দেশবিদেশের গল্প:: গোলাপকুমার - দোয়েল বন্দ্যোপাধ্যায়

গোলাপকুমার

দোয়েল বন্দ্যোপাধ্যায়


(জাপানের প্রচলিত রূপকথা মোমোতারো অবলম্বনে রচিতজাপানি ভাষায় মোমো শব্দের অর্থ গোলাপি, তাই এই নামকরণ করা হলমূল গল্প অপরিবর্তিত )

অনেক-অনেক বছর আগের কথা। এক জঙ্গলের ধারে ছোট্ট বাড়িতে থাকত এক বুড়ো আর বুড়ি। বুড়ো সকাল বেলা জঙ্গলে কাঠ কাটতে যেত। বুড়ি ব্যস্ত থাকত ঘর সংসারের কাজ নিয়ে। মাঝে-মাঝে ময়লা জামাকাপড় কাচতে বুড়ি যেত নদীর ধারে। বুড়ি প্রতিদিন বুড়োকে বলতো, “শোনো সন্ধে নামার আগেই জঙ্গল থেকে ফিরে এসো কিন্তু।” বুড়োও মিষ্টি হেসে বুড়িকে বলতো, “তুমিও নদীতে সাবধানে যেও, পা পিছলে পড়ে যেওনা আবার!” একদিন বুড়ি নদীতে গিয়েছে কাপড় কাচতে। থপথপাথপ আওয়াজ করে কেচেই চলেছেনদীর ধারেই ছিল একটা মস্ত গোলাপজামের গাছ। সেখান থেকে টুপ করে একটা ফল খসে পড়ল বুড়ির কোলে বুড়ির বেশ খিদে পেয়েছিল। সে ঝটপট মুখে পুরে দিল ফলটা। “আহ কী মিষ্টি!” বুড়ির মনে হল গাছ ভর্তি ফল, তাও আবার এত মিষ্টি যদি বুড়োর জন্যও একটা নিয়ে নেওয়া যেত। বুড়ি সুর করে বলল, “তেঁতো ফল-তেঁতো ফল গাছে যেন ঝোলে/ মিঠে ফল-মিঠে ফল এসো মোর কোলে!” বলা মাত্র আরেকটা মস্ত গোলাপজাম বুড়ির কোলে এসে পড়ল। বুড়ি খুশি হয়ে সেই ফল নিয়ে বাড়ি চলে গেল। সন্ধেবেলা বুড়ো কাঠ কেটে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরল। বুড়ি বলল, “এই দেখো তোমার জন্য মিষ্টি ফল এনেছি!” বুড়ো সেটাকে কাটতে যেতেই ফলটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেল আর সেখান থেকে বেরিয়ে এল চাঁদপানা এক ছেলে। বুড়ো-বুড়ি তো অবাক। ছেলেটা বেরিয়ে এসেই দারুণ লাফালাফি শুরু করলবুড়ি গরম জলে তাকে স্নান করিয়ে নতুন পোশাক পরিয়ে দিল। ছেলেটার গায়ের রঙ একদম গোলাপি। তাই বুড়ো তার নাম দিল গোলাপকুমার। গোলাপকুমার এক থালা ভাত খায় আর একটু বেড়ে ওঠে। দু থালা ভাত খায় আরও একটু বেড়ে ওঠে। দেখতে-দেখতে গোলাপকুমার খুব শক্তিশালী হয়ে উঠল। বুড়ো-বুড়ি তাকে যা শেখায় সে ঝটপট শিখে নেয়। বুড়ো আর বুড়ি দুজনেই খুব ভালবেসে ফেলল গোলাপকুমারকে

সেই গ্রামের শেষে থাকত এক দুষ্টু দৈত্যসে প্রায়ই গ্রামের এসে লুটপাট করত লোকজনকে মারতসে ছিল ভয়ানক শক্তিশালী। তার ভয়েতে সবাই চুপ করে থাকত গোলাপকুমার সেটা জানতে পেরে বেজায় খেপে গেলসে বুড়ো-বুড়িকে বলল ওই দৈত্যকে মেরে তবেই তার শান্তি বুড়ো আর বুড়ি তো কেঁদেই আকুলতারা অনেক বোঝাল গোলাপকুমারকে বলল, গোলাপকুমার এখনও অনেক ছোট, সে দৈত্যর সঙ্গে পেরে উঠবে না। কিন্তু তার সেই এক জেদদৈত্য না মেরে সে বাড়ি ফিরবে না বুড়ো-বুড়ি হাল ছেড়ে দিল। গোলাপকুমার বুড়িকে অনুরোধ করল তার জন্য গোটাকতক চালের পিঠে তৈরি করে দিতে। সেই কথা মত বুড়ি একশ খানা চালের পিঠে বানিয়ে দিল। সেই চালের পিঠে ছিল অত্যন্ত সুস্বাদু যা খেলে গোলাপকুমার একশ মানুষের শক্তি পাবে। বুড়ো তাকে নতুন জামাকাপড়, মাথার টুপি আর তার নিজের কাঠ কাটার কুঠার দিলসেসব নিয়ে বুড়ো-বুড়িকে প্রণাম করে গোলাপকুমার চলল দৈত্য মারতে।


পথে তার সঙ্গে এক কুকুরের দেখা হলসে বলল, “গোলাপকুমার তুমি কোথায় যাচ্ছ?” গোলাপকুমার বলল, “আমি যাচ্ছি দৈত্য মারতে” “তোমার ঝুলিতে কী আছে?” “আমার ঝুলিতে আছে সুস্বাদু চালের পিঠে” “গোলাপকুমার তুমি যদি আমায় একটা পিঠে দাও আমি তোমার সঙ্গী হতে পারি।” গোলাপকুমার রাজি হয়ে গেল। সে কুকুরকে একটা পিঠে দিল আর কুকুরটা তার সঙ্গী হলখানিকদূর যাওয়ার পর দেখা হল এক বাঁদরের সঙ্গে সে বলল, “গোলাপকুমার তুমি কোথায় যাচ্ছ?” গোলাপকুমার বলল, “আমি যাচ্ছি দৈত্য মারতে” “তোমার ঝুলিতে কী আছে?” “আমার ঝুলিতে আছে সুস্বাদু চালের পিঠে” “গোলাপকুমার তুমি যদি আমায় একটা পিঠে দাও আমি তোমার সঙ্গী হতে পারি।” গোলাপকুমার রাজি হয়ে গেল। সে বাঁদরকে একটা পিঠে দিল আর বাঁদরটা তার সঙ্গী হলখানিকদূর যাওয়ার পর দেখা হল এক পায়রার সঙ্গে। সে বলল, “গোলাপকুমার তুমি কোথায় যাচ্ছ?” গোলাপকুমার বলল, “আমি যাচ্ছি দৈত্য মারতে” “তোমার ঝুলিতে কী আছে?” “আমার ঝুলিতে আছে সুস্বাদু চালের পিঠে” “গোলাপকুমার তুমি যদি আমায় একটা পিঠে দাও আমি তোমার সঙ্গী হতে পারি।” গোলাপকুমার রাজি হয়ে গেল। সে কুকুরকে একটা পিঠে দিল আর কুকুরটা তার সঙ্গী হলএইভাবে গোলাপকুমার কুকুর, বাঁদর আর পায়রাকে নিয়ে এগিয়ে চলল। পর্বত, উপত্যকা, জঙ্গল পেরিয়ে তারা একটা নদীর সামনে উপস্থিত হলনদীর ওপারে এক দ্বীপ। আর সেই দ্বীপেই থাকে সেই দুষ্টু দৈত্য। নদীর তীরে নৌকো বাঁধা ছিল। গোলাপকুমার আর তার সঙ্গীরা তাতে চেপে বসল। শুধু পায়রা তাদের সঙ্গে-সঙ্গে উড়তে থাকল। নৌকো ছুটে চলল দুরন্ত গতিতে। খানিক দূর যাওয়ার পর পায়রা বলল “আমি সেই দৈত্যের দ্বীপ দেখতে পাচ্ছি।” গোলাপকুমার ও তার সঙ্গীরা সেই দ্বীপে পৌঁছে দেখল সেখানে একটা বিরাট দরজা। গোলাপকুমার হাঁক পাড়ল, “কেউ আছেন?” কেউ সাড়া দিল না। তখন সেই বাঁদরটা দেওয়াল টপকে ভিতরে ঢুকে দরজা খুলে দিল।গোলাপকুমার কুঠার উঁচিয়ে হুংকার দিল “কোথায় সে দৈত্য? আজ তাকে শেষ করে দেব আমি!” দৈত্য ঘুমোচ্ছিল। সে তো চিত্কার শুনে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর গোলাপকুমারের মত ছোট্ট ছেলেকে দেখে হেসেই কুটোপাটি। গোলাপকুমার লাফিয়ে এসে তার পায়ের কাছে মারল এক কোপ। দৈত্য উলটে পড়ে গেলআর সেই সুযোগে পায়রা তাকে ঠোক্কর মারল। বাঁদর আঁচড়ে দিল আর কুকুর কামড়ে দিল। দৈত্য পুরো কাবু হয়ে গেলসে কাঁদতে-কাঁদতে গোলাপকুমারের পায়ের কাছে এসে পড়ল“আমাকে তুমি ছেড়ে দাও গোলাপকুমার। আমি তোমার কাছে প্রাণভিক্ষা করছিআমি তোমায় কথা দিচ্ছি আর কোনওদিন কোনও খারাপ কাজ করব না। এতদিন তোমাদের গ্রাম থেকে যা লুট করেছি সব দিয়ে দেব” গোলাপকুমার খুশি হল। “ঠিক আছে তুমি যখন কথা দিচ্ছ আমি তোমায় ছেড়ে দিলাম” তারপর দৈত্যের ফেরত দেওয়া সব ধনসম্পত্তি একটা ঝোলায় নিয়ে ফিরে চলল। ঝোলাটা এত বড় ছিল যে গোলাপকুমারের সেটা কাঁধে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। অনেক কষ্টে সে বাড়ি পৌঁছল। বুড়ো আর বুড়ি তো ভীষণ খুশি। তারা বলল, “গোলাপকুমারের মত ছেলে হয় না।” গ্রামের প্রত্যেকটা লোক তাই বলল। গোলাপকুমার কিছু ধন সম্পত্তি বুড়ো বুড়িকে দিল আর বাকিটা গ্রামের লোকেদের মধ্যে বিলিয়ে দিল। গ্রামের সকলে ধন্য-ধন্য করল গোলাপকুমারকে। বুড়ো বুড়ি আর গোলাপকুমার সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে লাগল। সেদিন থেকে ওই গ্রামে সকলে চালের পিঠে খাওয়া শুরু করল এবং সেখানে একটা প্রবাদ চালু হয়ে গেল, “ছেলে হবে গোলাপকুমারের মত, নইলে নয়!”
__________
ছবি - দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী


লেখক পরিচিতিঃ দোয়েল বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘ দিন ধরেই লেখালেখির সাথে যুক্ত। ছোটোদের জন্যই লিখতে ভালোবাসেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও ওয়েবজিনে নিয়মিত তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়।

1 comment: