবী-পরিধির এক চতুর্থাংশ, অর্থাৎ ছ’হাজার দু’শো
পঞ্চাশ মাইল ছ’ঘণ্টায় অতিক্রম করার ফলেই সূর্য চলে আসে মাথার ওপর বারোটার সময়। কিন্তু পুবমুখী উড়োজাহাজটির গতিবেগ যা, তাতে ওই দূরত্বের অর্ধেক, মানে ৩১২৫ মাইল পার হতে
সময় লাগছে মাত্র তিনঘণ্টা। অর্থাৎ, মাথার ওপর সূর্য আসছে ন’টায়। কারণ,
পৃথিবীর আহ্নিকগতিও যেহেতু উড়োজাহাজের বেগের সমান, তাই ওই তিন ঘণ্টায় সূর্য একই আপেক্ষিক বেগ নিয়ে ৩১২৫ মাইল পশ্চিমে পাড়ি
দিয়েছে। তারপর একই গতিবেগ নিয়ে উড়োজাহাজটি পশ্চিম থেকে পুবে এগিয়ে যাওয়ার ফলে
সূর্য আবার ঢলে পড়ছে দিগন্তে, মানে অস্ত যাচ্ছে তিন ঘণ্টা
পরে ঠিক বারোটায়। এইভাবে একটা দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে ছ’ঘণ্টায়। একই কারণে রাত
সম্পূর্ণ হতেও সময় লাগবে ছ’ঘণ্টা। এবার বুঝলে তো, একটা দিনরাত
শেষ হতে লাগছে মোটে বারো ঘণ্টা সময়?”
“না বুঝে উপায় আছে! তবে মগজের
ঘিলুটিলুগুলো স্বস্থানে আছে কি না দেখতে হবে,” চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে গিয়ে হেসে
বললেন মিসেস বসুরায়। তারপর স্বামীকে উৎসাহিত করবার ভঙ্গিতে বললেন, “সবকিছু ভালো না বুঝলেও এটুকু বুঝেছি যে, তুমি বিরাট একটা ব্যাপার ঘটাতে চলেছ। মানে, অভিনব
একেবারে! এ নিয়ে কোনও বিজ্ঞানীই আজ অবধি বোধহয় ছিটেফোঁটাও মাথা ঘামাননি।”
“না, ঘামাননি,” জোরের সঙ্গে বলে ওঠেন
বসুরায়, “বুঝলে আরতি, যদি সফল হই, তবে বিজ্ঞান জগতের এক নতুন দিগন্ত উদ্ভাসিত হবে আর আমিই হব প্রথম পথিকৃৎ।”
ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের আড়ালে মিসেস বসুরায়
স্বামীকে যে কতখানি শ্রদ্ধা করেন তা ওই মুহূর্তে বোঝা গেল তাঁর দু’চোখের
সাফল্যকামী দৃষ্টিতে।
।। তিন ।।
কঠিন পরীক্ষার পর নভোচারী হিসেবে
নির্বাচিত হল পাঁচজন তরুণ এবং একজন তরুণী। তারপর নভোপরিক্রমা শুরুর আগে পাক্কা তিনটি
মাস কঠোর প্রশিক্ষণে রাখা হল তাদের। যতরকম জটিলতা আসতে পারে দীর্ঘযাত্রায়, সেসব বিষয়েই সতর্কতা নেওয়া হল এবং প্রতিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করা হল
নভোচারীদের।
অবশেষে বিশেষ দিনের বিশেষ মুহূর্তে
যাত্রা শুরু করল মহাশক্তিধর উড়োজাহাজ ‘নীল ঈগল’। নামকরণ স্বয়ং
বসুরায়ের। ঈগলের মতোই অচঞ্চল অথচ তীব্রগতিসম্পন্ন এ আকাশযান।
হিন্দুস্থান এরোনটিক্স নভোচারীদের
জন্যে তারিখযুক্ত বিশেষ ধরনের ইলেকট্রনিক ঘড়ি বানিয়ে দিয়েছে, যাতে চব্বিশ ঘণ্টার পরিবর্তে বারো ঘণ্টায় একটি দিনরাত্রি সূচিত হয়।
দিব্যেন্দু বসুরায়ের পরিকল্পনামাফিক
এই উড়োজাহাজে নভোচারীদের কাটাতে হবে পার্থিব ছ’টি মাস। ওদের ওই বিশেষ ঘড়ির
হিসেবমতো একবছর। ঠাসা কাজের যে ফিরিস্তি শোনা গেছে বসুরায়ের মুখে, তাতে সেসবই সম্পূর্ণ করতে হবে ওই সময়সীমার মধ্যে। ব্যর্থ হলে আকাশবিহার
আরও দীর্ঘস্থায়ী করা হবে। অর্থাৎ,
যতক্ষণ না নভোচারী পাঁচটি তরুণ ও একটি তরুণী ঈপ্সিত মানের দ্রুতগতিসম্পন্ন হয়ে
উঠছে, ততক্ষণ পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে না ওদেরকে।
ভূপৃষ্ঠের কন্ট্রোল রুম অর্থাৎ
বসুরায়ের ল্যাবরেটরির সঙ্গে বেতার মারফত দৈনন্দিন সংবাদ জানাবার ব্যবস্থা হয়েছে
মাত্র দু’মিনিটের জন্যে। এর বেশি সময় নষ্ট হোক ডক্টর বসুরায় তা চান না। অবশ্য একমাস
অন্তর কাজের গতি কতখানি উন্নত হল জানাবার জন্যে দু’মিনিটের পরিবর্তে একটি
নির্দিষ্ট দিনে পাঁচ মিনিট ধার্য করা হয়েছে, যাতে করে কিছুটা বিস্তারিত রিপোর্ট পাওয়া যায়।
যাত্রার চার-পাঁচদিন পর থেকেই খবর
আসতে শুরু করল যে, স্বল্প দৈর্ঘ্যের দিনরাত্রির
সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে নভোচারীরা। কাজের প্রাত্যহিক লক্ষ্যমাত্রা
থেকে ইতিমধ্যেই অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছে তারা। অবশ্য আশার কথা এই, উৎসাহে ভাটা পড়েনি কারোরই এবং সকলেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আপ্রাণ।
মাসখানেক পর থেকে খবর আসতে লাগল
অন্যরকম। কাজের লক্ষ্যমাত্রা থেকে যথেষ্ট পিছিয়ে থাকলেও প্রাথমিক বিপর্যয়টুকু
কাটিয়ে উঠতে পেরেছে নভোচারীরা। সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী,
দৈনন্দিন কাজের লক্ষ্যমাত্রার শতকরা আশি ভাগ সম্পন্ন করতে পারছে ওরা, শুরুতে যা শতকরা বিশ-পঁচিশের বেশি ছিল না।
তিনমাস পরের খবর স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল যে, নভোচারীরা সফলকাম হতে চলেছে। মোট কাজের অর্ধেকেরও বেশি তখন সম্পন্ন হয়ে
গেছে।
তারপর বসুরায়কে অবাক করে দিয়ে পার্থিব
ছ’মাস পূর্ণ
হওয়ার সাতদিন আগেই খবর এল, সমস্ত কাজ শেষ।
অনতিবিলম্বেই অবতরণের নির্দেশ দিলেন
বসুরায়। আনন্দ করবার ফুরসত নেই তখন, সাফল্যের ঢের বাকি। ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যেই আবার আকাশবিহারে পাঠানো হল
নভোচারীদের। ডক্টর বসুরায় নির্দেশিত নতুন আকাশযান ‘ইন্ডিয়া কুইন’ প্রস্তুতই ছিল। চূড়ান্ত
পরীক্ষার পর সে পাড়ি জমাল দূর নীলিমায়। এবার বিষুবরেখা বরাবর পশ্চিম থেকে পুবে
গতিবেগ এমন যে, একটি দিনরাত্রির দৈর্ঘ্য মাত্র ছ’ঘণ্টা, অর্থাৎ আগের অর্ধেক। কাজের তালিকা আরও দীর্ঘ। পরিক্রমার নির্ধারিত সময়
পার্থিব তিনমাস। মানে, নভোচারীদের এবারের নতুন ঘড়ির হিসেবমতো সেই একবছর।
পার্থিব দিনের হিসেবে সময় চার ভাগের এক ভাগ হয়েছে, কিন্তু কাজের পরিমাণ আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে অনেক গুণ।
যাই হোক,
কিছুদিন পর থেকেই সাফল্যের খবরগুলো আসতে লাগল একে একে। ওরা আরও দ্রুতগতিসম্পন্ন কাজের মানুষ হয়ে উঠেছে; অসম্ভব অবিশ্বাস্য
দ্রুত জীবনেও আশ্চর্যজনকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে। দিব্যেন্দু বসুরায় আনন্দে উত্তেজনায়
অধীর হয়ে উঠতে লাগলেন ক্রমশ।
তারপর শতাব্দীর সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা
ঘটিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের দশদিন আগেই ওরা ফিরে এল মাটিতে।
পূর্বপরিকল্পনামতো বসুরায় নভোচারীদের
নির্বাসিত করে রাখলেন লোকসমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এক বাসস্থানে। কাজ, কাজ আর
কাজ। সেখানে যে কতরকমের কাজ ওদের দেওয়া হল, তার ফিরিস্তি দিতে গেলে দিস্তে দিস্তে কাগজ শেষ হয়ে যাবে। তবুও
কিনারা করা যাবে কি না সন্দেহ। কিন্তু ওই পাঁচজন তরুণ ও একজন তরুণী বসুরায়ের
বিস্ফারিত চোখের সামনে এগিয়ে চলল কম্পিউটারের মতো দ্রুততায়।
বসুরায় বুঝেছিলেন,
পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনবার পর পর্বতপ্রমাণ কাজের মধ্যে ডুবিয়ে না রাখলে
দীর্ঘ দিনরাত্রির পুরনো পরিবেশে অনিবার্যভাবেই অভ্যস্ত হয়ে উঠবে ওরা এবং এতদিনের
এত পরিশ্রম মাঠে মারা যাবে শেষপর্যন্ত। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই অভাবনীয়
সমস্যায় পড়লেন বসুরায়। নভোচারীরা কাজের বারো-আনাই সমাধা করে ফেলেছে নামমাত্র সময়ে।
এতটা আশা করেননি বিজ্ঞানী।
অবিলম্বে কাজের বিপুল ফর্দ প্রস্তুত
করবার নির্দেশ দিলেন বসুরায় সহকারী দুই বিজ্ঞানী অমিত বিশ্বাস ও মধুছন্দা চ্যাটার্জীকে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল,
তিনদিনের মধ্যেই দ্রুততম ওই পাঁচ তরুণ এবং এক তরুণী সব কাজ শেষ করে
ফেলে নতুন কাজের তাগাদা দিতে শুরু করেছে। শুরু করেছে মানে রীতিমতো টগবগ করে ফুটছে
ওরা তখন কাজের নেশায়। সামান্যতম বিলম্বও সহ্য হচ্ছে না। অগত্যা অসমাপ্ত ফর্দ থেকে
কাজ বেছে দেওয়া হল ওদেরকে। বসুরায় তখন খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আরও চারজন সহকারী
এনে মোট ছ’জনকে কাজের ফর্দ বানানোর নির্দেশ দিলেন।
কিন্তু দেখা গেল, নভোচারী ছ’জন ক্রমশই দ্রুততর হয়ে উঠছে। ওদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া অসম্ভব, এটা যখন হৃদয়ঙ্গম হল বসুরায়ের, তখন অনেক দেরি হয়ে
গেছে। অসহায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। তাঁর তখন মনে পড়ছে গল্পের
সেই মহাশক্তিধর দৈত্যের কথা, শেষপর্যন্ত যাকে কুকুরের লেজ
সোজা করার কাজ দিয়ে তবে রক্ষা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এই যন্ত্রদানবগুলোকে ওই একই
কাজ দিয়ে জব্দ করা যাবে কি? বিজ্ঞানের দৌলতে ওরা হয়তো
কুকুরের বাঁকা লেজও সোজা করে ফেলবে অবলীলায়! ভাবতে ভাবতে ক্রমশ আরও অসহায় হয়ে পড়তে
লাগলেন দুঁদে বিজ্ঞানী দিব্যেন্দু বসুরায়। চারদিক থেকে
ঘিরে ধরে কাজপাগল ছ’টি যন্ত্রদানব তখন তাঁকে পিষে ফেলতে চাইছে।
গোলমাল শুনে ছুটে এসেছেন মিসেস বসুরায়। হাতে
তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী রঙমলিন পুরনো একখানি বেহালা। বাজাতে বাজাতেই উঠে এসেছেন
তিনি। সব শুনে বললেন, “কোনও চিন্তা নেই, আমি কাজ দিচ্ছি তোমাদের। কিন্তু পারবে কি তোমরা করতে?”
ছ’টা যন্ত্র একসাথে গর্জে উঠল, “নিশ্চয়ই, আমাদের অসাধ্য কিছুই নেই। কিন্তু যা
দেবার চটপট দিয়ে ফেলুন, ম্যাডাম। চুপচাপ এভাবে একমুহূর্তও আর থাকতে পারছি না।”
ছ’জনের জীবনী সম্বলিত কাগজপত্রে দ্রুত
চোখ বুলিয়ে নিয়ে মিসেস বসুরায় অচঞ্চল কণ্ঠে বললেন, “এক নম্বর, প্রকাশ। আপনি দেখছি ভালো ছবি আঁকতে পারেন। এই যে তুলি-কলম, একটা মন ভরানো ছবি এঁকে দিন।
“দু’নম্বর, ইন্দ্রনীল। আপনি তো ভালো
কবিতা আবৃত্তি করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের কোনও বিখ্যাত কবিতার কিছু অংশ আবৃত্তি
করে শোনান।
“তিন নম্বর, অঞ্জলি। সুকণ্ঠ গায়িকা
আপনি। মনমাতানো গান গেয়ে ভরিয়ে দিন সবার মন।
“চার নম্বর...”
এভাবে বাকি তিনজনের একজনকে দিলেন
অভিনয় করতে, একজনকে মূর্তি গড়তে
এবং সর্বশেষ জনকে হাস্যকৌতুক পরিবেশন করতে।
বসুরায় হতাশ হয়ে স্ত্রীকে কিছু বলতে
যাবেন, মিসেস বসুরায় বাধা দিয়ে বললেন, “কথা নয়, শুধু দেখে যাও।”
একবার নয়, দু’বার নয়, ওরা চেষ্টা করল বারবার। কিন্তু প্রকাশের
তুলিতে যা ফুটে উঠল, তা এতই বিবর্ণ কিম্ভূতকিমাকার যে, ছবি বলা যায় না তাকে। কবিতা আবৃত্তি করতে গিয়ে ইন্দ্রনীলের কণ্ঠ থেকে
একটি বর্ণও বেরোল না, অসহ্য যন্ত্রণায় মুখচোখ বিকৃত হতে লাগল
শুধু। কোকিলকণ্ঠী অঞ্জলির কণ্ঠনিঃসৃত অসংলগ্ন দ্রুতগতির শব্দগুলোর সঙ্গে ভাঙা
গ্রামোফোন ডিস্ক থেকে বেরিয়ে আসা শব্দের যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া গেলেও গান তাকে
কোনওমতেই বলা চলে না। অভিনেতা, মূর্তিশিল্পী এবং হাস্যকৌতুক
পরিবেশকও একই ধরনের ব্যর্থতার পরিচয় দিল।
ছ’টি যন্ত্র তবু ক্ষান্ত না হয়ে
চেষ্টা করে যেতে লাগল বারবার। বিখ্যাত বিজ্ঞানী বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছেন তখন।
কাজপাগল দানবগুলোকে যে এত সহজে বশে আনা যেতে পারে, তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। প্রশংসাভরা কৃতজ্ঞ দৃষ্টি মেলে স্ত্রীর মুখের
দিকে চাইলেন তিনি। বললেন, “তুমি আজ আমায় অবাক করলে, আরতি। যা
আমার মাথায় এল না, তা তুমি করলে অনায়াসে!”
“কিন্তু তোমার ওপর যে অগাধ আস্থা ছিল
আমার, তা যে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল একেবারে!” ধরা গলায়
বললেন মিসেস বসুরায়, “স্রেফ তোমার পাগলামিতে খুন হয়েছে ছ-ছ’টা
মানুষ! অথচ একটু ভেবেচিন্তে যদি তুমি এগোতে, তবে তোমার
এক্সপেরিমেন্টের শিকার হতে হত না ওদের!”
“না, তুমি দেখে নিও আরতি, আবার ওদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনব আমি। উলটোদিক থেকে শুরু করব
এবার। যন্ত্রের মধ্যে জাগিয়ে তুলব প্রাণ।” আবেগ কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠলেন দিব্যেন্দু
বসুরায়।
আরতি বসুরায় ততক্ষণে কোলের ওপর তুলে
নিয়েছেন তাঁর অতিপ্রিয় সেই বেহালাখানা। তাঁর নির্লিপ্ত উদাস দৃষ্টি চার দেয়ালের সীমানা ছাড়িয়ে দূর নীলিমায় নিবদ্ধ। নরম হাতের
ছোঁয়ায় জমাট বাঁধা কান্না সুর হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময়। মিসেস বসুরায়ের দু’গাল বেয়ে
নেমেছে জলের ধারা।
-----
অলঙ্করণঃ পুষ্পেন মণ্ডল
No comments:
Post a Comment