বইঃ সব লজিকের বাইরে
লেখকঃ অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
আলোচনাঃ দীপঙ্কর ভদ্র
১। গ্যারি ক্যাসেলের চিঠিঃ গাছেদের ভাষা বোঝার জন্য ‘ট্রিল্যাঙ্গ’ নামে একটি যন্ত্র
আবিষ্কার করেন গ্যারি ক্যাসেল। সেই যন্ত্রটি নিয়ে রিসার্চ করার সময় একটি ঘটনা
সবকিছু পাল্টে দেয়। তার ধারণা গাছেদের প্রতি যত্নবান না হওয়ার জন্য খুব শীঘ্রই
মনুষ্যজাতির ওপর বড়সড় বিপদ নেমে আসতে পারে।
২। ডঃ লিওনার্ড ও অ্যালোপেশিয়াঃ এটা আমরা সবাই জানি, আমাদের দেশেই
আইনের নজর এড়িয়ে কন্যা ভ্রূণ হত্যার মতো পৈশাচিক কাজ হয়। এই গল্পে তেমনই উঠে
এসেছে এমন সব ভ্রূণ হত্যার প্রসঙ্গ যাদের কোনও না কোনও বংশগত রোগ আছে। তবে তাদের
মেরে ফেলা মানেও তো সেইসব শিশুদের প্রাণগুলোকে অকালে স্তদ্ধ করা। তাই না?
৩। স্বামী ভবানন্দ রহস্যঃ পরেশ রাওয়ালের ‘ওহ মাই গড’ আর আমির খানের ‘পিকে’,
এই দুটি মুভিতেই আমরা দেখতে পাই মানুষের অন্ধবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে কীভাবে কিছু
ভন্ড লোকেরা ব্যবসা করে যাচ্ছে। এই ছোট্ট গল্পটিতে লেখক এই ব্যাপারটাকেই আরও
বৃহৎভাবে দেখিয়েছেন। স্বামী
ভবানন্দের রহস্য ভেদ করতে বিভিন্ন সংবেদনশীল ক্ষেত্রগুলোকে লেখক যেভাবে লজিক্যালি
ব্যাখ্যা করেছেন, তা এককথায় অসাধারণ।
৪। চেনা মুখঃ কাহিনিটা অর্ণবের। তার অস্বাভাবিক ক্ষমতার কথা এখানে নাই বা
বললাম। তার জীবনে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক
ঘটনার কথাও এখানে উল্লেখ করছি না। শুধু বলছি, অতীতের কিছু ঘটনা এতটাই মর্মান্তিক হয় যে, সে ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি অনেক বছর পর
মুখোমুখি চলে এলে বুকের ভিতর জমাট বেঁধে থাকা কষ্ট যন্ত্রণার রূপ নেয়। সেই
পরিস্থিতিতে কি দোষীকে শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায়?
৫। দেওয়ালের রং ছিল সাদাঃ গল্পের প্রথম ভাগটা পড়লে মনে হবে টাইম মেশিনে করে ২৫ বছর পরের কলকাতাকে দেখতে এসেছি। দ্বিতীয় ভাগটা
আবার জানান দেয় সন্তানের প্রতি মা-বাবার অন্তহীন ভালোবাসার কথা, যা সর্বদাই অপরিবর্তিত। গল্পটির শেষে এসে ২৫ বছর
পরের উন্নত বিজ্ঞান কীভাবে মা-বাবার সেই ভালোবাসার মর্যাদা দেয়, সেটাই দেখান
লেখক।
৬। রাস্তা যখন শেষঃ পুলকের মতো ক্ষমতাবান লোকেরা যতই অন্যায় করুক না
কেন, ক্ষমতাবলে তারা আইন আদালতের ঊর্ধ্বে। কিন্তু তাদের সাজা দিতে অরিজিৎ-এর
মতো লোকেরা এগিয়ে আসছে, আর ভবিষ্যতেও আসবে।
৭। স্বাধীনতাঃ ১৫ই আগস্ট। আমাদের কাছে একটা ছুটির দিন। এর বেশি কিছু নয়।
যদি এই দিনটির আসল মাহাত্ম্য আমরা বুঝতাম, তাহলে অন্তত চোখের সামনে ঘটে চলা নোংরামি দেখেও চুপ করে থাকতে পারতাম
না। জাতীয় পতাকা হাতে নেওয়া মানে এদেশের দায়িত্ব হাতে নেওয়া। এটা বুঝতে গেলে
নামের পাশে লেখা বড়ো বড়ো ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় অনুভূতির। যেটা
এই গল্পে দশ বছরের পুনিতের মধ্যে ছিল।
৮। মিঃ পাই ও সেই ওষুধঃ মিঃ পাই-এর ওষুধের দৌলতে ভীতু অবিনাশবাবু হঠাৎই
হয়ে ওঠেন প্রচন্ড সাহসী। তারপরই শুরু হয় একের পর এক মজার কাণ্ড।
৯। অচেনা হাতঃ “এরকম যদি হত যে, আমাদের বাঁ-হাতটা যা করতে চায়, ডানহাতটা
তাতে বাধা দেয়, বাঁ পাটা যা করতে চায়, ডান পাটা তার ঠিক উল্টো করতে চায়, তা হলে
কী সাংঘাতিক ব্যাপার হত, তাই না?” এরকম একটা প্রশ্ন দিয়ে যদি গল্পের শুরু হয় আর
সাথে গল্পটি যদি হয় অনিলিখার, তবে গল্পটি যে দারুণ থ্রিলিং হতে চলেছে তা বলার
অপেক্ষা রাখে না।
১০। কে ছিল সেঃ ভৌতিক আবহের মোড়কে সন্তানের প্রতি ভালোবাসার এক অপূর্ব গল্প বলেছেন লেখক।
১১। মিঃ পাই-এর এক্সপেরিমেন্টঃ মিঃ পাইকে নিয়ে আরও একটি মজার গল্প। এক্সপেরিমেন্টগুলো
সত্যিই দারুণ। তবে ভবিষ্যতে লেখকের কাছ থেকে মিঃ পাইকে নিয়ে মজার সাথে সাথে ‘পরজীবী’-র মতো
থ্রিলিং গল্প পাওয়ারও আশা রইল।
১২। অনিলিখা ও ভূতঃ নামটা শুনেই মনে হচ্ছে নিশ্চয় যে গল্পটা ভূতের। কিন্তু
ভূত কি আর অত সহজে ধরা দেয়? বুঝলে না, তাই তো? চট করে গল্পটা পড়ে ফেল, সব বুঝে
যাবে।
১৩। মূর্তিঃ
একজন প্রকৃত শিল্পীর সমস্ত অনুভূতি তার সৃষ্ট শিল্পের মধ্যে ফুটে ওঠে। সবাই হয়তো
সেই অনুভূতিকে বুঝতে পারে না। কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে সেই শিল্পীর কাজে কোনও
খুঁত আছে।
১৪। ফ্লাইট নাম্বার ৩২: এ কাহিনি এমন একজন মানুষের যে এক বিরল জেনেটিক রোগের
শিকার। ছয়মাসের মধ্যেই মস্তিষ্কের সক্ষমতা হারাতে চলেছে সে। এইরকম অবস্থায় আরও
তাকে গ্রাস করে চলেছে তার একাকীত্ব। তাই এসব থেকে মুক্তি পেতে এক সাংঘাতিক
সিদ্ধান্ত নেয় সে। বাকিটা জানতে হলে এই ফ্লাইটে উঠে বসতেই হবে সবাইকে।
১৫। সময় যখন চারটে চল্লিশঃ ওয়েলসের পশ্চিম সীমান্তে টেলবী শহর। এই শহরের একটি ঐতিহাসিক ক্যাসেলকে দেখতে আসে
অভীক আর স্পর্শ। ক্যাসেলে ঘুরতে ঘুরতে একটি ঘরে এসে অভীকের মনে হয়, এখানে যেন ও
আগে অনেকবার এসেছে। এই ঘরের সবকিছুই যেন ওর খুব চেনা। নাহ! আর কিছু বলতে গেলে এই
গল্পের মজাটা নষ্ট হবে। তাই এখানেই থামলাম।
১৬। স্বপ্নের মধ্যেঃ এই গল্পটি পড়ার পর একটা খটকা কিন্তু থেকেই যায় যে,
কোনও সময় যন্ত্ররা যদি আমাদের থেকে বেশি বুদ্ধিমান হয়ে গিয়ে আমাদেরকে কন্ট্রোল
করতে সক্ষম হয়, তবে সেই সময় আমরা বাস্তবটা স্বপ্ন আর ওদের দেখানো স্বপ্নকে কি
বাস্তব বলে মেনে নেব?
১৭। নেপোলিয়নের সূত্রঃ বাবা-মা তাদের
সন্তানদের ওপর নিজেদের সমস্ত কিছু উজাড় করে দেন। সন্তানদের প্রতিটি সাফল্যের সাথে জড়িয়ে থাকে তাদের সাফল্য, তাদের জয়। তবে যদি দেখা
যায় সন্তানরা বড়ো মানুষ হতে গিয়ে বড়ো হল ঠিকই কিন্তু মানুষ হতে পারল না,
তাহলে কিন্তু সেটা তাদের মা-বাবার সবচেয়ে বড়ো পরাজয়।
১৮। সব লজিকের বাইরেঃ পরপর সাতমাস ধরে উওর কলকাতার হেদুয়ার কাছাকাছি সাত-সাতটা
খুন হবার পরও অপরাধীকে ধরা যাচ্ছে না। অনেক তদন্তের পর খুনির খুন করার প্যাটার্ন
বুঝতে পারে পুলিশ। এখন প্রশ্ন, এই লজিকের দ্বারা আদৌ কি খুনিকে ধরা যাবে? নাকি লজিকের গন্ডির বাইরেই শেষমেশ থেকে যাবে
অপরাধী?
এই বইটির কভারেই লেখা ১৮টি গল্পের মধ্যে ১০টি গল্প
কল্পবিজ্ঞানের ও ৮টি গল্প ভিন্ন স্বাদের। তবে সমস্ত পাঠকই বইটি পড়ে একটা বিষয়ে
একমত হবেন যে, প্রতিটি গল্পের মধ্যে মানবিকতার অনুভূতিগুলোকে যেভাবে যুক্ত করেছেন
লেখক, তা এককথায় অনবদ্য।
_____
No comments:
Post a Comment