সি ওয়ার্ল্ড
প্রদীপ্ত ভক্ত
ছোটবেলায় দেশবিদেশের অ্যাডভেঞ্চার পড়তে পড়তে কিংবা নতুন দেশের ছবি গল্প শুনতে শুনতে সবারই মোটামুটি আমাদের ইচ্ছে করে কবে যাব ওই সব জায়গা গুলো। না ফ্রান্সিস, বিমল কুমারের মত অ্যাডভেঞ্চার আমার হয়নি। তবে নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে কিছু।আমি যখন এদেশে আসি,আমার প্রোজেক্ট লোকেশন ছিলো ক্যালিফর্নিয়া। ভারী চমৎকার জায়গা ক্যালিফর্নিয়া। কালিফোর্নিয়ার আমি যেখানে উঠেছিলাম সেই জায়গাটার নাম অরেঞ্জ কাউন্টি। ওখান থেকে সী-বিচ গুলো কাছাকাছি। এছাড়া ডিজনিল্যান্ড ইউনিভার্সাল ষ্টুডিও তো আছেই। এছাড়া আছে স্যান ডিয়াগো, প্যাসিফিক ওশান এর পাশের শহর। স্যান দিয়াগোতে সি ওয়ার্ল্ডটা দেখার ইচ্ছে ছিল বহুদিন ধরেই। সি ওয়ার্ল্ড হলো একটা এনিম্যাল থিম পার্ক। মানে বিভিন্ন মজাদার রাইডের এর পাশাপাশি , সামুদ্রিক প্রাণীদের নিয়ে তৈরি পার্ক। তাদের নিয়ে শো হয়. এমনি ঘুরে দেখা যায়। আমেরিকার বেশিরভাগ প্রদেশে গাড়ি হলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বস্তু। সৌভাগ্যক্রমে আমি যেখানে ছিলাম সেখানে গাড়ি ছাড়াও চলাচল সম্ভব। মানে বাস,ট্রেন আছে আর কি।
অবশ্য আমার সঙ্গী নেই কেউ যাবার।তাই একা একাই একদিন বেরিয়েই পড়লাম। ও হ্যাঁ, এইখানে বলে রাখি আমার দেশে কেনা স্মার্টফোন বিদেশে এসে আনস্মার্ট হয়ে গেছে। যে ফোনটা ব্যবহার করি যার জিপিএস নেই। আমাদের দেশে জিপিএস ছাড়া অজানা জায়গায় যাওয়া কোনো বাপারই না। কেউ না কেউ দেখিয়েই দেবে। কিন্তু এদেশের লোকজন এতটাই টেকনোলজি নির্ভর সে আশা বৃথা। যেদিন যাব ঠিক করেছিলাম তার আগের দিন সন্ধ্যেবেলা গুগল সার্চ করে পুরো ব্যাপারটা নোট করে নিলাম। দুটো বাস বদলাতে হবে, তারপর ট্রেন, তারপর আবার বাস। দেশে এই বাপারটা এতটাই সহজ যে কোনো চাপ নিতে হয়না, কিন্তু এদেশে যেখানে সেখানে রাস্তাঘাটে "গুগল ম্যাপজানা" লোকজন থাকবেনা।
পকেটে বিস্কুট, ব্যাগে টুপি ও পাসপোর্ট, আর গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। বাসস্ট্যান্ডে ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর খেয়াল হলো -আরে এতক্ষণে তো বাস চলে আসার কথা ! গুগলে যে সময়টা দেওয়া থাকে বাসের , সেই সময়েই বাস আসার কথা। ভালো করে বোর্ডটা খেয়াল করে দেখি- যাহ বাবা, রোববার বাস বন্ধ থাকে! বোঝো কান্ড। এদিকে ৮.১০ এ ট্রেন। এখন উপায়! নতুন এসেছি, বুদ্ধি সুদ্ধি আমার একটু দেরিতে পাকে। এদিকে আমার কাছে ক্যাব এর নম্বর নেই। আসলে,ট্রেনের টিকেট কাটা নেই, তাই ফিরে আসাই যায়, তবে যাব বলে বেরিয়ে ফিরে আসতে কার ভালো লাগে বলো?তাই দৌড়ে বাড়ি ফিরে রুমমেটের ঘুম ভাঙ্গিয়ে তার থেকে ইয়েলো ক্যাবের ফোন নম্বর নিয়ে ফোন করলাম। ক্যাব এর ড্রাইভার শ্রীলঙ্কার লোক। দীর্ঘদিন আছেন। একজন বাঙালি আর একজন বার্মিজ এর সাথে থাকেন। বক বক করতে করতে ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছে কিনা আর চিন্তা করার অবকাশ পাইনি। নামার সময় চমক! দেখি কিছু একটা টিকেট আমায় দিতে চাইছে। জানা গেল, তার কাছে একটা গ্রীনলাইন ট্রেনের টিকিট আছে, এবং সেটাই সে আমায় দিচ্ছে ।এমনি এমনই। আর উনি এটা দিচ্ছেন আমি টিপস দেবার আগেই। (টিপস দেওয়াটা এদেশের বাধ্যতামূলক রেওয়াজ, না দিয়ে চলে যাওয়াটা চূড়ান্ত অসভ্যতা), যদিও সেই টিকিট আমার কাজে লাগার নয়, কারণ আমি যাব Amtrak ট্রেনে। কিন্তু সেটা কথা না, এমন বিদেশ বিভুঁইে এমন অপ্রত্যাশিত ভালবাসা পেলে মনটা ভরে ওঠে। দেশের গন্ডি তখন উপমহাদেশ হয়ে গেছে।
ট্রেন দেখে যথারীতি ধাক্কা খেয়ে গেলাম। দোতলা ট্রেন। ভিতরটা ভারী চমৎকার। গদিমোড়া চেয়ার, কিছু সিট এর সামনে টেবিল আছে,কফি খেতে খেতে কাচ ঢাকা জানলা দিয়ে বাইরে দিকে তাকিয়ে থাকতে পারো। তোমার খুশি। Amtrak এর এই ট্রেনটা প্যাসিফিক ওশান এর পাশ দিয়ে যায়। জানলা দিয়ে তাকালেই ঝকঝকে নীল আকাশ , ঘন নীল্ সমুদ্র। একতলাটায় ডাইনিং স্পেশ আর টয়লেট। সত্যি বলতে কি, আমার চোখে তখন আমার দেশের লোকাল ট্রেনের চেহারাটা ভেসে উঠেছে, ইশশ আমরাও যদি পাব্লিক প্লেসে এমন পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতাম! আমরা নিজেরাই একটু দ্বায়িত্ব নিয়ে যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা না ফেললেই তো এমন ঝকঝকে ট্রেন হয়ে যেতো। চেকারকে অনুরোধ করলাম, যেন সান ডিয়েগো এলে আমায় বলে দেন, আমি যদি এনাউন্সমেন্ট মিস করি বা ঘুমিয়ে পড়ি। তিনি বলে দিয়েছিলেন। এদেশের মানুষজন সম্পর্কে অনেকেরই শীতল ধারণা আছে, কিন্তু সে ধারণা ঠিক না তার উদাহরণ বহুবার পেয়েছি।
সী ওয়ার্ল্ডে পৌঁছে মেতে উঠতে সময় লাগেনা। শামুর শো দিয়ে শুরু। শামু হলো এক তিমির নাম, তার নাচ দেখে মনটা একেবারে তাজা হয়ে গেল। এমনকি আমার মত খুঁতখুঁতে লোককেও জলের ঝাপ্টায় ভিজিয়ে দিল বলে একটুও রাগ হোলোনা।
ডলফিনের মত বুদ্ধিমান প্রাণীর কসরত দেখতে দেখতে মনটা আরো খুশীতে ভরে গেল।
পেঙ্গুইনের নাচানাচি, সী -লায়ন এর ঝাঁপাঝাঁপি , মাছদের খেলা এইসব নানান জিনিসের মধ্যে দিয়ে দিনটা কখন ফুরিয়ে গেল টেরই পেলাম না।
শেষে জলের মধ্যে খেলে বেড়ানো ওই ক্ষুদে ক্ষুদে মাছগুলো, ঠিক আমাদের মৌরলা মাছের মত দেখতে,ওদের সাথে খেলতে দিয়ে দেরী হয়ে গেল। জলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে রাখলে ওরা এসে হাতের মধ্যে মৃত কোষ খেয়ে যায়, বেশ মজা লাগে। বাপারটা আমি কাটিয়েই দিচ্ছিলাম, জানতামনা আগে, এক মার্কিন ভদ্রমহিলা নিজের থেকেই বললেন আমি যেন ওটা অবশ্যই করি, যদি করে না থাকি।ভাগ্গিস বলেছিলেন।হঠাৎ খেয়াল হতে দেখি স্টেশন যাবার বাস আমি মিস করেছি এবং পরের বাস আধঘন্টা পরে, তারমানে ৬.৪৫ এর ট্রেনও আমি মিস করেছি!
স্টেশনে এসে Amtrak এর কাস্টমার কেয়ারে খোঁজ নিয়ে জানলাম পরের ট্রেন 9.11 তে। এবং সেটাই লাস্ট ট্রেন।বাজছে সবে সাতটা কুড়ি। দুঘন্টা এই স্টেশনটাতে বসে থাকতে হবে!
স্টেশনটা আমাদের দেশের অজ পাড়াগাঁয়ের স্টেশন এর মতোই প্রায়। আসে পাশে একটাও দোকান নেই যে কিছু কিনে খাবো।বিস্কুট সেই কখন শেষ হয়ে গেছে, আর ঘোরাঘুরির নেশায় সারাদিন কিছু খাওয়াও হয়নি। শেড আছে কিন্তু যা হাওয়া দিচ্ছে, তাতে শেড থাকা না থাকা সমান। তারমধ্যে শার্টের দুটো হাতায় ভেজা, মাছগুলোর সাথে ছ্যাবলামো করার সময়। আমি এমনিতেই শীতকাতুরে, কি ঠান্ডা হাওয়া বাপরে বাপ, হাড় অব্দি কেঁপে যাচ্ছে। স্টেশনে লোক নেই বিশেষ।না একজন আছে দেখছি। স্টেশনে এর শেষ প্রান্তে একজন বসে বসে বিয়ার খাচ্ছে আর ফোনে কথা বলছে। ভালো লোক না মন্দ লোক কে জানে! আমার থেকেই খোঁজ নিলো ট্রেন এর, LA যাবে। এই ট্রেন টাই , অরেঞ্জ কাউন্টি মানে আমি যেখানে থাকি সেখান হয়ে LA যাবে। অন্ধকার স্টেশন, বাতাস বইছে হুহু করে, একটাই অজানা লোক, আশেপাশে দোকানপাট নেই, সব মিলিয়ে গা ছমছমে অবস্থা। এ যদি গুন্ডা বদমাশ জাতীয় লোক হয়, হয়ে গেলো আজ আমার।উফফ , না মনটা অন্যদিকে ঘোরাই , দুঘন্টা এরকম খালি পেটে চিন্তা করে করে কাটানো যায় নাকি। থ্রিলার পড়তে গেলেও গরম কফি চাই আর সেখানে থ্রিলারের চরিত্র হতে গেলে খালি পেটে পোষাবেনা বাপু।
ধ্যান করব নাকি! উহহ আবার হাওয়া দিস কেন বাবা, একটু থামলেও তো পারিস। এই ভিজে শার্ট পরে এই ঠান্ডা হাওয়ায়, খালি পেটে ধ্যান করতে গেলে আমায় মহাপুরুষ হতে হবে। কাউকে ফোন করা যায়, তাতে মনটা অন্যদিকে ঘুরবে, বা বই পড়া যায় বা খেলা যায়, কিন্তু কিছুই করা যাবেনা। আমার অচল স্মার্ট ফোন যেটা কিনা এইসব কাজেই ব্যবহার করি তার চার্জ শেষ। আর যে ফোনটা কাজের, মানে যার থেকে ফোন করি সেটার চার্জ প্রায় তলানিতে, খানিকটা তো রাখতেই হবে।
অফিসের এক কলিগকে ফোন করে বললাম আমার ১১তা বাজবে সান্টা আনা স্টেশন পৌঁছতে সে যেন কষ্ট করে একটু আসে নিতে তার গাড়ি নিয়ে।আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে, কাঁপতে কাঁপতে ঘন্টা দেড়েক কাটালাম।
এইসময় আরো একজন এলো. সেও আমার ওদিকেই যাবে।তার সাথে গল্প করে বাকি সময়টা কাটলো। ভদ্রলোক অ্যানিমেশন এর কাজ করতেন আগে। ‘লাইফ অফ পাই’ এর কিছু গ্রাফিক্স এর কাজ হয়েছিল ওদের কোম্পানি থেকে।এখন নিজেই একটা ব্যবসা খুলেছে। স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে। জমি বাড়ি কেনাবেচার। বোঝো! কোথায় অ্যানিমেশন কোথায় জমি-বাড়ি। আস্তে আস্তে আরো কিছু লোকজন এলো। ট্রেনও এলো। সারাদিনের ধকল এর পর ট্রেন এর উষ্ণ পরিবেশে ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এলো। ওই ভদ্রলোককেই বললাম, সান্টা আনা স্টপেজ এলে যেন আমায় একটু ডেকে দেন। তারপরই গভীর ঘুম।
স্টেশনে নেমে দেখি কলিগটি এসে গেছে।
বাড়িতে খাবার ছিল না , কেনাও হয়নি । এমন সময় রুমমেটের মেসেজ পেলাম, আমি যেন কোনো দ্বিধা না করে ওর থেকে নিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়ি। ...পৃথিবীটাকে যতটা কঠিন বলে, অতটা মোটেই নয় ।
____________
চমৎকার লেখাটা। আর বিদেশে যখন এইসব অচেনা লোকেরা টুক্রো টুকরো ঘটনার মধ্যে দিয়ে আপন হয়ে ওঠে তখন সত্যি ভারী ভালো লাগে।
ReplyDeleteonek dhonyobad Tapabrata :)
DeleteDarun hoyeche lekhata.. Anyone can visualize every moment 😊
ReplyDeleteonek dhonyobad Soumi :)
Delete