দংষ্ট্রা-করাল
সেই বৃষ্টির রাতে!
ঋজু
গাঙ্গুলী
বছরটা
১৯৮৩। বিশ্বের জনপ্রিয়তম সাহিত্যিকদের
অন্যতম মাইকেল ক্রিকটন সামার ব্লকবাস্টারের চিত্রনাট্য হিসেবে একটি প্লট খাড়া
করলেন। তাতে একটি বাচ্চা ছেলের দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হল এক গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টের
ডাইনোসর বানিয়ে ফেলার দারুণ রোমহর্ষক উপাখ্যান। পরে
একটি ডাইনোসর বানানোর খরচা হিসেব করে ক্রিকটন সিদ্ধান্ত নেন যে সেই খরচ জোটানো
একটি ছাত্রের পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব। তখনকার মতো সেই চিত্রনাট্যও চাপা পড়ে যায়।
আশির
দশকের শেষদিকে যখন মার্কিন বিনোদনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে জাপানি পুঁজি দারুণভাবে
ঢুকে পড়ছে, ক্রিকটন বোঝেন যে ল্যাবরেটরিতে নীরস প্রোজেক্ট হিসেবে ডাইনোসরের কোনও
ভবিষ্যৎ না থাকলেও বিশেষ ধরনের চিড়িয়াখানা বা ফ্যামিলি পার্ক বানাতে গিয়ে ধনী
ব্যক্তিরা এমন এক বা একাধিক হারিয়ে যাওয়া প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীকে সেখানে রাখতেই পারেন।
১৯৯০
সালে বিস্তর রিসার্চ এবং পরিমার্জনার শেষে আত্মপ্রকাশ করে ক্রিকটনের জনপ্রিয়তম বই ‘জুরাসিক
পার্ক’। এই গল্পটাই সামান্য পরিবর্তনের পর
১৯৯৩-এ স্টিভেন স্পিলবার্গের পরিচালনায় হয়ে ওঠে সমনামী এক সিনেমা, যা কল্পবিজ্ঞান
তথা অ্যাডভেঞ্চারের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের জন্ম দেয়।
কী
ছিল সেই সিনেমায়?
ইনজেন
টেকনলজিস-এর তরফে কোস্টা রিকার উপকূলের কাছে আইলা নুবলার নামের এক ছোট্ট দ্বীপে
তৈরি হয়েছে এক নতুন ধরনের থিম পার্ক - জুরাসিক পার্ক। জুরাসিক যুগের বিভিন্ন
রক্তপায়ী পোকা, যারা গাছের আঠার মধ্যে আটকে পড়ে গেছিল কোনওভাবে, সেই যুগের বিভিন্ন
ডাইনোসর তথা অবলুপ্ত প্রাণীর জেনেটিক মেটিরিয়াল বা ডি.এন.এ. ধরে রেখেছিল নিজেদের
মধ্যে। সেই ক্ষয়প্রাপ্ত ডি.এন.এ.-তে এই সময়ের নানা প্রাণীর ডি.এন.এ.-র অংশবিশেষ
যোগ করে তার থেকে ক্লোনিং করে তৈরি করা হয় বিভিন্ন ডাইনোসর। কিন্তু সেই ডাইনোসরদের
আক্রমণে কিছু মানুষ হতাহত হওয়ায় পার্ক তৈরি হয়েছে যাঁদের অর্থে, তাঁরা চিন্তিত হয়ে
পড়েছেন। তাই ইনজেন-এর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার জন হ্যামন্ড (অভিনয়ে, স্যার রিচার্ড
অ্যাটেনবরো) তড়িঘড়ি উড়িয়ে আনেন প্যালিঅনটোলজিস্ট অ্যালান গ্র্যান্ট (স্যাম নিল)
এবং এলি সেটলার (লরা ডার্ন)-কে, যাতে ‘এই পার্ক কিছুতেই টিকবে না’ মতে কঠোর
বিশ্বাসী গণিতবিদ ইয়ান ম্যালকম (জেফ গোল্ডব্লাম) এবং পার্কের ইনভেস্টরদের আইনি
প্রতিনিধি ডোনাল্ড জেনারো-কে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পার্ক চালানোর ব্যাপারে একটা ঐক্যমতে
পৌঁছনো যায়। কিন্তু হ্যামন্ডের নাতি-নাতনিদের সঙ্গে নিয়ে যখন এই অতিথিরা পার্কের
নানাদিক ও তার প্রাণীদের দেখছেন তখন অন্য এক ঘটনা ঘটে। পার্কের কন্ট্রোলিং
সফটওয়্যার-এর চিফ প্রোগ্রামার ডেনিস নেড্রি পার্ক থেকে ডাইনোসরের জমে থাকা ভ্রূণ
ইনজেন-এর প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য চুরি করে এবং নিজের
পালানোর সুবিধা করার জন্য পার্কের বিদ্যুৎ সংযোগ এবং তার ওপর নির্ভরশীল যাবতীয়
ইলেকট্রিক ফেন্স অচল করে দেয়। এদিকে সেই রাতেই এক মারাত্মক ঝড়বৃষ্টি হামলে পড়ে
আইলা নুবলার-এর ওপর। পালানোর ফাঁকে মারা যায় নেড্রি। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো ক্ষতি
হয়, যখন বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন ফেন্সের বাধা পেরিয়ে বেরিয়ে আসে একের পর এক ডাইনোসর,
যাদের মধ্যে অবশ্যই ছিল সেই ভয়ংকর প্রাণীটি, যার নাম শুনলেই আমাদের মেরুদণ্ডে একটা
ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায় - টিরানোসরাস রেক্স! আর তারপর…
এবং
এরপর
সেই পার্কে কী হল, কে বাঁচল, কে মরল এবং ইয়ান ম্যালকমের কথা মেনে কীভাবে প্রকৃতি
বিজ্ঞানীদের তোয়াক্কা না করে ঠিকই একটা রাস্তা বেছে নিল, তার রোমহর্ষক এবং দম আটকানো
কাহিনি জানতে গেলে ঝট করে সিনেমাটা একবার দেখে নেওয়া উচিত।
সেই
সময়ে সিনেমাটা কতটা জনপ্রিয় হয়েছিল তা হয়তো এই তথ্য থেকে জানা যাবে যে, ১৯৯৮-এ
টাইটানিক-এর হাতে রেকর্ডটা ভাঙার আগে অবধি এটিই ছিল সিনেমার ইতিহাসে হাইয়েস্ট গ্রসিং
ফিল্ম! শুধু জনপ্রিয়তা বা জনমানসে ডাইনোসরদের প্রায় সুপারহিরো করে তোলাই নয়,
অ্যানিম্যাট্রনিক ভিজুয়াল এফেক্টস, কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজারি এবং সাউন্ড
এফেক্টস, এই তিন ক্ষেত্রেই এই সিনেমা নতুন পথ দেখায়।
জনপ্রিয়তার
সহজ সূত্র মেনে এরপর আসে আরও দুটি সিনেমাঃ
১)
১৯৯৭-এ আসে ক্রিকটনের ১৯৯৫-এ প্রকাশিত উপন্যাস অবলম্বনে ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ডঃ
জুরাসিক পার্ক’।
২)
২০০১-এ আসে ‘জুরাসিক পার্ক থ্রি’, যাতে মূল ভিলেইন বা দুশমন ছিল স্পিনোসরাস, পৃথিবীর
ইতিহাসে বৃহত্তম (আজ্ঞে হ্যাঁ, টিরানোসরাস রেক্স এবং জাইগান্টোসরাস-এর চেয়েও বড়ো!)
মাংসাশী ডাইনোসর।
২০০৪-এই
ইউনিভার্সাল স্টুডিও এই সিরিজে নতুন সিনেমার জন্য ভাবনাচিন্তা শুরু করে।
কিন্তু সেটা আমরা শেষ অবধি পাই ২০১৫-য়।
কী
ছিল এই সিনেমায়?
ভূতপূর্ব
জুরাসিক পার্কের অবশেষের ওপর আইলা নুবলার-এ গড়ে উঠেছে একটি নতুন থিম পার্ক, ‘জুরাসিক
ওয়ার্ল্ড’। এই সফল পার্কের বর্তমান সঞ্চালক
মাসরানি গ্লোবাল কর্পোরেশন, যার মালিক হলেন সাইমন মাসরানি (অভিনয়ে ইরফান খান)।
পার্কে ঘুরতে এসেছে দুই ভাই জাক ও গ্রে, যাদের আন্ট ক্লেয়ার ওই পার্কের অপারেশনস
ম্যানেজার।
পার্কে
মুখ্য আকর্ষণের মধ্যে আছে মারাত্মক ভেলিকোর্যাপটররা, তাদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণার
পাশাপাশি যাদের কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নেভি-ফেরত ওয়েন গ্রেডি (ভূমিকায়
ক্রিস প্র্যাট)।
আছে
দৈত্যাকৃতি জলচর টিকটিকি মোসাসরাস।
কিন্তু
এই সিনেমার ঘটনা যেদিনের, সেদিন মাসরানি বোঝার চেষ্টা করছিলেন তাঁর পার্কের সবচেয়ে
নতুন এবং একাধিক ডাইনোসরের ডি.এন.এ. মিশিয়ে তৈরি করা ডাইনোসর ইনডমিনাস রেক্স
পার্কের দর্শনার্থীদের কাছে পেশ করার মতো অবস্থায় আছে কি না।
নিজেকে
ক্যামোফ্লাজ করে, এমনকি নিজের হিট সিগনেচারটিকেও লুকিয়ে ফেলে নিজের খাঁচা থেকে
পালাতে ও হত্যালীলা চালাতে সক্ষম হয় ইনডমিনাস। ইতিমধ্যে নিজেদের মতো করে পার্কে
বেড়ানো জাক ও গ্রে এবং তাদের খুঁজতে বের হওয়া ওয়েন ও ক্লেয়ার আলাদাভাবে ইনডমিনাসের
হাত থেকে কোনওক্রমে বেঁচে যায়।
কিন্তু
মাসরানি ও তাঁর রক্ষীদের গুলির হাত থেকে বাঁচতে ইনডমিনাস পার্কের অ্যাভিয়ারি ভেঙে
ফেলে, যার ফলে একঝাঁক টেরোসর সেখান থেকে বেরিয়ে পার্কের সর্বত্র হামলা চালায়।
ফলে ক্রমেই গোটা পার্কের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সিকিওরিটি অ্যাডভাইসর
হসকিন্স, যে ক্লোন করে পাওয়া ডাইনোসরদের যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে কাজে লাগাতে চায়,
পরামর্শ দেয় যাতে ওয়েন ও তার র্যাপটররা সম্মিলিতভাবে ইনডমিনাসের সঙ্গে লড়তে
চেষ্টা করে।
নানা
ঘাত-প্রতিঘাতের পর র্যাপটররা ইনডমিনাসকে আক্রমণ করলেও যখন পাল্লা ক্রমেই
ইনডমিনাসের দিকে ঝুঁকে পড়ছে তখন মরিয়া হয়ে ক্লেয়ার মুক্তি দেয় এই পার্কের অন্য
একমাত্র প্রাণীকে, যে ইনডমিনাসের সঙ্গে লড়তে পারে আর তার পরেই আমরা পাই সেই দুরন্ত
লড়াই, যেখানে ইনডমিনাস রেক্স মুখোমুখি হয়
টিরানোসরাস রেক্স-এর।
কিন্তু
সেই রক্তাক্ত লড়াইয়েও টিরানোসরাসের পরাজয় ও মৃত্যু যখন প্রায় নিশ্চিত তখন একমাত্র
জীবিত র্যাপটর, যার নাম ছিল ‘ব্লু’, ইনডমিনাসকে আক্রমণ করে। টি.রেক্স ও ব্লু-র সম্মিলিত
আক্রমণে ক্রমেই পিছিয়ে খাঁড়ির দিকে সরে যেতে বাধ্য হয় ইনডমিনাস। আর
তারপর আসে সেই মুহূর্ত, যখন জল থেকে
শিকারের সন্ধানে উঠে আসে মোসাসরাস।
শেষ
অবধি এই পার্ক এবং আইলা নুবলার আবার পরিত্যক্ত হয়। তবে এই সিনেমার সাঙ্ঘাতিক
জনপ্রিয়তা, বিশেষ করে শেষ মারদাঙ্গার সময়ে হলে প্রায় দম বন্ধ করে ছোটো ও বড়ো
দর্শকদের অপেক্ষা এবং সম্ভব হলে ‘লগান’-এ আমিরের দলের জন্য সংরক্ষিত সমর্থন
টি.রেক্স-এর উদ্দেশে উজাড় করে দেওয়া আবার প্রমাণ করে দেয় দুটো জিনিস।
প্রথমত, দর্শকদের মনে ভয় (ও ভক্তি) জাগানোয় ডাইনোসরদের কোনও
তুলনা নেই। এটা খুব সহজে বোঝা যায় জুরাসিক ওয়ার্ল্ডেই আমাদের বিনোদন জোগানো বাস্তব
ও কল্পিত প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের (সঙ্গে এই সিনেমার নায়কেরাও আছেন) ফিরিস্তি দেখলে।
দ্বিতীয়ত, মানুষেরা এই সিনেমাগুলোয় খুচরো ভিলেইনের ভূমিকা
নিলেও আসল ভিলেইন হল ডাইনোসর, বিশেষত কার্নিভোরাস ডাইনোসর প্রজাতি। জুরাসিক
ওয়ার্ল্ড-এ যাদের দেখা গেছে তাদের তুলনামূলক আকার-প্রকারের আভাস দিই তাহলে।
তাহলে ২০১৮-য় আমাদের স্ক্রিন ও মাল্টিপ্লেক্স কাঁপাতে
আগুয়ান ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ডঃ ফলেন কিংডম’-এ কোন ডাইনোসর আমাদের ভয়ে ফ্যাকাশে করতে
আসবে? মোটামুটি বড়ো মাপের ডাইনোসরদের প্রায় সবাইকেই ইতিমধ্যে পর্দায় দেখে ফেলেছি
আমরা, যেটা বোঝা যায় নিচের চার্ট থেকে।
অথবা এই বিস্তৃততর বিবরণ থেকে।
পরিচালক ও প্রযোজকেরা যদি একবার ভাবেন, ‘ডাইনোসর কি কম
পড়িয়াছে?’, তাহলেই পরের সিনেমায় আমরা দেখতে পাব নতুন কোনও ‘ডিজাইনার
ডাইনোসর’।
এই সিরিজের ফিল্মগুলোর মাথা খারাপ করে দেওয়া জনপ্রিয়তা
প্রমাণ করে, আমাদের মনের মধ্যে জমে থাকা ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন কমপ্লেক্স’, অর্থাৎ
ঐশ্বরিক শক্তির মালিক হয়ে প্রাণ সৃষ্টি করা এবং সেই প্রাণ তথা প্রাণীর ওপর
নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে বিপন্ন বোধ করার টানাপোড়েন চলতেই থাকবে।
আর সেই টানাপোড়েনকে পপকর্ন এবং পিৎজা সহযোগে উপভোগ করতে
যাতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে না হয় সেটা নিশ্চিত করার জন্য আইম্যাক্স টেকনোলজি এবং
থ্রিডি ইত্যাদি নিয়ে সদা তৎপর থাকবে হলিউড।
তাহলে সে কথাই রইল। পপকর্নের ভার আমার। পরের সিনেমা দেখার
সময় পাশের সিটটা আমার জন্যেই থাকছে তো?
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment