আলোক ভেদ্য
মূল কাহিনিঃ টি.সি. ।। রচনাঃ বিমল কে. শ্রীবাস্তব
প্রকাশঃ সায়েন্স রিপোর্টার
ম্যাগাজিন, ২০০৪
অনুবাদঃ প্রতিম দাস
“বস, কী খবর?” বন্ধু-কাম-সিনিয়র প্রফেসর রাওয়ের কাছে জানতে
চাইল হেমন্ত।
ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট
অফ টেকনোলজির ফিজিক্সের প্রফেসর রাও বয়সে হেমন্তের চেয়ে দশ বছরের বড়ো। এখানে কাজে অবশ্য যোগ দিয়েছিলেন একই দিনে। বয়সের পার্থক্য থাকা
সত্ত্বেও ওরা একে অপরের
সান্নিধ্য পছন্দ করেন। হেমন্তের
প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর রাও জানালেন, নতুন কিছু না। আলো যখন বিভিন্ন স্বচ্ছ বস্তুর মধ্যে দিয়ে যায় তখন তাদের ফ্রিকোয়েন্সির স্থান পরিবর্তন লক্ষ করছেন।
গত কয়েকদিন ধরে হেমন্ত
প্রফেসর রাওয়ের আচার-আচরণে একটা অস্থিরভাব দেখতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনও বিশেষ একটা কিছু রাওকে
বিস্ময়াবিষ্ট করে রেখেছে। আর সেটা কী সেটাই
জানার জন্য হেমন্তের ভেতরে একটা আগ্রহ দানা বাঁধছে।
“প্রফেসর
রাও, একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
“কর।”
“আপনি কি
কোনও বিশেষ বিষয় নিয়ে ইদানীং ভাবনাচিন্তা
করছেন? বিস্তারিত বলার দরকার নেই। আমি জানতেও চাইছি না। কেন জানি না মনে হচ্ছে
আপনি কিছু একটা ভাবনা নিয়ে খুব চাপে আছেন। ইচ্ছে হলে তার কিছুটা ভার এই ছোটোভাইটার
কাঁধে চাপিয়ে দিতে পারেন।”
“আমিও এই
ব্যাপারটা নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছিলাম। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করব সেটাই বুঝতে পারছি না।”
“শুরু
থেকেই শুরু করে দিন।”
“ওকে।
তাহলে একটা প্রশ্ন দিয়েই শুরু করি। তুমি কাউকে
অদৃশ্য করতে পারবে?”
হেমন্ত হো হো করে হেসে উঠল, “আপনি কী শোনাতে চান বলুন তার আগে। কল্পবিজ্ঞান নাকি বাস্তবের কোনও ঘটনা?”
“বেশ
তাহলে ঘুরিয়ে আর একটা প্রশ্ন করি। তুমি অদৃশ্য
কোনও কিছুর সংস্পর্শে এসেছ
কোনওদিন?”
“ইয়ে, না মানে, তেমন কোনও অভিজ্ঞতার কথা তো মনে
পড়ছে না। তাছাড়া অদৃশ্য হলে দেখতে পাবই বা কী করে?”
“আমি
দেখার কথা বলিনি। সংস্পর্শে আসার কথা বলেছি। হাওয়া বিষয়ে তোমার মতামত কী? তুমি হাওয়া দেখেছ? ওটা কি অদৃশ্য নয়? নাকি ওর অস্তিত্বে তোমার বিশ্বাস
নেই?”
“না না, তা বলছি না। কিন্তু হাওয়া তো জীবন্ত নয়!”
“ঠিক আছে, এবার বল, খাঁটি জল বা নিখুঁত কাচের রঙ কী?”
“রঙই নেই।”
“তার মানে তুমি একটা রঙহীন বস্তু দেখতে পাও?”
“অবশ্যই
না। অবশ্য আমাদের দর্শন ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতা...”
হেমন্তর কথার মাঝেই কথা
বলে উঠলেন প্রফেসর রাও, “ঠিক। এটাই আমি বলতে চাইছি।”
“বুঝেছি। হ্যাঁ, বস্তু অদৃশ্য হতে পারে যদি তারা নিজেদের ভেতর দিয়ে আলোকরশ্মিকে যেতে দেয়,” হেমন্ত বলল।
“একদম ঠিক। আচ্ছা
ধরে নাও, একটা অস্বাভাবিক মাত্রার পরিষ্কার আর স্বচ্ছ কাচের দরজা
আছে আমাদের সামনে। আমরা কী করব?
বুঝতে না পেরে ওটার ভেতর দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করব, তাই তো?”
“হ্যাঁ,
তা করতেই পারি। পাখি বা পোকামাকড় তো হামেশাই এরকম করে দেখতে পাওয়া যায়।”
“তাহলে
তুমি এ ব্যাপারে আমার সাথে একমত যে, এরকম
কিছু বস্তু আছে যা স্বচ্ছ এবং বেশ কিছু পরিমাণে অদৃশ্য আমাদের চোখে।”
“হ্যাঁ, আমি মেনে নিচ্ছি। তবে আমি কিন্তু কোনও স্বচ্ছ জীবিত প্রাণী দেখিনি।”
“কেন, তুমি কি এমন কোনও পতঙ্গ দেখনি যার ডানা স্বচ্ছ?
কিছু মাছের প্রজাতি আছে যারা প্রায় স্বচ্ছ। যেমন, গ্লাস ফিস। আমাদের চোখের লেন্স পুরোপুরি স্বচ্ছ।
আমার মনে হয় টিভি চ্যানেলে ওই ডকুমেন্টারিটাও দেখেছ যেটায় অতল সমুদ্রের তলায় বসবাসকারী বিভিন্নরকম সুন্দর অস্বচ্ছ
আলোকভেদ্য শরীরের অধিকারী ট্যান্সলুসেন্ট প্রাণীদের দেখাচ্ছিল। ওরা একটা এই প্রজাতির স্কুঈডও দেখিয়েছিল। চোখ আর ইঙ্ক গ্ল্যান্ড বাদে ওটার পুরো শরীর ছিল আলোকভেদ্য। আর
এই কারণেই আমি বিশ্বাস করি, এই পৃথিবীতে সেরকম প্রাণীও আছে
যারা সম্পূর্ণ রূপে স্বচ্ছ দেহের অধিকারী। আর
সেজন্যই ওরা অদৃশ্য। ফলে আমরা ওদের দেখতে পাই না এবং ওদের বিষয়ে আজ অবধি অবগত হতে পারিনি।”
হেমন্ত প্রফেসর রাওয়ের কথাগুলো শুনে কিছুটা সময় চুপ করে
থেকে বলল, “যদি তাইই হয়, তবে এটা আপনার কেন মনে হচ্ছে না যে আজ পর্যন্ত কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ ওরকম প্রাণীর সম্মুখীন
হত? কিন্তু এরকম কোনও নজির তো আমাদের হাতে নেই।”
“তোমার
ভাবনাটা ভুল নয় হেমন্ত। ভুলে যেও না হিমালয়ের ইয়েতি বিষয়ে অনেক অনেক অভিজ্ঞতার কথা
কিন্তু অনেক মানুষ বলেছেন। অদৃশ্য কিছুর অস্তিত্বের কথা যে একেবার বলা হয়নি, তা নয়। কিন্তু আমরা সেগুলোকে অলীক গল্পকথা আর ভূতুড়ে আখ্যা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এরা সেই অদৃশ্য প্রাণীও তো হতে পারে, যার কথা আমি ভাবছি।”
“দেখুন
প্রফেসর, আপনার কথাগুলোর যুক্তি বেশ শক্তিশালী এবং প্রায় বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু
বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ দিতে না পারলে তো এইধরনের কোনও প্রাণীর অস্তিত্ব প্রমাণ করা যাবে না।”
“একদম ঠিক
বলেছ তুমি। প্রমাণ না দেওয়া পর্যন্ত আমাকে কেউ
বিশ্বাস করবে না। তবে আমার আন্তরিক বিশ্বাস, আমি
একদিন না একদিন এরকম প্রাণী খুঁজে
বার করবই।”
কথাগুলো বলে প্রফেসর রাও একটা ফাইল বাড়িয়ে দিলেন হেমন্তের দিকে,
“অবসর সময়ে মন দিয়ে এটা পড়ে দেখো।”
*
রিপোর্টটির কিছু নির্বাচিত
অংশ।
‘এ পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে সবুজ টিয়া, কালো কাক, কেশরওয়ালা সিংহ,
চিত্রবিচিত্র ঘোড়া, নীল ময়ুর, বহু রঙে রাঙানো প্রজাপতি। কিন্তু কোনও স্বচ্ছ বা রঙহীন প্রাণী আমরা দেখতে পাই না কেন?
বেশ কিছু নিম্নস্তরীয় জটিল
কোষযুক্ত প্রাণীরা প্রায় স্বচ্ছ। আবার
অনেকের দেহাংশ বা টিস্যু ট্রান্সলুসেন্ট। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য
হল অতল সাগরের স্কুইড ও ফ্রনিমা, সামুদ্রিক বা মিষ্টি জলের চিংড়ি এবং শতাধিক
অ্যারোউওরম বা চ্যাইটোগন্যাথ।
কিছু প্রজাপতির (কাল্লিতায়েরা মিনান্ডার) পাখনা,
সমুদ্রের চভবোরাস পোকার লার্ভা এবং ক্রিপ্টোসরাস গোত্রের মাছেরা স্বচ্ছ।
১৯৬৭ সালে ফিনল্যান্ডের এক
বিজ্ঞানী একটি দক্ষিণ আটলান্টিক বাই কনভেক্স মেডুসার
কথা জানান যা একেবারে একটি লেন্সের মতো। যার
ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো ভেদ করে চলে যায়। উনি নাকি ওটার সাহায্যে
নিজের সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে ছিলেন।
স্বচ্ছ টিস্যুরা কিছু
সাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী – ক্ষুদ্র
অথবা একেবারেই রক্তের শিরাবিহীন। পিগমেন্ট কোষের অস্তিত্ব থাকে না। আলোক তরঙ্গের চেয়ে ক্ষুদ্র মাপের একটা সেলুলার স্পেস যুক্ত হয়। এছাড়াও প্রায় নিয়মিত পুনরাবৃত্তি
সম্পন্ন সম্পর্কযুক্ত আকৃতি হয় এদের। মিউকোপলি সাক্রাইডস এবং কোল্লাজেন্স প্রাণীদের স্বচ্ছতার সাথে এর সম্পর্ক লক্ষ করা যায়। আবার গ্লুকোপ্রোটিন (জেলিফিস) এবং চিটিন (পোকামাকড়) গোত্রেও এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। যার ফলে এদের আলোকভেদ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই
এদেরকে সাহায্য করে ঠিকঠাকভাবে নিজেদের দেখতে না
দিয়ে শিকারির হাত থেকে বাঁচতে। আবার সাথে
সাথেই শিকার করতেও। সামুদ্রিক প্রাণীদের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি কাজ করে জলের বিভিন্ন স্তরের ঘনত্ব
অনুসারে আলোকমাত্রা পরিবর্তিত হয় বলে।
অবশ্য সব টিস্যু স্বচ্ছ হয় না এটাও মনে রাখতে হবে। আর একটা কথা, স্বচ্ছ প্রাণীদের শরীরের স্নায়ুর রঙ সাদাই হয়। এইসব প্রাণীদের
খাওয়া-খাদ্য যতক্ষণ না হজম হয় ততক্ষণ খাবারের রঙ দেখতে পাওয়া যায় শরীর ভেদ করে।’
*
হেমন্ত বুঝতে পেরেছে, প্রফেসর রাও তার গবেষণাটা নিয়ে বেশ ভালোভাবেই মনোনিবেশ
করেছেন। তাই সুযোগ পেয়ে পরের দিন লাঞ্চের সময় একাধিক প্রশ্ন করে আরও অনেক কিছু জেনে নিল ওনার কাছ থেকে।
প্রফেসর রাও এটা মেনে নিলেন যে এটা খুবই কঠিন কাজ, একজন মানুষের পক্ষে একটা অদৃশ্য প্রাণীকে দেখা বা খুঁজে বার করা। সাথে সাথে এটাও জানালেন, মানুষের চোখে না পড়লেও ইনফ্রারেড ক্যামেরার চোখ কিন্তু এরকম প্রাণীর ছবি তুলতে সক্ষম হবে। আর সেটাই করতে হবে তাঁকে।
“বুঝলাম।
কিন্তু এরকম ধরনের প্রাণী খুঁজতে আপনি যাবেনটা কোথায়?”
“আন্দাজ
কি করতে পারছ না, এরকম প্রাণীকে খুঁজে
পাওয়ার আদর্শ স্থান কোথায় হতে পারে?”
হেমন্ত বলল, “না, আমার মাথায় কিছু আসছে না।”
“ঠিক আছে,
আমি তোমায় হিন্ট দিচ্ছি। বেশিরভাগ প্রাণী যারা
মরুভূমিতে বাস করে তাদের গায়ের রঙ
বালির মতো। ঘাসে বসবাসকারী কীটপতঙ্গের রঙ সবুজ। যারা
গাছের ছায়া আশ্রয় করে জীবন কাটায় তাদের রঙ বাদামি। মেরুভাল্লুক সাদা। কিছু আন্দাজ করতে পারছ কি?”
“আরে, তাই তো! আমার মনে হচ্ছে এ ধরনের প্রাণী হয় জলে না হলে বরফ আছে এমন কোনও জায়গায়
খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।”
প্রফেসর রাওয়ের মুখে উল্লাসের ভাব ফুটে উঠল। “ঠিক বলেছ, হেমন্ত। অবশ্য এর সাথে আমি আর
একটা তথ্য যোগ করতে চাই। যে স্থানে
এরকম প্রাণী এখন বেঁচে আছে সেটা খুবই নির্জন
কোনও এলাকা এবং মানুষের পা পড়েনি। আর
সেরকম একটাই জায়গা এখন এই পৃথিবীতে আছে। তার নাম
অ্যান্টার্কটিকা।”
“আপনি কি
একাই যাবেন নাকি ওখানে? তাছাড়া এরকম একটা অভিযানের খরচও তো কম নয়। সে অর্থ আসবে
কোথা থেকে?”
“সে আমি
ব্যবস্থা করে নেব। হেমন্ত একটা আন্তরিক অনুরোধ,
ট্র্যান্সলুসেন্ট ক্রিয়েচার বা যাদের আমি সংক্ষেপে
টিসি বলে উল্লেখ করেছি, সেটার ব্যাপারটা আমি চাই বাইরের
আর কেউ যেন জানতে না পারে। সব মানুষেরই তো কিছু না কিছু একটা লোভ থাকেই। আমারও লোভ নোবেল প্রাইজ পাওয়ার। আর তার জন্যই এর গোপনীয়তা থাকা দরকার।”
*
এতক্ষণ যে বিবরণ দেওয়া হল, তা
ঘটেছিল দু’বছর আগে। এরপর প্রফেসর রাও তার
স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন এবং সেটা দেখে হেমন্ত আশা করেছিল উনি বোধহয়
আলোকভেদ্য প্রাণী খোঁজার ভাবনা পরিত্যাগ করেছেন।
এরকমই এক সময়ে এল প্রফেসর রাওয়ের ফোন। আর
সেখানেই উনি জানালেন অ্যান্টার্কটিকা যাচ্ছেন। বরফ আচ্ছাদিত
পাথরের ওপর সূর্যালোকের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করার
জন্য। হেমন্ত বুঝল, তার ভাবনায় ভুল ছিল। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে শুভেচ্ছা জানাল প্রফেসর রাওকে। সাথে এটা জানাতে ভুলল না সে অপেক্ষায় থাকবে নতুন সম্ভাব্য নোবেলজয়ীর
অভিজ্ঞতা শোনার।
পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন নিউজ বুলেটিনের মাধ্যমে
অভিযানকারী দলটার খুচখাচ খবর হেমন্ত পেলেও
প্রফেসর রাওয়ের কোনও আলাদা খবর সে পায়নি। ইতিমধ্যে ওই
দলটির এক সদস্য শরীর খারাপ হওয়ায় ফিরে
চলে আসে। হেমন্ত তার সাথে
ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে প্রফেসরের খোঁজ নেওয়ার জন্য। সদস্যটি জানায়,
প্রফেসর রাও
নাকি বাকিদের সাথে কাজ করতেন না। একা একাই কী সব খুঁজে বেড়াতেন আর নিজের মনে বকবক করতেন। বাকিরা মনে করে অ্যান্টার্কটিকার
চৌম্বকক্ষেত্র ওনার মানসিক অবস্থায় প্রভাব ফেলেছে।
আর কিছুদিন পর হেমন্তর
কাছে এল আর এক খবর। প্রোজেক্টের কাজ শেষে অভিযানকারী দলটি ফিরে এসেছে, কিন্তু ফেরেননি প্রফেসর রাও।
হেমন্তর চিন্তা বাড়লেও
কিছু করার নেই। অ্যান্টার্কটিকার বেস ক্যাম্প থেকে এল এক চিঠি। প্রফেসর রাও নিখোঁজ। কয়েকদিন আগে এক রাতে
কাউকে কিছু না বলে ক্যাম্প ছেড়ে চলে যান। তারপর সাতদিন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ওনার
সন্ধান মেলেনি। ধরে নেওয়া হচ্ছে একটি তুষার গহ্বরে পড়ে গিয়ে উনি প্রাণ হারিয়েছেন। কারণ, ওই গহ্বরটির কাছে ওনার
পোশাকের কিছু টুকরো আর কয়েক ফোঁটা রক্ত পাওয়া গেছে।
দু’সপ্তাহ বাদে হেমন্ত অফিস থেকে একটা চিঠি পেল, প্রফেসর রাওয়ের যে সমস্ত জিনিস ওখান থেকে ফিরে এসেছে সেগুলো ওকে
নিয়ে আসতে হবে।
প্রফেসর রাওয়ের কাগজপত্র আর ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নিতে নিতে ব্যথিত মনে হেমন্ত ভাবছিল,
একজন মহান মানুষের কী পরিণতিই না হল। সবকিছু নতুন করে
সাথে আনা লেদার স্যুটকেসে প্যাক করার সময় বুঝতে পারল, প্রফেসরের ওভারকোটটার ভেতরে কিছু একটা ঢোকানো আছে। হাতড়ে দেখতেই স্বাভাবিক
পকেটের পেছনের গুপ্ত পকেটের ভেতর পাওয়া গেল একটা ডায়েরি। ওটাকে
নিজের কাছেই আলাদা করে রেখে দিল। পড়তে
যদিও পারল না, কারণ তেলেগু ভাষায় লেখা। বাকি জিনিসপত্র জমা
দিয়ে দিল অফিসে।
এরপর নিজের মহল্লায় খুঁজে
বার করল এমন একজন মানুষকে যে তেলেগু পড়তে পারে। কিছু
অর্থের বিনিময়ে ওটা অনুবাদের জন্য রাজি করাল। শেষের
দিকের কয়েকটা পাতা বাদ দিলে যা উদ্ধার হল তার অনেকটাই হেমন্তর
জানা। বাকিটা হতাশা আর নিরাশার দিনলিপি বলা যেতে পারে। তবে
শেষের কয়েকটা দিনের কথা যথেষ্টই কৌতূহলজনক।
ডায়েরির নির্বাচিত অংশ
১৬ জানুয়ারি
আমি নিশ্চিত, পূর্বদিকের বরফজমা সমুদ্রের কাছের খাড়া পাহাড়ের কাছে কিছু একটা আছে। আমি একটা এমন গর্ত দেখতে পেয়েছি যেখানে রহস্যজনক কিছুর অস্তিত্ব
আছে।
১৯ জানুয়ারি
ইনফ্রারেড ক্যামেরার
সাহায্যে ফটো তোলার চেষ্টা করলাম। ফল সম্পূর্ণ নেতিবাচক নয় মনে হচ্ছে। শুধুমাত্র
বাষ্পের আউটলাইন ছাড়া আর কিছুই আসেনি। যেটা আমার ধারণামতে টিসি’র শরীর নিঃসৃত তাপমাত্রার রূপরেখা।
২৫ জানুয়ারি
ক্রমাগত পর্যবেক্ষণে আমি
বুঝতে পেরেছি, টিসি’র আকৃতি একটা প্রমাণ মাপের শুয়োরের মতো বড়ো। অন্তত দুটো আছে এখানে। ওরা বেশ ভালো সাঁতারু।
৩১ জানুয়ারি
ওরা মাংসাশী। দেখলাম, একটা পেঙ্গুইন গর্তটার কাছে গেল এবং সহসাই অদৃশ্য হয়ে গেল। যেভাবে ওটা
গর্তটার ভেতরে ঢুকে গেল তাতে আমি নিশ্চিত ওটাকে ওরা টেনে নিল।
৯ ফেব্রুয়ারি
মনে হচ্ছে বেঁচে থাকার
জন্য ওদের খুব একটা বেশি খাবারের প্রয়োজন হয় না। একটা পেঙ্গুইন এক সপ্তাহের জন্য
যথেষ্ট ওদের জন্য। পেঙ্গুইন শিকারের নয়দিন পর আবার ওখানে নড়াচড়ার আভাস পাছি। এবার
একটা মাছকে টেনে নিল ওরা গর্তের ভেতর।
১৫ ফেব্রুয়ারি
আর কিছু ফটো ডেভলপ করলাম। কিন্তু
না, সবই ফাঁকা। তার
মানে ইনফ্রারেড ক্যামেরা কোনও কাজ করছে না। স্পেশ্যাল কোনও
ফটোগ্রাফি করার কোনও সুযোগ নেই আমার কাছে। অতএব একমাত্র
উপায় নিজের চোখের ওপরেই ভরসা করা। ওদের শরীর
থেকে যে তাপমাত্রা নিঃসৃত হয় তার বাষ্পের রূপরেখার দিকে নজর রাখা।
১৮ ফেব্রুয়ারি
এটা ভালোমতো বুঝতে পেরেছি, ওরা শিকার করে সেটা গর্তের ভেতরেই খায়। খাওয়ার পর ছয় থেকে আটদিন আর বাইরে
আসে না। তারপর আবার কোনও অসতর্ক শিকার ধরে। খাদ্যের অংশবিশেষ
সম্ভবত ওদের শরীর ভেদ করে পেটের ভেতর থেকে দেখা যায়। ওরা
সেটা বোঝে। পরীক্ষার জন্য যেভাবেই হোক টিসি’র মলমূত্র আমাকে যোগাড় করতেই হবে।
১৮ মার্চ
আজ প্রমাণ পেলাম, টিসিদের রক্তও স্বচ্ছ, গ্লিসারিনের মতো। আমি কয়েক ফোঁটা রক্ত সংগ্রহ করতে পেরেছি। আজ যখন একটা
টিসি একটা পেঙ্গুইনকে আক্রমণ করে তখন ওই পেঙ্গুইনের সাথে থাকা আর দুটো পেঙ্গুইন
ওটাকে আক্রমণ করে ঘুরিয়ে। তার ফলেই রক্তপাত ঘটেছে। ছবিতে পেঙ্গুইনদের গায়ে লেগে থাকা বস্তুটা যে টিসি’র রক্ত, এ আমি সিওর। পুরো ঘটনাটার ভিডিও
তুলেছিলাম। পরে দেখে মনে হচ্ছে তিনটে পেঙ্গুইন নিজেদের ভেতর মারামারি করছে।
২৩ মার্চ
বাপ রে বাপ! আজ খুব বেঁচে গেছি। ওরা আমাকে আক্রমণ করেছিল। কী ধারালো দাঁত ওদের! আমি ভাগ্যবান যে ওদের হাত থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছি।
হাতের কাটা জায়গাটায় দ্রুত ব্যান্ডেজ করে নিয়েছি।
২৪ মার্চ
দলীয় সদস্যরা জানতে চাইছে
হাতে কী হয়েছে। ওদের বলেছি কিচেন নাইফে
কেটে গেছে। কিন্তু ওদের চোখমুখ দেখে বুঝতে পারছি, ওরা আমায় বিশ্বাস করছে না।
৬ এপ্রিল
আমি পর্যবেক্ষণ করার
জায়গাটা বদলেছি। সন্দেহ নেই, ওরা আমাকে দেখতে পেলেই আক্রমণ করবে। আমি যে ওদের অস্তিত্বের কথা জানতে পেরে
গিয়েছি। ওদের চলাফেরার গতিবেগ অবিশ্বাস্য রকমের দ্রুত। ঘণ্টায় প্রায় ১০০ কিমি।
১২ এপ্রিল
আজ আবার একটা বড়ো মাপের আক্রমণ থেকে বেঁচে ফিরলাম। সাথে আইস
অ্যাক্সটা ছিল বলে বেঁচে ফিরেছি। কিন্তু আমার গোড়ালি ভেঙে গেছে। আপাতত শয্যাশায়ী।
ক্যাম্পের ডাক্তার প্লাস্টার করে দিয়েছে। সাথে
কিছুদিন রেস্ট নিয়ে এখান থেকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু আমি ফিরে যেতে
পারব না। ওদের প্রোজেক্ট আমাকে ছাড়াও সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। কিন্তু আমার নিজের
প্রোজেক্টের কী হবে?
২০ এপ্রিল
আমি আগামীকাল আবার ওখানে যাব। এই
প্লাস্টার নিয়েই। যত কষ্টই হোক। ডাক্তার আর দলীয় সদস্যরা যা ভাবে ভাবুক। যা স্টেপ নেয় নিক। আমাকে আরও কিছুটা
টিসি’র রক্তের নমুনা যোগাড় করতেই হবে। এবার সাথে করে পিস্তলটাও নিয়ে যাব।
*
২১শে এপ্রিল সেই দিন যেদিন
রাতে দলীয় সদস্যরা বুঝতে পারেন প্রফেসর রাও
ক্যাম্প ছেড়ে চলে গেছেন।
_____
অলঙ্করণঃ পুষ্পেন মণ্ডল
লেখক পরিচিতিঃ প্রতিম দাস
মূলত চিত্রশিল্পী। ২০১৩ সাল থেকে ভারতের সব পাখি আঁকার লক্ষ্য
নিয়ে কাজ করে চলেছেন। ৭৭৫+ প্রজাতির ছবি আঁকা হয়ে গেছে। তবে
শুধু পাখি নয়, অন্যান্য বিষয়েও ছবি আঁকা চলে
পাশেপাশেই। সেইসঙ্গে দারুণরকমের পাঠক। ‘যা
পাই তাই পড়ি’ ধরনের। প্রিয় বিষয় রূপকথা, ফ্যান্টাসি,
সায়েন্স ফিকশন ও অলৌকিক। টুকটাক
গল্প লেখার সঙ্গে সঙ্গে আছে অনুবাদের শখ।
No comments:
Post a Comment