ওল গাছে ফুল এবং একটি হুজুগ
সৌম্যকান্তি জানা
সকাল সকাল পয়লা মে-র খবরের কাগজ খুলতেই চক্ষু ছানাবড়া। কাটোয়ার খাজুরডিহি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত মন্ডলহাট ঘোষপাড়ায় জনৈক নাড়ু পালের বাড়ির পাশে ঝোপের মধ্যে ওল গাছে গজিয়েছে ফুল, আর তা নিয়ে এলাকায় পড়ে গেছে হৈচৈ। শুরু হয়ে গেছে পুজো-পাঠ। জমে গেছে মেলা। মিলছে অঢেল দর্শনী।
চোখ কচলে খবরটা বার দুয়েক পড়লাম। ওল গাছে প্রায় আট ইঞ্চি লম্বা বেগুনি রঙের একটা ফুল গজিয়েছে। ফুলের আকার অনেকটা শিবলিঙ্গের মতো। সুতরাং এলাকার মঙ্গল অনিবার্য। এলাকার এক পুরোহিতের পরামর্শে নাকি শুরু হয়েছে পুজো। আবার নিন্দুকেরও যে অভাব নেই তাও মালুম হল ওই সংবাদ পড়েই। যেহেতু নীল হল বিষের রঙ, তাই গোটা তল্লাটে নাকি এবার বিষ ছড়াবে। তবে নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে ‘অলৌকিক’ এই ঘটনা নিয়ে জমজমিয়ে চলছে পুজো ও মেলা।
খবরটা পড়ে আমার রাগ কিংবা হতাশ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হলাম না। যে দেশে বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চে বলা হয় গণেশের মাথায় হাতির মাথা জুড়ে দেওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে ভারতে প্লাস্টিক সার্জারির উদ্ভব হয়েছিল, ভারতেই পীথাগোরাসের তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে, বৈদিক যুগে নাকি ভারতেই বিমান আবিষ্কৃত হয় যাতে চেপে ভারতীয়রা গ্রহান্তরে পাড়ি দিত এবং মঙ্গল গ্রহে গিয়ে যুদ্ধ করত, সে দেশে ওলের ফুলকে শিবলিঙ্গ-জ্ঞানে পুজো করা এমন কী আর আজব ঘটনা!
আসল ব্যাপার হল ওল গাছে ফুল আসার ঘটনা আদৌ আজব বা অলৌকিক ঘটনা নয়। খবরে যা ফুল বলা হয়েছে উদ্ভিদবিজ্ঞানে তা অবশ্য ফুল নয়, পুষ্পমঞ্জরী (Inflorescence)। ওল পরিবারে (Family)-র বৈশিষ্ট্যই হল স্প্যাডিক্স (Spadix) জাতীয় পুষ্পমঞ্জরী। এক্ষেত্রে মঞ্জরীদন্ড হয় বেশ মোটা ও রসালো এবং এর উপর খুব ঘন সন্নিবদ্ধভাবে ফোটে বৃন্তহীন অসংখ্য ফুল। নিচের দিকে ফোটে স্ত্রী ফুল, মাঝে থাকে পুরুষ ফুল। আর উপরে থাকে অসংখ্য বন্ধ্যা ফুল। গোটা পুষ্পমঞ্জরী ঢাকা থাকে স্পেদ (Spathe) নামক একপ্রকার আবরণ দিয়ে। কুঁড়ি অবস্থায় পুরো পুষ্পমঞ্জরী স্পেদ দিয়ে ঢাকা থাকে। আর ফোটার সময় স্পেদ খুলে যায়। তখন সমগ্র পুষ্পমঞ্জরী বাইরে বেরিয়ে আসে ও স্পষ্ট দেখা যায়। খোলা স্পেদ দেখতে লাগে ঠিক ঘন্টার মতো। স্পেদ সাধারণত রঙ্গিণ হয়। ওলের ক্ষেত্রে বেগুনি, খয়েরি বা হালকা সবুজ রঙের হয়। আবার হলুদ রঙের হয় কচুর ক্ষেত্রে। স্পেদের ভেতর দিকে থাকে বিশেষ খাঁজ বা গুটি যা পতঙ্গ ফাঁদ হিসেবে কাজ করে।
ওলের ক্ষেত্রে স্প্যাডিক্স পুষ্পমঞ্জরী বেশ বড়ো হয়। স্পেদ খুলে যাওয়ার পর স্প্যাডিক্সকে দেখতে লাগে ঠিক যেন শিবলিঙ্গ। বোধহয় এই কারণেই ওলের গণ (Genus) হল Amorphophallus, গ্রিক শব্দে যার অর্থ আকারবিহীন পুরুষাঙ্গ। আমাদের পরিচিত যে ওল আমরা খাই তার বিজ্ঞানসম্মত নাম Amorphophallus paeoniifolius (A. campanulatus). আবার ওলেরই এক জাতভাইয়ের পুষ্পমঞ্জরী বিশ্বের দীর্ঘতম শাখাবিহীন পুষ্পমঞ্জরী। তার নাম Amorphophallus titanium. লম্বা হয় ৩ মিটার বা তারও বেশি। ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম সুমাত্রা অঞ্চলে বর্ষা অরণ্যের মধ্যে স্বাভাবিক উদ্ভিদ হিসেবে এই ওল দেখা যায়।
ওলের যে অংশ আমরা খাই তা আসলে মাটির নিচে থাকে কান্ড। খাদ্য সঞ্চয় করে তা পুষ্ট ও গোলগাল হয়। উদ্ভিদবিজ্ঞানের ভাষায় এইরকম কান্ডকে বলে গুঁড়িকন্দ (Corm)। মাটির উপরেও থাকে কান্ডের কিছুটা বায়বীয় অংশ যা সাধারণ কান্ডের মতোই। তার উপর জন্মায় পাতা। সব মিলিয়ে মাটির উপরের অংশ দেখতে অনেকটা ছাতার মতো। ওল বর্ষজীবী উদ্ভিদ। গাছ জন্মাবার ৮/৯ মাস পরেই মাটির উপরের কান্ড ও পাতা হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায়। এর পর খাওয়ার জন্য মাটি খুঁড়ে ওল অর্থাৎ গুঁড়িকন্দ বের করা হয়। যদি না মাটি খুঁড়ে ওল তোলা হয় তবে পরের বছর ঐ কন্দ থেকে আবার বায়বীয় কান্ড ও পাতা গজায়। তবে প্রজাতিভেদে ওল গাছে ফুল আসে এক থেকে তিন বছর অন্তর। চাষ করা ওল যেহেতু লাগানোর ৮/৯ মাস পর খোঁড়া হয়ে যায় তাই ফুল জন্মাবার সুযোগ থাকে না। তাই আমরা ওলের ফুলের সাথে পরিচিত নই। কিন্তু বন্য ওল থেকে স্বাভাবিক নিয়মেই ফুল জন্মায়। তবে ফুল বলতে যা বুঝি তা হল ওই পুষ্পমঞ্জরী।
ওল হল সহবাসী উদ্ভিদ, অর্থাৎ ওল গাছের পুষ্পমঞ্জরীতে আলাদা আলাদাভাবে স্ত্রী ও পুরুষ ফুল ফোটে। তবে এই ফুল খুব ছোটো আর বৃতি ও দলমন্ডলবিহীন। স্ত্রী ফুল বলতে আছে শুধু গভর্পত্র, আর পুরুষ ফুল বলতে শুধু পুংকেশর। পুষ্পমঞ্জরীর একেবারে নিচে কিছুটা জায়গা জুড়ে থাকে স্ত্রী ফুল। তার উপরে কিছুটা জায়গা জুড়ে পুরুষ ফুল। তারপর আগা পর্যন্ত অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকে বন্ধ্যা ফুল। এই ফুলে থাকে কেবল বন্ধ্যা পুংকেশর। এই অংশকে বলে অ্যাপেন্ডিক্স।
ওল গাছে একই পুষ্পমঞ্জরীতে স্ত্রী ও পুরুষ ফুল জন্মালেও সচরাচর নিষেক সফল হয় না। কারণ মূলতঃ স্ত্রী ফুলের অগ্রিম প্রষ্ফুটন। পুরুষ ফুল যখন ফোটে তখন স্ত্রী ফুলের আর নিষিক্ত হওয়ার ক্ষমতা থাকে না। আর তাছাড়া স্পেদ প্রষ্ফুটিত হয় দেরিতে। ফলে কীটপতঙ্গরা সফল পরাগমিলন ঘটানোর সুযোগ পায় না। এই সব কারনেই চাষ করা ওলে ফুল ফুটলেও বীজ হয় না। তবে বন্য ওলে ফুল ও বীজ দুটোই হতে দেখা যায়।
ওল গাছে পরাগযোগের বাহক হল পোকামাকড়। অধিকাংশ ওলের পুষ্পমঞ্জরীর গন্ধ পচা মাংসের মত। স্পেদ খুলে গেলে পচা মাংসের গন্ধে মাছি ও অন্যান্য পোকামাকড় উড়ে আসে। কিন্তু তারা আটকা পড়ে স্পেদের ভেতরে থাকা বিশেষ একধরনের ফাঁদে। স্পেদ খোলার আগেই স্ত্রী ফুলের প্রষ্ফুটন হয় ও তার সক্ষমতা থাকে। কিন্তু পোকারা ধরা পড়ার পর পুরুষ ফুল ফোটে। পুরুষ ফুলের পরাগধানী থেকে প্রচুর পরাগরেণু আটকে থাকা পোকাদের গায়ের উপর ঝরে পড়ে। পরাগরেণু মাখা যেসব পোকা স্পেদের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে তারা যখন অন্য সদ্য ফোটা পুষ্পমঞ্জরীর স্পেদের মধ্যে প্রবেশ করে তখন আগের ফুলের পরাগরেণু দিয়ে ওই পুষ্পমঞ্জরীর স্ত্রী ফুলকে নিষিক্ত করে। এভাবেই ওল সহবাসী উদ্ভিদ হওয়া সত্ত্বেও স্বনিষেক প্রতিহত করে ইতর নিষেক ঘটায়।
ওল গাছে ফুল আসার ঘটনা আরও অসংখ্য গাছে ফুল আসার মতোই খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এতে কোনও অস্বাভাবিকতা বা অলৌকিকতা নেই। সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে স্বাভাবিক ঘটনাকে অলৌকিকতার তকমা লাগায় কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ। সেই সুযোগসন্ধানীদের দলে খাজুরডিহির কিছু মানুষ যেমন রয়েছে, রয়েছে দেশের তাবড় তাবড় নেতা-মন্ত্রীও। বিজ্ঞানমনস্কতার বিকাশ নাহলে সামাজিক এই আঁধার কাটবে না। এজন্য চাই যথার্থ শিক্ষা। যথার্থ শিক্ষাই পারে এইসব অলৌকিকতার কারবারীদের কোণঠাসা করতে।
_____________
ছবিঃ আন্তর্জাল
Thanks for the information
ReplyDeleteamader barite futeche
ReplyDeleteআমার বাগানে এবছর সাত(7)খানা মাদ্রাজী ওল-ফুল ফুটেছিল। ওলগুলো ঠিক থাকবে না নষ্ট হয়ে যাবে?যদি ঠিক থাকে তা মাটি থেকে কোন মাসে তুলতে হবে?যদি কেউ জনান?
ReplyDelete