একটু ভাবি
তন্ময় বিশ্বাস
দুরে ডালপালার গারদ ভেদ করে সূর্যটা উঠে আসে। চারদিকে ছড়িয়ে দেয় গেরুয়া আগুন। পাখির ডানায় চড়ে তারা ছড়িয়ে পরে দিকবিদিক। পুজোর বার্তা নিয়ে।লম্বা বারান্দাটায় অলস ভাবে গা এলিয়ে দেয় একফালি রোদ। এখানকার বাসিন্দাদের মতই তার কোন কাজ নেই। শুধুই পড়ে থাকে। যেন থেকেও নেই। একটু পরেই দোতলা বাড়িটার সারি সারি ঘরগুলো জেগে ওঠে। যেন না উঠলেও চলে। নেহাতি নিয়মের তাগিদে ওঠা। অভ্যাসের বসে বেঁচে থাকা!
সামনে একটা মাঠ। বড় বড় ঘাস। একটা নালার ক্ষীণ জলধারা বয়ে চলেছে তির তির করে। কোথা থেকে আসছে কেউ জানে না। শুধুই বয়ে যায়। নালার ওপাশে বন। খুব একটা গভীর নয়। মাঝে মাঝেই ময়ূরের কেকা ভেসে আসে। এখানে প্রাকৃতিক ভাবেই ময়ূর আছে। তবে শরৎ কালে তাদের দেখা পাওয়া ভার।
সামনের সাইন বোর্ডটায় দুটো চড়াই এসে বসে। কিচির মিচির করে কি যেন বলাবলি করে। তারপর আবার ফুড়ুৎ! বোর্ডটায় বড় বড় করে লেখা 'ঢাকেশ্বরী ওল্ড-এজ হোম', সাদা বাংলায় 'বৃদ্ধাশ্রম'। ঘর বোঝাই জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত কিছু সৈনিক। সারাজীবন যুদ্ধের পর যাদের পুরস্কার একমুঠো বঞ্চনা, থেকেও না থাকা কিছু মুখ, আর একরাশ চোখের জল। ড্যাম্প ধরা দেওয়াল গুলো ধরে সময় যেন এগোতে চায় না। সময় এখানে বড্ড বেশি নির্বাক। বড্ড বেশি নিশ্চল।
বছর কাটে। পুজো আসে, আবার চলেও যায়। পুজোর গন্ধ এ বাড়িতে আসে না। চিহ্ন বলতে শুধু দূরের মাঠে মাথা দোলানো কাশফুল, আর ক্যালেন্ডারের কয়েকটা পাতা। লালকালির কয়েকটা তারিখ। একফালি রোদটা ধীরে ধীরে বড় হয়। টুকরো টুকরো হয়ে ঢুকে পড়ে সারি সারি খোলা দরজা দিয়ে। একফালি গিয়ে উঠে পড়ে শ্রদ্ধা ঠাকুমার কোলে। ঠাকুমা একমনে সোয়েটার বুনে চলেছে। নাতিকে দেখেনি বহুদিন হয়ে গেল। আন্দাজে বোনা। জানে নাতি এসব 'ওল্ড ফ্যাশন' এর জিনিস পড়বে না। তবু বোনে। কাটা-উলের যুগলবন্দীতে বোনা হয়ে যায় কিছু নীরব ভালোবাসা। একপক্ষ ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা গায়েমাখার কেউ নেই।
আরেক টুকরো সোনালী রোদ গিয়ে পড়ে স্নেহ দাদুর ঘরে। ঘর জুড়ে দলা-পাকানো কাগজ। দলা-পাকানো কবিতা। লেখেন আর দলা-পাকিয়ে ফেলে দেন। কিছুই মনমত হয় না। সেই কলেজ জীবনে ফেলে এসেছেন কবিতাদের। তারপর সংসার যন্ত্রে সব পিষে গেছে। এখন তিনি সেই যন্ত্রেরই বিকল একটা অংশ। ম্যানুফ্যাকাচারিং ডিফেক্ট! তাই আবার সেই কবিতা। কিন্তু, অভিমানী কবিতারা আসতে চায় না। একদিন আসবে ঠিকই। ততো দিনে হয় তো শেষের দিনটাও কড়া নাড়বে। শেষের দরজাটা যে এখান থেকে বড্ড কাছে!
পাশের ঘরে জহর কোট পরা যতীন দাদু। মেরুদণ্ড এক্কেবারে সোজা। ঠোঁটের কোণায় সবসময় ফিঙের মত নাচছে একখানা পাইপ। সামনে ধরা ওথেলো। কাউকে পরোয়া করেন না। স্ত্রী-মেয়ের সাথে বনিবনা হয়নি। পেনসন টেনশন সব বাড়িতে ফেলে স্বেচ্ছায় চলে এসেছেন আশ্রমে। ঘরে ঢুকলেই বলেন 'welcome young man to our dead city' তারপর হেসে নিজের দিকে দেখিয়ে বলবেন 'And meet the only living person.' হো হো করে হেসে ওঠেন। টেবিলের ওপর রাখা ইনহেলারটাও কেমন যেন বাঁকা বাঁকা হাসে!
একতলার বারান্দা ধরে রান্নাঘরের দিকে যায় বাসন্তী ঠাম্মা। সাদাকালো রোদ্দুর ছায়া মেখে। শরীরে শুধুই হাড়। ফোকলা প্রায় মাড়িগুলো গাল দু’টো কে টেনে নিয়েছে। মুখে একটা মিষ্টি হাসি। কাজের মেয়ে কুসুমকে হালকা ঠ্যালা দিয়ে বলে 'কি রে দুধটা দে তাড়াতাড়ি?'
কুসুমের মেজাজ তিরিক্ষে। হাতের বাটিটা দিয়ে সটাং একটা বাড়ি মারে ঠাম্মার মাথায়। ঠং করে একটা ধাতব শব্দ ওঠে।
কি ভাবছেন? এবার বাড়াবাড়ি করছি? বিশ্বাস, অবিশ্বাস সম্পূর্ণ আপনার ব্যাপার। এই একজোড়া চর্মচক্ষে ঘটনাটার সাক্ষী থাকতে হয়েছে। আমরা রে রে করে উঠেছিলাম। তুমুল চেঁচামেচি। মনুষ্যত্বের ধানাই পানাই। তারপর নিয়ম মত একসময় সব থেমে গেছে।
আমরা 'স্পর্শ'র তরফ থেকে সেদিন জড়ো হয়েছিলাম। কয়েক টুকরো আনন্দ যদি ফিরিয়ে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টায়। পূজোর আনন্দ। দিনটা ছিল ষষ্ঠী।
এখানকার সব আবাসিকদের নিয়ে একটা পূজা পরিক্রমা। একসাথে খাওয়া দাওয়া। সবাই যেতে পারবেন না। চলার ক্ষমতা নেই। একটা বাস আর কয়েকটা গাড়ি রওনা হয়ে গেল। পেছনে দোতলা বাড়িটা। ক্ষণিকের বিদায়।
সবার সাথে আমিও ছিলাম। আমি 'স্পর্শ'-র কেউ নই। আমার কোনও কাজও নেই তাও ছিলাম। দাদু-দিদা-দের স্নেহ ভালোবাসা মেখে বেড়াচ্ছিলাম। কারোর দাদুভাই তো কারোর নাতি-সাহেব! চলন্ত জানলার হাওয়ার তোড়ে কত কত হাসি। কত কত আনন্দ। হয়তো অনেকদিন পর, হয়তো বা শেষবার।
বেশ কিছু প্যান্ডেলে ঘোরা হল। থিম, সাবেকি সবরকম। কোনও প্যান্ডেলে সম্বর্ধনা, কোথাও দাদু দিদারাই ফিতে কেটে পুজোর সূচনা করে, কোথাও বা স্রেফ ভোঁ ভাঁ! কিচ্ছু নেই। এসেছ এসো, যাচ্ছ যাও। আমাদের কি!
এক ঠাকুমা আবদার জোড়ে মা-কে ছোঁব। তেমন চলতে পারেন না। পুজো কমিটি সাগ্রহে অনুমতি দেন। আমাদের একজন কোলে করে নিয়ে যায়। প্রতিমার চিবুকে হাত বোলান ঠাম্মা। বলিরেখার ভাঁজে ভাঁজে এক মুহূর্তের জন্য হলেও আলো জ্বলে ওঠে। "শক্তি রুপেণ সংস্থিতা!"
কোথা দিয়ে যেন দিনটা কেটে যায়। সেই সব বিস্তারিত অন্য কোন দিন। অন্য কোনও কলমে। দিনের শেষে আবার সেই দোতলা বাড়ির কবলে রেখে আসতে হয়, কিছু ভাগ্যহীন-ভাগ্যহীনার বাবা মা দের। রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে যাওয়ার পরও যেন আনন্দ থেকে যায়। থেকে যায় শান্তি। শেষে বাস-ড্রাইভার কে পাওনা মেটাতে গেলে, সে হাত জোড় করে বলে ’দাদা, পাপ লাগবে যে। ও টাকা কোথায় রাখব?"
সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিছু কিছু মানুষ নিজের অজান্তেই সবাইকে স্তব্ধ করে দেয়। নিজের অজান্তেই অন্যদের ছাড়িয়ে যায়।
'স্পর্শ'-র এই উদ্যোগ তিন বছরের বেশি চলেনি। আর নাকি ডোনেশান ওঠে না। আজও ষষ্ঠীর দিন মনটা খারাপ হয়ে যায়। তারা এখনো একা। আজো পুজো এসে ফিরে যায়। দোতলা বাড়িটায় নোনা-হাওয়ার ঝাঁক হুল ফোটায়। যেন বলে 'আর কতদিন? অনেক তো হল!'
শুধু ঢাকেশ্বরী নয়। আরো অনেক 'বৃদ্ধাশ্রম'-এর চিত্র এমনটাই। ছেলেমেয়েরা দেখতে আসা তো দূরের কথা ফোন পর্যন্ত করে না। চিকিৎসার ব্যবস্থাও তথৈবচ!
আচ্ছা মা-বাবা সন্তানদের পৃথিবীর আলো দেখায়, মানুষ করে কি এই দিনটা দেখার জন্য? শেষ বয়সে একটু সন্মান, একটু যত্ন-আত্তিও কি তাদের প্রাপ্য নয়? সারা জীবন যারা শুধুই দিয়ে গেছে। আমাদের মধ্যে দিয়ে স্বপ্ন দেখেছে, বাঁচতে চেয়েছে, তাদের উপহার একটা ১০ফুট বাই ১০ ফুট ঘর? কমন বাথরুমে ভোর ৫টা থেকে লাইন? সারা দিন অন্তত দশ বার ছেলের কথা ভেবে জল ফেলা? নাকি, মাথায় বাটির বাড়ি খাওয়া? কোনটা? এগুলোর মধ্যে কোনটা তাদের প্রাপ্য একটু বলবেন প্লিজ? ওল্ড এজ হোমে এই সবকটাই জোটে। হ্যাঁ হ্যাঁ সবকটাই!
একটা বয়সের পর অনেক সময় মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। তারা অনেক কিছু ভুলে যান। ভুল কাজ করে ফেলেন। তাই বলেই তাদের দূরে সরিয়ে দিতে হবে? ছোটতে আমি-আপনি ভুলভাল করিনি? বিছানা ভিজিয়ে দিয়ে রাতের পর রাত মায়ের ঘুম নষ্ট করি নি? নাকি ময়দা আনতে গিয়ে আটা নিয়ে ফিরিনি? করেছি তো! তবে? বাবা-মারা কি তখন আমাদের ফেলে দিয়েছেন?
বাবা-মা কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠালে বাড়িটা অনাথ আশ্রম হয়ে যায়। আচ্ছা একটু যদি চেষ্টা করি তবে কি ওই বৃদ্ধাশ্রম গুলোতে চিরকালের মত তালা ঝুলিয়ে দিতে পারি না? পারি না তাদের স-সন্মানে রেখে দিতে? অনেকে হয়তো পশ্চিমের উদাহরণ টানবেন। বলবেন 'ওখানে অনেক ছোট বয়স থেকেই ছেলে মেয়েরা বাবা মার কাছ থেকে আলাদা থাকে!' ডিয়ার স্যার, ওদের দেশের যা কিছু ভালো তা আমাদের দেশে আছে তো? মা-বাবাদের সন্মান দেওয়াটা আমাদের দেশের সংস্কৃতি। সেটা পশ্চিমী হাওয়ায় উড়িয়ে দেব কেন!
বয়স, সময় কোনটাই থেমে থাকবে না। আপনিও একদিন বৃদ্ধ হবেন। বাবা-মা কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে, নিজের জন্যই সিট-বুকিং করে রাখছেন না তো? একটু ভেবে দেখবেন প্লিজ!
_________
Chomotkar Tanmoy , tomader ei udhyog jodi abar chalu kora jay bolo, ami pashe thakbo
ReplyDeleteঅসাধারণ লেখা। খুব ভালো লাগল। এরকম দরদী লেখা আরও পড়তে চাই।
ReplyDeletedujon kei onek onek dhonobad. hey obosoi bolbo
ReplyDeletekhub bhalo lekha.
ReplyDelete