![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEj2LxYeN-RCzVexwmKbyiDVD1cFkz9dh7Nee79FUyE_rFnfCpZTK1-xwvMClPQShPy5FfbGTgDPXLr83xFmCzVKneBzbeegCePGoI5QNX_cwbqTpndMR8gYh9KWL7dayHcKyb6qYELssZs/s640/joler+tolay+samantyak.jpg)
অনীশ দেব
জি.টি. রোডের ধারে একটা ঝাঁকড়া বটগাছ চোখে পড়তেই সুশীল-মাঝি বললেন, “ওই গাছতলায় গাড়ি থামান।”
আমি তাঁর কথামতো কাজ করলাম। টার্বো জিপটাকে ম্যাগনেটিক ব্রেক কষে চোখের পলকে দাঁড় করিয়ে দিলাম। তারপর জিপ থেকে নেমে সাইরেন অফ করে দিলাম। ড্যাশবোর্ডের মাইক্রোফোনের কাছে মুখ নিয়ে কোড নম্বর বলে কম্পিউটার লক করে দিলাম গাড়িটাকে।
সুশীল-মাঝিও নামলেন গাড়ি থেকে। পরনের ধুতিটা সামলে নিয়ে বললেন, “আসুন রত্নেশ্বরবাবু, ওই বাঁশবনটা পেরোলেই সেই পুকুর।”
আমি পকেট থেকে কম্পিউটার প্রিন্ট আউটের একটা পৃষ্ঠা বের করলাম। এই রিপোর্টটাই গতকাল এসেছে আমার কাছে। বড়ো রহস্যময় ঘটনা। জলের তলায় কী এমন ঘটনা ঘটল যাতে...
সুশীলবাবু আচমকা বললেন, “রত্নেশ্বরবাবু, এই সেই মরণ-পুকুর, প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো।”
বড়ো রাস্তা ছাড়িয়ে ঘাসে ছাওয়া উঁচুনিচু ঢিবি পেরিয়ে আমরা বেশ কিছুটা পথ এসেছি। চারদিকে নানান গাছপালা, বাঁশবন, আগাছার ঝোপ। আর কয়েকটা
অশ্বত্থগাছ মাথা চাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে। তারই ফাঁক দিয়ে ছোটো ছোটো পায়ে চলা পথ। সেইরকমই দুটো পথ মাটির ঢাল বেয়ে নেমে গেছে বহু প্রাচীন ভাঙাচোরা ঘাটের দিকে। পুকুরটা খুব বেশি বড়ো নয়, বড়োজোর বিঘে খানেক হবে। চেহারাটা না গোল, না চৌকো। এই গরমের সময় জল যতটা শুকিয়ে যাওয়ার কথা ততটা শুকোয়নি। জলের রং সবুজ আর চারদিকেই আগাছার ঝাড় নেমে গেছে একেবারে জলের কিনারা পর্যন্ত। এককথায় নোংরা ডোবাও বলা চলে। পুকুরের একটাই মাত্র ঘাট। ঘাট বলতে কতকগুলো কাত হয়ে পড়া ইটের চাঙড়। সেখানে একজন মহিলা বসে কাপড় কাচছেন। আর একজন পুরুষ ঘাটে বসে মগ দিয়ে জল তুলে স্নান করছেন। ঘাট যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে ঢালের মুখে বাঁদিকে একটা প্রকান্ড কাকতাড়ুয়া। তার বুকে একটুকরো জং ধরা টিনের পাতের ওপরে কাঁচা হাতে লেখা - বিপদ।
আমাদের দেখে পুরুষমানুষটি স্নান থামিয়ে নমস্কার করলেন সুশীলবাবুকে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, সুশীল-মাঝি এখানকার অঞ্চল-প্রধান। আর মহিলাটি তাড়াহুড়ো করে কাচাকাচি সেরে উঠে চলে গেলেন। প্রথম মানুষটি গামছা দিয়ে গা মুছতে মুছতে ওপরে উঠে এলেন। আমার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। সুশীলবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। তাঁকে বাধা দিয়ে আমি একটা আইডেন্টিফিকেশন কার্ড বের করে আগন্তুককে দেখলাম। বললাম, “আমার নাম রত্নেশ্বর রায়। গভর্নমেন্টের প্যারানরমাল ফেনোমেনা এনালিসিস উইং থেকে আসছি। গতকালের ঘটনা নিশ্চয়ই জানেন? তার রিপোর্ট পৌঁছেছে আমাদের ডিপার্টমেন্টে। আমি সেটাই তলিয়ে দেখতে এসেছি।”
ভদ্রলোক আমার কথা শেষ পর্যন্ত শুনলেন না। সুশীলবাবুর দিকে ফিরে উত্তেজিতভাবে বললেন, “ওসব তদন্তে-ফদন্তে কিস্যু হবে না সুশীলদা। এ-পুকুরের জলের তলায় অপদেবতা আছে, অভিশাপ আছে।”
সুশীলবাবু তাঁকে শান্ত করার ভঙ্গীতে বললেন, “আহা নৃপেন, তুমি থামো। ওঁকে ঠিকমতো কাজ করতে দাও।”
নৃপেনবাবু একবার আমার দিকে তাকালেন। তারপর আবার তাকালেন সুশীল-মাঝির দিকে। তারপর চাপা গলায় বললেন, “এই পুকুর আমার বাপকে খেয়েছিল। সে-ঘটনা যারা স্বচক্ষে দেখেছিল তারা বলেছে, জলের তলা থেকে কোনও দানো বাপের পা ধরে টেনে নিয়েছিল। কালকের ব্যাপারটাও তাই।”
একথা বলে নৃপেনবাবু কীসব বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলেন। তাঁকে আমি কী করে বোঝাব এই একবিংশ শতাব্দীতে অলৌকিক ঘটনার কোনও স্থান নেই। আর জনসাধারণের মন থেকে মিথ্যে ভয় আর কুসংস্কার তাড়ানোর জন্যই সরকার তৈরি করেছে ‘প্যারানর্মাল ফেনোমেনা এনালিসিস উইং’। কোনওরকম অলৌকিক ঘটনার হদিশ পেলেই আমাদের দপ্তর সেখানে বিশেষজ্ঞ পাঠিয়ে দেয়। আমি জলবিভাগের লোক এবং বিশেষজ্ঞ। রিপোর্টটা আমার হাতেই ছিল। সেটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলাম।
নৃপেনবাবুর বাবা যখন মারা যান, তখন কোনও শোরগোল হয়নি। আমাদের ডিপার্টমেন্টেও কোনও খবর পৌঁছয়নি। কিন্তু গতকালের ঘটনা সম্পূর্ণ আলাদা। গতকাল এই পুকুরে ডুবে মারা গেছেন বিখ্যাত সাঁতারু চিরদীপ দাস। গত ২০০৪ সালের ওলিম্পিকে যিনি সাঁতারে দু-দুটো সোনা জিতেছেন। একটা ১০০ মিটারে আর একটা ২০০ মিটারে সাঁতারে ভারতের একমাত্র সোনা বিজয়ী। রিপোর্ট ছাড়া বাকি গল্পটুকু আমি জীপে আসতে আসতে সুশীলবাবুর মুখেই শুনেছি। এই গাঁয়ে চিরদীপ দাসের আদি বাড়ি। গত বিশ বছর ধরে এখানে ওঁরা কেউই থাকতেন না। তবে মাঝে মাঝে কেউ কেউ গাঁয়ের বাতাস গায়ে মাখতে আসতেন। যেমন গত পরশু চিরদীপ একা এসেছিলেন। কোন ছোটোবেলায় গাঁ ছেড়ে চলে যাবার পর এই তাঁর প্রথম আসা এবং এই শেষ।
বেশ বুঝতে পারছি, ঘটনাটা কী ঘটেছিল। গাঁয়ে এসে এই পুকুরের অভিশাপের গল্প নিশ্চয়ই চিরদীপের কানে গিয়েছিল। তখন অলিম্পিক সাঁতারু চিরদীপ সেটা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারপর অভিশাপের ব্যাপারটা যে ভিত্তিহীন, উদ্ভট কল্পনা, সেটা প্রমাণ করতে চিরদীপ এই পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ব্যাপারটা দেখার জন্য প্রচুর লোক পুকুরপাড়ে জড়ো হয়েছিল। আর তাদের চোখের সামনেই খাবি খেতে খেতে তলিয়ে গেছেন ওলিম্পিকে সোনা বিজয়ী সাঁতারু চিরদীপ দাস। সুশীলবাবুও নিজের চোখেই দেখেছেন চিরদীপের মৃত্যু।
আমি বুঝতে পারলাম, সুশীলবাবু আমাকে লক্ষ করছেন। বোধহয় উনি আঁচ করেছেন আমি কী ভাবছি। একটু পরেই ওঁর কথায় তার প্রমাণ পেলাম। আমাদের গায়ে চড়া রোদ লাগছিল। সুশীলবাবু আমাকে আলতো করে একটা গাছের ছায়ায় টেনে নিলেন। হাত বুলিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন, “চিরদীপকে নিয়ে এ-পর্যন্ত মোট পাঁচজন হল। মানে আমার জীবনে। তার আগে আরও কত গেছে কে জানে। সকলকে সাবধান করার জন্য এই বিপদের নোটিস আজ প্রায় বারো বছর ধরে লাগানো আছে। আমরা কি এ-পুকুরে স্নান করি না? করি। তবে ওই ঘাটে বসে মগ, বালতি কি বাটি দিয়ে। ওই নৃপেনকে যেমন দেখলেন।”
আমি পুকুরের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সুশীল-মাঝিকে দেখলাম। বললাম, “চিরদীপবাবুকে তো আপনি মরতে দেখেছেন। আপনার কি মনে হয়েছিল যে, তাঁকে কেউ জলের তলা থেকে টেনে নিচ্ছে?”
সুশীলবাবু মাথার কাঁচাপাকা চুলে হাত চালালেন। বার দুয়েক গাল চুলকে বললেন, “হতে পারে। ভালো করে বুঝতে পারিনি। তবে চিরদীপ ভীষণ আঁকুপাঁকু করে হাত পা ছুঁড়ছিল। ‘বাঁচাও’ বলে। কিন্তু কে বাঁচাবে বলুন?”
সুশীলবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেললেন। বললেন, “দেখুন, আপনি যদি এর একটা সমাধান করতে পারেন। এতগুলো লোকের চোখের সামনে জোয়ান
ছেলেটা মারা গেল, অথচ আমরা কিছু করতে পারলাম না।”
পুকুরের পাড় ঘেঁষে প্যাঁক
প্যাঁক করে বেশ কয়েকটা হাঁস ঘুরঘুর করছিল। লক্ষ করলাম, ওরা মোটেই জলে নামছে না।
বরং ডাঙা থেকে ঠোঁট বাড়িয়ে জলের কিনারা
থেকে খাবার খুঁটে খাচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এ-পুকুরে হাঁস নামে না?”
সুশীল-মাঝি বললেন, “ওরা তো আর আমাদের মতো নয়। ওরা বিপদের গন্ধ পায়।”
আমি অবাক হয়ে পুকুরের সবুজ
জল দেখতে লাগলাম। রোদের ছোঁয়া লেগে জল ঝিকমিক করছে। এলোমেলো বাতাসে জলে ছোটো
ছোটো ঢেউয়ের শিরা ফুটে উঠছে। দেখে কে বলবে, এই পুকুর অন্তত
পাঁচজনের প্রাণ নিয়েছে!
রিপোর্টটা পকেটে রেখে আমি
একটা বড়সড় মাটির ঢেলা কুড়িয়ে নিলাম। কিছু
না ভেবেই ছুঁড়ে মারলাম পুকুরের শান্ত জলে। ঝুপ করে একটা শব্দ হল। তারপর ঢেউ উঠল।
গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারদিকে। আমি পকেট থেকে দুটো স্টেরিলাইজড পলিথিন ব্যাগ
বের করলাম। জলের নমুনা নিতে হবে এতে। তারপর নিয়মমাফিক বিশ্লেষণ করতে হবে
ল্যাবরেটারিতে। কিছু পাওয়া যাক আর না যাক, এটাই তদন্তের প্রাথমিক নিয়ম।
ভাঙা ঘাটে
নেমে ঝুঁকে পড়ে জল সংগ্রহ করতে লাগলাম। সুশীলবাবুও আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন।
উনি যে বেশ কৌতূহল নিয়ে আমার কাজকর্ম লক্ষ করছেন তা বেশ বুঝতে পারছি। জল নেওয়া হয়ে
গেল। ব্যাগদুটো এক বিশেষ ধরনের আঠা ‘ইন্সট্যাফিক্স’ দিয়ে সিল করলাম। এই আঠা সঙ্গে সঙ্গে জুড়ে দেয়। জোড়ায়
কোনও ফাঁক থাকে না। সুশীলবাবুকে
প্রশ্ন করলাম, “আগের চারজনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল তো?”
সুশীলবাবু কিছুক্ষণ ভেবে
নিয়ে জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, পাওয়া গিয়েছিল। প্রায় আড়াই-তিনদিন পরে।”
আড়াই-তিনদিন! একটু অবাক
হলাম। সময়টা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু কেন? জলের তলার অপদেবতা কি লাশ
আগলে বসে থাকে? হাসি পেল আমার। তবে সেটা বাইরে প্রকাশ না করে আবার প্রশ্ন করলাম,
“লাশ পরীক্ষা করে অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি?”
“না। শুধু কয়েকটা ঘায়ের
মতো দেখা গিয়েছিল। নৃপেনের বাবার লাশ তো পুলিশ মর্গে নিয়ে কাটাছেঁড়াও করেছিল,
কিন্তু রিপোর্টে কিছু পাওয়া যায়নি বলেই শুনেছি।”
আমি মনে মনে একটা হিসেব
কষছিলাম। দেড়শো বছরের পুরনো পুকুর। জলজ আগাছায়
ভর্তি। হাঁস এই পুকুরে নামে না। লাশ ভেসে ওঠে অনেক দেরিতে। তাহলে কি...?
“আচ্ছা সুশীলবাবু, এ-পুকুরে মাছ-টাছ নেই?” সুশীলবাবুকে প্রশ্নটা করে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম
তাঁর দিকে। আমার হিসেব যদি এক কণাও
সত্যি হয়, তাহলে উত্তরটা বোধহয় আমি জানি।
সুশীলবাবু বললেন, “আছে, খুব সামান্যই। তবে বেশিরভাগ কই, মাগুর, শোল এইসব মাছ।”
বুঝলাম, উনি ঠিকই বলেছেন। এইসব মাছের দুটো শ্বাস অঙ্গ আছে। বেঁচে থাকার জন্য বাতাস
থেকেও এরা অক্সিজেন নেয়। শুধু জলের ওপরে নির্ভর করে এইসব মাছ বাঁচতে পারে না।
আমি ঘড়ি দেখলাম। ডিপার্টমেন্টাল
টিমের আসার সময় হয়ে গেছে। আমার বুক পকেটে রাখা খুদে ওয়্যারলেস ট্রান্সমিটারের বীপার বেজে
উঠল। ওটা বের করে নিয়ে কথা বললাম। ওরা আর বিশ কিলোমিটার দূরে রয়েছে। ওরা এসে পড়লেই
এখানে তুলকালাম শুরু হবে। জলে জাল ফেলবে। চিরদীপ দাশের লাশ উদ্ধার করবে। তখন কি
একই সঙ্গে পাওয়া যাবে কোনও আশ্চর্য
জলচর প্রাণী? মনে হয় না। ওরা হয়তো জলে ডুবুরি নামাবে। তারপর
রকমারি যন্ত্রপাতি দিয়ে মাপজোকের পরীক্ষা শুরু করবে।
কিন্তু ওরা এসে পুকুর
তোলপাড় করার আগে একটা ঝুঁকি কি আমি নিতে পারি না? সেটাই হবে আমার চরম পরীক্ষা। আর
তার ফলাফল হবে চরম প্রমাণ। কেমন একটা জেদ চেপে বসল মাথায়। পলিথিনব্যাগদুটো নিয়ে জীপের দিকে রওনা হলাম। সুশীলবাবুকে বললাম, “এক মিনিট অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।”
জলের নমুনা রেখে আমি যখন
ফিরে এলাম, সুশীলবাবু আমায় দেখে অবাক হয়ে
গেলেন। বললেন, “কী
ব্যাপার, রত্নেশ্বরবাবু?”
অবাক হওয়ারই কথা। কারণ, এখন আমার পরনে সাঁতারের পোশাক। চোখে ডুবুরি-চশমা। কোমরে ইস্পাতের আংটার
সঙ্গে লাগানো নাইলন দড়ি। আর তার পাশেই ফিতেয় বাঁধা খাটো ছুরি।
নাইলন দড়ির খোলা দিকটা
সুশীলবাবুর হাতে দিয়ে বললাম, “শক্ত করে ধরে রাখুন। আমি পুকুরে নামছি। যদি কোনও বিপদ হয় চিৎকার করে উঠব। আর সঙ্গে সঙ্গে আপনি দড়ি টেনে আমাকে ঘাটে তুলবেন।
কী, পারবেন তো?”
সুশীলবাবুর বয়স্ক মুখে
একটা প্রতিজ্ঞার ছাপ ফুটে উঠল। বললেন, “পারব মানে, আমায় পারতেই হবে!”
আমরা দু’জন ঘাটের কাছে নেমে গেলাম। সুশীলবাবু দড়িটা হাতে কয়েক পাক পেঁচিয়ে একটা
ইটের চাঙড়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন। আর আমি, “কোনও ভয় নেই,” বলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম মরণ-পুকুরের
সবুজ জলে।
অলিম্পিকে সোনা পাইনি বটে, কিন্তু সাঁতারে আমি ছেলেমানুষ নই। জলে পড়ে সাঁতার কাটতে গিয়ে আমি চমকে
গেলাম। কিছুতেই শরীরটাকে আমি ভাসিয়ে রাখতে পারছি না। শুধু হাত-পা
ছোঁড়াছুঁড়ি সার। আমাকে ঘিরে মরণ-পুকুরের জল ছিটকে উঠছে চারদিকে। ভালো করে
ঠাহর করে দেখলাম। না, আমার পা ধরে কেউ টানছে না। তবুও আমি তলিয়ে যাচ্ছি।
সুশীলবাবু চিৎকার করে
উঠলেন। দূরে টার্বো-প্রপ জীপের শব্দ
শোনা গেল। দলবল এসে গেছে। কিন্তু আমি চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে
কোনও শব্দ বার করতে পারছি না। শুধু প্রাণপণে বাতাস টানতে চাইছি। সুশীলবাবু আবার
চিৎকার করে উঠলেন। টের পেলাম নাইলন দড়িটা উনি প্রাণপণে টানছেন। আমার চোখের সামনে
অসংখ্য জলের কুচি রোদ পড়ে চিকচিক করে উঠছে। ভালো করে কিছু দেখতে পারছি না। বুকের মধ্যে যেন হাপর চালাচ্ছে।
জ্ঞান ফিরতেই দেখি
অনেকগুলো মুখ আমার মুখের ওপরে ঝুঁকে রয়েছে। সুশীলবাবু ছাড়া অন্য মুখগুলোকে চিনতে
পারলাম। ওরা আমার ডিপার্টমেন্টের লোক। আমি উঠে বসলাম। সুশীলবাবু বললেন, “কোনও কষ্ট
হচ্ছে না তো?”
আমি কষ্ট করে হেসে তাঁকে
বললাম, “না, ঠিক আছি।”
তারপর আমাদের দলের ফার্স্ট
অফিসার শর্মাকে ডেকে নির্দেশ দিলাম, “রুটিন ইনভেস্টিগেশান আর অ্যানালিসিসগুলো করে
ফেলুন। তবে মনে হয় ব্যাপারটা আমি ধরতে পেরেছি। আপনি ইনসট্রুমেন্ট বক্স থেকে ডিজিট্যাল ডেনসিমিটারটা শুধু আমাকে দিন।”
শর্মা সকলকে কাজে লেগে
পড়তে বলল। তারপর চটপট উঠে গেল যন্ত্রটা জীপ থেকে নিয়ে আসতে। আমি সুশীলবাবুকে ধন্যবাদ জানালাম। উনি দড়ি টেনে ঘাটে না
তুললে আমার অবস্থাও হত চিরদীপ দাসের মতো।
ওঁকে সঙ্গে নিয়ে বড়ো রাস্তার দিকে এগোলাম। যেতে যেতে
বললাম, “সুশীলবাবু, দেড়শো বছরের পুরনো এই পুকুরের
তলায় কোনও প্রাণীও নেই, কোনও
অপদেবতাও নেই। আর অভিশাপের ব্যাপারটা কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়।”
উনি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, “তাহলে?”
শর্মা মিনিয়েচার
ডেনসিমিটারটা আমার হাতে দিয়ে গেল। আমি ওকে বললাম, “পনের মিনিট পর পর আমাকে
প্রোগ্রেস রিপোর্ট দেবেন, হেডকোয়ার্টারে
ট্রান্সমিট করব। আমি গাড়িতেই আছি।”
পুকুর নিয়ে আমার আর কৌতূহল
নেই। কারণ, উত্তরটা আমার নিশ্চিতভাবে জানা
হয়ে গেছে। ডেনসিমিটারের পরীক্ষাটা শুধু অকাট্য প্রমাণ পাওয়ার জন্য।
জীপের কাছে
গিয়ে একটা পলিথিনব্যাগ খুলে খানিকটা জল ডিজিট্যাল ডেনসিমিটারের ভলিয়ুম চেম্বারে
ঢেলে দিলাম। তারপরে সুইচ অন করতেই ডিসপ্লে প্যানেলে একটা সংখ্যা ফুটে উঠল - ০.৮০।
অকাট্য প্রমাণ। আমি হেসে
উঠলাম। সুশীলবাবু ভুরু কুঁচকে আমাকে দেখতে লাগলেন। আমি মিটারের সুইচ অফ করে তাঁকে
বললাম, “সুশীলবাবু, এই পুকুরের জলের ঘনত্ব স্বাভাবিক জলের ঘনত্বের চেয়ে অনেক কম।
তাই...”
আমাকে বাধা দিয়ে সুশীল-মাঝি বললেন, “ঘনত্ব মানে?”
আমি এক সেকেন্ড ভেবে
বললাম, “মানে বলতে পারেন, স্বাভাবিক জলের চেয়ে এই পুকুরের জল পাতলা। যেমন ধরুন,
অনেকটা কেরোসিন তেলের মতো। তাই এই জলে সাঁতার কেটে ভেসে থাকা অসম্ভব। এমনকি
হাঁসেরাও পারে না। সেইজন্যই ওরা এই পুকুরের জলে নামে না। আর মানুষের মৃতদেহও ভেসে
ওঠে অনেক দেরিতে, অনেক বেশি ফুলে-ফেঁপে ওঠার পর। চিরদীপ দাশ একই কারণে এই পুকুরে তলিয়ে গেছে। যেমন আমিও তলিয়ে যাচ্ছিলাম।”
কতকগুলো রহস্যময় দুর্ঘটনার
কী সহজ এবং নিষ্ঠুর উত্তর। ঘনত্বের শতকরা কুড়ি ভাগ তফাত কী অদ্ভুতভাবেই না
বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
সুশীল-মাঝি জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু জলটা পাতলা হল কেমন করে, রত্নেশ্বরবাবু?”
আমি চুপ করে রইলাম। সেটা
তো আমারও প্রশ্ন। জিওলমাছ ছাড়া অন্য মাছ এ-পুকুরে
বিশেষ নেই। হয়তো দেড়শো বছরে এই জলের সঙ্গে মিশে
গেছে এমন কোনও জৈব রাসায়নিক তরল যার ঘনত্ব জলের চেয়েও অনেক কম। বলা যায় না, এই
পুকুরের জলে হয়তো রয়েছে এমন সব জলজ উদ্ভিদ, যা পচে গলে তৈরি হয়েছে কোনও
হাইড্রোকার্বন যৌগ। তারপর তা থেকে এসেছে কোনও জৈব রাসায়নিক। ক্রমাগত জলে মিশে গিয়ে সেই রাসায়নিকই হয়তো কমিয়ে দিয়েছে এই পুকুরের জলের
ঘনত্ব। আর একই সঙ্গে জিওলমাছ ছাড়া অনান্য মাছ একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
এতসব সম্ভাবনার কথা না বলে
সুশীলবাবুকে ছোট্ট করে জবাব দিলাম, “পুকুরের জলের নমুনা ল্যাবরেটারিতে পরীক্ষা করলেই
সেই কারণটা হয়তো জানা যাবে।”
এমন সময় পুকুরের দিক থেকে
একটা হইচই কানে এল। বোধহয় চিরদীপ দাসের
মৃতদেহটা ওরা খুঁজে পেয়েছে।
_____
অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
Ageo Parechi. Khub bhalo.
ReplyDeleteবেশ ভালো লাগলো।
ReplyDeleteKhub bhalo ekta golpo.
ReplyDeleteগল্পটা বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহ তৈরি করবার পথের একটি অন্যতম দিশারী। কিন্তু কল্পবিজ্ঞানের গল্প এটিকে কে বলা যাবে কি?
ReplyDelete