দুই
প্রোফেসরের কথা
সুচরিতা
দত্ত
প্রোফেসর
হেশোরাম হুঁশিয়ার কিন্তু ভারি রাগ করেছেন। না না, ভয় পেয়ো না, তোমাদের উপর নয়, উনি রাগ করেছেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকা আর তার সম্পাদক সুকুমার রায়ের উপর। তা রাগ হবে নাই
বা কেন? ‘সন্দেশ’ পত্রিকা সেকাল একালের কত জীবজন্তু, আশ্চর্য ঘটনার কথাই লেখে আর হেশোরাম হুঁশিয়ার যে কত কষ্ট
করে তার দলবল নিয়ে কোন সেই কারাকোরামের বন্দাকুশ পাহাড়ে কী ভয়ানক অভিযানটাই না করে
এলেন, কত অদ্ভুত জীবজন্তুদের কিম্ভুত
কীর্তিকলাপের কথাই না জানলেন, সেই বিষয়ে কারোর কোনও মাথাব্যথাই নেই! রাগ না হয়ে
যায়?
ভাবছ
তো কেই বা এই হেশোরাম হুঁশিয়ার? তিনি
সুকুমার রায়ের উপর রাগ করেছেন কি না জেনে ভারি বয়েই গেল! উঁহু, অমন মুখ ঘুরিয়ে থাকলে প্রোফেসর হুঁশিয়ারের দুর্ধর্ষ রোমহর্ষক
অভিযানের কথা তোমরা জানবে কী করে?
প্রোফেসর হেশোরাম হুঁশিয়ার আর তাঁর দলবল |
আজ
থেকে প্রায় একশো বছর আগে ১৯২২ সালে
প্রোফেসর হুঁশিয়ার, তাঁর ভাগনে
চন্দ্রখাই, দুই পাঞ্জাবী শিকারি ছক্কড় আর
লক্কড় সিং, ছয়জন কুলি ও একটা কুকুরসহ অভিযান
করেছিলেন কারাকোরামের বন্দাকুশ পাহাড়ের অজানা জায়গায়। যেসব জায়গায় তারা গিয়েছিলেন
তা যেমন অতি অদ্ভুত তেমনি সেখানকার গাছপালা, ফলমূল, জীবজন্তু
সবই কেমন যেন অতি কিম্ভূত। সেসব জায়গায় প্রাণীদের যেমন কেউ কখনও দেখেনি, তেমনি তাদের নামও কেউ জানে না। ভাগ্যিস প্রোফেসর ওরকম
দুর্গম জায়গায় অভিযান করেছিলেন! তাই তো আমরা সেই বিদঘুটে প্রাণীগুলোর পরিচয় পেলাম।
ভাবছ তখন থেকে অদ্ভুত-কিম্ভুত-বিদ্ঘুটে এইসব বিশেষণের বোঝা বাড়িয়েই যাচ্ছি? কী এমন
প্রাণী তারা!
তাহলে
শোন তাদের বর্ণনা।
হাতির
চাইতেও বড়ো প্রকান্ড এক মানুষ (নাকি বাঁদর?) সারাক্ষণ শুধু খেয়েই যায়। প্রোফেসর তার নাম দিয়েছিলেন ‘হ্যাংলাথেরিয়াম’।
তারপর? তাপ্পর আরও আছে। উটপাখির মতো বড়ো লম্বা গলার অদ্ভুত পাখি ‘ল্যাগব্যাগর্নিস’। সে যে
কোনদিকে চলবে, এগোবে না
পিছোবে তা নিজেই জানে না! কাঁকড়ামতী নদীর ধারে আছে বিশালাকৃতি জানোয়ার ‘ল্যাংড়াথেরিয়াম’, আছে না সাপ, না মাছ, না
কুমীর ‘চিল্লানোসোরাস’, ছোটো নিরীহ
গোছের নিতান্তই গোবেচারা ‘বেচারাথেরিয়াম’। আছে খিটখিটে, খুঁতখুঁতে গোমড়া মেজাজ আর অনন্ত বিরক্তিকর মুখ
করে থাকা বিকট প্রাণী ‘গোমড়াথেরিয়াম’।
হ্যাংলাথেরিয়াম |
কী? এদের নাম শুনেছ কখনও? শোনোনি তো? তাহলেই
ভাবো, ভাগ্যিস প্রোফেসর কারাকোরামে ওরকম অদ্ভুত জায়গায় গিয়ে পড়েছিলেন! তাই তো আমরা জানতে পারলাম সে জায়গার প্রাণীদের কথা। সত্যি
মিথ্যে না হয় তোমরাই বিচার করে নিও। আমার আর কী!
কিন্তু
তারপর কী হল প্রোফেসর হুঁশিয়ারের? তা
আর কী বলব দুঃখের কথা! তিমিমাছের মতো কী এক বিশাল নাম না জানা জন্তুর ডানার
ঝাপটানিতে প্রোফেসর ও তার দলবল পুরো ছত্রভঙ্গ হয়ে কোনওরকমে নিজেদের প্রাণটা নিয়ে
পালিয়ে এসে বেঁচেছেন! তবে সুকুমার রায়ের উপর তাঁদের বোধহয় আর রাগ নেই। কারণ, তাদের
এই রোমহর্ষক অভিযানের কাহিনি সুকুমার রায় ছিলেন বলেই তো আমরা জানতে পারলাম!
তা প্রোফেসর
হেসোরাম হুঁশিয়ার আর কোনও অভিযান করেছিলেন কি না তা বাপু আর জানার জো নেই। কারণ,
বিখ্যাত এই চরিত্রের স্রষ্টা সুকুমার রায় খুব অল্প বয়সে মারা যান।
ল্যাংড়াথেরিয়াম |
প্রোফেসার
হেশোরামের অভিযানের প্রায় চল্লিশ বছর পর ১৯৬১ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় আবার এক অভিযানের কাহিনি প্রকাশিত হয় সুকুমারপুত্র
সত্যজিৎ রায়ের কলমে – ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি’। এই অভিযানের
পুরোভাগে ছিলেন ভারত তথা পৃথিবীবিখ্যাত বৈজ্ঞানিক প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু।
জানিয়ে রাখি শঙ্কুর চরিত্র নির্মাণের প্রারম্ভে সত্যজিতের অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর
বাবার সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র প্রোফেসর হেশোরাম হুঁশিয়ার ও আর্থার কোন্যান ডয়েলের
প্রোফেসর চ্যালেঞ্জার। লক্ষণীয়, প্রোফেসর হেশোরাম হুঁশিয়ারের অভিযান কাহিনি লেখা
হয়েছিল ডায়েরির আকারে। কাহিনির নাম ছিল ‘হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’। ১৯৬১ সালে
শঙ্কুর প্রথম অভিযানের নামও ছিল ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি’। শঙ্কুর
সমস্ত অভিযানগুলিও লেখা ডায়েরির আদলেই। তাছাড়া সুকুমার রায় আর সত্যজিৎ রায়ের
অলঙ্করণে নির্মিত হেশোরাম আর শঙ্কুর চেহারা দেখলেই সাদৃশ্যের স্পষ্ট ছাপ কারোরই
নজর এড়িয়ে যাবে না।
জানি
তোমাদের অনেকের মনেই আবার প্রশ্ন জেগেছে, কে এই শঙ্কু? তোমরা অনেকেই হয়তো এর মধ্যে শঙ্কুর অভিযানের কিছু কাহিনি
পড়ে ফেলেছ। তাঁকে সবচেয়ে বেশি চেনেন একমাত্র সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ-এর কলমে শঙ্কুর
যেটুকু পরিচয় পাওয়া যায়, তা হল ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু ওরফে তিলুর বাবা ত্রিপুরেশ্বর
শঙ্কু ছিলেন পেশায় পদার্থবিদ। শঙ্কুর অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহের নাম বটুকেশ্বর শঙ্কু।
ছোটো থেকেই শঙ্কু অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। মাত্র বারো বছর বয়সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এর চার বছর পর অর্থাৎ ষোল বছরে (যেই বয়সে আমরা
মাধ্যমিক নিয়ে হিমসিম খাই) তিনি পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন দু-দুটি বিষয়ে অনার্স ডিগ্রি
লাভ করেন! ১৯৯২ সালে আনন্দমেলায় পূজাসংখ্যায় প্রকাশিত শঙ্কুর শেষ সম্পূর্ণ অভিযান ‘স্বর্ণপর্ণী’
থেকে জানা যায় ২০ বছর বয়সে শঙ্কু স্কটিশচার্চ কলেজে
অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। তবে ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি’ থেকে শুরু করে অন্যান্য অভিযানগুলিতে আমরা শঙ্কুর যে চিত্র
পাই তা প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় পৌঁছনো এক বিজ্ঞানসাধকের। তাই বলে সারাক্ষণ কি তিনি মুখ
গোঁজ করে ল্যাবরেটরিতে কাজ করেন? মোটেই
তা নয়। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। শুনলে অবাক হয়ে যাবে যে তিনি ৬৯টি
ভাষায় পারদর্শী। শুধু বিজ্ঞানসাধক বললে তাই তাঁর প্রতিভাকে খাটো করা হয়। তিনি আদপেই
একজন প্রকৃত জ্ঞানসাধক।
তো
এহেন প্রফেসর শঙ্কুর নিবাস উশ্রী নদীর তীরে গিরিডিতে। সাথে থাকে চাকর প্রহ্লাদ ও
২৪ বছর ধরে তাঁর একান্ত অনুগত বিড়াল নিউটন। তাঁর বাড়ির কাছেই থাকেন প্রতিবেশী
অবিনাশ মজুমদার। শঙ্কু শুধু ভারতেই না, পৃথিবীর বিজ্ঞানীমহলেও এক অতি পরিচিত নাম। তাই পৃথিবীব্যাপী
তার জ্ঞানীগুণী বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও নেহাৎ কম না। ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক জন সামারভিল, জার্মান নৃতত্ত্ববিদ উইলহেলম ক্রল, ব্রিটিশ ভূ-তত্ত্ববিদ জেরেমি সন্ডার্স যেমন তাঁর
বন্ধুতালিকায় ঝকমক করেন তেমনি এঁরা শঙ্কুর কোনও কোনও অভিযানের সহযাত্রীও বটে।
শঙ্কুর
আবিষ্কারের কথা যদি শোনো তো চোখ কপালে উঠবেই। কী নেই সেই তালিকায়! টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ, এক্স-রেস্কোপের সমন্বয়ে তৈরি অমনিস্কোপ, ধন্বন্তরি ওষুধ মিরাকিউল, লিঙ্গুয়াগ্রাফ, মহাকাশযাত্রার জন্য শাঁকোপ্লেন, নিশ্চিহ্ন করার অস্ত্র অ্যানাইহিলিন গান বা নিশ্চিহ্নাস্ত্র, রোবট রোবু, হাঁচির
জন্য স্নাফগান, আরও কত কী! সব বলতে গেলে এ লেখা আর শেষ হবে না।
প্রোফেসর
শঙ্কু মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন দেশ থেকে বা বিভিন্ন ব্যক্তির আমন্ত্রণ পান এবং তারপরই
শুরু হয় একের পর এক দুর্ধর্ষ অভিযানের পটভূমি। মাঝে সাঝে বাড়িতে বসে অথবা বাইরে
বেড়াতে গিয়েও জড়িয়ে পড়েন একাধিক সমস্যায়, রহস্যের জালে। তাঁর গিরিডির বাড়ি থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য, জাপান, ইউরোপের
একাধিক দেশ, সাহারা, বলিভিয়া মায় সৌরজগৎ (ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি) থেকে জলের অতল (প্রোফেসর
শঙ্কু ও রক্তমৎস্য রহস্য) পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে টান টান রহস্যের জাল ও অ্যাডভেঞ্চারের
হাতছানি। ১৯৬১ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি’ থেকে শুরু করে ১৯৯২ সালে ‘আনন্দমেলা’ পুজোসংখ্যায় ‘স্বর্ণপর্ণী’ একত্রিশ বছর ধরে সত্যজিৎ রায় শঙ্কুর আটত্রিশটি অভিযানের
কাহিনি রচনা করেছেন। সত্যজিতের মৃত্যুর পর দুটি কাহিনি অসমাপ্ত থেকে যায় – ‘ইনট্রেলেক্টন’
ও ‘ড্রেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনা’। সমাপ্ত ও
অসমাপ্ত মোট চল্লিশটি কাহিনি একসাথে দুই মলাটের মধ্যে এনে ২০০২ সালে আনন্দ
পাবলিশার্স ‘শঙ্কু সমগ্র’ প্রকাশ করে। এছাড়া শঙ্কুর একাধিক কীর্তিকলাপ একত্র করে
প্রকাশিত অন্যান্য বইগুলি হলঃ
প্রোফেসর
শঙ্কু, নিউ স্ক্রিপ্ট, কলকাতা, ১৯৬৫
প্রোফেসর
শঙ্কুর কান্ডকারখানা, আনন্দ, ১৯৭০
সাবাশ
প্রোফেসর শঙ্কু, আনন্দ, ১৯৭৪
মহাসংকটে
শঙ্কু, আনন্দ, ১৯৭৭
স্বয়ং
প্রোফেসর শঙ্কু, আনন্দ, ১৯৮০
শঙ্কু
একাই ১০০, আনন্দ, ১৯৮৩
পুনশ্চ
প্রোফেসর শঙ্কু, আনন্দ, ১৯৯৩
সেলাম
প্রোফেসর শঙ্কু, আনন্দ, ১৯৯৫
এছাড়াও
‘শঙ্কুর কঙ্গো অভিযান’, ‘প্রোফেসর
শঙ্কু ও ইউ.এফ.ও’, ‘মরুরহস্য’
ইত্যাদি বেশ কিছু অভিযান পৃথক বই আকারেও আনন্দ থেকে
প্রকাশিত হয়েছে।
বেশ
কিছু কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে কমিকস আকারেও।
এরপর? এরপর আর কী? প্রোফেসর শঙ্কু নিয়ে অনেক কথাই তো জানলে। এরপর চটপট পড়ে নাও
শঙ্কুর অভিযানগুলি। আর হ্যাঁ, তার আগে কিন্তু প্রোফেসর হুঁশিয়ারের কথা পড়তে ভুলো
না। একটা সুখবর দিয়ে লেখাটা শেষ করি।
সত্যজিৎপুত্র
সন্দীপ রায় খুব তাড়াতাড়িই সিনেমার পর্দায় আনতে চলেছেন প্রোফেসর শঙ্কুকে। আমরা মানে
যারা শঙ্কুর ভক্ত, তারা এখন
সেই প্রতীক্ষায় দিন গুনছি।
_____
khub sundor
ReplyDelete