![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiqUYMgsUpguQVFyrIRwK3S9C-aKYJGc7LhVZLRaOce6S3f620bOJFyWrLzQ8yYKer1xMddPXDojyGrqyQ365kqJzOtpNw0rQMfSUIzSAKykRnBbp9gI0gDhnRkPHPb8r7H4iqgP9KyqW4/s640/Kamalbikash+Black-Hole.jpg)
মহাকাশে
কান্না
কমলবিকাশ
বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রায়
এক বছরের চেষ্টায় পিন্টু আর চিন্টু দু’জনে মিলে মহাকাশযানটা বানিয়ে ফেলল। কেউ যাতে
দেখে না ফেলে তাই সেটাকে পিন্টু ওদের বাড়ির পিছনের বাগানে একটা ঝোপের আড়ালে রেখে
দিয়েছে। এখন শুধু ওড়ার অপেক্ষায়। এত অত্যাধুনিক মহাকাশযান এর আগে তৈরি হয়নি।
বিল্ট-ইন রকেট থাকায় একে মহাকাশে তোলার জন্য আলাদা করে কোনও রকেটের দরকার হয় না। ঠিক
হয়েছে আগামীকালই এতে চড়ে ওরা মহাকাশে একটা চক্কর মেরে আসবে।
দুই
বন্ধু পাশাপাশি বাড়িতে থাকে। একই সাথে বড়ো হয়েছে। অ্যারোনটিক্স-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার
সময়েই পিন্টুর মাথায় এই নতুন ধরনের মহাকাশযান বানানোর মতলব ঘুরপাক খেতে শুরু
করেছিল। চিন্টুর সাহায্য নিয়ে এতদিনে সেই স্বপ্ন সফল হয়েছে।
পিন্টু,
চিন্টুকে নিয়ে পূর্ব নির্ধারিত সময়েই মহাকাশযান আকাশে উড়ল। দুরন্ত গতিতে ছুটে
চলেছে। মহাকাশযানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই পিন্টু-চিন্টু দু’জনেই অবাক। মহাকাশজুড়ে
শুধু গ্যালাক্সি আর গ্যালাক্সি। সীমাহীন মহাকাশে গ্যালাক্সিগুলি অর্থাৎ,
তারাজগতগুলি যেন দলবেঁধে ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রতিটি গ্যালাক্সিতে রয়েছে গ্রহ-নক্ষত্রের
মেলা। চিন্টু হঠাৎ পিন্টুর পিঠে আলতো টোকা মেরে মহাকাশের একদিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে
বলল, “ওইদিকে দেখ, একটা হালকা আলো দেখা যাচ্ছে না?”
পিন্টু
সেইদিকে তাকিয়ে বলল, “তাই তো! একটা হালকা নীল আলো দেখা যাচ্ছে। দাঁড়া, দূরবীনটা
দিয়ে ভালো করে দেখি।”
দূরবীনে
চোখ রেখে একটু পরে পিন্টু বলল, “ওটা প্যান্ডোরাস তারাজগতগুচ্ছ (Pandora’s Cluster)। ওখান থেকেই আলোটা
আসছে।”
“বিজ্ঞানীরা
যাকে ‘আবেলি ২৭৪৪’ বলে?”
“ঠিক
বলেছিস, চিন্টু।”
“ওখান
থেকে ওরকম আলো বের হচ্ছে কেন? অন্য তারাজগতগুচ্ছগুলি থেকে তো বের হচ্ছে না?”
“তারাজগতগুলি
যখন জোট বেঁধে তারাজগতগুচ্ছ তৈরি করে তখন অনেক সময় দুটি তারাজগতের মধ্যে সংঘর্ষ
ঘটে। এই বিধ্বংসী সংঘর্ষে বহু তারা নিজের নিজের তারাজগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এরা তখন সেই তারাজগতগুচ্ছে ভবঘুরের মতো একা একা ঘুরে বেড়াতে থাকে। টফির দুটি
প্রান্ত ধরে টানলে যেমন মাঝখানটা সরু হতে হতে একসময় ছিঁড়ে যায় তেমন সংঘর্ষের ফলে ও
মহাকর্ষ বলের টানে কখনও কখনও কোনও কোনও তারাজগতেরও তেমনি দশা হয়। ছিন্নভিন্ন হয়ে
নিষ্প্রভ এই তারাজগতগুলি তারাজগতগুচ্ছের মধ্যে মৃতবৎ অবস্থায় ঘুরে বেড়ায়।
প্যান্ডোরাস তারাগুচ্ছের মধ্যে ছয় বিলিয়ন বছর ধরে ছিন্নভিন্ন হওয়া এরকম ছ’টি মৃতবৎ
তারাজগত আছে। ছিন্নভিন্ন তারাজগতগুলির যে তারাগুলি ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে
সেগুলির জ্বালানি শেষ হয়ে গেছে। পুরো তারাজগতগুচ্ছটিতে এইধরনের তারা আছে দুশো
বিলিয়নের মতো। এই তারাগুলি নিষ্প্রভ হলেও এগুলি থেকে এখনও একধরনের হাল্কা নীলাভ
আলো বেরিয়ে আসছে। সেটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি।”
মহাকাশের
এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে মহাকাশযান একটা কৃষ্ণ-গহ্বরের সামনে এসে পড়েছে
ওদের খেয়ালই ছিল না। যখন খেয়াল হল তখন সেটা ঘটনা দিগন্তর কাছাকাছি এসে পড়েছে। আর
কিছুটা গেলেই সেটা ঢুকে পড়বে ঘটনা দিগন্তে। তারপর সেটা ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যেতে
থাকবে কৃষ্ণ-গহ্বরের দিকে। সেখান থেকে কোনওমতেই আর বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে
ঢুকে যাবে কৃষ্ণ-গহ্বরে। তারপর? না, তারপরের কথা চিন্টু আর ভাবতে পারছে না। স্টিফেন
হকিং-এর কথা মনে পড়তেই ও শিউরে উঠল। বাস্তব কালের পরিপ্রেক্ষিতে দু’জনের কারোরই আর
বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আর সেই মৃত্যু হবে ভয়ংকরভাবে। কী ঘটবে
তখন? মাথা এবং পায়ের দিকে মহাকর্ষীয় বলের পার্থক্যের দরুণ তাদের দেহ ক্রমশ লম্বা
হতে থাকবে। শেষে সরু সুতোর মতো হয়ে ছিঁড়ে যাবে। যদিও মহাবিশ্বে বাস্তব কাল বলে
কিছু নেই। তাই কাল্পনিক কালের প্রেক্ষিতে বিচার করলে এমনটা নাও ঘটতে পারে। পিন্টু-চিন্টুর
প্যাকাটির মতো সরু হয়ে যাওয়া শরীরে হয়তো প্রাণটা ধুকপুক করতে থাকবে। কৃষ্ণগহ্বর
থেকে কণিকা এবং বিকিরণ বেরিয়ে এলে সেটার ভর কমতে থাকবে এবং সেটা ছোটো হতে হতে একসময়
হয়তো মিলিয়ে যাবে। যদি এমনটা ঘটে তাহলে ইতিমধ্যে ওই কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে পড়ে থাকা
অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে পিন্টু-চিন্টু নিজস্ব একটি শিশু-মহাবিশ্বে চলে যাবে যার
স্থান, কাল সবই কাল্পনিক। জানা নেই সেখানে তারা কেমন থাকবে।
পিন্টু
প্রাণপণ চেষ্টা করছে মহাকাশযানটাকে ঘটনা দিগন্ত থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু
পারছে না। একটার পর একটা বোতাম টিপেই চলেছে। শেষ পরিণতির কথা ভেবে চিন্টু ভয়ে কাঠ
হয়ে বসেছিল। এবারে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। আর কী আশ্চর্য, মহাকাশযান ঘটনা দিগন্তর
ঠিক সীমানার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল। পিন্টু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। নিজের মনে বলল, ‘যাক,
মহাকাশযানটাকে আটকানো গেছে। এবারে এখান থেকে বেরিয়ে যাবার পথ খুঁজতে হবে।’
হঠাৎ
চিন্টুর দিকে চোখ ফেরাতেই অবাক হয়ে পিন্টু বলল, “কী হল তোর? ওরকম ভেংচি কাটছিস
কেন?”
“কোথায়
ভেংচি কাটছি?”
“তাহলে
ওরকম মুখ করে বসে আছিস কেন?”
পিন্টু
ওর মুখের সামনে একটা আয়না ধরে বলল, “দ্যাখ, তোর মুখের অবস্থা।”
চিন্টু
এবার হেসে ফেলল। বলল, “ধ্যাৎ, আমি মোটেই ভেংচি কাটছিলাম না। ভয়ে আমার কান্না পেয়ে
গিয়েছিল।”
“এই
তোর কান্নার ছিরি? চোখ থেকে তো এক ফোঁটাও জল পড়ল না!”
পিন্টুর
কথা শুনে চিন্টু গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে গেল। হু-হু করে যেভাবে কাঁদছিল তাতে তো
চোখের জল গাল বেয়ে টপ টপ করে পড়ার কথা। কিন্তু গাল তো শুকনো! জল গেল কোথায়?
চিন্টুর
অবস্থা দেখে পিন্টু হো হো করে হেসে বলল, “তুই কি কুমিরের কান্না কাঁদছিলি?”
এবারও
এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। পিন্টু হো হো করে হেসে উঠতেই মহাকাশযান ছিটকে ঘটনা দিগন্ত
থেকে দূরে সরে এল। তারপর পৃথিবীর উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করল।
এতক্ষণে
চিন্টুর মুখে হাসি ফুটেছে। পিন্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ রে, কান্নার সময় আমার
চোখ থেকে জল পড়ল না কেন রে?”
চিন্টুর
দিকে তাকিয়ে পিন্টু বলল, “তোর ভয় এখনও কাটেনি দেখছি। বিজ্ঞানটাই ভুলে গেছিস। এখানে
কি কোনও মাধ্যাকর্ষণ আছে যে চোখ থেকে জল পড়বে?”
“তাই
তো!” বলে চিন্টু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মহাকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে গুন
গুন করে গান ধরল।
_____
ছবিঃ
আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment